ছবি : ইন্টারনেট |
প্রতিবন্ধী কাঁকড়ার গল্প
মৌসুমী দেবঘোষ
আমার সাদা মনে কাদা নেই কিন্তু, একটা প্রশ্ন আছে।আমি জানতে চাই ,পৃথিবীতে সত্যি এমন কোন পুরুষমানুষ আছেন কি, যিনি বাজার করে তাঁর অর্ধাঙ্গিনীর মুখে হাসি ফোটাতে পেরেছেন ? আমি আজ পর্যন্ত পারিনি! আমার বাপু স্থির বিশ্বাস এমন মানুষ কেউ থাকতেই পারে না। যদি কেউ থাকেন তো তাঁকে দেখে এই নশ্বর-জীবন ধন্য করতে চাই।সেই বিরল প্রজাতির পুরুষদের জন্য আমি একটা প্রতিযোগিতার আয়োজন করবো ভাবছি এবং প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় সান্ত্বনা এই সব পুরস্কারও দেবো । কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা বলে, ঘোষণাই সার হবে, প্রার্থী পাওয়া যাবে না। কারণ আজ পর্যন্ত এমন সৌভাগ্য আমার একদিনও হয়নি, যেদিন আমি বাজার করে এনেছি আর আমার স্ত্রী বলেছেন –‘সব ঠিক আছে !’
বাজার থেকে যাই আনি না কেন, কিছুতেই গিন্নীর পছন্দ হয়না। কুমড়ো আনলে বলে পুঁই কোথায় ,লাউ এনেছ তো চিংড়ি নাওনি কেন, পালং শাক এনেছ ,মুলো কই ,মাছ কিনেছ তেল কোথায় রেখে এলে,আরও কত কি !এটা আনি তো ,ওটা নেই কেন উত্তর দেবার জন্য তৈরি থাকতে হয়। ধরুন কোনদিন খুব মনে করে করে সব ঠিক ঠাক আনলামও , তাতেও রেহাই পাবো ভাববেন না ।তখন
আবার
শুরু
হবে
কোয়ালিটি নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া । কুমড়োটা মিষ্টি নয়, মাছটা পচা , মুলোটা বুড়ো ,শাকগুলো কেমন যেন শুকনো ইত্যাদি ইত্যাদি!
তবু এরমধ্যে যে কিকরে এক একদিন ওনার মনের মত বাজার করে ফেলি, সে সব দিন নিজেই নিজের প্রতিভা দেখে চমকে যাই !কি করে বুঝি ,বাজারটা তেনার মনের মত হয়েছে ? হুঁ হুঁ বাবা, এসব অনেক দিনের রিসার্চের ফল।সিম্পটম দেখে- দেখুন মনস্তত্ব আমি তেমন জানি না এটা ঠিক ।কিন্তু এটা জানি, ফুল ফুটলে তার গন্ধ ছড়াবেই , শাক দিয়ে যতই মাছ ঢাকুন না কেন আঁশটে গন্ধ আপনি আটকাতে পারবেন না কিছুতেই!
এই ধরুন, যেদিন বাজারটা গিন্নীর মনের মত হয়,মানে আমি যেদিন একশ’র মধ্যে মেরেকেটে সত্তর-পঁচাত্তর পাই আরকি - বাজার থেকে ফিরলেই সেদিন সঙ্গে সঙ্গেই এক কাপ গরম চা পাবই।কোনদিন তারসাথে টা-ও পাই। বাজার যেদিন মাঝারি মানের হয়, সেদিন চা পাই বটে, টা জোটে না কপালে। আর যেদিন বাজারটা একেবারেই গিন্নীর পছন্দ মত হয়না-বিশ্বাস করুন সেদিন চাও মেলে না! চাইতে গেলে বরং মুখঝামটা শুনতে হয়-‘গ্যাস খালি নেই, এখন ওসব হবে না।’
বেশি কিছু বলতে যাই না , বলা তো যায় না চায়ের সাথে দুপুরের মিলটাও গায়েব হয়ে গেল হয়তো । সেদিন রান্নাঘরের সামনে থাকা খুব বিপদজ্জনক ! কারণ প্রতিমুহূর্তে যেসব গোলাগুলি আপনার দিকে ছোঁড়া হবে , আপনি ঘায়েল হতে বাধ্য।তখন সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং বজায় রাখাই সব থেকে নিরাপদ!
কিভাবে গিন্নীর মনের মত বাজার করা যায় এরকম যদি কোন ক্রাশ কোর্স থাকত আমি নির্ঘাত এতদিনে করে নিতাম! কিন্তু পেলাম না জানেন। আমি তাই নিজে নিজেই ভেবে একটা পথ বের করেছি।আপনাদের বলি , যদি কারো কোন উপকারে লাগে। বাজারে গিয়ে এখন আমি প্রথমে বার দুয়েক পুরো মহল্লাটা চক্কর মেরে নিই ,ওই যাকে আপনারা ‘রেকি’ করা বলেন আর কি! তৃতীয় বারে শুরু হয় কেনাকাটা। এভাবে সময় অনেক লেগে যায় বটে, তবে এভাবেই আমি আমার ভুলের পরিমাণ কমিয়ে ফেলেছি অনেকটাই।
যেমন ধরুন এখন আমি জানি-ঢ্যাঁড়স কিনতে গেলে টাটকা কিনা বুঝবার জন্য ওর সূঁচাল দিকটা ভেঙে দেখতে হয়, ঝিঙের শিরা । বেগুনে পোকা আছে কিনা বুঝবার জন্য কানের কাছে এনে নেড়ে দেখতে হয়। মোচা তেতো কিনা তা দাঁতে কেটে দেখতে হয়, আলু চন্দ্রমুখী না পোড়ারমুখী এটা বোঝা আমার এখন বাঁয়ে হাত কি খেল।ইলিশ পদ্মার, না ডায়মন্ড-হারবারের গঙ্গার , নাকি কোল্ড স্টোরেজের , চিংড়িটা পচা না ভালো , মাছ টাটকা না সাত-বাসি, কিম্বা ডিমটা হংস-ডিম্ব না অশ্ব- ডিম্ব , তা এক লহমায় বুঝে নিই ঠিক !এখন এই ব্যাপারে মোটামুটি আমার পি এইচ ডি করা হয়ে গেছে। বাজার করতে করতেই এসব দুর্লভ বাজারি-জ্ঞান আমি অর্জন করেছি।
তবু দুঃখ কি জানেন,আমার গিন্নীর কাছে এসবের কোন মূল্যই নেই! তিনি তো আমার এই অর্জিত জ্ঞানকে মোটেই পাত্তা দেন না।প্রায়ই আমায় খোঁটা দেন-‘কেমন করে বাজারটা যে করো বাপু বুঝি না,কিছুই ঠিকমত আনতে পারনা,ও বাড়ির চ্যাটার্জিবাবুকে দেখো কেমন সব কিছু গুছিয়ে বাজার করে আনেন, দেখেও তো শিখতে পারো নাকি !’
মনের দুঃখে থাকতে না পেরে একদিন বাজারের পথে চ্যাটার্জিদাকেই পাকড়ালাম । বললাম-‘ কি করে আপনি আপনার গিন্নীর মনের মত বাজার করেন আজ আমাকে বলতেই হবে দাদা ।’ আমার অমন নাছোড়বান্দা দশা দেখে উনি তো ‘থ’ ! কিছুক্ষণ চুপ করে আমার মুখের দিকে বোধহয় তাকিয়ে ব্যাপারটা হৃদয়ঙ্গম করতে একটু সময় নিলেন। তারপর আমাকে টানতে টানতে বাজারের একধারে নিরিবিলি স্থানে নিয়ে গিয়ে কানে কানে বললেন-‘ একথা কে বলল আপনাকে, আপনার গিন্নী ? হরি হে দীনবন্ধু ! তবে শুনুন ওই একই কথা আমার গিন্নীও আমাকে রোজ বলেন আপনার সম্বন্ধে । আমিই তো ভাবছিলাম সুযোগ মত আপনার কাছেই মন্ত্রগুপ্তিটা শিখে নেব !’
আমার
গালে
ওই
কি
বলে
না ,এক গাল মাছি তাই!আমার অমন আমশিপারা মুখখানা দেখে চ্যাটার্জিদার মনে হয় বড় দুঃখ হোল। বললেন-‘ এই হয় দাদা, আমাদের গিন্নীদের সব দূরবীন –চোখ বুঝলেন!’
-‘ দূরবীন চোখ --?’ আমার হ্যাঁ কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না দেখে ,হো হো করে হেসে উঠলেন চ্যাটার্জিদা,
-‘ বুঝলেন না তো ?’
আমি দুদিকে মাথা নেড়ে আমার অপারগতা জানাতেই হাসতে হাসতে বললেন- ‘ দূর মশাই বুঝলেন না, দূরবীন-চোখ মানে দূরের জিনিসই ভালো দেখে, কাছেরটা নয়!’
-‘ অ্যাঁ !’
-‘ অ্যাঁ নয় হ্যাঁ । হাঁ বন্ধ করুন, মশাই বাজারের মাছিগুলো ঢুকল বলে।চলুন বাজারটা সেরে নিই এইবেলা। নইলে কপালে সত্যিই দুঃখ আছে দুজনেরই।’
কথাটা যে কত সত্যি তা আমার থেকে কে আর বেশি জানে !
****
সেদিন চ্যাটার্জিদার কাছ থেকে দিব্য জ্ঞান প্রাপ্ত হয়ে আমি তো মহাজ্ঞানী হয়ে বাড়ি ফিরলাম।গিন্নী যথারীতি এটা ওটা নিয়ে কাঁই-মাই জুড়লেন ।আমি
পাত্তাই দিলাম না।কাগজ পড়তে লাগলাম । লক্ষ্য করলাম এখন সব বল গুলো উইকেটের বাইরে দিয়ে যাচ্ছে ,আমাকে ছুঁতেও পারছে না। আমার মনের মধ্যে বেশ একটা মহাপুরুষ সুলভ উদাসীনতা এসেছে।গিন্নির কোন কথাই গায়ে মাখছি না !চা দিলেও ভালো ,না দিলেও, চাইছি না।বাজারেই পল্টুর দোকানে খেয়ে নিচ্ছি।
আমার এই পরিবর্তনটা অর্ধাঙ্গিনীর কিন্তু নজর এড়াল না । কাকে একটা ফোনে বলতে শুনলাম-‘ কি হোল বলত, মানুষটার ? সাড়া শব্দই করছে না কোন !’ আমি রহস্য বজায় রাখলাম। এখন দেখি বাজার থেকে এলেই গিন্নী নিজেই চা নিয়ে হাজির। আমি অম্লান বদনে বলি-‘ এখন আর চা খাবো না, নিয়ে যাও।’
কিন্তু আমার মত অপটু অভিনেতা কদিন আর চালাতে পারে এভাবে ! চ্যাটার্জিদার বুদ্ধিও কাজে এলো না। অচিরেই আমার সব জারিজুরি ধরা পড়ে গেল গিন্নীর কাছে। আমার এত সাধের অর্জিত জ্ঞান ভেস্তে গেল, গর্বের ফানুশটা ফুস করে ফাঁসিয়ে দিল – কে? একটা কাঁকড়া ! সেই কোন ছোটবেলায় মায়ের কোলের কাছে শুয়ে শুনেছিলাম একটা ছড়া –‘ কাঁকড়া কড়মড়ি / ঘর থেকে বেরো না গড় করি’ ,এমনই কিছু হবে। আজ আমাকেও বাধ্য হয়ে কাঁকড়ার পায়ে গড় করতে হল । কেন , শুনবেন?
বাজার থেকে এসে ব্যাগটা রান্নাঘরের সামনে নামিয়ে রেখে বেসিনে হাত ধুচ্ছি। আজ বাজারে বেশ বড় বড় সাইজের সমুদ্রের কাঁকড়া পেয়েছিলাম,গিন্নীর খুব প্রিয় একটি জিনিস ।
তাই
আজ
আর
যাই
করুক বাজার নিয়ে কিছু বলবে না জানি। প্রত্যাশা মতই আজ একটু পরেই পেয়ে গেলাম গরম গরম বেগুনী –মুড়ি,সঙ্গে ধোঁয়া ওঠা চা ! যাক, আজকের মত শান্তি।
কিন্তু কে জানত,বিপদ এখনো কাটেনি। সবে ঘরে এসে কাগজখানা নিয়ে যুৎ করে বসেছি কি বসিনি। গিন্নী কোমরে হাত দিয়ে এসে দাঁড়ালেন সামনে। গিন্নীর এই ভঙ্গিমাটি আমি হাড়ে হাড়ে চিনি। এটা হল গিয়ে যুদ্ধের আহ্বান, ঝড়ের আগের অবস্থা ,মনে মনে প্রমাদ গনি –কি হল আবার? আজ কি ভুল করলাম ?সবজিগুলো তো বেশ টাটকাই ছিল! কাঁকড়াগুলোও তো জান্তই ছিল, দিব্যি হেঁটে চলেই বেড়াচ্ছিল,পচা হতেই পারে না,তবে?
গিন্নীর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই গনগনে গলায় বলে উঠলেন –‘ বলি বাজার করবার সময় তোমার নজর কোন দিকে থাকে শুনি ?’
-‘কেন, কি হোল আবার ?’ আমি সাহস বজায় রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালাই।
-‘ কি হল জিগ্যেস করছ,লজ্জা করে না তোমার! বলি হ্যাঁগো কাঁকড়ার কটা পা থাকে ?’
-‘কাঁকড়ার কটা পা!’ আমি বিষম খেতে খেতে রয়ে যাই । মরেছে, এসব জীববিজ্ঞানের প্রশ্ন কেন করছে গিন্নী বুঝতে পারি না।
-‘ হ্যাঁ , কাঁকড়ার পা ?’
-‘ কেন ওই দুপাশে বড় দাঁড়া দুটো আর ছোট ছোট চারটে করে, মোট দশটা হবে ’মনে মনে গুনে নিয়ে বলি আমি।
-‘ তাহলে , চারটে কাঁকড়ার কটা বড় দাঁড়া হবে ?’মরেছে, গিন্নী তো এবার বিজ্ঞান থেকে সোজা অঙ্কে ড্রাইভ মেরেছেন, কি মুস্কিল! হাওয়া কোন দিকে যাচ্ছে ধরতেই পারছি না ঠিক । ভেবে বললাম-
-‘ ওই আটটা মতন হবে’ ।গিন্নী মুখের সামনে এসে বললেন-‘তাই যদি হয়, তাহলে ব্যাগে মাত্র ছ’টা পা কেন ? কাঁকড়া ,প্রতিবন্ধী হয় বলে তো শুনি নি বাপু কোনদিন ।’
‘প্রতিবন্ধী কাঁকড়া’ ,আমি রীতিমত বিষম খাই- ‘এটা কি করে সম্ভব !’
-‘ আমিও তো সেটাই বলছি,এটা সম্ভব নয়। তার মানে, নির্ঘাত তুমি অন্যমনস্ক ছিলে, ওই সুযোগে দোকানদার -ব্যাটা বড় দাঁড়াগুলো সরিয়ে নিয়েছে, ঠিক কিনা ? বলি, লজ্জা হয় না তোমার ? করার মধ্যে তো সংসারের ওই একটা কাজই করো। সেটাও মন দিয়ে করতে পারো না !’
হা হতোস্মি!দোকানদার কাঁকড়া বেছে পলিথিনে ভরে দিয়েছে,আমি নিয়ে এসেছি,পা কে গুনেছে ?আপনারা গোনেন ? কোথায় ভাবলাম এতো বড় বড় কাঁকড়া দেখে গিন্নী খুশী হবে,তা না, এই কাঁকড়ার পা লাথি মেরে সকালটাই নষ্ট করে দিল ! নাঃ, আমাকে আরও কেয়ারফুল হতে হবে। কাঁকড়ারে তোর গোদা পায়ে থুড়ি দাঁড়াতে শতকোটি গড় !!
...(সমাপ্ত)...
No comments:
Post a Comment