1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, October 2, 2024

শ্মশান ফেরত

ছবি  : ইন্টারনেট

শ্মশান ফেরত

মৃণাল বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়

সকাল, 9-40 থেকে সকাল, 11-23

প্রচন্ড জোড়ে হুটারে আওয়াজ করতে করতে  তীব্র গতিতে অ‍্যাম্বুলেন্সটা বালুরঘাট  সদর হাসপাতালের দিকে ছুট লাগালো। সমরেশ বাবুর হাত ও পায়ের তালু পুরো ঠান্ডা  হয়ে  গেছে। হার্ট বিটটা এখনো চলছে, কিন্তু  খুবই ধীর  গতিতে। ইমার্জেন্সি কল করার পর বাড়িতে পাড়ার মোড়ের  অলোক’দার  ‘কিওর এন্ড  কেয়ার ‘ ওষুধের দোকানের  জেনারেল  ফিজিসিয়ান ডক্টর সৌমিক  রায় দেখেই  বললেন,” মেজর কার্ডিয়াক অ‍্যারেষ্ট। রোগী পুরো আচ্ছন্ন হয়ে আছেন। বলা যায়না হয়তো কোমা স্টেজেও চলে যেতে পারেন। তাই আর এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে যত শীঘ্র সম্ভব রোগীকে  এক্ষুনি হসপিটালে সিফ্ট করাতে হবে।“ এবং  সেই মতই  অলোক’দা ওনার চেনাশোনা  একজনকে  ফোন করে  যত শীঘ্র সম্ভব অ‍্যাম্বুলেন্সটা জোগাড়  করে  দিলেন। আপাতত হাসপাতালে ক্লোজ অবজার্ভেশনে রাখা হয়েছে। মনিটরিং চলছে। অক্সিজেন এবং স‍্যালাইন দুটোই চলছে। ইমিডিয়েট যেটা দরকার, সেটা হলো রোগীর পাল্স রেটটাকে নরমালে আনা। কিন্তু এই মুহূর্তে প্রধান সমস‍্যা হলো লাঙ্স এবং হার্ট, কোনোটারই অবস্থা মোটেও সুবিধার নয়।

আচ্ছা, উনি কি খুব স্মোক করতেন? কারণ ওনার লাঙ্সের যা অবস্থা সেটা একজন সাধারণ পুরুষ মানুষের এই বয়সে হওয়ার কথা নয়।“ ইমার্জেন্সি বিভাগের সিনিয়র নার্স মায়া’দি প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলেন। তিনি আরও বললেন, “ দেখুন, ভদ্রলোকের বয়স খুব একটা বেশি না হলেও কি হবে, উনি মনে হয় গত পাঁচ-দশ বছর ধরে নিজের শরীর স্বাস্থ‍্যের দিকে একেবারেই নজর দেননি। তবে ডক্টর ঘোষাল এবং ডক্টর চ‍্যাটার্জী দুজনেই এই মুহূর্তে আমাদের হসপিটালের মোস্ট এফিসিয়েন্ট ডাক্তারদের মধ‍্যে দুজন। দুজনেরই দেশী, বিদেশী প্রচুর ডিগ্রী। ওনারা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন যাতে করে রোগীকে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায়। তবে যে ঢাক্কাটা উনি এ যাত্রায় খেয়েছেন তাতে করে শতকরা একশ ভাগ সুস্থ, এই জীবনে আর হতে পারবেন বলে মনে হয় না। ঐ যে কদিন বাঁচবেন, অবশ‍্য ঈশ্বরের কৃপায় যদি বাঁচেন, সেক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের লাইফ সাপোর্ট নিয়েই ওনাকে বাঁচতে হবে। এখন রোগী যদি চিকিৎসায় ঠিকমতো সাড়া দেন তাহলেই মঙ্গল, শরীরের যা হাল করে রেখেছেন। ওনার বাড়ির লোক কে আছেন? একটু এদিকে শুনবেন প্লিজ। কিছু জিনিস বলে দিচ্ছি, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেগুলো বাড়ি থেকে আনিয়ে নিতে হবে।“

সমরেশ বাবুর সাথে  হসপিটালে  গেছেন পাড়ারই  রথীন বাবু,  সমীর  আর তাপস। এরা সবাই স্থানীয় লেবুতলা স্পোর্টিং ক্লাবের  সদস্য। সমরেশ  বাবুও গত  প্রায় তেইশ বছর  ধরে  এই  ক্লাব  তৈরির  একেবারে  শুরুর থেকে  এই ক্লাবের  পার্মানেন্ট  মেম্বার। গত  দু- বছর  ধরে  উনিই  ক্লাবের  সেক্রেটারি। আর  মাত্র  উনিশ  দিন বাদে দুর্গা পুজো। গত ছয় বছর  ধরে লেবুতলা  স্পোর্টিং  ক্লাবের দুর্গা পুজো  এলাকায়  যথেষ্টই সুনাম  অর্জন  করেছে।আর তার মধ‍্যেই  এরকম  একটা  ঘটনা সবাইকে  স্বাভাবিক ভাবেই  খুব  চিন্তায়  ফেলে  দিয়েছে। সমরেশ বাবু একজন অবসরপ্রাপ্ত  স্কুল শিক্ষক। মাত্র ছয় বছর হলো রিটায়ার করেছেন। এলাকায় খুবই নাম ডাক। নির্ভেজাল ভালো মানুষ বলতে যা বোঝায়, সমরেশ বাবু একদম সেই রকম। কোনও অহংকার নেই। যে কোনো মানুষের বিপদে-আপদে সদাই পাশে। আশেপাশের সবাই ‘সমরেশ মাষ্টার’, বললে এক ডাকে চেনে। তার উপরে অভিঞ্জতাও প্রচুর। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই গোটা পাড়ায় একটা  থমথমে  ভাব।

বৌমা  বলছিল , মানে সমরেশ’ বাবুর বউ- যে,  গতকাল রাত্রে  যথাসময়েই  দুটো  রুটি,  ছোট  এক  বাটি  পাতলা মুসুর  ডাল  আর ছোট  এক  বাটি  ঝিঙে- আলুর  পোস্ত  খেয়ে  একটু আধা ঘন্টার মতো গতবারের ক্লাবের পুজোর  হিসেবপত্র  নিয়ে বসেছিলেন। তখনই মনে হলো যে, কোথায় যেন হিসাবটা ঠিক মেলাতে পারছেন না। যতবারই গুনছেন প্রায় সাত হাজার টাকার মতো হিসেব কিছুতেই মিলছে না। আমাকেও বললেন সে কথা। আমি অবশ‍্য ততটা গুরুত্ব দিইনি। শুধু বললাম যে, এখন থাক। সকালে সবাইকে ডেকে ব‍্যাপারটা মিটিয়ে নিও। হতেই পারে দু-একটা খরচের হিসেব পরে টুকবে বলে হয়তো তোমাদের কোষাধ্যক্ষ, নির্মল বাবু টুকতে ভুলে গেছেন। কিন্তু আপনাদের দাদা কিছুতেই সেটা মানতে রাজি নন। বারবার একই কথা,

এটা হতেই পারেনা। এটা কি করে সম্ভব? গতবার পুজো শেষ হওয়ার পরে প্রতিবছরের মতই সবাই মিলে আয়-ব‍্যায়ের পূর্ণাঙ্গ হিসেব চেক্ করে সর্বসম্মত ভাবে ক‍্যাশবুক ক্লোজ করা হয়েছে।তখন কারোর চোখে পরলোনা!! আর এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সাত হাজার বিয়াল্লিশ টাকা আমাদের ফান্ডে উদ্বৃত্ত থেকে যাওয়ার কথা। কিন্তু ব‍্যালেন্স দেখাচ্ছে মাত্র তেপ্পান্নো টাকা। তাহলে বাকি প্রায় সাত হাজার টাকা গেলো কোথায়?”

আমি আর কি বলবো, শুধু বললাম, “ সে যেখানেই যাক, আছে নিশ্চই কোথাও। তুমি অহেতুক এত টেনশন কোরোনা। ঠান্ডা মাথায় সকালে সবাই মিলে বসে ভেবেচিন্তে একটা সমাধানের রাস্তা নিশ্চই খুঁজে বের করা যাবে। এখন ঐসব ছাই-পাশ রেখে ঘুমিয়ে পরো।“

না গো, বাপ্পার মা। তুমি বুঝতে পারছো না। তুমি যতটা সহজ  ভাবছো, এটা মোটেই ততটা সহজ হবে না। আমি একজন পদার্থ বিদ‍্যার শিক্ষক হয়ে চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার মাত্র ছয় বছরের মধ্যেই হিসেবে কি এতটাই কাঁচা হয়ে যাব যে, এই সামান্য হিসেবটা মেলাতে পারবো না!! কোথাও তো কিছু একটা নির্ঘাত গড়বড় হয়েছে। এবং এই ব‍্যাপারে আমি শতকরা একশত ভাগ নিশ্চিত।“

সকাল, 10-42

হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই যিনি আবাসিক মেডিকেল অফিসার, মিহির বোস, সমরেশ বাবুকে দেখলেন।

এতো প্রচন্ড ক্রিটিক‍্যাল অবস্থা!! পালস তো খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না। প্রেশারও নেমে গেছে প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি। রুগীকে এখনই ইমারজেন্সি বিভাগে ভর্তি করতে হবে। আমার তো দেখে মনে হচ্ছে উনি অলরেডি কোমায় চলে গেছেন। ওনার সাথে ওনার  বাড়ির লোক কে কে আছেন? হ্যাঁ শুনুন আপনি কি ওনার বাড়ির লোক? তাহলে এই ফর্মটা ফিলাপ করে দিন। বন্ডেও সই করতে হবে।“

ডাক্তার বাবু আমরা ওনার প্রতিবেশি। ওনারা স্বামী  স্ত্রী,দুজনে এখানে থাকেন। একটিই মাত্র ছেলে। থাকে ব‍্যাঙ্গালোরে। ছেলেকে ফোন করা হয়েছে। হয়তো বিকেলের মধ্যেই চলে আসবে। যা যা দরকার আমাদের কে বলুন।আমরাই সব ব‍্যবস্থা করে দেব।ওসব ফর্মালিটিস নিয়ে একদম ভাববেন না।“

আপনারা এখানে ওনাকে নিয়ে এসেছেন ঠিক আছে কিন্তু আমরা উনার আবারও সুস্থ হওয়ার ব্যাপারে কোনরকম নিশ্চয়তা দিতে পারছি না।রোগী কোমায় চলে গেছেন। এক দু-দিনও লাস্টিং করতে পারেন আবার কয়েক মাস বা কয়েক বছরও বিছানায় শুয়ে থাকতে পারেন। আমাদের এসব রোগীর ক্ষেত্রে বিশেষ কিছুই করার থাকেনা। আমরা ওনাকে অবজারভেশনে রাখবো, চব্বিশ ঘন্টা ধরে মনিটরিং চলবে। এবার যদি ওনার কপালে বাঁচা লেখা থাকে তবেই উনি বাঁচবেন আর না হলে সবটাই উপরওয়ালার মর্জি। ওনার মত রোগীর ক্ষেত্রে মেডিকেল সায়েন্স পুরোপুরি ফেলিওর। এরকম হলো কিভাবে, বয়স তো এ যুগে বসে খুব একটা বেশি নয়? কত হবে বড়জোর পয়ষট্টি।“

হ‍্যা স‍্যার, বছর ছয়েক হোলো স্কুল জীবন থেকে রিটায়ার করেছেন। খুবই নিয়মের মধ্যেই থাকতেন। তারপরেও মানুষের শরীর তো, কিছুই বলা যায়না। এই ভালো তো পরক্ষণেই খারাপ। কখন যে কার কি হয়ে যাবে কেউ বলতে পারে না। ওনার স্ত্রী’র কাছে যেটা শুনলাম, তাতে করে গতকাল রাতে ডিনার করার পরে উনি ক্লাবের গতবারের দুর্গা পুজোর হিসাবপত্র নিয়ে বসেছিলেন। আসলে উনিই গত দু-বছর ধরে আমাদের ক্লাবের সেক্রেটারি। তো সেখানে, বৌদির কথামতো উনি প্রায় হাজার শাতেক টাকার হিসেব কিছুতেই মেলাতে পারছিলেন না। এখন সেই কারণেই অতিরিক্ত টেনশন থেকেই হলো কিনা।“

হতেই পারে, তবে এই ধরনের রোগীদের নিয়ে খুবই সমস্যা।বুঝতেই তো পারছেন। খুব বেশী দিন তো হাসপাতালের বেড আটকে ওনাকে এখানে রেখে দেওেয়া সম্ভব নয়। দু-পাঁচ কিংবা দশ দিনের মধ্যে চলে গেলে উনিও বাঁচবেন আবার ওনার পরিবারের লোকেরাও বাঁচবেন। শুনতে হয়তো খারাপ লাগছে। আমার ও বলতে ইচ্ছা করছে না তথাপি বলতে বাধ্য হচ্ছি। আসলে একটু আগেই বললাম না, এই ধরনের রোগীদের ক্ষেত্রে মেডিকেল শাস্ত্রে কোন চিকিৎসা নেই। বুঝতেই তো পারছেন দীর্ঘদিন শুধু স‍্যালাইন আর ভিটামিন ইঞ্জেকশন দিয়ে একটা পূর্ণবয়স্ক মানুষকে কতদিন বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব? এরকম ভাবে দু- চার মাস বিছানায় পড়ে থাকলে ওনার চেহারার অবস্থা দেখে ওনার বাড়ির লোকেদেরই খারাপ লাগবে। ঠিক আছে এটা তো সরকারি হাসপাতাল। বুঝতেই পারছেন পরিসেবা কতটুকু পাবেন। আর যে কোন ভালো নার্শিংহোমও এই ধরনের রোগী ভর্তি করিয়ে বেড আটকে রাখবে না। ঠিক আছে কয়েক দিন তো থাকুক। তার পরে ওপরওয়ালার মর্জি আর ওনার ভাগ‍্য।“

ডাক্তারবাবু, এই ধরনের রুগীরা কি একেবারেই সার্ভাইব করে না?”

ঐ যে বললাম। সবই ওপরওয়ালার মর্জি। হয়তো দশ হাজারে একজন। আপনাদের কে কিছু জিনিস এনে দিতে হবে। আমি সিনিয়র নার্সকে বলে দিচ্ছি সেগুলোর লিষ্ট তৈরি করে দিতে। একটু দয়া করে তাড়াতাড়ি আনিয়ে দেওেয়ার ব‍্যাবস্থা করুণ।“

স‍্যার, বলছিলাম যে কোন কার্ডিওলজিষ্ট কে দিয়ে একটু দেখানোর ব‍্যবস্থা করা যাবেনা?”

হ‍্যা হ‍্যা ওসব নিয়ে ভাববেন না। রুটিন চেকআপ বা চিকিৎসা আমাদের তরফ থেকে যা যা করার সবটাই করবো। কিন্তু ঐ যে, সার্ভাইবাল রেট প্রতি দশ হাজারে মাত্র একজন।“

চার দিন বাদে, বিকাল, 4-36

নাঃ।অনেক চেষ্টা করেও চার দিনের বেশী বাঁচানো গেল না। গোটা পাড়া জুড়ে শোকের ছায়া। বড্ড ভালো মানুষ ছিলেন সমরেশ বাবু। কখনো কারো সাতে- পাঁচে থাকতেন না। এরকম একটা ভালো মানুষ হঠাৎ করে সেরকম মেজর কোন কারণ ছাড়াই এইভাবে অসময়ে চলে যাবেন কেউ মন থেকে মেনে নিতেই পারছে না। ভগবান কেও বলিহারি, এত খারাপ লোক, অসুস্থ অক্ষম, বয়সের ভাড়ে বেঁকে যাওয়া লোকজনদের ছেড়ে বেছে বেছে সুস্থ সবল ভালো মানুষ গুলোকে কেন যে সময়ের আগেই তুলে নেন, তিনিই জানেন!!”

সবই অদৃষ্ট রথীন’ দা, কার যে কখন ওপর থেকে ডাক আসবে কেউ জানেনা। ভগবানের আইন বোঝা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কম্ম নয়।“

ঠিকই বলেছ ভায়া। আসলে ঠিক দুর্গা পুজোর মুখে তো। তাই কেমন যেন বড্ড খারাপ লাগছে। সমরেশ’ বাবুর খুবই ইচ্ছে ছিল বিশাল ধুমধাম করে দুবছর বাদে রজত জয়ন্তী পালন করবেন। সেই ইচ্ছাটা সমরেশ বাবু আর পূরণ করে যেতে পারলেন না। এটাতেই বড্ড খারাপ লাগছে রে সমীর। “

কি করবে বলো কারোর জন‍্যেই তো কিছু থেমে থাকেনা। কত কাছের লোককেই তো বিগত দুবছরে এক এক করে চলে যেতে দেখলাম। বরই ভয় হয়, কবে যে ওপারের ডাক চলে আসে। দু- দুটো মেয়ে। একটারও এখনো বিয়ে দিতে পারিনি।“

ছাড় ওসব কথা। এখন অনেক কাজ। সমরেশ -বাবুর সৎকারটাতো করতে হবে। চল চল হাত গুটিয়ে বসে থাকলে হবেনা। বডি নিতে হবে। মনে করে ডেথ সার্টিফিকেট-টা সঙ্গে নিয়ে নিস নাহলে ঘাটে দাহ করানো যাবেনা।“

রাত্রি, 11-17

আজকাল কোথাও একটু ফাঁকা নেই!! এতো রাতেও আট জনের পেছনে লাইন। কি হারে লোকে মরছে ভাব।“

হবেনা?? লোক সংখ্যা দেখো।শুধুমাত্র বালুরঘাট শহরের লোকসংখ‍্যাই এখন প্রায় সত্তর হাজার। আশেপাশের লোকেরাও তো এই শ্মশানেই আসে। তাহলে ভীড় হবেনা?“

যাক গে কিছু করার নেই। বাপ্পা শরীর ঠিক আছে তো বাবা? কোন রকম অসুবিধা হলে তৎক্ষণাৎ আমাদের বলবি। এই তো সবে বোধহয় পঁচিশ কি ছাব্বিশ। এই বয়সেই ছেলেটার ওপরে বিশাল দায়ীত্ব পরে গেলরে। ওর মা-কে যে ব‍্যাঙ্গালোরে নিয়ে যাবে নিজের কাছে সেও তো সম্ভব নয়। ওর মায়ের তো এখনো বছর দেড়েক বোধহয় চাকরি আছে।“

না রথীন জ‍্যেঠু আমি ঠিক আছি। মা-কে নিয়েই ভাবছি গো। একা একা এখানে থাকা কি সম্ভব? একটা ভালো সবসময়ের লোক খাওয়া পড়া দিয়ে রাখতে হবে। তোমরাও একটু দেখো তো জ‍্যেঠু। সমীর’ দা, তাপস’ দা, পলাশ কাকু তোমাদের কেও বলছি।একটু খুঁজে দেখ। ভালো বিশ্বস্ত বয়স্ক মহিলা দেখতে হবে,যার কোন পিছুটান নেই।“

ও নিয়ে ভাবতে হবেনা।তোমার জ‍্যেঠিমা এই ব‍্যাপারে একেবারে যাকে বলে দক্ষ লোক। ইতিমধ‍্যেই একজনের কথা ভেবেও রেখেছে। কাজ গুলো সব নির্বিঘ্নে মিটে যেতে দাও। তুমি তো মিনিমাম পনেরো দিনের আগে ব‍্যাঙ্গালোরে ফিরতে পারবে না। এখনো হাতে যা সময় আছে তার ভেতরে সব ঠিক হয়ে যাবে। তোমার মা খুবই ভালো মানুষ।যে কেউ ওনার সাথে অ‍্যাডজাস্ট করে নিতে পারবে।“

আজকে গরমও খুব।“

পচা ভাদ্র, হবে না!!”

যা বলেছিস তাপস। আরে ওদিকে দেখ।আর কটা বাকি?”

রথীন’ দা, সমরেশ’ দার আগে এটাই লাস্ট। আগেরটা মিনিট দশেক হলো চুল্লীতে ঢুকে গেছে। ঐ যে ঠাকুরমশাই ডাকাডাকি শুরু করে দিয়েছেন।“

বাপ্পা শীঘ্রই উঠে আয় বাবা। আগে তো মুখাগ্নিটা করতে হবে। আরে তাপস, সমীর, বলাই, পলাশ চল চল হাত লাগা সব।“

ওনার ছেলেকে ডাকুন তাড়াতাড়ি। এখনো আরও পাঁচটা লাইনে রয়েছে। আমার আর আজকে রাত্রে বাড়ি ফেরা হবেনা বলেই মনে হচ্ছে।দুনিয়ার সব লোকের আজকেই যেন মরবার তাড়া লেগে গেছে। এক বছরও হয়নি। সদ‍্য বিয়ে করা বৌটার প্রথম পোয়াতি। হ‍্যা পাটকাঠি গুলো একসাথে মুঠো করে সামনেটায় আগুন ধরাও। এবার যখন যেভাবে বলবো জ্বলন্ত পাঠকাঠি গুলো মৃতদেহের মানে তোমার মৃত বাবার মুখের কাছে ছোঁয়াবে। নাও একবার চারপাশে ঘুরে এসে মুখের কাছে জ্বলন্ত পাঠকাঠি গুলো ঠেকিয়ে বলো- ওং, পিতৃ শান্তি কামনাও.........”

ওরে এই বাপ্পা। কি করছিস থাম। জ‍্যান্ত বাপটাকে শেষে পুড়িয়ে মারবি নাকি?? আরে পুরোহিতটাকে আগে থামা। মরার আগেই সৎকার করে দিচ্ছে ব‍্যাটাচ্ছেলে !!”

কি হলো, এত চিৎকার করছো কেন? কে পুড়িয়ে দিল??”

কে কে?? রত্না? আমাকে শ্মশানে নিয়ে এসেছো কেন??”

কি আবোল তাবোল বলছো? মাথাটাই গেছে।“

পরের দিন বিকাল, 6-58

এই নিয়ে গত চার মাসে তিন বার হলো ডাক্তার বাবু। লোকটা কি শেষে পাগল হয়ে যাবে ?”

আরে না না। এত ঘাবড়ানোর মত কিছু হয়নি। মাথায় যে কোন কারণে হোক স্ট্রেস পরেছে।ফলে নার্ভ গুলো একটু দুর্বল হয়ে গেছে। কটা ভিটামিন ট‍্যাবলেট আর একটা একেবারেই হালকা ডোজের ঘুমের ওষুধ লিখে দিলাম। তবে খাবারে পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রোটিন জাতীয় খাবার রাখতে হবে। আমি খাবারেরও একটা চার্ট করে দিলাম। দিন পনেরো একটু নিয়ম মেনে চললেই উনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবেন। আপনি একদম ওনাকে নিয়ে টেনশন করবেন না।কারণ আপনারও যে বয়স হয়েছে সেটা কিন্তু মাথায় রাখতে হবে। এবং এই মুহূর্তে উনি যেন কোনো এমন ধরনের কাজ না করেন যেখানে টেনশন আছে। এটা আসলে কোন রোগ নয়। কিন্তু ঘুমের মধ্যে অনেক সময় হার্টফেলও হয়ে যেতে পারে। সো, প্লিজ অলওয়েস বি কেয়ারফুল।“

 ...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment