1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, October 2, 2024

একটি সফল প্রেমের কাহিনী

ছবি  : ইন্টারনেট

একটি সফল প্রেমের কাহিনী 

গীতশ্রী চক্রবর্ত্তী মল্লিক

রাত বড়ো প্রিয় শ্রী-র। সাউন্ড সিস্টেমে বাজছে ওস্তাদ রশিদ খাঁ-র ভীমপলশ্রী। বড়ো করুণ রাগ, বড়ো নরম। বারান্দায় একা ইজিচেয়ারে, ভাসিয়ে নিয়ে যায় সময়ের অতীত-ঢেউ।

      সবে নতুন বিয়ে করে এসেছে। হ্যাঁ, বাবা-মায়ের অমতে এই বিয়ে, অসবর্ণ বিবাহ। শ্রী ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে। বিক্রম অব্রাহ্মণ। তাই অমত। নতুন পরিবেশ, শ্বশুরবাড়ীতে বড়ো পরিবার। তখনও শ্রী ভাবতে পারে নি "এই এক বাড়ীতে থাকাকেই কি পরিবার বলে"?

প্রায়ই লক্ষ্য করে এক টেবিলে  খেয়ে বাবা ও ছেলে যে যার মতো বেরিয়ে যায়। কিছু জিজ্ঞেস করে না বিক্রমকে। একদিন গাড়ীতে বেড়াতে গিয়ে হঠাৎ একটা বাড়ীর সামনে গাড়ীটা থামায়। শ্রী-কে নেমে আসতে বলে। ওই বাড়ীতে ঢুকে যায় এবং একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোকের সামনে দাঁড়িয়ে বিক্রম বলে-----" এই আমার স্ত্রী"। শ্রীকে প্রণাম করতে বলে।

শ্রী বুঝতে পারে, ইনি একজন অ্যাডভোকেট। প্রণাম সেরে শ্রী চেয়ারে বসে।

ভদ্রলোক বলে ওঠেন----- "বিক্রম, এত সুন্দর একটা লক্ষীমন্ত মেয়েকে তোর বাবা কোর্টে বাজারের মেয়ে বলেছে"!!!

ব্যাপারটা বোধগম্য হয় না শ্রী-র।

বাড়ীতে ফিরে বিক্রমকে জিজ্ঞেস করে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে। বিক্রম বলে------ "তোমাকে আগে বলি নি, কারণ তোমাকে হারাতে চাই নি। যেহেতু তোমার বাড়ীর অমত, সেটা আমার পয়সাওয়ালা বাবার prestige-এ লেগেছে। আমাকে আটকাতে পারবে না, তাই রেজেস্ট্রি-র পর যাতে তোমাকে নিয়ে বাড়ী ঢুকতে না পারি সেইজন্য আমার বাবা আমার বিরুদ্ধে কোর্টে কেস করেছে  "বাজারের মেয়ে" এনে ছেলে ঘর দখল করছে।

শ্রী বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। বিয়ের আগে মামলা-মোকদ্দমার নাম শোনে নি। একটা সুসংস্কৃতিসম্পন্ন পরিবারের মেয়ে শ্রী। নানা প্রশ্ন ভীড় করে মনে। মুখে কিছু বলে না। একই বাড়ীতে একই পরিবারের এতগুলো মানুষ! কিন্তু কারোর সঙ্গে কারোর আত্মিক যোগ নেই। প্রত্যেকটা সম্পর্ক টাকাপয়সার সুতোয় বাঁধা। এমনকি বাবা-মায়ের সঙ্গেও তাই এবং এইভাবে সম্পর্কের সমীকরণের কারিগর বিক্রমের বাবা-মা।

শ্রী-র পড়াশোনা সাহিত্য নিয়ে। বাংলা অনার্স নিয়ে গ্রাজুয়েশনের পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার ডিগ্রী, তারপর এম. ফিল। এরই মাঝে বিক্রমের সাথে পরিচয়, প্রণয় ও পরিণয়। পি. এইচ. ডি করছিল। কিন্তু শেষ করতে পারলো না শ্বশুড়বাড়ীর অসহনীয় পরিবেশ ও পরিস্থিতি। শ্রী সঙ্গীতশিল্পীও বটে। ছোটোবেলা থেকেই গান শিখেছে। প্রথমে বাবা ও পরে প্রতিথযশা শিল্পীর কাছে সঙ্গীতের তালিম। যথেষ্ট ভালো গাইত। বিভিন্ন ফাংশন ও আকাশবানীতে প্রোগ্রাম করেছে। এমন পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে শিল্পী-মানসিকতা কোথায় যেন হাবুডুবু খেতে লাগলো, ক্রমশঃ দমবন্ধ পরিবেশ।

স্বাধীন জীবনটা কোথায় যেন হারাতে শুরু করলো শ্রী-র। বিক্রমরা ছয় ভাই। ছয় ভাইয়ের পাঁচ বউ। এদের মধ্যে শ্রী নতুন। সকাল ৭টার মধ্যে দোতলায় নেমে যেতে হয় বৌ-দের। লাটে উঠেছে শ্রী-র সকালের গানের রেওয়াজ। দোতলায় শ্বশুর-শাশুড়ী ও ছোটোছেলের বাস। তিনতলায় বাকি ভাই ও বৌ-রা। শ্রী লক্ষ্য করে, বৌদের কোনো সম্মান বা অস্তিত্ব নেই। পড়ে থাকা পুরোনো খাবার, বাড়ীর পুরুষদের পাতে পড়ে থাকা খাবার বৌ-দের খাওয়া অপরিহার্য। শ্রী মুখে কিছু বলে না, কিন্তু ওইসব এঁটো খাবার খায় না। বাকি বউরা এইসবে অভ্যস্ত। ফলে শ্রী সকলের কুনজরে পড়তে শুরু করলো।

এইভাবে চলতে লাগলো। শ্রী মুখে কিছু বলে না, কিন্তু তেল দিয়ে চলার পাত্রী নয়। সংসারের ঝোলে-ঝালে-অম্বলে থাকতে পছন্দ করে না। ক্রমশঃ সকলে বুঝতে পারছিলো "শ্রী অন্য জগতের মানুষ"। বাকি বৌরা দুজন গ্রাজুয়েট, দুজন স্কুল ডিঙোয় নি। ফলে শ্রী হয়ে উঠলো সবার ঈর্ষার কারণ।

ছলে-বলে-কৌশলে শ্রী-র পেছনে লাগা শুরু হোলো, পদে পদে অপদস্থ করা। এত মিথ্যাচার, এত মিথ্যাচার------মানুষ যে এত মিথ্যে কথা বলতে পারে ----বিক্রমদের বাড়ীতে না এলে জানতেই পারতো না শ্রী। বিক্রম কিন্তু সবার মত নয়, সহজ মানুষ। ফলে বিক্রমকে ছেড়ে চলে যাবার কথা ভাবতে পারত না শ্রী। বিক্রম নিজের ব্যবসায় সুপ্রতিষ্ঠিত। ফলে অন্যান্য ভাইদের ঈর্ষার কারণ বিক্রম। শ্রী ক্রমশঃ বুঝতে পারে পারিবারিক সম্পত্তি থেকে বিক্রমকে ঠকানোর চক্রান্ত। মিথ্যে মামলায় দুজন ভাই বিক্রমকে ফাঁসিয়ে দিল। শ্রী অবাক বিস্ময়ে হতবাক। এদের হাত থেকে বিক্রমকে বাঁচানোটাই শ্রী-র প্রধান কর্তব্য হয়ে দাঁড়ালো। গানবাজনা,পি.এইচ.ডি সব লাটে উঠলো। ক্রমশঃ মামলা-মোকদ্দমা, পুলিশ-উকিলে ছেয়ে গেল শ্রী-বিক্রমের নতুন দাম্পত্য।

বিক্রমের মন সর্বদা উচাটন। কেস হারলে "কি হবে, কি হবে"!! শ্রী-র মত একটা সুশিক্ষিতা মেয়ে-কে " বাজারের মেয়ে"-তে পরিণত করা!! বিক্রমের বাবার কি শয়তান মস্তিস্ক!

শ্রী ভাবে উকিলরাও বা কি! এইসব মিথ্যে মামলায় পয়সা উপার্জন করে পরিবার প্রতিপালন করে! শেষপর্যন্ত কি ভালো হয় এইশ্রেণীর উকিলদের?

এরমধ্যে আরেক ঘটনা ঘটলো। ন'বৌ বদমাইশি করে শাশুড়ীর কান ভরালো। সকালবেলায় দোতলায় নামতেই শাশুড়ী শ্রী-কে গালাগাল শুরু করলো। শ্রী চুপচাপ শুনছিলো, কিন্তু যেই শ্রী-র বাবা-মা তুলে গালাগাল করেছে শ্রী প্রতিবাদ করে বলেছে------"মা, আমি তোমার মেয়ের মত, অন্যায় করলে আমাকে তোমার মারার রাইট আছে। কিন্তু আমার বাবা-মা তুলে গালাগাল করবে না। কারণ আমার বাবা-মা এই বিয়ে দেয় নি। আমি স্বেচ্ছায় তোমার ছেলেকে বিয়ে করেছি, কিন্তু সত্তা বিক্রী করি নি"।

এই বলে শ্রী তিনতলায় চলে আসে। পরপর তিনদিন কিছু খায় না। বাড়ীর অন্যরা তখন তামাশা দেখছে------ কি হয়, কি হয়।

শ্রী-ও দমবার পাত্রী নয়। তিনদিন দোতলায় নামেও নি, খায়ও নি। অন্য বউরা ভাবতেই পারে না এই প্রতিবাদ। তারা তাদের বাবা-মা নিয়ে গাল শুনতে অভ্যস্ত। বিক্রম লুকিয়ে খাবার এনেছে। শ্রী রিফিউজ করে বলেছে-------"তোমার মা-কে নিজে হাতে খাবার দিতে হবে, তবে খাবো, নয়তো নয়। মরতে হলে মরবো"।

বাড়ীর অতো লোক শুধু দেখছে তামাশা, একে তো কোর্টে কেস চলছে "বাজারের মেয়ে এনে ঘর দখল"।

শ্রী কিন্তু শাশুড়ীকে মন থেকে ভালোবেসেছিল, তাই প্রথম সম্বোধনেই " মা *আপনি* নয়, মা *তুমি* বলেছিল। যা অন্য বউরা পারে নি। এটাও অন্য বউদের একধরণের জ্বলন। তবে এই ভালোবাসা নিতে পারারও ক্ষমতা থাকা চাই। বিক্রমের মা শ্রীর এই নির্ভেজাল ভালোবাসা নিতে পারে নি।

তিনদিনের দিন রাতের বেলায় শ্রী-র ক্রমশঃ শরীর খারাপ হতে শুরু করলো। হাত-পা অবশ হয়ে আসছে, পেটে খিঁচুনি ধরছে। বিক্রম ভয় পেয়ে  মা-কে বলতে যায়। একে একে সব বৌ, শাশুড়ী ও এক আশ্রিতা পিসীমা হাজির হয় বিক্রমের ঘরে। 498 ধারার কেসটা তখন মানুষজন মোটামুটি জেনে গেছে। শ্রী তো কিছুতেই খাবে না, ভীষণ আত্মসম্মানী। তখন শাশুড়ী এক গ্লাস দুধ নিজে হাতে শ্রী-কে দিয়ে খেতে বলে। শ্রী-র শরীর বিধ্বস্ত,শুনতে পাচ্ছে ওই পিসীমা বলছেন ------" বিভাবরী ( শাশুড়ীর নাম) এই মেয়ে ষোলোআনা জিদ্দি মেয়ে, অন্য বৌদের মত এর সঙ্গে ব্যবহার করিস না"।

যাইহোক শাশুড়ী দেবার পর শ্রী খায়, কিন্তু টানা তিনদিন না-খাওয়া ও মানসিক ধকলে কাহিল হয়ে পড়েছিল। বুঝতে পারে বড়ো ভুল জায়গায় এসে পড়েছে।

আবার রোজকার নিয়মে দিন গড়াতে থাকলো। ক্লাসিক গান শোনে, রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করে--------

"হে মোর দুর্ভাগা দেশ,যাদের করেছো অপমান

অপমানে একদিন হতে হবে তাহাদের সবার সমান"।

শক্তি পায় মনে। ক্রমশঃ তিনতলার ঐ কোনের ঘরটা একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হয়ে উঠলো। সকলের কৌতুহল ঐ ঘর, ঐ মেজো বৌ-কে নিয়ে। শ্রী-ই মেজ বৌ। রবীন্দ্রনাথের স্ত্রীর পত্র শ্রী পড়েছে। কিশোরীবেলায় খবরের কাগজে পড়েছে সুরূপা গুহ ও দেবযানী বনিকের নারকীয় হত্যাকান্ড। মনে মনে তৈরী হয়ে যায়, এখানে থেকেই আত্মসম্মানের লড়াইটা চালিয়ে যাবে।

ওদিকে "বাজারের মেয়ে এনে ঘর দখল" -এর কেসটা তো চলছে। সেদিন বিক্রম কিছু না খেয়েই কোর্টে বেরিয়ে যায়। সেদিন ফাইনাল হিয়ারিং। বিক্রমের বাবা তুষার পালের খুব বদনাম, মামলাবাজ লোক। শ্রী ভেতরে ভেতরে খুব চিন্তিত, বিক্রমকে বুঝতে দেয় না। কারণ বিক্রম খুব সহজ মানুষ, মামলা-র কোনো অভিজ্ঞতা নেই। ক্রমশঃ তাকে অন্যায়ভাবে  জড়িয়ে ফেলেছে মামলায়।

সারাদিন শ্রী চুপচাপ, ভেতরে ভেতরে অস্থির,কিন্তু বুঝতে দেয় না। পুরো বাড়ীটায় সেদিন যেন উৎসব লেগেছে।যেন কেসের ফলাফল ওরা জেনেই গেছে। তুষার পাল কোনোদিনও কেস হারে নি। বড় বড় উকিল লাগিয়েছে।

কিন্তু বিক্রমের সহায় হোলো ঈশ্বর। ও খুব ভক্তিমান। বিক্রমও খুব বড়ো উকিল লাগিয়েছে, কারণ শ্রী-র সম্মান, শ্রীকে কোনোমতেই হারাতে পারবে না বিক্রম।

শেষ-বিকেলে ফোন এলো বিক্রমের------ " শ্রী, রেডি থেকো। বাড়ী ফিরেই তোমাকে নিয়ে বেরোবো। গ্লোবে সিনেমা দেখে কোয়ালিটিতে ডিনার করে ফিরবো।বাড়ী ফিরে সব বলছি"। ফোন কেটে দেয় বিক্রম।

শ্রী বুঝতে পারে বিক্রম কেস জিতে গেছে। ততক্ষণে বাড়ীর সবাই ফলাফল জেনে গেছে। সারা বাড়ী থমথমে, তুষার পাল হেরে গেছে, ছেলের কাছে বাবা হেরেছে, সত্যের কাছে মিথ্যা হেরেছে।

কিছুক্ষণ বাদে বিক্রম ফিরে আসে, শ্রীকে পরম আদরে জড়িয়ে ধরে, আদরে-চুমুতে ভরিয়ে দেয়। বলতে থাকে-----"শ্রী, আর আমাদের বের করে দেবার ক্ষমতা নেই আমার বাবার। তোমার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট, গানের সার্টিফিকেট-শংসাপত্র দেখে বাবার উকিলকে জজসাহেব প্রচন্ড ধমকেছেন এইভাবে মিথ্যা মামলায় একজন নারীর চরিত্রহননের জন্য। রায়ে ঘোষণা করলেন, বিক্রমের আইনত স্ত্রী হিসেবে ওই বাড়ীতে থাকার"।

বিক্রমের জয়ের আনন্দ বাঁধনহারা। শ্রী রেডি হয়েই ছিলো। দুজনে বেরিয়ে যায় গাড়ীতে নতুন দাম্পত্য সেলিব্রেশানের জন্য।

...(সমাপ্ত)...

No comments:

Post a Comment