1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, September 21, 2025

পবন গুণ্ডার ডিগবাজি


ছবি : ইন্টারনেট

পবন গুণ্ডার ডিগবাজি

অমর নস্কর

এই শালা! তোর মালিককে ডাক তো বে--

উত্তমদা তো নেই এখন।

----কোথা আবার ফুটলো?

জানিনা—। আমি বলতে পারবো না—কোথা যায় আমাকে কি বলে গেছে!

বিরক্ত প্রকাশ পেল অমিয়-র কথায়।

প্রশ্ন কর্তা যে স্বাভাবিক অবস্থায় নেই সেটা ওর গা থেকে যে উগ্র গন্ধ বেরুচ্ছে তাতে সহজেই অনুমেয়। তা ছাড়া এ তল্লাটে একজন নামকরা গুণ্ডা-এরকমই অভিজ্ঞতা অমিয়র। নাম পবন। এলাকায় ওর নাম শুনলে সবারই গা শিউরে ওঠে। পাশের বস্তিতে থাকে। সব সময় নেশা করে থাকে ও। অমিয়র মালিক উত্তমদার কাছে ওর খাতির একটু ছিল। উত্তমবাবু ওর সঙ্গে গায়ে গা দিয়ে চলেন। ব্যাবসা করতে এসে ঝুট-ঝামেলায় জড়িয়ে যাওয়ার ভয় ছিল ওনার। টাকা পয়সা দিয়েই মূলত ওদের বোঝাপড়া। সেদিন পবনের টাকাকড়ি ঘাটতি ছিল--তার জন্যই উত্তমবাবুর খোঁজে ওর আগমন। অমিয়ও জানতো পবনের আগমনের হেতু।

বস্তির নাম গোবরঝুরি বস্তি। বস্তির পাশে সরকারি ও বে-সরকারি চাকুরে লোকজন লোন নিয়ে বাড়ি ঘর করে আছেন। এদের মধ্যে বেশিভাগই ব্যাংকে কাজ করেন। এদের সঙ্গে বস্তিবাসির সব সময়ই বৈরিতা। বস্তিবাসির কালচারের সঙ্গে এদের কালচারের সংঘাত সদা সর্বদাই ছিল। বস্তির ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা প্রতিদিন ভোর না হতেই এদিকে খেলাধূলো করে। কারো গেটের সামনে কারো খালি বারান্দা খোলা পেলে ঢুকে পরে চিৎকার চেঁচামেচি করে আর অকথ্য ভাষায় গালি-গালাজ চলে। কেউ প্রতিবাদ করলে আর রক্ষে নেই। দলে দলে আণ্ডা-বাচ্চারা বস্তি থেকে উজার হয়ে ছুটে আসবে। ইঁট-পাটকেল ছোঁড়াছুঁড়ি চলবে। বাচ্চাদের সঙ্গে ওদের বাবা-মা’রা এসে গালিগালাজ চালাবে—সেটা ঐ টুকরো হল্লার থেকে অন্য দিকে রূপ নেবে সে কথা বলার অপেক্ষায় নেই। এই ভয়ে তটস্থ সবাই। বস্তিবাসিদের বেশিভাগ রিক্সাচালক-মাছের কারবারি। ছোটখাটো লেদে বা অন্য কোথাও কাজ করেন। শিক্ষার আলো ঢোকেনি—বা ঢুকতে পারেনি। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড বাড়িগুলোর আড়াল করে রেখেছে চারদিক থেকে। সমস্ত কিছু সুযোগ সুবিধা কেড়ে নিতে চাইছে যেন ওদের। আগে এই বস্তি ছিল কলোনী জুড়েই। বে-দখলি অবস্থায় ছিল বলে ওদের আধিপত্য ততটা ছিল না। আস্তে আস্তে ঐ সব জমি প্লট করে বিক্রি হয়ে যায়। স্বাভাবিক ভাবেই ওদের হঠে যেতে হয়। হঠতে হঠতে এক কোণে ওরা জড়ো হয়ে আছে। এখানে একটা বিশাল বুজে যাওয়া ঝিল ছিল। সেটাই বুজিয়ে নিয়ে ঝুপড়ি করে ওরা থাকে। সমস্ত অসামাজিক লেনদেন এখানে চলে—যেমন মদ, গাঁজা, চরস, হিরোইন—এমনকি মেয়েছেলে সাপ্লাইও চলে আড়ালে আবডালে। সব প্রতিষ্ঠিত পার্টি ভোটের স্বার্থে ওদের ব্যবহার করে এসেছে। বাবুদের বাড়ি কি চাই, ওখান থেকে সাপ্লাই হচ্ছে। বাবারা রিক্সা নিয়ে কিম্বা কাজে বেরিয়ে যায়—মায়েরা বাবুর বাড়ি কাজে চলে আসে বাসন মাজতে, আর ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা খেলনা নিয়ে ব্যাংক কলোনিতে চলে আসে খেলা করতে। এই হচ্ছে বস্তির প্রতিদিনের ইতিহাস। এই সমস্ত কর্মে পবন ওখানকার সমস্ত কিছু ঝুট-ঝামেলা সামাল দেয়। বস্তিবাসী পবনকে মানে। ব্যাংক কলোনির লোকজনও পবনকে মানতে বাধ্য হয়।

এই পবনগুণ্ডা অমিয়র কাছে উত্তমদার খোঁজ করছে কিছু টাকা পয়সা দরকার বলেই। ওদের এই কলোনিতেই একটা ফ্ল্যাটের ছোট একটা গ্যারেজ ঘরে ব্যাবসা। ব্যাবসা হচ্ছে প্রেস। ছোট একটা মেসিন নিয়ে কিছু টাইপপত্র নিয়ে তৈরি। তিনজন কাজ করে ওরা। অমিয়ই বেশিভাগ সময় থাকে। সেদিন অমিয় উত্তমবাবুর সাইকেলটা প্রেসের সামনে দাঁড় করিয়ে রেখে কাজ করছিল—এমন সময় পবন এসে ওর উপর চড়াও হল।

পবন অমিয়র কথার মানে বুঝে উত্তমের সাইকেলটা দেখে অমিয়কে বলল—সাইকেলের চাবিটা দেখি, চাবিটা—

অমিয় বুঝল সাইকেলটা দিলে উত্তমদা ওকে বকবেন। তাছাড়া পবন যে অবস্থায় আছে তাতে ওর টাকা খুবই দরকার বোঝা যাচ্ছে। যদি সাইকেল বিক্রি করে দেয়—কিম্বা বন্ধক দিয়ে মদ খায় বিপদ হবে। এদিকে সাইকেলটা কিন্তু চাবি দেওয়া নেই। পবন মদের খেয়ালে সাইকেলটা চাবি দেওয়া আছে ভেবেই চাবিটা চাইল। অমিয় পবনের চাবির প্রসঙ্গ অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে কথার ফাঁকে সাইকেলের চাবিটা দিয়ে দিয়েছে। পবন বুঝতেও পারেনি যে সাইকেলটা খোলাই ছিল। অমিয় চাবিটা দিচ্ছেনা দেখে রেগেমেগে পকেট থেকে একটা ছোরা বের করে অমিয়র দিকে তুলে বলল—

চাবিটা দে বলছি, নইলে—এই ছোরাটা দিয়ে কলজে ফুটো করে দেব কিন্তু।

ছোরাটা দেখে অমিয় প্রথমটায় ঘাবড়ে গিয়েছিল ঠিকই, তবে নিজেকে সামলে নিয়ে হঠাৎ পুরনো দিনের ছবিটা তার মনে পরে গেল। ঠিক এরকমই একটা ঘটনার প্রত্যক্ষ দৃশ্য ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল।

তখন ও ধনেখালিতে। সেখানে একটি প্রেসে কাজ করত। মালিকের বাড়ি পাশের দুটো গ্রাম ভেতরে। রাত্রে মালিকের বাড়িতেই থাকতো। ওখানে থাকার সুবাদে অশোক নামে এক ডানপিটে ছেলের সঙ্গে ওর আলাপ হয়। প্রতিদিন সন্ধ্যায় ওর সঙ্গে আড্ডা মারতো অমিয়। বাড়ির পাশেই দুর্গামণ্ডপ। সেদিনটা অষ্টমি পুজোর দিন। সবাই পুজায় ব্যস্ত। অমিয় পুজামণ্ডপের পাশে বসে ঢাক বাজানো দেখছিল—এমন সময় আশোক এসে ওর পাশে বসল। ফিসফিস করে অশোক ওকে একটা চকচকে ছোরা জামার ভিতর থেকে বার করে দেখিয়ে বলল, ঐ শালা যামিনীব্যাটাকে দেখছিস। এই ছোরাটা আজ ওর বুকে ঢুকিয়ে দেব—তবেই আমার নাম অশোক বুঝলি।

অমিয় আশোকের গোঁ জানত। যা করব বলে ঠিক তা করেও। অমিয় অশোকের কথায় মারাত্মক ভয় পেয়ে ওর কাছ থেকে পালিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে ভাবতে লাগল, কি করে যামিনীদাকে বাঁচানো যায়। ভাবতে ভাবতে ওর মালিকের বড়দার সামনে বলে ফেল্লো “বড়দা ভারি বিপদ—খুন-টুন হয়ে যেতে পারে বলে মনে হচ্ছে। অশোক একটা ধারালো ছোরা নিয়ে ঘোরাঘুরি করছে—আমাকে এই মাত্র বলল”— যামিনীদাকে নাকি খুন করবে।

বড়দা শুনে মুচকি হেসে বললেন, “ধুর পাগল—যে খুন করবো বলে প্রচার করে সে খুন করতে পারবে না—তোমার ভয় নেই।

সত্যিই সেদিন কিন্তু কিছুই ঘটেনি।

অমিয় পুরনো অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে পবনকে বলল—আমাকে খুন করে কি হবে আপনার? চাবিতো আমার কাছে নেই। আর যদি মারতেই চান তবে এই আমি বুক খুলে দিচ্ছি মারুন। বলে সাহসের সাথে বুক চিতিয়ে অপেক্ষাকৃত দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে পরলো ও।

সেই মুহূর্তে অন্য যারা কাজ করছিল, তারা ভীত-সন্ত্রস্ত চোখে অমিয় ও পবনের দিকে ঘনিষ্টভাবে তাকিয়ে। পবন কিছুটা তরপে শেষে রণে ভঙ্গ দিয়ে আপন খেয়ালে টলমল পায়ে চলে গেল।

ঘন্টা দুই বাদে পবন আবার প্রেসে ঢুকে অমিয়র পায়ে হাত রেখে বলে উঠল—

অমিয়দা কিছু মনে করো না—আমি মদের খেয়ালে ছিলাম—মাফ করেদিও দাদা—

অমিয় পবনের কাঁধে হাত দিয়ে ওকে তুলে বুকে বুক ঠেকিয়ে বলল, আমি কিছু মনে করিনি পবনদা। কিছু ভাবিনি।

সাহস যে জয়ের পূর্বশর্ত অমিয় নতুনকরে সবাইকে বুঝিয়ে দিল।

...(সমাপ্ত)...


No comments:

Post a Comment