![]() |
ছবি : ইন্টারনেট |
চণ্ডীদাস অ্যাভিনিউয়ের সেই অদ্ভুত বাড়িটা
আশরাফুল মণ্ডল
সন্ধে সাতটা তিন। দুর্গাপুরের চণ্ডীদাস অ্যাভিনিউয়ে নিস্তব্ধতা! সোজা একটা ফাঁকা রাস্তা। হাওয়া নেই। শুধু কারও চাপা নিঃশ্বাস যেন ভেসে আসে! মৃদুল থামে। বাঁদিকে একটা বাড়ি। জীর্ণ। ধুলো মাখা। এক সময় হয়তো ছিল কোনো শিল্পচর্চার ঠিকানা। আজ সকালে এই বাড়ির সামনেই একটা খুন হয়েছে। প্রতিটি দৈনিক কাগজে জ্বলজ্বল করছে এই নিয়ে ছোট্ট একটা খবর।
মৃদুল বসু। এখন
দুর্গাপুরের একটি বেসরকারী কলেজের অধ্যাপক। কিন্তু আগে সে ছিল কলকাতার সাইবার
শাখার হ্যাকার-সহকারী। হঠাৎ চাকরি ছেড়ে চলে আসে দুর্গাপুরে।
চণ্ডীদাস অ্যাভিনিউয়ের ওই বাড়িটা এক মাস ধরে মৃদুলকে তাড়া করছে। চোখ বন্ধ করলেই ভেসে ওঠে সেই লোহার গেট। ভাঙা কাঁচ। ছেঁড়া পোস্টার। তার বারবার মনে হতে থাকে এই বাড়িটার সঙ্গে তার কোনো পুরনো যোগ আছে। আজ সন্ধেয় হাঁটতে বেরিয়েছিল। সে ভেবেছিল কাছ থেকে একবার দেখে নেবে ওই বাড়িটা।
সন্ধে সাতটা তিন। দুর্গাপুরের চণ্ডীদাস অ্যাভিনিউয়ের রাস্তায় মানুষ নেই। একটানা ফাঁকা রাস্তা। হাওয়া নেই একটুও। গাছের পাতাও নড়ছে না। হঠাৎ মনে হলো কেউ যেন নিশ্বাস নিচ্ছে খুব আস্তে! মৃদুল থামে। চারপাশে তাকায়। কারও দেখা নেই। তবু স্পষ্ট শুনতে পায় একটা কণ্ঠস্বর। ফিসফিস করে বলছে - "মৃদুল..."। মৃদুল চমকে ওঠে। পিছনে তাকায়। কেউ নেই। গলার স্বরটা যেন তার চেনা! কিন্তু মনে করতে পারে না কোথায় শুনেছে। তার পা আপনাআপনি এগিয়ে যায়। সেই বাড়িটার লোহার গেট আধখোলা। সে থেমে যায়। তারপর সে ধীরে ধীরে ঢোকে। একটা ঠান্ডা হাওয়া তার গা ছুঁয়ে যায়। ঠিক তখনই তার মোবাইল কেঁপে ওঠে। স্ক্রিনে একটা মেসেজ - “তুই এসেছিস তাহলে! এবার খেলাটা শুরু হোক মৃদুল।” তার হাত ঠান্ডা হয়ে যায়। সে চুপ করে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকায়। অন্ধকার আরও ঘন হচ্ছে।
২
ওই অদ্ভুত
বাড়িটার মূল দরজাটা বন্ধ। ভেতর থেকে কেউ যেন চাবি ঘুরিয়ে বন্ধ করে রেখেছে। কিন্তু
মৃদুলের হাতে একটা চাবির গোছা আছে। পুরোনো। জং ধরা। এই চাবির গোছা সহকর্মী রমেন
গোপ মারা যাওয়ার আগের দিন তাকে দিয়েছিল। মৃদুল সিওর যে, রমেন আত্মহত্যা করেনি। ওকে কেউ মরতে বাধ্য
করেছে। আর তার মৃত্যুর কিছু একটা গভীর যোগ আছে ওই বাড়িটার সঙ্গে। সে চাবি ঢুকিয়ে
ঘোরায়। দরজা খুলে যায়।যেন কেউ ভেতর থেকে টেনে খুলছে! ভেতরে ঢুকে পড়ে মৃদুল। বাড়ির
ভিতরটা একদম নিঃশব্দ। দেয়ালে রঙচটা একটা পোর্ট্রেট। এক বৃদ্ধ। তার দিকে তাকিয়ে
থাকলে গা ছমছম করে। ঘরের এক কোণে কাঠের একটা টেবিলের উপর রাখা একটা পুরনো ডায়রি।
মৃদুল ধীরে গিয়ে ডায়রিটা তোলে। দেখে প্রথম পাতায় তারিখ লেখা -
“০৩ মে, ১৯৯৩”
ঠিক তার নিচেই লেখা -
“আজ আবার সেই মেয়েটাকে দেখলাম। ভিজে পায়েও কোনো ছাপ পড়েনি!"
মৃদুলের শরীর হিম হয়ে আসে। আর তখনই মোবাইলটা বেজে ওঠে। ভিডিও কল। নাম নেই। নম্বর গোপন। ধীরে ধীরে কলটা রিসিভ করে সে। স্ক্রিনে ভেসে ওঠে একটা ঘর। আরে এ তো এই অদ্ভুত বাড়িটারই ভেতরের একটা অংশ! আলো কম। দেয়ালের ছায়াগুলো যেন হেঁটে বেড়ায়। একটা জানালা আধখোলা। পর্দা বাতাসে থরথর করছে। মৃদুল অনুভব করে এই ঘরেই কিছু একটা ঘটে গেছে। ভিডিওতে দাঁড়িয়ে আছে একটা মানুষ। মুখ ঢাকা। মুখোশ পরা। আর মুখোশের উপর বড় হরফে লেখা - “০৩ মে”। মৃদুল চিৎকার করে ওঠে - “কে? তুই কে?” কোনো উত্তর নেই। ভিডিওটা আচমকাই বন্ধ হয়ে যায়। মোবাইলটা কালো স্ক্রিন হয়ে যায়। মৃদুল দৌড়ে যায় ড্রইংরুমে। চোখে পড়ে দেয়ালে একটা পুরনো ঘড়ি। ঘড়িটা থেমে আছে ঠিক সাতটাটা তিন মিনিটে। এই সময়েই তো সে এখানে ঢুকেছিল। ঠিক এই সময়েই তো সেই ফুসুরফাসুর কণ্ঠস্বর শুনেছিল। ঘড়ি থেমে আছে! ঠিক এই সময়ে! ঘড়িটা কে থামাল? কেন থামাল?
সে ধীরে ধীরে বাড়ির ভেতরে এগোয়। হঠাৎ কিছু একটা স্পর্শ করে তার হাত। সে মুহূর্তে ঘুরে তাকায়। কেউ নেই। শুধু মেঝেতে পড়ে থাকা একটা চিরকুটে লেখা - “ওরে তুই যা খুঁজছিস সে তো তোকে খুঁজছে।” মৃদুল নিঃশ্বাস নিতে ভুলে যায়। বাড়িটার নিঃশব্দতা যেন তার গায়ে চেপে বসে। চণ্ডীদাস অ্যাভিনিউয়ের এই বাড়িটা এখন তো শুধু একটা বাড়ি নয়! এ যেন একটা খেলা! একটা ফাঁদ! আর কেউ একজন জানে নিশ্চয়, মৃদুল এখানে এসেছে!
৩
চিরকুটটা শক্ত
করে মুঠোয় ধরে রাখে মৃদুল।
ডায়রির পাতা উল্টাতেই সে থমকে দাঁড়ায়। আরেকটি নোট। হাত কাঁপতে থাকে। তাতে লেখা - “সে আসবে। প্রতিবার ৩ মে সে ফিরে আসে। মুখোশ পরে।” মৃদুলের হাত ঘেমে যায়। কী মানে এ সব কথার? ‘সে’ কে? প্রতি বছর ৩ মে-তে কী হয়?কে লিখেছিল এই ডায়েরি? কেন এই ভয়? মৃদুল আরেকটু সাহস করে পাতাগুলো ওল্টায়। হঠাৎ চোখ আটকে যায় এক পাতায়। তাতে একটা কোড লেখা - "সেই : অ/বা/চ/অ্যা।" সে চমকে ওঠে। এই কোডটা চেনে সে। রমেন একবার একটা ফাইল এনক্রিপ্ট করেছিল এই পাসওয়ার্ডে। তারা তখন একসাথে কাজ করছিল সাইবার সেলে। তৎক্ষণাৎ মৃদুল মোবাইলে নিজের পুরনো ড্রাইভ খুলে। সেই ফাইলটা খুঁজে পায় - “প্রকল্প - সেই অদ্ভুত বাড়ি"।
ডা. নীতা সেন, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। একসময় কাজ করতেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ও স্নায়ুবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানে। কেস নাম্বার - ৭৭৭। শ্বাস নিতে ভুলে যায় মৃদুল। চোখের পাতা কাঁপে। নীতা সেনের গবেষণার বিষয় ছিল - “ইন্দ্রিয়-উদ্দীপক মাধ্যমে স্মৃতি বদলানো”। মানে! সবকিছু একে একে মিলে যাচ্ছে। এ বাড়িতে কেউ এক ভয়ঙ্কর পরীক্ষা চালিয়েছে। এটা আত্মহত্যার ঘটনা নয়। এটা খুনের চেয়েও ভয়ঙ্কর!
নিচতলার দিক থেকে একটা শব্দ ভেসে আসে। কেউ হাঁটছে যেন! ভারী বুট পরে। মৃদুল মোবাইলের টর্চ জ্বালে। ধীরে ধীরে নামতে থাকে সিঁড়ি বেয়ে। নিচে ঘুটঘুটে অন্ধকার। তার চোখে পড়ে এক লোহার দরজার গায়ে লেখা - “প্রবেশ নিষেধ - বিপজ্জনক”। সে বুঝতে পারে আসল সত্যি লুকিয়ে আছে এই দরজার ওপারে। ঠিক তখনই দরজার ভিতর থেকে একটা কণ্ঠ ভেসে আসে - “তুই ঠিক করে ফ্যাল, কী মুছবি আর কী মনে রাখবি?”
মৃদুল পিছন ফিরে তাকায়। কেউ নেই। তবু গলা যেন পরিচিত লাগে। তার শরীর ঠান্ডা হয়ে আসে। তার কেবলই মনে হয় এই কণ্ঠ আগেও শুনেছে। এই ঘরেও সে আগে এসেছে। হয়তো কেউ তার স্মৃতির কিছু অংশ মুছে দিয়েছে। সে বুঝতে পারে যে, সে নিজেই একটা চিপ। যার মেমোরি মুছে আবার লেখা হচ্ছে। স্মৃতি যদি অস্ত্র হয়, তবে সবচেয়ে ভয়ানক শত্রু সে-ই! মৃদুলের মুখ দিয়ে শব্দ বেরোয় না। সে শুধু দাঁড়িয়ে থাকে দরজার সামনে। একটি ভয়ংকর সত্যের মুখোমুখি।
৪
ছোট্ট ক্লিনিক ঘরটিতে আলো ঢোকে না। ঘরটায় একটা গা ছমছমে ছায়া। এক কোণে রাখা কাচের বাক্সে থরে থরে সাজানো একাধিক মুখোশ। প্রতিটি মুখোশে একটি করে তারিখ লেখা। মৃদুলের চোখ গিয়ে পড়ে এক মুখোশে। বড় বড় অক্ষরে লেখা - “মৃদুল সান্যাল, ১১ জুলাই”। সে স্থির হয়ে যায়। চোখে বিস্ময়। “সান্যাল?” “আমার তো পদবী বসু!" “তবে কি আমি!এই মুখোশটা পরেছিলাম?” তার নিঃশ্বাস কেঁপে ওঠে। এই তারিখ! এই দিনই তার তো ছোটবোন শতরূপা হারিয়ে গিয়েছিল!
মৃদুলের বুক ধড়ফড়
করতে থাকে। এই মুখোশ! এই তারিখ! এই ল্যাব! হঠাৎ তার মাথায় বিদ্যুৎ খেলে যায়। এই
মুখোশগুলো শুধু ছদ্মবেশ নয়।
এরা স্মৃতি মুছে দেয়। যে এই মুখোশ পরে সে নিজের নাম-পরিচয় ভুলে যায়। সে হয়ে ওঠে এক "এজেন্ট"। সে নির্দেশে চলে।আদেশে খুন করে। নিজের জীবনের ছায়াটুকুও চিনতে পারে না। মৃদুলের কপালে ঘাম। তার ঠোঁট ফিসফিস করে ওঠে - “আমিও কী তাহলে! একসময় ওই মুখোশ পরেছিলাম?”
একটা ঝাপটা হাওয়া
ঘরের ভিতর ছুটে আসে।
ডেস্কের ওপর রাখা পুরনো নথিগুলো উল্টে পড়ে। একটায় লেখা - "বিষয় মৃদুল। অবস্থা : মুছে ফেলা হয়েছে।"
৫
মৃদুল হাঁটছে সুড়ঙ্গের ভিতর। নির্বাক। নিঃসঙ্গ। চারপাশে কেবল নিঃশ্বাসের শব্দ আর একঘেয়ে দমবন্ধ অন্ধকার। তার মনে হচ্ছে এই জায়গা কোথাও দেখেছে। সে থামে না। হঠাৎ কানের খুব কাছে একটানা একটা শব্দ বাজে - টিক টিক টিক! কিন্তু সময় এখানে থেমে আছে বহুদিন। সে পেছনে তাকায়। কিছু যেন নড়ে উঠছে সেই অন্ধকারের ভেতর। শ্বাস ফেলে কেউ যেন তার ঠিক কানে বলছে - “পিছন দিকে ঘুরবে না, মৃদুল”।
সে ঘোরে না। ধীরে হাঁটে। একসময় একটা দরজা চোখে পড়ে। আলো ঝলকাচ্ছে তার চারপাশে। চোখ ধাঁধিয়ে দেয় এমন এক ধরনের নীল রং। দরজার গায়ে কোনো লেখা নেই। মৃদুল দম নেয়। হাত তোলে দরজার দিকে। সে হ্যান্ডেলে হাত রাখে। দরজা আপনা থেকেই খুলে যায়। ভিতরে ছোট একটা ঘর। ঘরটা যেন একটা মিউজিয়াম। আদতে লাইব্রেরি। দেয়ালে লম্বা তাকে সাজানো পুরনো বই। কিন্তু ধুলোর স্তর নেই। মানে কেউ বা কিছু এখানে নিয়মিত আসে। ঘরের মাঝখানে একটা টেবিলের ওপর ছড়িয়ে আছে কিছু কেসফাইল। মাথার কাছেই একখানা ভিডিও ক্যাসেট। আর মাঝখানে রাখা একটা ফ্রেম করা ছবি।
ছবিটা দেখতে
ইচ্ছে করছে না মৃদুলের। তবু যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে টেনে নিচ্ছে তার দিকে!
ছবিতে তিনজন মানুষ।
একজন মহিলা। হয়তো কোনো মা! তার পাশে একটা ছোট্ট মেয়ে। হাসি নেই। চোখে ভয়। পেছনে দাঁড়িয়ে আছে এক মুখোশধারী পুরুষ। মৃদুলের হঠাৎ গা ছমছম করে ওঠে। মেয়েটাকে সে চেনে। ও তো তার বোন! শতরূপা! ছবির নিচে লেখা - “৩ মে ১৯৯৩ - সর্বশেষ দিন।” তার শিরদাঁড়া বেয়ে এক যেন ঠান্ডা স্রোত নেমে আসে! আজই তো সেই দিন - যেদিন শতরূপা হারিয়ে গিয়েছিল!
মৃদুল পেছিয়ে
আসে। তার চোখ সরছে না মুখোশ থেকে। ধীরে ধীরে মুখোশধারী এগিয়ে আসে। তারপর সে থামে।
আঙুল তোলে নিজের মুখের দিকে। মুখোশটা খুলে ফেলে।
মৃদুল যেন কথা হারিয়ে ফেলে। এই মুখ তো চেনা ! এই মুখ তার বাবার!
৬
ঘরটা নিঃশব্দ। ঠান্ডা। মৃদুল দাঁড়িয়ে আছে। নড়ছে না। শুধু তাকিয়ে আছে সেই মুখটার দিকে। তার বাবার মুখ কী! চোখের দৃষ্টি স্থির। মৃদুল ফিসফিস করে - “বাবা?” মুখোশধারী কোনো উত্তর দেয় না। শুধু একধরনের অদ্ভুত যন্ত্রচালিত শব্দ হয় তার গলায় - “তুমি প্রস্তুত তো?”
মৃদুল না চাইতেও পা রাখে সিঁড়িতে।একসময় সে একটা বিশাল কাচঘেরা ঘরে পৌঁছে যায়। ঘরটার ভেতর একের পর এক বদ্ধ ঘর। প্রতিটা ঘরে একজন করে মানুষ। সবাই মুখোশ পরা। সবাই চুপ।মুখোশধারী মৃদুলের দিকে তাকিয়ে বলে - “ওরা সবাই ভুলে গেছে কে ছিল। তুমিও ভুলে যাবে। তোমার নাম, পেশা, পরিবার সব মুছে যাবে।” “কেন?” - মৃদুলের ঠোঁট কাঁপে। “কারণ তুমি জানো। আর জানলে মুখোশ পরতেই হয়।”
হঠাৎ একপাশের ঘর থেকে শব্দ হয়। এক নারী চিৎকার করে উঠেছে। আবার সেই পরিচিত গলা। শতরূপা! মৃদুল দৌড় দেয়। কাচে ধাক্কা দেয়। ভেতর থেকে ভেসে আসে কাঁপা গলায় বলা কিছু কথা - “দাদা, দাদা আমাকে মুক্ত করো।” হঠাৎ শব্দ থেমে যায়। আলো নিভে যায়। মুখোশধারী এবার খুব নিচু গলায় বলে- “এই ভয়ই মুখোশের উপহার। যত ভয় পাবে, ততই স্মৃতি মুছে যাবে।”
মৃদুল বসে পড়ে। আচমকা কাচের ঘরগুলোতে আলো জ্বলে ওঠে। প্রতিটি ঘরে মৃদুল! প্রতিটি মুখোশের নিচে মৃদুল! সে আর পারছে না। গলা দিয়ে একটা তীক্ষ্ণ আর্তনাদ বেরিয়ে আসে, "আমি কে?” কাচের বাক্স থেকে উঠে আসা ধোঁয়ার মধ্যে ভেসে উঠছে লাল হরফে লেখা কিছু শব্দ - "প্রকল্প : সেই রহস্যময় বাড়ি - প্রবেশ অনুমোদিত। বিষয় শনাক্তকরণ নম্বর : ক : ভ/বা। অবস্থা : মুছে ফেলা হয়েছে।" মৃদুল বহু কষ্টে উঠে দাঁড়ায়। চোখে শেষবারের মতো বিশ্বাসের অন্ধ আলো। সে চিৎকার করে - “আমি এখনো মানুষ। আমি কোনো ‘প্রোজেক্ট’ নই।” আর সেই মুহূর্তে পেছনে থাকা মুখোশধারী বলে - “তাহলে প্রমাণ করো। তোমাকে এখন ল্যাবরেটরিতে নিয়ে যাওয়া হবে।”
৭
নতুন সকাল। সূর্যের আলো ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকছে। একটা জানালার কাচে নীলাভ আলো পড়ে আছে। জানালার পাশে একটা খুব সাধারণ ঘর। ঘরে একটা খাট। একটা চাদর। একটা ছোট টেবিল। খাটে শুয়ে আছে মৃদুল। সে ধীরে ধীরে চোখ মেলে। চেতনা ঝাপসা। সে চারদিক দেখে। অচেনা লাগে।
মৃদুলের কিছু মনে পড়ে না। নিজের নামও না। কেবল একটা শব্দ ভাসে মাথার ভেতর - ওই যে, সেই বাড়িটা! সে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। জানালার বাইরে কুয়াশা। নীলাভ। ঘন কুয়াশার আড়ালে যেন লুকিয়ে আছে কেউ! অথবা কিছু!
ঠিক তখনই দরজায় শব্দ। একটা ছোট্ট মেয়ে দৌড়ে আসে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলে- “দাদা! এত ঘুমোচ্ছ? আমি তো কত ডেকেছি!” মৃদুল চমকে তাকায়। মেয়েটার মুখ চেনা লাগে। কিন্তু মনে পড়ে না। সে ধীরে জিজ্ঞেস করে - “তুমি কে?” মেয়েটি হেসে বলে - “আমি তোমার বোন! ভুলে গেলে নাকি? মা বলেছে তোমাকে বিরক্ত না করতে। তুমি এখন বিশ্রামে আছ।”
মৃদুলের শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। তার গা ঘামে ভিজে যায়। একদিন দুপুরে একটা পুরোনো বাক্স থেকে সে বের করে একটা ক্যাসেট। তাতে লেখা - “নির্যাতিত - ট্র্যাক ৯”। সে সেটি চালায়। ভেতর থেকে ভেসে আসে এক কিশোরীর কণ্ঠ - “আমাকে পরীক্ষা করা হচ্ছে। আমার শরীরে কোড আছে। আমার দাদা যেন কিছু না মনে রাখে। আমাকে ভুলে যাক। সে যেন মুক্ত থাকে।" মৃদুল হঠাৎ উঠে বসে। এই কণ্ঠ তো তার বোনের! কিন্তু সে তো প্রতিদিন স্কুলে যাচ্ছে! তাহলে? ঘরের আলো নিভে যায়। হঠাৎ দেয়ালে ভেসে ওঠে একটা প্রোজেকশন। লেখা - “নতুন প্রজেক্ট : মৃদুল-বিটা” তারপরই এক অদৃশ্য কণ্ঠস্বর - “তুমি মুক্ত নও, মৃদুল।তোমাকে আবার ফিরতে হবে। এখনো সেই বাড়িটা জেগে আছে।”
প্রাক্তন বিজ্ঞানী নীতা মৃদুলের হাতে একটা কাগজ দেন। তাতে লেখা - “তোমার সত্য জানতে হলে ফিরে যেতে হবে সেই চণ্ডীদাস অ্যাভিনিউয়ের বাড়িটাতে। ঘর ৫১’-এ। সেখানে সব স্মৃতি অপেক্ষায় আছে।” মৃদুলের মাথায় একটা প্রশ্ন ঘুরছে - “আমি কি মানুষ? নাকি এক পরীক্ষার ফসল?” রাতে আবার স্বপ্ন। এইবার সব স্পষ্ট। সে মুখোশ পরছে। তার সামনে দাঁড়িয়ে তার বাবা। বাবা বলছেন - “তুমি যদি সব মনে রাখো তাহলে তুমি বিপজ্জনক। তোমাকে ভুলে থাকতে হবে।” মৃদুলের ঘুম ভেঙে যায়। চোখে আগুন। সে এবার মনে রাখতে চায়। সে বোনকে খুঁজে পেতে চায়। সে ওই সেই অদ্ভুত বাড়িটার সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করতে চায়। সে খোঁজে নিজের পুরোনো খাতা। একটা নোট খুলে। ছোট ছোট হাতের লেখা - “আমি মৃদুল। আমার বোনকে বাঁচাতে হবে। স্মৃতি হারালে আমি কেউ নই। আমি মুখোশ ছিঁড়ব। আমি নিজের সত্য হব।”
তার চোখে আলো
পড়ে। সেই আলো ভোরের।
সে হাঁটতে শুরু করে। লক্ষ্য - চণ্ডীদাস অ্যাভিনিউয়ের সেই বাড়িটা - ঘর ৫১’। এইবার ভয় নেই। শুধু প্রতিশোধ। পথ অন্ধকার। তবু ভিতরে আলো জ্বলে।
৮
ঘন অন্ধকার। নিঃশব্দ রাত। মৃদুল হাঁটছে। ধীরে ধীরে। পায়ে পায়ে এগিয়ে সে একসময় সুড়ঙ্গের মুখে পৌঁছায়। একটা জংধরা দরজা। তাতে লেখা - “সেই বাড়িটা ঘর-৫১”। দরজার ধাক্কা দেয় সে। ধীরে ধীরে খুলে যায় দরজা। ভিতরে একটা লম্বা করিডর। নিভু নিভু আলো। দেয়ালে পুরোনো পোস্টার। একটার উপর লেখা - “মানুষ নয়, প্রজেক্ট!”
মৃদুল হাঁটতে
থাকে। চলতে চলতে দেয়ালের ছবি দেখে। একটা ছবিতে কিশোর বয়সের মৃদুল। পাশে নীতা সেন।
আর এক বিজ্ঞানী।
মুখ ঢাকা। একটু
পর একটা ঘরে ঢোকে সে।
ঘরটা ঠান্ডা।
নিস্তব্ধ। দেয়ালে একটা বোতাম।
সে চাপ দেয়।
চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়।
হঠাৎ ছায়ার মতো
ভেসে ওঠে প্রোজেকশন।
তাতে দেখা যাচ্ছে - একটা টেবিলে বাঁধা মৃদুল। তার শরীরে তারিখ লেখা হচ্ছে - ৩ মে ১৯৯৩। পাশে কাঁদছে তার বোন শতরূপা।
হঠাৎ পেছন থেকে আওয়াজ - “তুমি আবার ফিরে এসেছো?” মৃদুল ঘুরে তাকায়। এক বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে। চোখে ভারি চশমা। তিনি বলেন - “তুমি ভুলে যাওনি?” মৃদুল জবাব দেয় না। সে শুধু বলে - “আমার বোন কোথায়?” বৃদ্ধ হেসে ওঠে। “তোমার বোন তো এখন কোড। তুমি নিজেও তো কোড, মৃদুল। তুমি কি জানো তুমি কেবল শরীর নও। তুমি একটি অস্ত্র!”
মৃদুলের গলা শুকিয়ে যায়। সে পেছনের দেওয়াল ধরে দাঁড়ায়। “আমি মানুষ। আমার স্মৃতি আছে।” বৃদ্ধ এগিয়ে আসে। তার হাতে একটা সুঁচ। সে বলে - “তোমার সেই স্মৃতিই বিপদ। তুমি যদি সব মনে রাখো তাহলে তো বাড়িটা ধ্বংস হয়ে যাবে।” ঠিক তখনই কোথাও কাঁচ ভাঙার শব্দ। ঘরের পাশে গোপন দরজা খুলে যায়। ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে নীতা সেন। তার হাতে একটা ডিভাইস। তিনি বলেন - “তোমার সময় শেষ হয়নি, মৃদুল। চলো তোমাকে সব দেখাতে হবে।”
বৃদ্ধ পালিয়ে
যায়। মৃদুল নীতার সঙ্গে হাঁটতে শুরু করে। তারা চলে যায় ল্যাবের গোপন অংশে। সেখানে
দেখা যায় সারি সারি কাচের ঘর। তাতে ঘুমিয়ে আছে অনেক ছেলেমেয়ে।
সবাই কারও না
কারও মতো দেখতে। একটা ঘরে আছে ঠিক মৃদুলের মতো আরেকজন!
মৃদুল চমকে ওঠে।
৯
চারপাশে কালো
অন্ধকার। আলো নেই। দিগন্ত নেই। দিকভ্রান্ত এক কুয়াশাঘেরা নরক যেন!
মৃদুল দাঁড়িয়ে। নীতা তার পাশে। হাতের আলো ধরা। হালকা নীলচে রঙের। নীতা বলে - “এটাই ছায়াদের ঘর। মৃদুল কিছু বুঝতে পারে না। তার চোখ ছানাবড়া। গলার স্বর শুকিয়ে আসে - “মানে? কারা তারা?” নীতা বলেন - “তোমার বা আমার মতোও কেউ। জীবিত মানুষ যারা পরীক্ষায় ব্যর্থ। কিংবা সফল।”
কোনো শব্দ হয় না। শুধু একটা হাওয়ার আওয়াজ। তাও যেন মানুষের দীর্ঘশ্বাস। ধীরে ধীরে আলোর নিচে আসে কয়েকটি ছায়া। তারা মানুষ নয়। চেহারা নেই। তবু মুখের ভঙ্গি পরিষ্কার। কেউ কাঁদছে। কেউ হাসছে। কেউ ঠোঁট না নেড়ে গান গাইছে।
মৃদুল ঘেমে যায়। এক ছায়া এগিয়ে আসে তার দিকে। মৃদুল চিৎকার করে ওঠে - “তুমি কে?নীতা বলে - “ও তোমার বোন নয়। ও তার স্মৃতি। একটা টুকরো মাত্র। যা প্রজেক্টে ব্যাকআপ রাখা হয়েছিল।” মৃদুল চেঁচিয়ে ওঠে - “তবে আমার বোন কোথায়?” ছায়াগুলো ধীরে ধীরে ঘিরে ধরে তাকে। তার ঘাড়ের পেছনে নিঃশ্বাস ফেলে কেউ। একটা কণ্ঠ বলে - “বাঁচাতে পারলে না! তুমি কেবল একটা ভাঙা ক্যাসেট।” মৃদুল চিৎকার করে ওঠে - “চুপ করো! তোমরা আমার কেউ নও! তোমরা শুধু আমার ভয়!”
চারপাশ ঘন হয়ে
আসে। আলো কমে যায়।
মৃদুল চোখ বন্ধ করে ফেলে। তার বুক ধুকপুক করে। তখনই নীতা তার হাত ধরে। এক টান দেয়। সে বলে - “চলো, এখান থেকে যেতে হবে। তোমার মেমোরি এখনো বেঁচে আছে। ওদের ঘরে থাকলে তুমিও ওদের একজন হয়ে যাবে যে!”
দৌড় শুরু হয়।
ছায়ারা চিৎকার করে ওঠে।
“তুই ফিরবি! তোকে ফিরতেই হবে! এই ভুলে যাওয়া স্মৃতি থেকে মুক্তি নেই!” দেয়াল ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়।
১০
দেয়াল সরে গেলে সামনে ফসফরাসের মতো এক আলো। সবুজ। অদ্ভুত। চোখে তীব্র জ্বালা। নীতা এগিয়ে চলে। মৃদুল পিছনে। তার পা পাথরের মতো ভারী যেন! সিঁড়ি নেমে যায়। একটার পর একটা। আরও নিচে। আরও নিচে। কোথায় শেষ? কে জানে?
একসময় ঘর ফুরোয়। একটা গম্বুজ। মাঝখানে দাঁড়িয়ে একটা চেয়ার। মাথার উপর ঝুলে আছে তার মতোই একটা মুখ। হুবহু! চোখ বন্ধ। চুল এলোমেলো। মৃদুল চেঁচিয়ে ওঠে - “ও কে? এটা আমার মুখ! এটা আমি?” নীতা বলে - “না, এটা তোর ‘প্রাথমিক স্মৃতি-সংরক্ষক’। মৃদুল কাঁপতে থাকে। একটা স্ক্রিন জ্বলে ওঠে। লেখা আসে - "স্মৃতি পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া : সক্রিয়। স্বাগতম ফিরে আসার জন্য, মৃদুল।"
স্ক্রিনে ভেসে
ওঠে তার বোনের হাসি। তার মায়ের চিৎকার। চারপাশে হুলুস্থুল। শব্দ থেমে যায় এক
মুহূর্তে। শুধু কানের ভেতর ঘূর্ণির মতো বাজে একটা ডাক -"বাঁচাও"! সেই
মুহূর্ত যেন! যেদিন সে ছাদে দাঁড়িয়েছিল! ঝাঁপ দিতে চেয়েছিল! সব দেখা যাচ্ছে। সব।
আশ্চর্য, এত নিখুঁত! যেন
কেউ ক্যামেরা বসিয়ে রেখেছিল মস্তিষ্কের ভেতরে! মৃদুল পেছনে তাকায়। চারপাশ শুনশান।
শুধু শীতল একটা গন্ধ। যেন কেউ সার্জারি করছে আশেপাশে। স্ক্রিনে আবার লেখা -
"পরিচয়-সংঘাত সনাক্ত।
তুমি নকল।"
চোখ খুলতেই সে
নিজেকে দেখে। একটা সাদা ঘরে। আয়নায় মুখ দেখে আঁতকে ওঠে। ওটা তার মুখ নয়। তবু চোখের
পেছনে যেন একটা স্মৃতি ঘুরছে! একটা মেয়ে বলেছিল - “তুমি ফিরবে...” ঘরের বাইরে লেখা
- “প্রকল্প ‘সেই অদ্ভুত বাড়ি’ : বিষয় ০১১ – পুনর্জাগরণ সফল।” “অবস্থা : স্মৃতি
সিলমোহরবদ্ধ। সত্তা পুনর্গঠিত।” একটা সাদা পোশাকের মহিলা এসে বলেন - “শুভ সকাল
মৃদুল। আপনি এখন নিরাপদ।” মৃদুল কিছু বলতে চায় কিন্তু ঠোঁট সিল করা। চোয়াল মুখোশে
আঁটা। কপালে এক নীল আলো টিমটিম করে জ্বলছে। আর সেই অদ্ভুত ঘরটি নিঃস্তব্ধ!
No comments:
Post a Comment