![]() |
ছবি : ইন্টারনেট |
মনে পড়ে রুবি রায়
তপন তরফদার
মনে পড়ে রুবি রায় – আমাকে সারা জীবনই তাড়া করে আসছে। হাঁ, আমার নাম কাকতলীয় হয়ে মিলে গেছে ওই রুবি রায়ের সঙ্গে। মানুষেরই মন আছে। মানুষের মনই নিয়ন্ত্রণ করে তার চিন্তা ভাবনা, চলা ফেরা, কাজ কর্ম সব সবকিছুই। সদ্য আমার এক মাত্র মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। মনটা ভারী হয়ে আছে। বাড়ির ছাদে পায়চারি করছি, আমি রুবি রায়। বাতাসে বসন্তের হাওয়া বইছে। এখন বসন্ত কাল নয় তাও ঝিড়িঝিড়ি বাতাস বইছে। শিউলি ফুলের সুগন্ধ মনকে উদাস করে দিচ্ছে। রাত এগারোটা বাজে, চাঁদের আলোয় স্নান করতে করতে ছাদে পায়চারি করছি। অনেক স্মৃতি মনের মধ্যে উঁকি দিচ্ছে। রুবি রায়ের দুঃখী মনের খোঁজ কেউই রাখেনা ।
এখন এই অবসর জীবনে মনে পড়ে রুবি রায়ের ফেলে আসা জীবনের ঘটনা। জাবর কাটতে ভালোই লাগে। জীবনে কি পেলাম কি পেলাম না তার সালতামামি করতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছা করে একটা আত্মজীবনী লিখি। আচ্ছা, আত্মজীবনী লিখলে সব সত্যিই লিখতে হয়, না জল মেশাতে হয়।
আমি রুবি রায়, যতদূর মনে পড়ে অঢেল না থাকলেও মোটামুটি সুখ-শান্তিতে শৈশব কাটিয়েছি। স্কুল জীবনের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে ঢুকে ছিলাম।। আমার স্কুলটা বাড়ির পাশেই ছিল। বাস থেকে নামার কোনো গল্প ছিলনা। কলেজটা একটু দুরে। কলেজ এক মুক্ত পৃথিবী। নতুন নতুন বন্ধুত্ব কয়েক দিনের মধ্যেই মন জয় করে নিল আমাদের। মনে হলো, কত জন্মের একাত্মতা আমাদের।
গায়ের রং বেশ ফর্সা। লম্বা, চওড়া , সুঠাম , সুদর্শন। কিছু পুরুষের এক চৌম্বক শক্তি থাকে যা মেয়েদের কে টেনে নিয়ে যায়। যা কবি কালিদাস ও তার ভাষায় প্রকাশ করতে পারেন নি। আমি না চাইলেও সুমিতদার সঙ্গে কথা বললে, চোখে চোখ রাখলে হৃদয়ে কি একটা যন্ত্র বাজতে থাকে, যা আমাকে যন্ত্রণা দেয়। আমার জীবনে ঝড় তুলে এক ঝলক সমুদ্রের ঝোড়ো টাটকা বাতাসের মতো লাগল সুমিতদাকে। প্রথম দর্শনেই ওই পুরুষের প্রেমে পড়ে গেলাম আমি, রুবি রায়। কিন্তু বোকা মেয়েদের মতো (তখন মোবাইল ফোনের রমরমা ছিলোনা।) ওকে ইশারা করে বা চিঠি দিয়ে, তুমিই আমার সব, এমনকি মদন দেবতাও বলে হ্যাংলামি প্রকাশ করলাম না। আটঘাট না বেঁধে কিছুতেই এগোবোনা। এমন পরিস্থিতি তৈরী করতে হবে, সুমিতদা যেন আমায় প্রত্যাখ্যান না করে ।
অনেক মেয়েই আমার মাথা ভর্তি কোঁকড়ানো চুল, বিখ্যাত নায়িকার মত আমার ফিগার দেখে ঈর্ষা করে। গায়ের রংটা হলুদের মত ফর্সা নয়, তবে একটা পেলবতা আছে, চোখে মাদকতা আছে এই রুবি রায়ের । শুনেছি অনেক প্রখ্যাত নায়িকাদের গায়ের রং ও ফর্সা নয়। আমিও খুব একটা ফেলনা নয়। কিছু পুরুষ তো পিছনে ঘুরঘুর করেই। সব মেয়েদেরই একটা জন্মগত জিন থাকার জন্য মেয়েরা বুঝতে পারে, কোন পাখি জালে ধরা পড়েছে। আমি বুঝলাম এবার চিড়িয়াকে পোষ মানান যাবে। সুমিত নিজেই বললো, “রুবি, আমাকে শুধু সুমিত বলে ডাকতে অসুবিধা হবে।“
আমি হৃদয় উজার করে ভালবাসলাম। ঈশ্বরের কাছে প্রত্যেক মেয়েই যা চায় তাই চাইলাম। স্বামী- সন্তান নিয়ে যেন আমরা দুধে-ভাতে বেঁচে থাকি। আমার ওই ন্যকা ন্যকা মেয়েদের মতো বিরাট কোনো চাহিদা নেই। ওদের চাহিদার শেষ নেই। অযৌক্তিক চাহিদাই সংসার কে সাগরে ডোবায় । সুমিতের সঙ্গে আমার মনের মিল প্রায় একশো শতাংশ। স্বপনে সুমিতের সঙ্গে একটা সাজানো সংসার গড়েই তুলেছি। সুমিতের একটা চাকরি হলেই আমাদের স্বপ্ন সার্থক হবে। মনে হলো ভাগ্যে শিকে ছিঁড়লো। কগনিজেন্ট কনসার্ন থেকে চাকরির চিঠি পেয়েছে।
আমার ও সুমিতের এই ভালোবাসার বিষয়টি দুই বাড়ির কেউ জানেনা। আমাদের বাড়ি কলকাতার অন্যতম বনেদি পরিবার। সুমিতরা বাংলাদেশ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে এখানে এসেছিল। বিভিন্ন মানুষের দানে, সহযোগিতায় ঘুরে দাঁড়িয়েছে। লেখাপড়া শেষ করতে পেরেছে।
স্বপ্নেরা সত্যিই ক্ষণস্থায়ী! আমার জীবন দিয়ে আমি বুঝেছি। আমার বাড়ি থেকে পাত্র খোঁজা হচ্ছে। আমি আর সুমিত ঠিক করেছি চাকরিতে ও যোগ দিলেই মাসখানেকের মধ্যে বাড়িতে জানাব, দুজনে বিয়ে করবে। আমি জানি সহজে আমার বাড়ি রাজি হবেনা এই বিয়েতে। যে পরিবারের কোনো ইতিহাস নেই, সম্পত্তি নেই,, পরিচিতি নেই সেখানে আমার বিয়ে দেবেনা। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করবো সন্মতির জন্য। যদি একান্তই না দেয় আমরা ওই “ পূর্ণিমা রাতে চ পলায়ে” যাব।
আমরা দুজনেই আনন্দে পরিপূর্ণ। বন্ধুর বিয়েতে দুদিন ওদের বাড়িতে থাকব বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সুমিতের সঙ্গে দীঘায় চলে আসলাম। আনন্দ আর আনন্দ। সমুদ্রের জলের ঢেউ এ ভাসলাম, বিছানায় ও সুমিতের সঙ্গে সাগরের ঢেউ তুললাম। প্রথমে আমি একটু ইতস্ততঃ করেছিলাম, সুমিতের যুক্তির কাছে আমি হার মেনে নিজেকে বিলিয়ে দিলাম। ক্ষতি কি, আগামী এক মাসের মধ্যেই বিয়ে করবো আমরা।
দীঘা থেকে ফিরেই পরের দিন বর্ধমানের নাদন ঘাটে এক হিতৈষীর মেয়ের বিয়েতে সুমিতদের সপরিবারে যেতে হবেই। সুমিতদের ওই দুঃসময়ে সাহায্য করে বাঁচিয়ে রেখে ছিলেন তুষার ঘোষ। তার মেয়ে তৃপ্তির বিয়ে। এই তুষার ঘোষের বাড়িতে শরণার্থী হয়ে আসার সময় এখানেই এক মাষ্টারের কথায় ঠাঁই পেয়েছিল। অনেক অনেক সাহায্য করেছেন এই তুষার ঘোষ। তাঁর মেয়ের বিয়েতে কোমর বেঁধে খেটেখুটে উৎরে দিতে হবে।
তুষারবাবুর পরিবার ওদেরকে পরিবারের লোক বলেই গণ্য করে। সুমিত, সুমিতের বাবা মাও ঘনিষ্ঠ আত্মীয়র মতো হাসতে হাসতে বিয়ে বাড়িতে হাত মিলিয়ে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করে চলছেন। গোধূলি লগ্নে বিয়ে। ইচ্ছে করেই গোধূলি লগ্নে বিয়ের ঠিক করা হয়েছে। বিয়েটা তাড়াতাড়ি সেরে ফেললে অনেক অনেক সুরাহা হয়। অথিতি, অভ্যাগাতদের আপ্যায়ন করার সুবিধা হয়। সময় পাওয়া যায়। পাত্র ভগোবানগোলা থেকে আসছে। বরযাত্রীরা বাসে আসছে। পাত্র রাজ্যসরকারি কর্মী। সরকারি কনট্রাকটর বিলাসবহুল গাড়ি দিয়েছে। মোবাইলে খবর এলো, বাড়ি থেকে সুন্দর-সুন্দর ফুলদিয়ে সাজানো গাড়িতে চেপে এইমাত্র বর বেরিয়ে গেল বিয়ে করতে।
এখনো আধঘন্টা বাকি। বরযাত্রীদের বাস থেকে ফোন আসলো, আমাদের আগে আগেই বরের গাড়ি চলছিল। জলঙ্গী সেতু পার হওয়ার সময় দ্রতগামী এক লরিকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যেতে গিয়ে সেতুর সিমেন্টর রেলিং ভেঙ্গে মাঝনদীতে পরে গেছে বরের গাড়ি । মৃর্হতে বিয়ে বাড়ি শোক বাড়িতে পরিণত হলো। তৃপ্তির মা আঘাত সহ্য না করতে পেরে অজ্ঞান হয়ে গেল। তুষারবাবু মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছে। পুলিশের টিম ঘোষণা করে দিয়েছে দমবন্ধ হয়ে সব যাত্রীরা মারা যাবেই। কলকাতা থেকে উদ্ধারকারী দল এসে গাড়িটা উদ্ধার করার চেষ্টা করবে। তুষারবাবুর দাদা কিশোরবাবু তুষারকে বলে এভাবে ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। তোকে শক্ত হতে হবে। মেয়েটা যাতে লগ্নভ্রষ্টা না হয় সেটা দেখতে হবে। কিছু ব্যবস্থা করতেই হবে। যত বয়স্ক গুরুজনরা এসেছে সবাই এক মত মেয়েকে লগ্নভ্রষ্টা করা যাবেনা। তুষারবাবু সুমিতের বাবার দুহাত ধরে বলে, আমার এই বিপদ থেকে তুমিই উদ্ধার করতে পারো। সুমিতের বাবা ব্যপারটা না বুঝেই বলে, তোমার নুন খেয়েছি, তুমিই আমাদের ভাত জুগিয়েছো। তোমার বিপদ মানে আমার বিপদ বলো কোথায় যেতে হবে। কি করতে হবে। তুষারবাবু বলে, আমাকে বাঁচতে পারো তোমরাই। তোমার সুমিতের সঙ্গে আমার মেয়ে তৃপ্তির বিয়ে দিয়ে। সুমিতের মা বলে, ঠাকুরপো তোমার মেয়েতো আমাদের ও মেয়ে। ওর ক্ষতি হতে দেবনা। আমার ছেলেই বিয়ে করবে। এক নিমেষেই কত কি ঘটে গেলো। ঘটনাটা সুমিতের নিয়ন্ত্রণে থাকলোনা। কলের পুতুলের মতো বিয়ে করতেই হলো। প্রতিবাদ করার সুযোগই পেলনা সুমিত।
আকাশ থেকে বজ্রপাত হলোনা। খবরটাই বজ্রপাতের মতো আমার মাথায় পড়লো। ওদিকে আমার সিক্সথ সেন্স বলছে, দীঘার হোটেলের ঘটনাগুলোয় কোন অঘটন ঘটিয়ে ফেলেছি। যা সন্দেহ করে ছিলাম,ইউরিন টেস্ট করে বুঝলাম তাই ঘটে গেছে। নিজকে বাঁচানোর একমাত্র উপায় তাড়াতাড়ি বিয়ে করে কোন ছাতার তলায় আশ্রয় নেওয়া। বাবাকেই বললাম “আমি বিয়ে করতে রাজী।“ বাবা বললো ঠিক সময়ে বলেছিস। এই মাসেই বিয়ে করতে হবে। ঘোষ বাড়ির সুশান্তর সঙ্গে। ওদের তোকে পছন্দ। সুশান্তর দাদুর লিভারের ক্যান্সার ধরা পড়েছে। মরার আগে নাত বৌ দেখে যেতে চায়। পাত্রটি ও বেশ ভালো। শিক্ষিত। দেখতে মোটামুটি ভালোই। এক কালের বনেদি পরিবারের ছেলে। সুশান্ত এখন সরকারি চাকুরে। অতএব বাড়ির কারোর অপছন্দ হওয়ার কোনো কারণ ছিল না।
(২)
বিয়ে হয়ে গেল আমার ধুমধাম করেই সুশান্তর সাথে। সুখের সংসার আমার। লক্ষ্মী উপচে পড়ছে।কোন কিছুর অভাব নেই। আমার বাপের বাড়ির লোকজন আমার স্বামীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এরকম স্বামী নাকি আমি সাতজন্মের তপস্যা করে পেয়েছি। আমি ও নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করে সুখী হতে চাইলাম। সবকিছু ভুলে আমি সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাই। পিছনের দিকে তাকিয়ে খামোকা দুঃখদায়ক স্মৃতির জাবর কেটে লাভ নেই।
সেই খবরটি আর চাপা থাকলোনা। আমি 'মা' হতে চলেছি। পরিবারের কেউ কোনো সন্দেহ করলোনা। সবাই খুশি। বিধাতাকে শতকোটি প্রণাম জানালাম আমাকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য। সুখবর। শ্বশুর - শাশুড়ি এমনকি ওর সেই দাদুও নতুন অথিতির র আগমনের জন্য আলোর জোয়ারে ভাসতে লাগল। নতুন অথিতিকে বরণ করার প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল। বিশ্বের যিনি নিয়ন্ত্রক, তিনি এক অন্য পথের দিকে ঠেলে দিলেন। স্নানঘরে পা পিছলে পড়ে গেলাম। রক্ত ক্ষরণ শুরু হল। এবার হৃদয়ে নয়। শরীরের অভ্যন্তরে। হারিয়ে ফেললাম আমার অজানা অদেখা প্রাণভোমরাকে।
(৩)
মানুষ কত স্বার্থপর। যে আসছিল তার প্রকৃত পরিচয় জানতো না বলেই আমাকে মাথায় তুলে আদর করতো। যদি আসল ঘটনাটা জানতে পেরে যেত আমার কি অবস্থা হতো ভাবলেই গায়ে কাঁটা ফুটে যায়। আমি অতটা ভেঙে পড়েনি। একদিকে ভালোই হয়েছে। সারা জীবন ওই কাঁটা গলায় বিঁধে থাকতো। মানসিক যন্ত্রণা কাটা ঘায়ের থেকেও বেশি যন্ত্রণা দায়ক।
পৃথিবী ঘুরেই যায়, সময়ও বয়ে যায়। আড়াই বছর পেরিয়ে গেল, আমি কোনো সুখবর দিতে পারলাম না। শাশুড়ি অনেক মন্দিরে, সাধুবাবা, গুনিনদের কাছে নিয়ে গেলেন, অনেক টোটকা খাওয়ালেন। কোনো ফল ফললোনা। ফলে শশুর বাড়ীর সকলের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হলাম। কিছুদিনের মধ্যেই আমার কপালে সিঁদুরের টিপের বদলে অপয়া মেয়েছেলের ছাপ পড়ে গেল। স্বামী প্রেমের কথা তো দুরঅস্তু, ভালো করে কথাই বলে না আমার সাথে। । ঘরের কোণে বসেই সময় কাটে। তিরস্কার আর শুধুই তিরস্কার। রান্নাঘরেও এই অপয়ার ঢোকা বারণ। আমি যে ব্রাত্য! সন্তানের জন্ম দিতে পারিনি। আমি ডাইনি । স্বামী কোনো প্রতিবাদ করেনা। শাশুড়ির চূড়ান্ত অপমানজনক কথা শুনেও স্বামী অসম্ভব রকমের নিশ্চুপ ।
আমি বাড়িতে ওদের চোখের সামনে থাকলেই ওদের গাত্রদাহ হয়। আমি ও কিছুটা শান্তির খোঁজে এটা ওটা কেনার নাম করে সারা দুপুরটা, কিছু কিছু সময়ে বিকাল টাও বাড়ির বাইরে কাটিয়ে ঘরে ফিরতে লাগলাম।
ভগবান যখন যাকে দেন “ছপ্পর ফুঁড়ে”দেন। বিবেকানন্দ মেট্র স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের উপর দাঁড়িয়ে সুমিত। এইমাত্র ট্রেন গেছে, পনেরো মিনিটের আগে আর ট্রেন আসছেনা। আমি একরকম দৌড়ে গিয়ে সুমিতকে পাকড়াও করলাম। সুমিত প্রাথমিক বিহ্বলতা কাটিয়ে মিনিট তিনেকের মধ্য ধাতস্থ হয়ে আগের মতোই কথা-বার্তা শুরু করে দিল। সুমিতই বললো চলো স্টেশন থেকে বেরিয়ে গিয়ে রেষ্টুরেন্ট থেকে গলা ভিজিয়ে আসি।
হাজার হোক আমাদের প্রেমেতে কোন খাদ ছিলোনা। এটা আমি বুঝতে পারি সুমিতের কোনো দোষ নেই। সেই মূহুর্তে বিদ্রোহ করার ও সুযোগ ছিলনা। সুমিত ও চায় আমার সঙ্গে যত কম সময় কাটাতে পারে ততই ভালো লাগে বা ভালো থাকে।
সুমিতের পোষ্টিং কলকাতাতেই। দুজনেই সল্টলেকের এক গেষ্ট হাউসের কেয়ারটেকারকে টাকা দিয়ে দুপুর বেলাতেই মিলিত হতে লাগল। আমি সুমিতকে সেই ঘটনার কথা বলিনি। হাজার হোক সুমিত এখন অন্য জনের স্বামী। আবার আমি মা হতে চললাম।
বাড়িতে খবরটা অতি দক্ষতার সঙ্গে ছড়িয়ে দিলাম যাতে কারো মনে কোনো সন্দেহ উঁকিঝুঁকি না মারে।
শ্বশুর শাশুড়ির মনে আনন্দের জোয়ার। আমি হৃত সন্মান ফিরে পেলাম।
সুশান্ত কিন্তু অদ্ভুত ভাবে বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে গেল। ঠাণ্ডা মানুষ যখন রেগে যায় ভয়ংকর হয়ে যায়। রাতে বিছানায় শুয়ে হুংকার ছেড়ে বলে, কি করে হলো। আমি তো কোনো দিন...। ওর কথা শেষ করার আগেই আমি মাথা ঝাঁকিয়ে বলি খেয়াল আছে কি দুমাস আগে নেশায় বুঁদ হয়ে তোমার হুঁশ কোথায় ছিল। সুশান্তর মুখে কেউ যেন থাপ্পর মেরে দিল। একথা সত্যি, ইদানীং সুমিত নেশা করতে শুরু করেছে।
এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। সেদিন ও রাত করে বাড়ি ফিরেছে। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি জেগে রয়েছি সদর দরজার খিল না খুলে দিলে বাড়িতে ঢুকতে পারবেনা। রাত এগারোটা বেজে গেছে। টিভির সিরিয়ালটা সাড়ে এগারোটায় শেষ হবে। কলিংবেলের আওয়াজ শুনে, সদর দরজার খিলটা খুলতে গেলাম। হ্যাঁ সুশান্তই। পা টা টলছে। তবুও সিধে শোবার ঘরে ঢুকে দরজার খিল তুলে দিয়ে পকেট থেকে একটা খাম বিছানায় ছুঁড়ে দিয়ে বলে, পড়ে দেখ বেশ্যা মাগী। খামের উপর পার্কস্ট্রিটের বিখ্যাত ল্যাবরটারীর নাম লেখা, রিপোর্টে লেখা “স্পার্ম কাউন্ট টু লো ফর রিপ্রোডাকসান।“ আমাদের বাচ্চা হচ্ছেনা বলে তোমাকে গঞ্জনা শুনতে হচ্ছিল। আমার কেন জানিনা মনে হচ্ছিল, আমার কোন দোষ নেইতো। তখনই পরীক্ষা করে দেখেছিলেম আমার বাবা হওয়ার কোন ক্ষমতা নেই। আবার টেস্ট করালাম সত্যিটা কি জানতে। ছি, ছি তুমি যা করেছো তা মানুষ সমাজের যোগ্য নয়। আমি বোঝাতে পারলাম না, তোমাদের বংশ বাঁচতে, নিজকে বাঁচাতে এ ছাড়া অন্য পথ খোলা ছিল না।মহাভারতই আমার অনুপ্ররেণা।
আমি বোঝাতে পারলাম না, তোমাদের বংশ বাঁচতে, নিজকে বাঁচাতে এ ছাড়া অন্য পথ খোলা ছিল না।
সুশান্ত বিষয়টি থেকে মুক্ত হতে পারলোনা। নিজের পৌরুষ কে হারিয়েছে এককালের বনেদী বাড়ির ছেলে। যে বংশের ছেলেরা গন্ডা গন্ডা বাঈজী পুষতো। কেমন মনমরা হয়ে গেল। বাড়ির লোকজন ওর দিকে নজর দিলনা। সব নজর আমার দিকে। বংশধর আসছে তাতেই সব মশগুল। একদিন খবর আসলো সুশান্তর মটরসাইকেল ডানলপ ব্রীজে এক আটচাকার লরির নিচে ঢুকে পড়ায় মৃত্যু হয়েছে। আমি কিন্তু বুঝতে পেরেছি ও আত্মগ্লানিতেই আত্মহত্যা করেছে।
মানবিক কারণে আমাকে ওর অফিসেই আমাকে চাকরি দেওয়া হয়। আমার ছেলে হয়নি। আমার কন্যা সন্তান আমার কোল আলো করলেও পরিবারের অন্যান্যরা খুশি নয়। ঠিক সাতদিন আগে আমার সেই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। সবই ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।
প্রথমেই বলা উচিত ছিল আমার নাম কৃষ্ণা। আপনারা বলবেন, এই মাতাল করা জোৎস্নার আলোতে কৃষ্ণা নাম খন্ডন করতে। না তা নয়, অনেকেই জানেনা কৃষ্ণার অপর নাম দৌপ্রদী।
...(সমাপ্ত)...
No comments:
Post a Comment