![]() |
ছবি : ইন্টারনেট |
দৃশ্যান্তর
জনা বন্দ্যোপাধ্যায়
"গল্পটা তো ছোট
নয় যে দু এক কথায় তোকে বলব! একদিন বসে আলোচনা করব, যদি তোর রোলটা পছন্দ হয় তুই করবি!"
অনিকেতকে ফোনে
কথাগুলো বলেন মিতালী।
ইদানীং' দর্পণ' নামক নাটকের গ্রুপে স্ক্রিপ্ট লিখে ও পরিচালনা করে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন তরুণ
প্রতিভা মিতালী বোস। স্কুলের চাকরি ছেড়ে নাটকের জগতে এসে প্রতিকূলতাগুলো বুঝেছেন!
মিতালীর বয়স বত্রিশ ছাড়িয়েছে, বাড়িতে বিধবা মা
মেয়ের বিয়ের জন্য ব্যস্ত। মিতালীর সেসবে ভ্রুক্ষেপ নেই। কুর্তি জিন্স পরে
সিগারেট হাতে ছুটে বেড়াচ্ছে এ কথাই পাড়ার লোকে বলে!
কোয়েড স্কুলের ছোটবেলার বন্ধু
অনিকেতকে ফেসবুকে খুঁজে পেয়েছেন মিতালী। অনিকেতকে তাঁর পরের নাটকের একটি রোলে
নিতে চান। অনিকেতের চেহারাটা বেশ বলিষ্ঠ, নায়কের দাদার চরিত্রে মানাবে!
একদিন রবিবার দেখে অনিকেত মিতালীর বাড়ি
এলে মিতালী অনুরোধ করেন,
"আজ কিন্তু তোকে
দুপুরে খেয়ে যেতে হবে।"
অনিকেত রাজী হন।
মিতালীর চুলগুলো ছোট করে কাটা। মুখে একটু রুক্ষ ভাব। কিন্তু সেই স্কুল লাইফের মতো
আজও বেশ স্পষ্ট বক্তা। যা ভালো লাগে না, মুখের ওপর বলতে দ্বিধা করেন না। চিরাচরিত গতানুগতিক মেয়েদের অনিকেতের ভালো
লাগে না। মিতালী ব্যতিক্রমী বলেই হয়তো একটা ভালো লাগা তৈরী হয়েছে। মিতালীর
মায়ের অনিকেতকে বেশ পছন্দ হয়েছে। খোলামেলা হাসি, বেশ মিশুকে স্বভাব অনিকেতের। মিতালীর মুখে
দুপুরের খাওয়ার কথা শুনেই রান্না ঘরে গিয়ে হাজির হন অনিকেত!
"কাকিমা আজ কী
স্পেশাল মেনু বলুন। অনেক দিন পর জমিয়ে খাবো।"
মিতালী চা আর
মিষ্টির প্লেট সাজিয়ে দেন। খেতে খেতে নাটকের গল্পটা শোনায় অনিকেতকে। নাটকের
গল্পটা এক শিল্পীর লড়াই- এর। একজন পেইন্টার কী ভাবে বার বার নিজের যোগ্য কাজ ও
সম্মান থেকে বঞ্চিত হয়েও হাল ছাড়েনি -- এরকম একটা গল্প শুনে অনিকেত প্রশংসার
সুরে বলে, "শোন মিতালী,
তুইও আসলে শিল্পী,
তাই লড়াইটা বুঝিস।
কিন্তু আমি কাগজের রিপোর্টার। অভিনয় আমার দ্বারা হবে না! তোর সঙ্গে কিছুক্ষণ সময়
কাটাবো বলে এসেছিলাম। ভেবেছিলাম তোকে প্রোপোজ করব। কিন্তু না, তুই তোর জগত নিয়ে সিরিয়াস, তাই লেভেল ম্যাচ করল না!"
অনিকেতের এরকম
স্পষ্ট স্বীকারোক্তি মিতালীকে মুগ্ধ করে। এই মুগ্ধতা থেকে যায়!
মিতালীর বাড়িটা পুরোনো দিনের একতলা,
তাঁর বাবার বানানো। সামনে
ছোট ফুলের বাগান, এতটাই মায়া
জড়ানো যে মিতালী বিগত দশ বছর এই বাড়িতেই থেকে গেছেন। ফ্ল্যাট কেনার কথা অনেকেই
বলেছে, কানে তোলেননি। হঠাত হার্ট
অ্যাটাকে মিতালীর মায়ের মৃত্যু হলে বাড়িটা ফাঁকা হয়ে যায়। মিতালীর নাটকের দল
বিভিন্ন জেলায় শো করে, ব্যস্ততায় কেটে
যায়।
এর মধ্যে অনিকেতের বিয়ের খবর পেয়েছিলেন
মিতালী। প্রায় পঞ্চাশে বিয়ে করেন অনিকেত। কিন্তু মিতালী নিজের দল নিয়ে তখন
কলকাতার বাইরে।
বিয়ের এক বছরের মাথায় অনিকেত খুন হন।
একটা রেপ কেসের স্টোরি কভার করতে গিয়ে আসল তথ্য জানতে পারায় খুন হতে হয়। অনিকেত
মিতালীকে লড়াকু বলেছিলেন, কিন্তু তাঁর
লড়াইটাও কোনো অংশে কম ছিল না!
বাঁকুড়া শহরে নাটক করতে গিয়ে টেরাকোটা
মন্দিরের গ্রাম পাত্রসায়র যান মিতালী। নতুন নতুন জায়গা ঘোরার শখ ছাড়তে পারেন
না! গ্রামের ঘোষবাড়ির সংলগ্ন তিনটি পুরোনো মন্দির দেখেন। সেখানে পৌরাণিক ও সপ্তদশ
শতকের সামাজিক চিত্রের মেলবন্ধনে বিভিন্ন স্থাপত্যগুলো অনবদ্য! প্রাচীন মন্দিরের
প্রেক্ষাপটে একটি নাটকের কাহিনী ভাবতে ভাবতে ডুবে যান মিতালী। নাটকের দুনিয়ায়
প্রতিযোগিতা অনেক। তাই কিছু অভিনব ধারণা নিয়ে কাজ করতে চান তিনি। কলকাতা
নাট্যএকাডেমীর জনৈক কর্ণধার অলোক দের সঙ্গে আবহ সঙ্গীত নিয়ে কিছুটা তর্কবিতর্ক
হয়েছিল মিতালীর। কোনো মূল্যেই মিতালী নিজের মত পরিবর্তন করেননি। মিতালীর মতে
পৌরাণিক কোনো দৃশ্যে আধুনিক আবহের সংমিশ্রণ পরিবেশিত হলে খারাপ লাগে না! কিন্তু
অলোক দে এ কথা মানতে রাজী নন। মিতালীর দু তিনটে নাটকে কলকাতার বেশ কিছু
প্রেক্ষাগৃহে কম ভিড় হওয়ার পেছনে তথাগত সেনের হাত ছিল। তথাগত মিতালীর নাটকের
স্ক্রিপ্ট লেখার সুযোগ না পেয়ে অন্যান্য অভিনেতাদের মিতালীর বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ
করার চেষ্টা করেছিলেন। পরে দল থেকে বেরিয়ে গিয়ে নিজের দল তৈরী করেন। দক্ষতায়
তথাগত মিতালীর ধারের কাছে নন জেনেও অলোক দে তাঁকে সাহায্য করেন। মিতালী বোঝেন
নাটকের জগতে তাঁর প্রতিযোগী ও শত্রুর অভাব নেই! তবু এক অদম্য জেদ তাঁকে চালিত করে!
পাত্রসায়র গ্রামে একটি বছর কুড়ির
ছেলের সঙ্গে পরিচয় হয় মিতালীর। সরল চেহারা, মাধ্যমিক পাশ। ছেলেটির নাম শাক্য। নিজে হাতে
দোতারা বানিয়ে বাজাবার শখ তার। বাপ মা মরা মামার বাড়িতে মানুষ শাক্যর গুণ দেখে
তাকে কলকাতা নিয়ে আসেন মিতালী। ছেলে হিসাবে দত্তক নেন। মানুষজন নানান কথা বললেও
মিতালী গ্রাহ্য করেন না! শাক্য তার নতুন মায়ের খেয়াল রাখে। শাক্যর বাজনা মিতালীর
নাটকে নতুন মাত্রা এনেছে। একদিন শাক্য হঠাত করেই বাইক চালাতে গিয়ে বাসের সঙ্গে
ধাক্কা খায়। শাক্যকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে দেখে মিতালী নিজেকে ঠিক রাখতে পারেন
না! এই প্রথম মিতালীর মনে হয় লড়াইতে হেরে যাচ্ছেন!
প্রায় দুমাস মিতালী নাটকের মহড়ায়
যাননি। সহকারী পরিচালক মহুয়া সব দিক সামলাচ্ছেন।
নববর্ষের দিন তাঁদের নতুন নাটক কলকাতার একাডেমীতে। সেদিন সকাল থেকে মিতালী
প্রিন্সেপ ঘাটে এসে বসে আছেন। ভীষণ অন্যমনস্ক! বাইরে বেশ চড়া রোদ। মিতালীর মুখে
বিন্দু বিন্দু ঘাম! বার বার নাটকের দলের লোকজন ফোন করছে। কিন্তু মিতালী মোবাইল
ধরছেন না, শুধু জলের দিকে
তাকিয়ে আছেন! নিজের মা, অনিকেত, শাক্য সবাইকে একে একে মনে পড়ছে। এই প্রথম তিনি
ভাবেন নিজের জীবনের কথা লেখা হয়নি! এক সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত জীবনের
ঘূর্ণাবর্ত, অনন্ত লড়াই
মানুষকে ক্লান্তির পাড়ে পোঁছে দেয়! অবসন্ন প্রহরগুলো কাটানো কঠিন! মিতালী চোখ
দুটো বুজে বলেন," এবার শুধু নিজের
কথা লিখব!"
ছেঁড়া শাড়ি,
অবিন্যস্ত চুল নিয়ে এক
পাগলি মেয়ে দৌঁড়ে এসে মিতালীকে বলে," বিশ্বাস করো
আমি ঝগড়া করি না, তবু ওরা বাড়ি
থেকে আমায় তাড়িয়ে দিয়েছে!"
মিতালী ভাবেন,
পৃথিবী জুড়ে কত মানুষ
তাদের লড়াই এর কথা জানাতে চায়! তিনি কখন শুধু নিজের কথা লিখবেন!
...(সমাপ্ত)...
No comments:
Post a Comment