![]() |
ছবি : ইন্টারনেট |
শিবানী এলো বাপের বাড়ি
সবিতা
রায় বিশ্বাস
সকাল থেকে শিবানী চরকি পাক খাচ্ছেন| আর মাত্র তিনটে দিন বাকি| চার দিনের নাম করে বাপের বাড়ি গেলেও ফিরতে ফিরতে দিন দশেক লেগে যায়| মা, বাবার থেকেও কাকা, পিসিরা বেশি ভালবাসে| আর কাকার ছেলেমেয়ে মানে পিসির অন্য সব ভাইপো ভাইঝিরা যা করে! ছাড়তেই চায়না|
আজ নয় কাল, কাল নয় পরশু এই করতে করতে চতুর্থী থেকে শুরু করে দশদিন কোথা দিয়ে যে কেটে যায়! এখন তো ষষ্ঠীতে গেলে হয়না| পিসি বলে আগে আসবি, কলকাতার রাস্তায় যা জ্যাম| শেষে না হাওড়া ব্রিজেই আটকে থাকলি দুদিন| উমা তাই আগেই যায়| আসার সময় লক্ষ্মীটাকে রেখে আসতে হয়| মামা, মামী আবার লক্ষ্মীটাকে খুব ভালবাসে|
ওই দেখো সে লক্ষ্মীটা আবার কোথায় গেলো? একটা ছেলেমেয়েকেও যদি হাতের কাছে পাওয়া যায়| কৈলাসের পাহাড়ের খাঁজে লুকিয়ে থাকলে কার সাধ্যি খুঁজে বের করে| বড্ড জ্বালাচ্ছে ছেলেমেয়েগুলো| কতদিন আর সামলে সুমলে বয়স লুকিয়ে রাখা যায়| আর ফি বছর মামা বাড়ি গিয়ে কুসঙ্গে পড়ে একেবারে উচ্ছন্নে যাচ্ছে|
কেতোটা, সেদিনের ছেলে, বায়না জুড়েছে ওসব নাগরা জুতো নাকি আজকাল কেউ পরেনা| নাইকের জুতো কিনে দিতে হবে| আর ময়ূর! ছো: ওটা বাহন হলো! হিরো গ্লামার বাইক চাই|
সরোটাও হয়েছে তেমনি, কেতোর বাইক নেবার কথা শুনে সেও জেদ ধরেছে, স্কুটি কিনবে| ওই হাঁসের পিঠে চেপে আর যাবে না| বলে কিনা Disgusting. বীনা নিয়ে হাঁসের পিঠে চেপে সাদা শাড়ি পরে পোজ দেওয়া আর পোষাচ্ছে না| এবার জিন্স টপ পরে স্কুটি চেপে কাঁধে গীটার ঝুলিয়ে মামাবাড়ি যাবে|
সরোর কথা শুনে হাঁসটা টা –টা- করে উড়ে গেল মানস সরোবরের দিকে| যাবেই তো? সেই পৌরাণিক যুগ থেকে কলি যুগ পর্যন্ত নিয়মিত ডিউটি করছে| প্যাঁক প্যাঁক আওয়াজটুকুও করেনা| ঠায় বসে থাকে সরস্বতীর পায়ের কাছে| তাকে কিনা অগ্রাহ্যি! ওই স্কুটি না ফুটি যখন বিগড়ে যাবে তখন বুঝবে!
বোঝাই যাচ্ছে কেতো, সরো দুজনের গায়েই মামাবাড়ির দূষিত হাওয়া লেগেছে| লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে হল লক্ষ্মী| কি সুন্দর ধানের ছড়া হাতে, লাল বেনারসী পরে, পেঁচার পিঠে চেপে যায়| ওই জন্যেই বলে, বড় মেয়েরা শান্ত হয়| ছোটগুলোর মতো চতুরামি করেনা|
শিবানী একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে যাবে, তখনি ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কান্নার শব্দ পেলো| নিঃশ্বাস আটকে রইলো অর্ধেক হয়ে| কি মুশকিল! কে কাঁদছে? এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে ঘরে ঢুকে দেখে সিঁদুর কৌটো মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে| লক্ষ্মী পা ছড়িয়ে কাঁদছে| মাকে দেখে মেয়ের কান্না আরো বেড়ে গে | আঁচল দিয়ে চোখ মুছিয়ে দিলেন উমা| তারপর যা শুনলেন, তাতে হার্ট ফেল করার মতো অবস্থা| সিঁদুর কৌটো পড়ে যায়নি| লক্ষ্মী নিজেই ফেলে দিয়েছে| বললো ওসব সিঁদুর টিঁদুর আজকাল কেউ পরেনা| যদিবা দু-একজন পরে, চুল দিয়ে ঢেকে রাখে | যাতে কেউ দেখতে না পারে| কোনো বিশেষ অনুষ্ঠানে ছবি তুলে ফেবুতে পোস্টাবার জন্যে মানে বিয়েবাড়ি, বিজয়া দশমীর সিঁদুর খেলা তখন সবাই পরে|
এসব শুনে উমার সব রাগ গিয়ে পড়লো মহেশ্বরের উপর| স্মশানে মশানে পড়ে থাকলে কি আর ছেলেমেয়ে মানুষ হয়? পার্বতী একা কতদিক সামাল দেবে| তখনকার মতো লক্ষ্মীকে বুঝিয়ে সুজিয়ে দুটো ডালভাত খাইয়ে, ঘুম পাড়িয়ে দিল|
আচ্ছা গণুটা গেল কোথায়? সকাল থেকে তার শুঁড় ও দেখা যাচ্ছেনা| ভুঁড়িও না| ঘন্টায় ঘন্টায় খিদে পায় যে ছেলের, আজ তার সাড়া পাওয়া যাচ্ছেনা| ওর জন্যে নাড়ু বানাতে বানাতে পার্বতীর হাতের তালু ক্ষয়ে গেছে|
গণু –গণু –গণসা করে কয়েকবার হাঁক পাড়লো শিবানী| গণু এলোনা, সাড়াও দিলোনা| এলো নেংটি| বললো মা, গণপতি বাপ্পা বলেছেন তিনি আপনার সাথে বাংলায় যাবেন না| বাঙালিরা বেওসা করতে পারেনা| নিজেরা গণেশ উল্টায়, আর দোষ দেয় আমার প্রভুর| প্রভু বলেছেন মুম্বই ভালো| টাটা, আম্বানি এরা গণপতি বাপ্পাকে খুব খাতির করে| আহা! কি খাওয়া, দাওয়া| সব খাঁটি ঘিয়ের| সচিন তেন্ডুলকর, বিগ বি এরা যা খাতির করে সেতো বিশ্বসুদ্ধ সবাই জানে| বাঙালিগুলো পয়লা বৈশাখে কিপ্টের মতো পুজো করে| দু-চারটে ফলের টুকরো, একটু সন্দেশ ব্যাস্ হয়ে গেল| একটা লাড্ডু পর্যন্ত দেয়না| না: আমার গুরুদেব আর বাংলায় যাবেন না| এইতো ভাদ্রমাসে গণেশ চতুর্থী গেল| মুম্বইতে প্রচুর খাওয়া হয়েছে| এখন প্রভু কিছুদিন পাহাড়ের সুশীতল হাওয়া সেবন করবেন| আমার অপরাধ নেবেন না মা জননী, প্রভু আমাকে বলতে বললেন, তাই-- |
এইবার গণেশ জননী আর সহ্য করতে পারলেন না| গণু তার প্রথম সন্তান| সেও মায়ের কথা শুনছে না| গণুর মা বেশ একটা চওড়া পাথর দেখে তার উপর বসে লম্বা চুল এলিয়ে কাঁদতে বসলেন| নন্দী চরতে চরতে এসে এই দৃশ্য দেখে শিং বাগিয়ে ছুটলো মহাদেবকে খবর দিতে| মহাদেব তখন ভৃঙ্গীর সাথে মৌতাতে বসেছিলেন শ্মশানে| নন্দী এসে মায়ের কথা যেই না বলা মহাদেব অমনি ত্রিশূল হাতে বোম্ ভোলা বলে উঠে দাঁড়ালেন|
ভৃঙ্গী দেখলো মহা বিপদ| প্রভু কিছুতেই শিবানীর চোখের জল সহ্য করতে পারেন না| এখন যদি আবার ক্ষেপে যান, তাহলে এই শরত্কালে ধরাধামে প্রলয় কান্ড ঘটে যাবে| এদিকে ভৃঙ্গী আবার শিবানীকে মোটে দেখতে পারেনা| তার একমাত্র উপাস্য শিব| তাই শিব শিবানীর জন্য উতলা হয়ে মৌতাত ভঙ্গ করছেন এ ভৃঙ্গীর সহ্য হলনা| নন্দীকে খুব খানিকটা বকে দিল, মাথামোটা ষন্ড বলে|
তারপর তিন পায়ে কোনরকমে দাঁড়িয়ে করজোড়ে মহাদেবকে বললো, প্রভু উত্তেজিত হবেন না| ছেলে মেয়েরা বড় হয়েছে, এটা তো মা শিবানীকে বুঝতে হবে| এই তো কটা দিনের ব্যাপার| ওরা একটু আনন্দ করুক| আর গণুকে বুঝিয়ে বললে নিশ্চয় মায়ের সাথে যাবে| আপনি চিন্তা করবেন না প্রভু| উত্তেজিত হবেন না| আপনি কুবেরকে বলুন পুষ্পক রথ পাঠিয়ে দিতে| সে আপনার ধনরক্ষক| আপনার কথা অগ্রাহ্য করতে পারবে না| এবার আর নৌকা, ঘোড়া ওসবে মাকে পাঠাবেন না| পুষ্পক রথে গেলে মায়ের মনটা ভালো হয়ে যাবে, স্টেটাস ও বাড়বে|
সিংহ ব্যাটাও খুব ঝামেলা পাকাচ্ছে| বন্যপ্রাণী আইন এখন ওদের পক্ষে| পশুক্লেশ নিবারণী সমিতি আছে| তারা যদি মায়ের নাম কেস ঠুকে দেয় তাহলে কেলেঙ্কারী| সিংহটার ও রেস্ট দরকার| ও এখানেই থাকুক| পাহাড়ে ঘুরুক, ফিরুক|
উমা দেখলেন, ভৃঙ্গীটার বেশ বুদ্ধি আছে তো! যদিও পার্বতীর অভিশাপেই ভৃঙ্গীর অমন কঙ্কালসার চেহারা| ভৃঙ্গী শিবের ভক্ত| পার্বতীর পুজো করে না| সেইজন্য পার্বতী কূপিতা হয়ে ভৃঙ্গীকে অভিশাপ দিয়েছিলেন| এখন সেই ভৃঙ্গী সমস্যার সমাধান করে দিল!
যাই হোক, শেষ পর্যন্ত সব ছেলেমেয়েরা রাজি হয়েছে মামাবাড়ি যেতে| তবে ওদের কথাও রাখতে হচ্ছে| একটা কথা বলে রাখি, সবাই প্যান্ডেলে ঠাকুর দেখতে গিয়ে যদি সরস্বতী ঠাকুরকে গীটার নিয়ে দেখো ঘাবড়ে যেও না| মোদ্দা কথা হল, কোনো দেবতাকেই সাবেকি পোজে দেখতে পাবেনা| এমনকি মা দুর্গাও একটু অন্যরকম সেজেই প্যান্ডেলে যাবেন| ছেলেমেয়েদের হাওয়া মায়ের গায়েও লেগেছে যে!
...(সমাপ্ত)...
No comments:
Post a Comment