![]() |
ছবি : ইন্টারনেট |
রুকুর পুজো
পল্লব পত্রকার
এবার পুজোটা যে মাঠে মারা যাবে, তা বেশ বুঝতে পারছে রুকু। দূরে কোথাও বেড়াতে যাওয়া হচ্ছে না বলে নয়! সেজন্য তার কোনও দুঃখ নেই! বরং যেতে হয়নি বলে সে বেঁচে গেছে। পর পর দু বছর কলকাতা ছেড়ে গিয়ে কি বিচ্ছিরি যে কেটেছে! কি দরকার এই সময়ে বিদেশ বিভুঁই যাবার! সিমলা-কুলু-মানালিই হোক, বা রাজস্থান-গুজরাট! এখানকার মতো সেসব জায়গায় না আছে সুন্দর সুন্দর প্যান্ডেল, না আলোর রোশনাই বা দারুণ দারুণ ঠাকুর! ঢ্যাং কুরাকুর বাদ্যিই বা কোথায়! অথবা ঘুরে ঘুরে ফুচকা আলুকাবলি আইসক্রিম খাবার মজা!
তবু বাধ্য হয়ে গত বছর তাকে যেতে হয়েছিল। তার আগের বছরও। মা বাবা ঠাম্মি তিতিরদি সঙ্গে ছিল। মামা মামী দিদিমারাও। কিন্তু সবাই থাকা সত্ত্বেও পুজোর কথা বারে বারে মনে পড়ছিল। কি মিশ কি মিশ! ভাগ্যিস এবার ট্রেনে রিজার্ভেশন পাওয়া যায়নি! না হলে টুকটাক কথা যে চলছিল না তা নয়! মা বারবার বাবাকে বলছিল, 'অন্তত পুরি বা দার্জিলিং চলো! এই তো কটা দিন মাত্র তোমার ছুটি! তারপর তো শুধু কাজ আর কাজ! ...' রুকু মনে মনে তখন ঠাকুর ঘরে যে কটা ঠাকুর আছে, তাদের সবার কাছে প্রে করেছে। 'হে মা কালি, হে কৃষ্ণ, হে জগন্নাথ … যেন টিকিট না পাওয়া যায়! হে লক্ষ্মী, হে সরস্বতী, হে কার্তিক, হে গণেশ, যেন টিকিট না পাওয়া যায় ….!'
ঠাকুররা তার প্রার্থনা শুনেছে। রুকু প্রচুর থ্যাংকস জানিয়েছে ঠাকুরদের। কিন্তু সমস্যা তো অন্য দিক থেকে এসেছে! কদিন আগে তাদের সংসার ভেঙে দু টুকরো হয়েছে। আগে যেমন জেঠুরা এক তলায়, তারা দু তলায় ছিল, তেমনটাই আছে। শুধু রান্নাঘর দুটো আলাদা হয়েছে! বুবাই টুকাই অঞ্জুদি তিতিরদি আর সে একতলায় বড় রান্নাঘরটায় রোজ খেতে বসত। স্কুল যাবার আগে, স্কুল থেকে ফিরে বিকেলে, রাত্তিরে। ছুটি ছাটার দিনগুলোয় ব্রেকফাস্টে। শুধু আনন্দ আর আনন্দ। কে আগে খাওয়া শেষ করবে, তাই নিয়ে কম্পিটিশন! এখন দোতলার নতুন এই রান্নাঘরে একা একা খাওয়া। বড়জোর দিদির সঙ্গে বসা। ইস্! কি বিচ্ছিরি! কি বিচ্ছিরি! তার ওপর পুজো এসে গেল! কি করে যে ছুটির দিনগুলো কাটবে! ভেবে ভেবে আকুল হচ্ছে রুকু।
আজ দুপুরে এই কথাগুলোই সে বলছিল তার ঠাম্মিকে। স্কুল ছুটি থাকায় সে ঠাম্মির ঘরে শুতে গিয়েছিল। ঠাম্মি তার গার্লফ্রেন্ড। মনের সমস্ত কথা ঠাম্মির সঙ্গে শেয়ার করে। এটা সেটা কথার পর ঠাম্মিকে বলল, 'আমার সময়েই কেন এমনটা হল বলো তো ঠাম্মি? বাবার সময়েও তো হতে পারত! বা তার আগে! কিম্বা ধর আমি বড় হয়ে যাবার পর! ...'
ঠাম্মি কোনও উত্তর দিতে পারেনি। প্রথমে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকেছে রুকুর মুখের দিকে। তারপর চোখের কোল দিয়ে জলের ধারা বয়ে গেছে ঠাম্মির।
'এ মা! তুমি কাঁদছ? সরি ঠাম্মি! তুমি কষ্ট পাবে জানলে আমি একদম বলতাম না!' রুকু চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। ঠাম্মিও। পুরনো দেওয়াল ঘড়িটা শুধু টিক টিক করে আওয়াজ করে যায়। একসময় হাসতে হাসতে রুকু বলে, 'এবার পুজোয় আমার ক সেট জামা প্যান্ট হয়েছে বলো তো ঠাম্মি?'
চোখে জল আর মুখে হাসি নিয়ে ঠাম্মি ঘাড় নাড়ে। 'জানিনা? '
'মোট পাঁচ সেট! বাপি একটা, জেঠু একটা। পিসিরা দুজন। আর আমার মামাবাড়ি থেকে।' একটু থেমে বলে, ' রাঙামামারা কই এ বছর দেয়নি! শুধু বুবাই টুকাই অঞ্জুদিকে দিয়েছে! না হলে তো প্রতি বছরের মতো এ বছরও ছটা হতো!'
ঠাম্মি আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে, রুকুর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, 'তোমার তো আরও এক সেট হবে দাদুভাই! ছোটকা ফেরার সময় নিশ্চয়ই আনবে!'
'তাই তো! আমি একদম ভুলে গেছি!' রুকুর চোখে মুখে হাসির বন্যা। 'ছোটকা কবে ফিরবে গো ঠাম্মি?'
'বলেছিল তো পুজোর আগেই! কিন্তু এখনও কই ফিরল না! আজ পঞ্চমী হয়ে গেল!'
ঠাম্মির সঙ্গে রুকুও বেশ চিন্তায় পড়ে। মাস দশেক আগে তার ছোটকা রেলে চাকরি পেয়েছে। প্রথম পোস্টিং দিল্লিতে। দু তিন মাস ছাড়াই চলে আসে। ট্রেনে তো ছোটকার ফ্রি! যখন খুশি চড়ে বসলেই হল! প্রতি বারেই আসার সময় কত কিছু আনে! ছোটদের জন্য নানা রকমের খেলনা। বড়দের দরকারি জিনিসপত্র। আর এবার তো পুজোর আগে আসছে! তার মানে আনবেই আনবে! কিন্তু কেন যে এখনও…
'আচ্ছা ঠাম্মি, ছোটকা এলে কাদের বাড়ি খাবে? আমাদের বাড়ি না অঞ্জুদিদের বাড়ি?' হঠাৎ করে জিগ্গেস করে রুকু।
নাতির প্রশ্নে থতমত খান ঠাম্মি। আবার সামলেও নেন। ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটিয়ে বলেন, 'দু জায়গাতেই খাবে! যখন যেখানে খুশি!'
দুপুরে আজ এই পর্যন্তই রুকুর কথা হয়েছিল ঠাম্মির সঙ্গে। তারপর সে চলে এসেছিল তাদের বাগানে। অঞ্জুদি তিতিরদি মজা করে ছাদে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে। বুবাই টুকাই হই হই করছে তাদের সঙ্গে। কদিন আগেই বৃষ্টি হচ্ছিল একটানা। এখন ঝকঝকে নীল আকাশের বুকে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর রঙ-বেরঙের ঘুড়ি! পেট্কটি চাঁদিয়াল মোমবাতি বগ্গা ...! এতসব ঘুড়ি রুকু আগে চিনত না। ছোটকাই চিনিয়েছে তাকে। এখন ছোটকা বাড়ি না থাকায় ঘুড়ি ওড়াতে একটুও ইচ্ছে করছে না। বাগানে কিছুক্ষণ পায়চারি করে বেলগাছের গোড়ায় বেদিতে গিয়ে সে বসল। নিরিবিলি জায়গাটা তার খুবই পছন্দের। এদিক ওদিক বেশ কয়েকটা ফুল ও ফলের গাছ। গন্ধরাজ জবা শিউলি কাঠচাঁপা স্থলপদ্ম হাস্নুহানা। আম জাম লিচু পেয়ারা জামরুল।
বেলগাছের পাশেই শিউলিতলায় কয়েকটা শিউলিফুল পড়ে আছে। জেঠিমা কিছু কুড়িয়ে পুজো করেছে সকালে। শিউলিতলা থেকে চোখ সরিয়ে জেঠুর সদ্য লাগানো ফুলগাছগুলোর দিকে তাকায় রুকু। গাঁদা দোপাটি এর মধ্যেই ফুটতে শুরু করেছে। কদিন পরে আরও কত দেশি বিদেশি ফুলে ভরে যাবে বাগানটা। সেই ফুল দু চারটে তুলে জেঠিমা তার গোপালের পায়ে চড়াবে। পরে জেঠুর কাছে ধরা পড়ে বকুনিও খাবে।
রুকু কোনও দিন বাগানের ফুল তোলে না। তাই জ্যাঠামশাই তাকে খু্ব ভালোবাসেন। কতবার আদর করে বলেছেন, 'তুমি সোনা ছেলে! তাই ফুলেদের কষ্ট বোঝ। মানুষের কেটে গেলে যেমন যন্ত্রণা হয়, ফুল ছিঁড়লেও গাছেদের যন্ত্রণা হয়। কেউ ফুল তুলছে দেখলেই তাকে বারণ করবে। ...' ব্যাপারটা ভাবতে ভাবতে রুকুর ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটে ওঠে।
সেই হাসি উল্লাসে পরিণত হয়, যখন সে দেখে, গেট ঠেলে ছোটকা গটমট করে ভিতরে ঢুকছে। সি গ্রীন জিনস, মেরুন টি সার্ট আর সানগ্লাসে ছোটকাকে যা লাগছে না! 'কি মজা! কি মজা! ছোটকা এসেছে! ছোটকা এসেছে! ...' বলতে বলতে তিড়িং করে লাফ মেরে রুকু দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে ছোটকাকে। ওপর থেকে বুবাই টুকাইরাও দেখতে পেয়েছে ছোটকাকে। দুদ্দাড় নেমে এল তারা। তারপর সবাই মিলে আদরের ছোটকাকে ঘিরে ধরল। 'আমার জন্যে কি এনেছ কাকু! আমার জন্যে! ...' সবার এক প্রশ্ন। সবার কাকুর ওপর সমান দাবি।
ছোটকা একে একে সবাইকে দেখাতে লাগল, কার কোন স্যূট বা স্কার্ট! শুধু ছোটদের নয়, বড়দের জন্যও ছোটকা এনেছে। বাবা আর জেঠুর জন্য জামা প্যান্টের পিস। মা জেঠিমা ঠাম্মির জন্য শাড়ি। সেগুলো যার যার হাতে তুলে দিয়ে ছোটকা প্ল্যানিং-এ বসল। পুজোর চারদিন কিভাবে কাটানো হবে, কোথায় কোথায় ঠাকুর দেখতে যাওয়া হবে, কি কি খাওয়া হবে! … প্রতি বছরের মতো বড় একটা মটরগাড়ি তো ভাড়া করতেই হবে। সপ্তমীর দিন যাওয়া হবে সাউদ ক্যালকাটা। অষ্টমীর দিন সেন্ট্রাল, আর নবমীর দিন নর্থে...।
'আজ তো পঞ্চমী হয়ে গেল। গাড়িটা এখনই বুক করা দরকার!...' বলতে বলতে ছোটকা সেলফোন বের করে। পাড়ার সুনীলকাকুর গাড়িটাই প্রতিবছর নেওয়া হয়। এ বছরও হল।
এবার খাওয়া দাওয়ার আইটেম। 'কি গো বড়বৌদি! কি গো মেজবৌদি! তোমরা এই কদিনের মেনু ঠিক করে ফেলেছ নাকি!'
ছোটকার কথা শুনে বাবা আর জেঠু গম্ভীর হয়ে থাকে। মা জেঠিমা আমতা আমতা করে। 'না না, এখনও ঠিক হয়নি! তুমিই বল না, কি হবে!'
'সে কি! আজ সকালে তুমি যে বললে, আমাদের একদিন ইলিশ, একদিন মাটন, একদিন চিলি চিকেন হবে!' অঞ্জুদি ফুট কাটে।
তিতিরদিও সামলাতে পারে না নিজেকে। 'আমাদের একদিন বিরিয়ানি, একদিন ফ্রায়েড রাইস, আর একদিন ভেটকির পাথুরি!'
অঞ্জুদি তিতিরদির কথা শুনে ছোটকা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। কিচ্ছু বুঝতে পারে না।
ঠাম্মিই তখন সামাল দেয় ব্যাপারটা। 'আসলে কি হয়েছে জানিস! তোর দাদারাই কদিন আগে ঠিক করেছে, এবার থেকে অঞ্জু আর তিতিরদের আলাদা আলাদা রান্না হবে। একসঙ্গে এত জনের ব্যাপার! সবারই খু্ব অসুবিধা হচ্ছিল। যারা বাজার করত, যারা রান্না করত...!'
'তার মানে! দাদারাই শুধু সিদ্ধান্ত নেবে! আমি এ বাড়ির কেউ না! আমাকে একবারও জানাবার প্রয়োজন বোধ করলে না তোমরা!' হঠাৎ রেগে গিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে ছোটকা।
তারপর গুম মেরে বসে থাকে কিছুক্ষণ।
একসময় গলাটা ঝেড়ে নিয়ে বলে, 'আমি যে কদিন এখানে থাকব, এসব কিচ্ছু হবেনা! দাদাদের বাজার-হাট করতে কষ্ট হয়, আমি রোজ বাজার করব। আর বৌদিদের রান্নাবান্নার অসুবিধা! ও পাড়ার ভোলা বামুনকে বলে আসব, এই কদিন সে-ই রান্না করবে। আমাদের প্রতিটা অনুষ্ঠানে তো ও রান্না করে! বেশ ভালো রান্না! তিতির অঞ্জুরা যেগুলো বলল, সেগুলোই হবে। একবেলা তিতিরের, আর একবেলা অঞ্জুর আইটেম!'
এতক্ষণ দালানের এক কোণে ঠাম্মির পাশে গুটিসুটি
দাঁড়িয়েছিল রুকু। ছোটকার ঘোষণায় তার কি আনন্দ যে হচ্ছে! প্রথমে সে তিড়িং বিড়িং করে
নেচে নেয় খানিকটা। তারপর দৌড়ে ছোটকার কাছে গিয়ে ছোটকাকে জড়িয়ে ধরে কি আদর, কি আদর! দু গালে হামি খেতে খেতে বলে, 'থ্যাংক ইউ ছোটকা! থ্যাংক ইউ!'
No comments:
Post a Comment