![]() |
ছবি : ইন্টারনেট |
বিসর্জন
রীতা রায়
দশমী পূজোর ঢাকের
বোলে মেতে উঠেছে পাড়ার ক্লাবের দুর্গামণ্ডপ। সকালের প্রাত্যহিক কাজ ও স্নানাদি সেরে
বৌয়েরা.. মায়েরা.. এসেছেন প্রসাদের থালা ও জল ভরা ঘট সাজিয়ে। মায়ের পূজো সমাপ্ত হলে
আশীর্বাদস্বরূপ সেই জলভরা ঘট নিয়ে ফিরে যাবে ঘরে যাতে তার আপন ঘরটি সারাবছর জন-ধন-সমৃদ্ধিতে
ভরে থাকে।
অপরাজিতা পূজা সমাপ্ত।
সকলে শুদ্ধবস্ত্রে আচমন মন্ত্র উচ্চারণ করে মন-প্রাণ শুদ্ধ করে নিচ্ছে মায়ের চরণে অঞ্জলি
দেবে বলে। পুরোহিতমশাই সংকল্প মন্ত্র উচ্চারণ করার আগে বলে দিলেন..
-- মায়েরা যারা ব্রাহ্মণ তারা নামের সাথে 'দেবী' বলবেন আর যারা অব্রাহ্মণ তারা নামের সাথে 'দাসী' বলবেন।
সংকল্প হয়ে গেলে পুষ্পাঞ্জলী.. সকলে ফুল হাতে প্রস্তুত। পুরোহিতমশাই আবার বললেন, যাঁরা ব্রাহ্মণ এবং দীক্ষা নিয়েছেন তাঁরা মন্ত্রের প্রথমে 'ওঁ' উচ্চারণ করবেন আর বাকিরা 'নমঃ' বলবেন।
সমাজব্যবস্থা যতই
উন্নত হোক, যতই মুখে সমানতার
দাবি উঠুক কিন্তু খাতায়-কলমে তো বটেই, সংস্কার-সংস্কৃতিতেও এই ফারাক আজও থেকে গেছে। একই পূজামণ্ডপে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে
একই পুষ্পপত্র থেকে ফুল নিয়ে একই দেবতার চরণে অঞ্জলী দিতে হলেও মন্ত্রউচ্চারণ হবে উচ্চনিচ
ভেদাভেদ জ্ঞানে। হে মা দুর্গা! এই যে সকলের পুষ্পাঞ্জলীর ফুল একটি থালায় একত্রিত করে
তোমার চরণে অর্পণ করা হল এর মধ্যে তুমি কী করে বাছবে যে কোনটা দেবীর আর কোনটা দাসীর
অর্পিত? কোনটার গায়ে ওঁ মাখানো আর
কোনটার গায়ে নমঃ?
যে কোনো সমাজের বুনিয়াদকে শক্ত করে তাদের সংস্কার। সংস্কার থেকেই জন্ম নেয় সংস্কৃতি। এই সংস্কার যদি সর্বজনস্বীকৃত হয় তাহলে তা হল সুসংস্কার আর যদি তা মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরি করে ও ক্ষতিকারক হয় তাহলে তা কুসংস্কার। সংস্কৃতির নামে তাই অপসংস্কৃতি প্রচার হয় অনেক বেশি।
এসব কথা ভাববার অবসর
যদিও কারো নেই, সকলেই ঠাকুরমশাইয়ের
নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছে।
অঞ্জলি দেওয়ার পর
আরতি পর্ব সমাধা হল।
এতক্ষণ মেয়েরা বসে
অপরাজিতা গাছের ডালপালা আর হলুদ কাপড় প্যাঁচিয়ে বালা বানিয়ে রেখেছিলো, সেগুলো একে একে ছেলেরা এসে পুরোহিতের কাছ থেকে দক্ষিনার
বিনিময়ে নিয়ে হাতে পরছে। একটি মেয়ে নেবার জন্য হাত বাড়াতেই ঠাকুরমশাই বলে উঠলেন,
'এগুলো মেয়েদের পরতে নেই,
এগুলো শুধু ছেলেরা পরবে।'
অনেক মা তাদের পুত্রের
জন্য নিলেন। সবাই অপেক্ষা করছে দশমীর আশীর্বাদ স্বরূপ লাল-হলুদ মৌলিসূতো হাতে বাঁধার
জন্য। এই সূতো অবশ্য সবারই জন্য যদিও যার যা সাধ্যমতো দক্ষিনা দিচ্ছে ঠাকুরমশাইকে।
-- সবাই প্রণাম করে মা দুর্গার কাছে মনোস্কামনা জানিয়ে
দিন। এবার ঘট বিসর্জন দেবো।
ঠাকুরমশাই মন্ত্র
উচ্চারণ করে পৈতাসমেত হাত দিয়ে ঘট নড়িয়ে ফুল তুলে বিসর্জন দিলেন। এবার ঠাকুরমশাই একটু
অন্যভাবে প্রতিমা বিসর্জন দেবেন ভাবলেন। বললেন,
-- ব্রাহ্মণ এঁয়োতি কেউ থাকলে এগিয়ে এসে সিঁদুর কৌটো নিয়ে মায়ের সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে আসুন।
এ পাড়াতে চার-পাঁচ
ঘর ব্রাহ্মণ থাকলেও আজ দশমীর সকালে কেবলমাত্র ব্যানার্জী বাড়ির ছোটবৌ রিমা এসেছে,
এগিয়ে এলো সিঁদুরকৌটো হাতে।
অমনি সব এঁয়োতিরা নিজ নিজ সিঁদুর কৌটো এগিয়ে দিয়ে বলতে লাগলো -- "আমার সিঁদুরকৌটোটি
একটু মায়ের পায়ে ছুঁইয়ে এনে দাও"।
এতগুলো সিঁদুর কৌটো
নিয়ে মায়ের পায়ের কাছাকাছি পৌঁছনো সহজ নয়, কখন কোন পূজাসামগ্রীতে পা ঠেকে যাবে। সন্ধ্যায় তো সবাই সিঁদুর খেলায় মাতবেই তা
সত্ত্বেও বিসর্জনের আগে মায়ের পায়ে সিঁদুর ছোঁয়ানোর ইচ্ছে সকলের। কিন্তু ইচ্ছে করলেই
তো আর সকলকে মায়ের গায়ে হাত দেওয়ার অনুমতি মিলবে না। কারণ মৃন্ময়ী মা এখনও চিন্ময়ী
রূপে বিদ্যমান। একজন ব্রাহ্মণকন্যাই স্পর্শ করার অনুমতি পেয়েছে। যদিও তাকে সাহায্য
করতে আর একজন সাধারণ কন্যা তার সাথে যাবার অনুমতি পেল।
সকলের সিঁদুর কৌটো
ছুঁইয়ে দিল মায়ের পায়ে রিমা মানে ব্যানার্জী বাড়ির ছোটবৌ। পুরোহিতমশাই তাকে উদ্দেশ্য
করে আবার বললেন,
-- মা, আপনি প্রতিমা স্পর্শ করে একটু নড়িয়ে দিন।
অন্যদের উদ্দেশে বললেন,
"মায়ের বিসর্জন হচ্ছে সকলে
উলুধ্বনি দিন।"
সকলে সমস্বরে উলুধ্বনি
দিয়ে উঠলো। ব্যানার্জী বাড়ির ছোটবৌ সিঁদুরে রাঙিয়ে দিয়েছে মায়ের সিঁথি আর মায়ের চরণযুগল।
ঢাকের বোলে বিসর্জনের বাজনা। দেবীর হাতেই দেবীমায়ের বিসর্জন। সম্মুখে রাখা জলভরা পিতলের
ঘটে ভেসে উঠলো দুর্গা প্রতিমার মুখ। মায়ের বিসর্জনের সাথে শেষ হল সেবারের দুর্গাপূজা।
মায়ের আশীর্বাদ, ঘট ও প্রসাদ নিয়ে যেযার ঘরে ফিরে গেল। পূজোর কদিন সকলের বাড়িতে নিরামিষ ভোজন চলেছে, আজ দশমীতে হবে আমিষ ভোজন। কারো ঘরে এসেছে জোড়া ইলিশ তো কারো ঘরে চিংড়ি, কারো বাড়িতে হয়েছে আবার পাঠার মাংসের আয়োজন।
.... মাত্র মাসখানেক আগের
এই ঘটনাগুলো পরপর চোখের সামনে ভেসে উঠছে রিমার। চিন্তায় ছেদ টেনে বড়ছেলে বললো,
-- মা পাসবুকটা দাও। দশটা বেজে গেছে, এতক্ষণে নিশ্চয় ব্যাংক খুলে গিয়ে থাকবে।
ছেলের কথায় হুঁশ এলো রিমার অর্থাৎ ব্যানার্জী বাড়ির ছোটবৌয়ের। ব্যাংকের পাসবুক এনে দিল তার বড়ছেলের হাতে। কয়েকদিন ধরে উনি মানে তার কর্তা অসুস্থ অনুভব করছিলেন। গত তিনদিন তিনি নার্সিংহোমে ছিলেন কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে গত রাতে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। চার ঘন্টা অবজারভেশনে রাখার পরও ছুটি মেলেনি কারণ নার্সিংহোম যে মোটা টাকার বিল হাতে ধরিয়েছে সেটা মেটানোর মতো অর্থ ঘরে নেই। সকাল দশটায় ব্যাংক খুললে তবেই টাকা তুলে বিল মিটিয়ে দেহ বাড়িতে নিয়ে আসা হবে।
ওই তো ওরা এলো মনে
হয়..
পাড়ায় খবরটা ছড়িয়ে পড়েছে ইতিমধ্যে, লোকে-লোকারণ্য বাড়ির সামনে। কতই বা বয়স ভদ্রলোকের? ওরকম ঠান্ডা মেজাজের লোকের এত তাড়াতাড়ি মৃত্যু ঘটবে সেটা কী কেউ ভেবেছিল? ছোট ছোট দুই ছেলে ও স্ত্রী রেখে চলে গেলেন অকালে। স্বামীর পায়ের কাছে বসে আছে রিমা। তার সিঁথি রাঙিয়ে দিচ্ছে সবাই সিঁদুরে.. শেষবারের মতো।
মা দুর্গার সিঁদুর
রাঙা মুখটা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে রিমার। নিজের হাতে সিঁদুর পরিয়ে মায়ের বিসর্জন
দিয়েছিল সে এবার। মাত্র মাসখানেকের ব্যবধান.. তার নিজের সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল। সবার
সিঁদুর কৌটো মায়ের পায়ে ছোঁয়াতে গিয়ে নিজের জন্য আশীর্বাদ চাওয়া হয়নি মায়ের কাছে। তাকে
আর কোনোদিন ঠাকুরমশাই ব্রাহ্মণ এঁয়োতি বলে মায়ের সিঁথিতে সিঁদুর ছোঁয়াতে ডাকবেন না।
সে এখন ব্রাহ্মণের ঘরের বিধবা। তার জন্য বিধিবদ্ধ হবে কত কত নিয়ম। সংস্কারের নামে এভাবেই
চলে আসছে সংস্কৃতির পরম্পরা।
...(সমাপ্ত)...
No comments:
Post a Comment