1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, September 21, 2025

সর্বজনীন


ছবি : ইন্টারনেট

সর্বজনীন

 মৈত্রেয়ী মুখার্জি

সাত দিন ধরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে মাঠ ঘাট পুকুর গুলো জলে ভরে সমান হয়ে গেছে ।ঘরের চালা থেকে বারান্দায় মাটিটাতে জল পড়ে কাদা কাদা হয়ে গেছে। হরেন বিরক্ত মুখে এবার আকাশের দিকে উঁকি দিয়ে তাকিয়ে আবার বিছানায় শুয়ে পড়লো ।গত বছর কষ্ট করে ঘরের মেঝেটা সিমেন্ট করে নিয়েছিল ।চালটা খড়ের ই আছে।  ঘরের দু-তিন জায়গায় টপটপ করে জল পড়ছে সেখানে বালতি হাড়ি ইত্যাদি রাখা আছে ।এবার বর্ষার  বৃষ্টির এতদিনেও  মন ভরেনি  আশ্বিন যে পড়ে গেছে সেটাও ভুলে গেছে ।বর্ষার জলে ধানের অর্ধেক তো নষ্ট করে দিয়ে গেছে যেটুকু আছে সেটা আশ্বিনের বর্ষায় যাবে। মালতী কে ডেকে হরেন বলে- বুঝলি মালতী এবার ভাবলাম ভালো ফলন হলে ঘরে টিনের ছাউনি দেবো তার হলো না যা ফসল উঠবে তাতে সারা বছরের চাল টুকুও কুলাবে না।

মালতী ঘরেরই এক কোনায় রান্না করছিল হরিণ আর মালতীর ছেলে মেয়ে মালা আর রুপো এক কোনায়  শতরঞ্জিতে বসে পড়ছে ।পড়া কম আর নিজেদের মধ্যে খুনসুটি বেশি হচ্ছে। দুজন পিঠোপিঠি ভাইবোন; রুপুর সাথে মালার বছর আড়াই এর বয়সের পার্থক্য এবং তাই মালা দাদা না বলে রুপু বলেই ডাকে এবং দুজনে দশ মিনিট অন্তর বিভিন্ন কারণে মার কাছে অপরের নামে নালিশ করছে ।অঝোরে বৃষ্টি, ধান নষ্ট হওয়া বা ঘরে জল পড়া কোন কিছুই তাদের উৎসাহ কম করতে পারেনি।মালতী ছেলে মেয়ের কোন কিছুতেই বিরক্ত হয় না বরং সবগুলো নালিশকে নিরপেক্ষ ভাবে সমাধান করার চেষ্টা করে, ফলে দাদা বোন বুকে বুঝে উঠতে পারে না মা কাকে বেশি ভালোবাসে। তাও একে অপরকে বলতে ছাড়ে না যে বাবা চাষের মাঠ থেকে কুড়িয়ে পেয়েছে অন্য জনকে বছর খানেক ধরে ঝগড়ায় রুপুর নাম্বার একটু বেশি থাকছে এই কারণে যে সে গত বছর পুজোর সময় সে বাবার সাথে বড় আবাসন বাড়িতে গিয়েছিল। পুজোর দিন কয়েক বাবা ঢাক বাজাতো আর ও কাঁসর ।আবার বাড়ির একটা ফর্সা টুকটুকে ছেলে ওকে বন্ধু করেছিল, ফেরার পথে ওই ছেলেটার মা ওকে একটা বড় চকলেট দিয়েছিল। রাস্তায় খাইনি কিন্তু, সেটা বাড়ি এসে বোনকে আগে খাইয়ে তারপর নিজে খেয়েছিল। বোনের মুখে খুশির আলো দেখতে দেখতে। এখন খুব গম্ভীর মুখে বোন কে সে বোঝাচ্ছিলো চার বছর আগে এরকম বৃষ্টির দিনে ধান খেতে বাবা গিয়ে দেখতে পায়  পুটলি বাধা একটা বাচ্চা মেয়ে ,তখন পুটলি খুলে ওরা মিষ্টি বোন পেল কিন্তু পুজোতে রূপুকেই তারা নিয়ে যায় কারণ সে হলো নিজের ছেলে ।এটা শুনে ছলছলে চোখে মালা হরেন কে গিয়ে বলে -বাবা এবার কিন্তু আমিও যাব। কোথায় যাবি রে মা সেটা বল ? কলকাতা যাব। যখন তুমি ঢাক বাজাতে যাবে .হরেন স্নেহভরা মেয়েকে কোলে নিয়ে বলে তুই যাবি মাকে ছেড়ে থাকতে পারবি?

 সে কথা শুনে মালা এক গভীর চিন্তায় পড়ে গেল ,মাকে জড়িয়ে ছাড়া সে শুতে পারেনা ।খানিক বিজ্ঞের মত ভেবে নিয়ে বলল -মা ও যাবে তাহলে, আমরা চারজনই যাব। মালতী সত্যিই কলকাতায় ঠাকুর দেখার বড় শখ ,মালাকে কখনো মুখ ফুটে বলেনি কিন্তু বিজ্ঞ মেয়েটা বোধহয় বুঝে গেছে ।বৃষ্টির দিনে সব সবজি দিয়ে খিচুড়ি রান্না করছিল সে। খিচুড়িতে ছক দিয়ে হাত মুছে হারানের কাছে এসে বলল- যাবে এবার সবাইকে নিয়ে?কলকাতার পুজো দেখব।হারানের ও চোখে ভেসে উঠলো পুরো পরিবার নিয়ে পুজোয় কলকাতা যাবার শখ,একসাথে উৎসব পালনের আনন্দ। কিন্তু বাস্তবটাও ভুলে গেলে নয়। মালতী কে বলে -দাঁড়া, বাবুরা বায়না করুক আগে ।কিন্তু আমাদের এত জনকে ওরা রাখবে কেন ,কলকাতায় খাবার খরচ অনেক বুঝলি?  মালতী  বলল-আমি ভোগ রেঁধে দিতে পারি তো? পয়সা নিবো নি। নাক টেনে খিচুড়ির সুবাস টেনে  হারান বলে -বোকা মেয়ে বাউরির বউয়ের রান্না ওরা পুজোয় নেবে কেন? এক কাজ করিস তুই ওদের বাসনপত্র মেজে পুজোর জায়গা পরিষ্কার করে দিস। আলোক বাবুর ফোন এলে আমি বলব -টাকা দিতে লাগবে নি ,বউ বাচ্চা কে আনবো যেন ঘরেতে সবাইকে থাকতে আর খেতে দেয়। বছর পাঁচেক এখানে পুজোয় বাজাতে যায়  হরেন। ঢাক বাজাবার সাথে সাথে ছোটখাটো ফরমাস খেটে দেওয়া, পূজোর জিনিস আনতে ভুল হলে চট করে দশকর্মার দোকানে দৌড়ে গিয়ে এনে দিয়ে বাবুদের বেশ নেক নজরেই আছে সে। তাই মনে হয় না বাবুরা মানা করবে ।সেদিন রাতে শুয়ে মালা আর রুপু আলোচনা করতে লাগলো কলকাতায় গিয়ে কি কি করবে? কোথায় কোথায় ঘুরতে যাবে ইত্যাদি বিষয়ে। হরেন মালতী কে জিজ্ঞাসা করল কিরে তোর কি কি করার ইচ্ছা? মালতী বললো হ্যাঁগা একদিন দক্ষিণেশ্বর নিয়ে যাবে আর আমার কাছে জমানো কিছু টাকা আছে সেই দিয়ে ছেলে মেয়ে দুটোকে শহুরে দুটো জামা কিনে দিবো। অন্ধকারে চারজন মানুষ শুয়ে পুজোর পরিকল্পনা আর সুখের জল্পনায়  ঘুমের দেশে পাড়ি দিল ।

পরদিন সকালে বৃষ্টি ধরে একটু রোদের মুখ দেখা দিয়েছে ।হরেন উপরে তোলা ঢাক টা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রোদে দিল ।ফোনটাই রি-চার্জ শেষ হয়ে গিয়েছিল ,সাত সকালে দোকানে গিয়ে ১০০ টাকা রি-চার্জ করিয়ে আলোক বাবুকে ফোন করে সব কথা বলে ফেলল। আলোক বাবু বিশেষ আপত্তি করলেন না চার জন আসবে শুনে ।আবাসন বাড়িতে পুজোর কাজে সব সময় লোকের অভাব ৪-৫ জনকে পুজোর কাজ করতে পাওয়া যায় ,বাকিরা মণ্ডপে সেজে-গুজে একটু ফটো-শুট করে ঠাকুর দেখতে বেরিয়ে পড়ে ।হরেনের বউ আসলে হাতে হাতে একটু কাজ করে দিলে ভালোই হবে ।তবে খুব রান্নার ব্যাপারে তিনি মত দিতে পারবেন না। তাদের বছর দশেকের এই আবাসনে ব্যানার্জি কাকিমাই এতদিন ভোগের দিকে  তদারকি করতেন, এখন পায়ের ব্যথায় বেশি সময় দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না বসে বসেই একজন রান্নার বামুন ঠাকুরকে সব রকম নির্দেশ দিয়ে ভোগ রাধানো আর মাকে সুন্দর করে পরিবেশন করার কাজটা করান ।বাউরির বউকে ভোগ রান্না দেবেন না বলেই মনে হয় কিন্তু আরও অনেক কাজ আছে। তার সাথে আবাসনের সকলে দিন চার একসাথে খাওয়া দাওয়া করেন। প্রয়োজনে সেখানে একটু হাত লাগিয়ে দেবে ।

হরেনের কাছে সব কথা শুনে মালতী আর বাচ্চা দুজনের আনন্দের আর সীমা থাকে না। মালতী ব্যাগ গোছাতে থাকে ,জামাকাপড়ের মধ্যে বেছে বেছে সবচেয়ে ভালো কটি ব্যাগে গুছিয়ে নেয়। পুজোয় একটি করেই নতুন জামা কিনতে পারে ছেলে মেয়ের ,সেটা তো কলকাতা গিয়ে কিনবে।

 হরেন স্টেশনে গিয়ে চারটে টিকিট কেটে সিট রিজার্ভ করে নেয়।ঢাক নিয়ে যাবে রিজার্ভ না হলে মুশকিল। চারজনের আড়াইটা  সিট বাকিটা ঢাকের। তার আর ছেলের টিকিটের টাকাটা বাবুরা দিয়ে দেয় আর বাকিটা একটু খরচা হবে কিন্তু বউ ছেলেমেয়ে সখ পূরণ করাটা টাকার থেকেও অনেক দামী।

 পঞ্চমীর দিন ভোর বেলা সবাই মিলে চেপে বসল ট্রেনে। হাওড়া স্টেশনে পৌঁছতে ঘন্টা আড়াই তারপর ওখান থেকে বাসে কর যেতে হবে। চারিদিকে পুজো পুজো আবেশ হরেন কাশফুল তুলে সুন্দর করে ঢাকটাকে সাজিয়েছে আর মালতী একটা একটা লাল কাপড়ের খোল বানিয়ে দিয়েছে। সেজে-গুজে তিনিও চলছেন কলকাতা। হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে রিমি ধিমি করে ঢাকের তাল তুলল হরেন ।পুজোর জন্য চারিদিকে সুন্দর করে সাজানো, লোকজন চেঁচিয়ে উঠল জয় মা দুগ্গা। বাসে করে যাবার সময় হাওড়া ব্রিজ আর মা গঙ্গাকে দেখে মালা আর রুপুর কি আনন্দ।

 মালতী বলে -ওরে প্রনাম কর মা গঙ্গা, সুযোগ পেলে একবার মাথা ডুবিয়ে নেব। হরেন বলে- ঠিক আছে। আগে কাজের জায়গায় তো পৌঁছাই তারপর দেখা যাবে। ৪০- ৪৫ মিনিট বাদে বাস থেকে নেমে মিনিট দশেক পায়ে হেঁটে ওরা পৌঁছে গেল মাতৃমা আবাসনের গেটে ,ঢুকেই ঢিমিঢিমি ঢাকের বোল তুলল হরেন। রুপু কাঁসরে তুলল কাঁইনানা বোল আর মালা মনের আনন্দে ঘুরেঘুরে নাচতে লাগল ।দেবী প্রতিমা একটু আগে মণ্ডপে ঢুকেছে ,ব্যানার্জি গিন্নি আর কিছু জন তদারকি করে দেবীকে প্রতিষ্ঠা করাচ্ছেন। একই সময় হরেন এর  আগমন ।বাচ্চারা ছুটে চলে এলো উপরের ফ্ল্যাট গুলো থেকে, একটা মালার বয়সী বাচ্চা মেয়ে ও ঢাকের তালে নাচতে থাকলো। মিনিট দশেক বাজিয়ে জয় মা বলে বাজনা বন্ধ করলো হরেন ।ব্যানার্জি গিন্নি আর বাকি সকলেরও বড় প্রিয় এই বাজনদারটি ।শুধু ভালো বাজায় তা নয় অভাবের সংসার হলেও নির্লোভ আর বড় ভালো স্বভাবের। ব্যানার্জি গিন্নি বললেন -আয় আয় হরেন ,বৌমা আর মিষ্টি লক্ষী গনেশকেও নিয়ে এসেছিস।খুব ভালো করেছিস। কত আনন্দ সাথে নিয়ে ঢুকলি এবার পুজো খুব ভালো কাটবে; জয় মা ।মালার সাথে ওই বাচ্চা মেয়েটির যার নাম নীরা ঝপ করে বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। নীরা মালাকে আবাসনটা ঘুরিয়ে দেখিয়ে দিল। মালা গর্বিত চোখের রূপুর দিকে তাকাচ্ছে ।রুপু গত বছর গড়ে তোলা বন্ধুটির এখনো দেখা পায়নি।

 অলোক বাবু ওদের থাকার ঘর দেখিয়ে দিল, একটু লজ্জা পাচ্ছিলেন তিনি ,সিঁড়ির তলায় এই ছোট ঘরটা ছাড়া আর অতিরিক্ত ঘর নেই ।চারজনের জন্য বেশ ছোট হবে ,অপেক্ষাকৃত ভালো ঘরটা ঠাকুরমশাই বরাদ্দ যিনি সন্ধ্যেবেলায় পৌঁছাবেন। হরেন বলল -না না বাবু কিছু অসুবিধা হবে না।

আমিই তো জোর করে সবাইকে আনলাম তোমাদের সাথে চার পাঁচ দিন আনন্দ করে থাকবো কোন কষ্ট নাই।

 সন্ধ্যাবেলায় পুটুলি থেকে মালতি কিছু সবজি আলু চারটে নারিকেল ব্যানার্জি গিন্নির হাতে দিয়ে বলল, মা আমাদের চাষের সবজি মায়ের পূজোয় লাগলে বড় খুশি হতাম। ব্যানার্জি গিন্নি চোখ পাকিয়ে বলল -বলিস কিরে মেয়ে তুই ঘর থেকে এত সতেজ সবজি বয়ে এনেছিস মায়ের জন্য, আর সেটা আমরা মাকে ভোগ দেব না,তা কি হয়?রাখ এখানে। এই সময় অলোক বাবু আমতা আমতা করে বলে ফেলল- কাকিমা মালতী  রাঁধে ভালো, রান্নার ঠাকুর তো রাতে চোখে কম দেখে বিশেষ কিছু করতে চায় না। সন্ধ্যার সময় লুচি সুজিটা আজ মালতী কে করিয়ে দেখতে  পারেন । ব্যানার্জি গিন্নি দাপুটে মানুষ, ভারী গলায় বললেন -থাম বাপু বাউরির মেয়েকে দিয়ে মায়ের ভো রাঁধাবো? আশেপাশের সবাই একটু অপ্রস্তুত মালতী  মাথা  নিচু করে দাঁড়িয়ে ।ব্যানার্জি গিন্নি বলে চললেন - সবাই তোমরা ভাবো কি ?আমি কি এতই আগের যুগে তোমরা ভেবে নিয়েছো মালতীকে আমি ভোগরাঁধতে দেব না, নারে মা মায়ের চোখে বামুন চাঁড়াল বাউড়ি সবাই ভক্ত ।।সবাই মায়ের সন্তান আর এই লক্ষ্মী মস্ত মেয়েটাকে আমি মায়ের কাজ করতে দেব না? মালতীর আনন্দে চোখে জল এসে যায়, ইতিমধ্যে রুপু তার পুরনো বন্ধুর সাথে আরও তিনটি সমবয়সী ছেলেকে পেয়ে গেছে ।চেয়ারে গোল করে বসে রুপু ওদের নিজেদের গ্রামের কথা শোনাচ্ছে আর ওরা অবাক বিস্ময় শুনছে -হ্যাঁরে রুপু তোরা পুকুরে নেমে মাছ ধরতে পারিস? আর একজন বলছে- হ্যাঁ রে গাছে উঠতে পারিস হাউ এক্সাইটিং। রুপু ওদের কাছে হিরো হয়ে গেছে ষষ্ঠীতে বোধনের শেষে মালতীর করা লুচি সুজির ভোগ মা কে নিবেদনের পর  সবাই অল্প করে প্রসাদ হিসাবে  পেয়েছে। ঘি দিয়ে করা মোহন ভোগ যেন ।মাইকে ভেসে আসছে যা দেবী সর্ব ভূতেষু। হরেন আর তার পরিবার একসাথে দাঁড়িয়ে দেবী কে প্রণাম করছে, প্রত্যন্ত গ্রাম আর কলকাতার আধুনিক আবাসনবাসীরা একসাথে মিশে গেছে দেবী বন্দনায়।

...(সমাপ্ত)...


No comments:

Post a Comment