1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, September 21, 2025

দাম্পত্য

ছবি : ইন্টারনেট

দাম্পত্য

রণজিৎ সরকার

ভারী ভাল লাগে মেয়েটিকে। ছড়া লেখার হাতটি বেশ মিষ্টি। মোবাইলে ওকে এখন অন দেখতে পাচ্ছি। মেসেঞ্জারে ‘হাই’ সেন্ট করার সাথে সাথেই  সাড়া দিল।

বলুন।’

কেমন আছ, ভাল আছ তো?’

ভাল আছি। আপনি?’

ভাল। আজ যে মোবাইলে রয়েছ সন্ধ্যে থেকেই, ব্যাপারটা কি?’

আজ শনিবার তো, কাল ছুটি। একটু অবসর, তাই বন্ধুরা কে কী পোস্ট করেছে দেখে নিচ্ছি আর কী।‘

জান,  আজ সকালে একটা গান রেকর্ড করেছি। হয়তো তোমার জন্য হয়েছি প্রেমে বন্য। একবার শুনবে নাকি? একচুয়ালি তোমাকে শোনাব বলেই গেয়েছি, বলা ভাল তোমার জন্যই গাইলাম।‘

ওমা, সে কী! কী ভাগ্যি আমার। এখুনি শুনে আপনাকে জানাচ্ছি।‘

খুব ভাল লাগা অনুভবে ছেয়ে গেলাম। মনে হল ও যেন পাহাড়ি ঝোরা। উপলখণ্ডে উছল  নাচের ছন্দে নেমে গেল। আগ্রহ নিয়ে বসে আছি। কখন তার বার্তা ভেসে আসে। এই আসে এই আসে, আসে না। অধৈর্য হয়ে উঠি। অদ্ভুত লাগছে নিজেকে। এ ভাবেও প্রেম ফিরে ফিরে আসে বুঝি। জানিনা। জানতেও চাই না। আপাতত একতরফাই  হোক। কোথাকার জল কোথায় গড়ায় সে না হয় পরেই ভাববো। অনন্ত সময় যেন বয়ে যাচ্ছে। বয়ে যাচ্ছে নাকি স্থবির পাথরের মত অনড় দাঁড়িয়ে আছে বুঝতে পারছি না। সময়ের ভার বোঝা হয়ে ঘাড়ে চেপে বসেছে যেন। এক সময় হতাশা এসে ঘিরে ধরে আমাকে। ও কি আমার সাথে ঠাট্টা করে সরে গেল! কী বোকা আমি! এই অসম প্রেম কি কখনো হয়? দুটি সন্তানের মা সে। বয়স আটত্রিশ। আর আমি? এই প্রান্তবেলায় এসে অপেক্ষায় আছি আর একটি প্রেমের। শরীরী না হোক, ঐশ্বরিক প্রেম---যাকে বলে প্লেটনিক লাভ হওয়া কি একেবারেই অসম্ভব! লোকে কি এটাকেই ভীমরতি বলবে? বলে বলুক, কী যায় আসে। মনের এই সব ভাবনার ভেতর মোবাইলে টিং করে নোটিফিকেশান ঢুকল একটা। আগ্রহ নিয়ে স্ক্রীণে চোখ রাখি। শিহরিত হলাম।

শুনলাম,এই গানটা কুড়ি বছর ধরে একজন শুনিয়ে আসছে আমায়। ভালই গেয়েছেন। অসাধারণ। গেয়ে যান হৃদয় দিয়ে।

ধুৎ, অসাধারণ না ছাই। শুধু মন রাখা কথা। আমি গান কোন দিন শিখেছি নাকি!’

গান না শিখেই তো গেয়ে দিচ্ছেন। আপনি প্রশিক্ষিতদের চেয়ে কোন অংশে কম নন।‘

কী বলছ! এত বড় কমপ্লিমেন্ট  কেউ আমাকে দেয়নি তো এর আগে।‘

আসলে এমন দরদ দিয়ে কখনো কাউকে শুনিয়েছেন? ভেবে বলুন।‘

এই রে, সত্যি করেই ভাবনায় ফেললে গো। বয়সকালের কথা তো অনেক দূরে ফেলে এসেছি।‘

সহসা বনির কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। ফার্স্ট ইয়ার ইকোনোমিক্সের বনি। শুরুতেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। নিষ্ঠুর ভগবান কদিনের জ্বরে ভুগিয়ে ওকে তুলে নিয়েছিল। তারপর তো এতগুলো বছর চলে গেল। কাউকেই মনে ধরল না । আর আজ এই প্রান্তসীমায় তুমি এলে পাঞ্চালী। কেন এলে বল তো? এবার সত্যিই কি আমার ভাসান হবে?

মেসেঞ্জারে টুং টুং করে কয়েকটা মেসেজ এলো পাঞ্চালীর।

কী হল, চুপ কেন?’

না না এই তো।‘

নিজেকে সামলে নিই। পুরনো দিনের ভাবনা নয় আর। নতুনেরে করি আহ্বান।

আমি যে একটা অনুরোধ করলাম----তুমি মোটেও আমার কথা শোন না।‘

ইঃ, মিথ্যুক কোথাকার। কোন কথাটা শুনিনা আপনার, হুঁ। আপনি কোন অনুরোধ তো করেননি।আর করলেও মনে তো পড়ছে না।‘

ওর কথাগুলো আন্তরিক হৃদয়কথন ভেবে মনে বেশ আনন্দ বোধ করছি। একটা নির্দোষ খুনসুটি করতে মন চাইল এই মুহূর্তে। পরক্ষণেই মনে হল, আপাতত থাক। আবার সুযোগ এলে না হয় দেখা যাবে। মুখে বললাম, ‘ ওই যে গো, কুড়ি বছর ধরে যে তোমায় গান শুনিয়ে আসছে, তাকে একটু দেখাবে না?’

ফেসবুকে আছে তো। সব সময় ওকে আমি ট্যাগ করি। ওর নাম অরূপ। আজকেও দেখুন পোস্ট আছে।‘

দ্রুত ওর প্রোফাইলে চলে গেলাম। ওর স্বামী নয়, ওকেই দু চোখ ভরে দেখতে থাকি। কম বয়সের প্রথম দেখার গুরু গুরু ডাক বুকের ভেতর টের পাচ্ছি। আবেগঘন মেঘ ছড়িয়ে পড়ছে আমার সারা মনে। স্ক্রীণশটে এডিট করে নিতে চাইলাম ওকে, কিন্তু নেয়া গেল না। মেসেজে জানান দিচ্ছে স্ক্রীণশট নেয়া যাবে না। আজকালকার ছেলে মেয়েরা বড় সাবধানী। অবশ্য ওরা ঠিকই করে। কত রকম মানুষ এই সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। এদের সকলকেই বিশ্বাস করার  যৌক্তিকতা নেই নিশ্চয়ই। এদের রুচি বা কুরুচির কথা তো প্রথমেই জানা সম্ভব নয়। সাবধানতার প্রয়োজন আছে বৈকি।তবুও যেন বিরক্ত হলাম। আমার প্রোফাইল তো পরিষ্কার। ফেক নয়। একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যায়। আমার সাথে খোলামেলা গল্প করাই যায়। পরক্ষণেই ভাবি এটা আমার একপেশে ভাবনা। আমার না হয় অখণ্ড অবসর। একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের শাখা-ব্যবস্থাপক হিসেবে অবসর নিয়েছি  বছর দুয়েক হল। পক্ষান্তরে পাঞ্চালীর তো অনেক দায়িত্ব রয়েছে। একটি উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষিকা সে। রয়েছে ভরভরন্ত একটি সংসার। সেখানে কি আমার ঢুকে পড়া উচিৎ? তবু মন মানে না যে। ছেলেমানুষ হয়ে পড়ি। ওর প্রতি যে আমি ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছি। মানসিক ভাবে ওর সঙ্গ চাইছি। এটুকু চাওয়ায় অন্যায় কোথায়।ও কি আমায় স্বীকার করে নেবে না?

কী হল, একেবারে স্পিকটি নট যে।ওকে দেখে বাক্য আর সরছে না তাই না?’

ঠিক তা নয়, তোমার থেকে চোখ ফেরানো সহজ কাজ নয় গো।‘

তাই। আপনি না সুন্দর বলেন। আমার রূপের প্রশংসা এত সহজে করে দিলেন যে, অবাক হচ্ছি।‘

যেটা সত্যি সেটাই তো বলেছি। কোথাও অতিকথন নেই। বিশ্বাস করতে পার।তা এত কম বয়সে বিয়ে করলে যে? বাবা জোর করে বিয়ে দিলেন বুঝি?’

না না তেমনটা নয়। ছোট্ট বেলার প্রেম তো। বেড়ে ওঠা এক সাথে।‘

একসাইটিং। সে সময়ের ফিলিংসগুলো কেমন ছিল? অনুভবে ছুঁতে কি পার?’

পারি তো।‘

আমার সাথে শেয়ার করা যায়?’

সরি, শেয়ার করলে সেই সুগন্ধ কী আর থাকবে!’

হয়তো ঠিক। থাকবে না, তবে আনন্দটা তো আবার ফিরে পেতে পার।‘

হয়তো। কিন্তু আমার দাম্পত্য আমি উপভোগ করি। থাক ওসব। এখন বলুন কেমন দেখলেন ওকে?’

দেখে তো বেশ শান্ত মনে হয়। সহজ সরল সাদাসিধে। আমার মত হুল্লোড়বাজ দামাল নয়।‘

আপনি যে দুরন্ত তা আপনার প্রোফাইল দেখে বোঝা যায়।‘

কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করি,’ কী রকম?

গুচ্ছ গুচ্ছ মেয়ে বন্ধু আপনার। তাদের নিয়ে ভালই কাটে, তাই না? আপনি যে গল্প লেখেন সেটাও জানি।আর এই যে আমার সাথে এত কথা হচ্ছে তার থেকেও আপনি যে গল্প খুঁজছেন সেটাও বুঝতে পারি।

চমৎকৃত হলাম ওর অনুভবে। কিন্তু পাঞ্চালী তুমি কি জান আমি আমার প্রেম খুঁজে ফিরি সকলের মধ্যে। আর সেই প্রেম কি সবার মধ্যে থাকে? থাকে না।অনেক সুন্দরীর সাথেই তো কথা বলেছি, কিন্তু প্রাণের আরাম পাই তো তোমার কাছ থেকেই। তুমি সুন্দরীর সুন্দরী। ওর অন্তর্দৃষ্টির কাছে ধরা পড়ে একটু যেন লজ্জাও পেলাম। কিন্তু ধরা না দিয়ে বললাম,’আমার কাছে আমার জীবনে মেয়েরা ভীষণ স্পেশাল। ওনারা বিভিন্ন রূপে এসে আমায় সমৃদ্ধ করেছেন। তুমিও তাদের মধ্যে অন্যতম। আমি তোমাদের সম্মান করি ভালবাসি। আই লাইক য়ূ ম্যাম।‘

পাঞ্চালী বলে উঠল,“জল যেখানে সোহাগ ভরে স্থলকে ঘিরে রাখে”

এমনি করে এমনি করে হৃদয় দিয়ে ঢাকে।‘

উৎসাহিত হয়ে উঠলাম ওর কথায়। এটাই বোধ হয় সেই মুহূর্ত।ওকে এখুনি ভালবাসার আবেদনে এবারে জড়িয়ে ফেলি। কী আর হবে, বড় জোর রাগ করবে।হয়তো এমন বলতে বারণ করবে। মনকে স্থির করে নিয়ে বলেই ফেললাম, ‘সামনে ধূসর বেলা জলচরের মেলা

সুদূর গ্রামের ঘর দেখা যায় তরুলতার ফাঁকে।‘

আমার অনেক সোহাগ তোমাকে ঘিরে থাকবে। অ্যাজ বিকজ আই লাভ য়ূ পাঁচি।‘

যাক লাইক থেকে তবে লাভ হল?’

হলো তো, তুমি এখন গ্রহণ করলেই বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়।‘

পাঞ্চালী চমকে উঠল, বলল,’কী বলছেন! এটা ভারী অন্যায়। আমাকে পরকীয়ায় উৎসাহ দিচ্ছেন?’

ক্ষতি কি, ওটা এখন আইনসিদ্ধ। ভয় কি!  এসো, এই আমার হাত দিয়েছি বাড়িয়ে।‘

ওকে ছেড়ে যাব? এত দিনের সম্পর্ক!

কীসের সম্পর্ক গো? সম্পর্ক একটা আপেক্ষিক শব্দমাত্র।জীবনের বৈচিত্র খুঁজে নেবার অধিকার সবার আছে।তুমি তাকে অস্বীকার করতে পার না।‘

আর আমার ছেলে মেয়ে?’

না, অতটা নিষ্ঠুর আমি নই। ওদের সাথে নিয়েই এস। ওরা আমার হৃদয় ভরে থাকবে।‘

এ তুমি আমার কী করে দিলে?ভীষণ দুষ্টু লোক তুমি!তুমি করে বললাম কিছু মনে করলে না তো?’

পাগলি একটা।‘

তুমি আমায় এমন করে পাগল কেন করলে? আর কী-ই-বা দেবার আছে আটত্রিশ বছর বয়সী একটি মেয়ের।

বয়স? ওটা তো একটা সংখ্যা মাত্র। দেখ আমাকে। বাষট্টি বছর বয়স আমার। চির তরুণ আমি। প্রেসার সুগার কোলোস্টোরেল লেভেল সব নরম্যাল। প্রতিদিন পাঁচ কিলোমিটার করে হাঁটি সকালে। বুঝলে?’

বুঝলাম তুমি এটলাস।  পৃথিবীর সব মেয়েদের ভালবাসা সংগ্রহ করে বোঝার মত মাথায় নিয়ে বইছ।‘

হা হা হা, এটা কিন্তু মন্দ বলনি।‘

 না গো আর না। অনেক্ষণ মোবাইলে আটকে আছি। যাকে ত্যাগ করতে বলেছো, সে এসে দরজায় দাঁড়িয়েছে দেখ। তার দাম্পত্য প্রয়োজন।‘

বিস্মিত হয়ে বললাম, ‘কী প্রয়োজন?’

দাম্পত্য গো দাম্পত্য। ও তুমি বুঝবে না। তুমি তো ব্যাচেলার।‘

মানে?’

আজ শনিবার কাল ছুটি। সব ওয়ার্কিং দম্পতির একটু ইয়ে, মানে দাম্পত্য পায় এই দিনে। বুঝলে বুড়ো খোকা? নাও চল তো, শুয়ে পড়বে।শরীর খারাপ করবে শেষে। কাল সকালে তোমার সাথে হাঁটতে বেরবো,ঠিক আছে? বাই।‘

কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ও অফ হয়ে গেল।ঠিক আছে, কাল সকালে তো কথা হবেই। অনেকদিন পর মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছে। আজ কি আর ঘুম হবে! বিছানায় শোয়ার আগে প্রতিদিন মোবাইল অফ করে শুই। আজ আর মোবাইল অফ করার কথা মনে রইল না।

     ভোর হয়ে এল । আলো ফুটছে সবে। কুসুম আলো।ধড়মড় করে উঠে বসি।ইস একটু যেন দেরি হল আজ। পাঞ্চালি কি ডেকে ফিরে গেল? মোবাইল টাকে আকড়ে ধরি। দ্রুত ওর মেসেঞ্জারে ঢুকে পড়ি। একি, ও তো মেসেঞ্জার ব্লক করে দিয়েছে! ঝড়ের বেগে ওর প্রোফাইলে গেলাম। এই প্রোফাইলটি উপলব্ধ নয় এখন। বুকটা দুমড়ে মুচড়ে ভেঙ্গে গেল। রঙ্গমঞ্চে আলো যেমন ধীরে ধীরে কমে গিয়ে অন্ধকার হয়ে আসে তেমনি আমার চারপাশ তমসাঘন।কাল রাতে জীবন সমুদ্রে আক্ষরিক অর্থে যে জোয়ার এসেছিল তা আর নেই। স্যান্ড ক্যাসেল ভেঙে সে ফিরে গেছে। বিষাদ সমুদ্র ওই পড়ে আছে দূরে।শুধু জেগে আছে ধু ধু নির্জন বালিয়াড়ি!

...(সমাপ্ত)...


No comments:

Post a Comment