1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, September 21, 2025

কোট নিয়ে কুট কচালি

 

ছবি : ইন্টারনেট

কোট নিয়ে কুট কচালি 

দয়াল বন্ধু মজুমদার

কোট, যাকে এখনকার ভাষায় বলে, ব্লেজার; তাই নিয়ে আমার কিছু গল্প আছে। আমরা যখন গ্রামে থাকতাম, মানে সেই ১৯৭৬ সালের আগে; আমাদের পরিচিত কাউকে কোট গায়ে দিতে দেখিনি। আমাদের শীতের পোশাক বলতে ছিল , একটা করে সুতির মোটা চাদর। সোয়েটারও সবার ছিল না। আমার প্রথম সোয়েটার গায়ে দেওয়ার প্রথম দিনটির কথা আজও পরিষ্কার মনে আছে। তখন ওয়েলিংটন স্কয়ারের পাশের ফুটপাথে বেশ জমজমাট ভুটিয়া বাজার বসত। কয়েক বছর আগেও দেখেছি, সেই রকম ভাবেই শীতের পোশাক, সোয়েটার, টুপী, মাফলার, চাদর এইসব নিয়ে, ভুটিয়া বা নেপালী মহিলারা অস্থায়ী দোকান সাজিয়ে বসেছে। আমি সেই ১৯৭৭ সাল নাগাদ, গ্রামের থেকে কলকাতায় এসে, উত্তর কলকাতার একটি স্কুলে ভর্তি হয়েছি। থাকি মেজদার সাথে, ধরে নিন মেসেই। দাদার রোজগারের উৎস কয়েকটি টিউশনি। বেশ টেনেটুনে চলত আমাদের। আমার কোন ফুলপ্যান্ট ছিল না। সাদা পাজামার উপর খদ্দরের পাঞ্জাবী গায়ে স্কুলে যেতাম। বাইরে বেরোতে হলেও ঐ একই পোশাক। শীত এসে গেলে দাদার মনে হল, একটা সোয়েটার কেনা দরকার। তখনকার যা বাসের ভাড়া বা মেসের খরচ ছিল, সেই অনুপাতে একটা হাফ সোয়েটারের দাম দশ বারো টাকার মত ছিল সম্ভবত। সোয়েটার এর বাজার এর কথা এখন আর মনে নেই। কিন্তু ঐ সোয়েটার কিনে গায়ে চাপিয়েই, ধর্মতলায় আমেরিকান লাইব্রেরিতে ঢুকেছিলাম। দাদা ওখানে প্রায়ই যেত। কিন্তু আমি সেই প্রথম। আমার মনে আছে, ভেতরে ঢুকে, দাদার পিছন পিছন এগিয়ে চলেছি; ভেতরের প্রায় সবাই আমার দিকে তাকিয়ে দেখছে। বেশ বুঝতে পারছিলাম, ঐ রকম অদ্ভুত পোশাক পরিহিত বস্তু লোকজন খুব একটা দেখেনি। আজকালকার দিন হলে হয়তো, বাংলাদেশ থেকে আসা জঙ্গি ভেবে নিত। সেই দিনটা আমার আরও বেশি করে মনে থাকার কারণ, ফেরার সময়, দোতলা বাসের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ফিরছিলাম। বেশ ভিড় ছিল। গুমোট গরম আর দুর্গন্ধে আমি বমি করে ফেলেছিলাম। দাদার সাথে, ঐ গলির অন্য প্রান্তের মেসের আর এক দাদা ছিলেন। ওরা আমাকে নিয়ে গিয়ে, ওদের মেসের একটা খাটে শুইয়ে রেখেছিল। সেই মেজদা , আমাদের সেই রাতের ডেরা থেকেই একটা চাকরী পেয়ে, ট্রেনিং নিতে কালিম্পং চলে গেল। বোধহয় মাস তিনেকের ট্রেনিং ছিল। আমি একাই সেই রাতের অস্তানায় থাকতাম, না কি সেজদা এসে আমার সাথে জুটেছিল, এখন আর মনে নেই। কিন্তু মেজদা ঐ, তখনকার দিনের সুদূর, কালিম্পং থেকে ফেরার সময় একটা সুন্দর কোট কিনে নিয়ে ফিরেছিল। দাম কত টাকা খরচ হয়েছিল জানিনা; কিন্তু কলকাতার থেকে চার পাঁচ ভাগের এক ভাগও দাম ছিল না ওটার। কিন্তু সেই অসম্ভব সুন্দর, ময়ূরকণ্ঠী রঙের কোট আমরা অনেক বছর গায়ে দিয়েছি। প্রথমে দাদা কয়েক বছর গায়ে দেওয়ার পর, আমি ওটা নিয়ে বাঁকুড়ায় হোস্টেলে চলে গেছলাম। আসলে ডাক্তারী পড়তে হোস্টেলে যাওয়ার আগে আমার কোন সোয়েটারও ছিল না, ফুল প্যান্টও ছিল না। ভাই হোস্টেলে থাকার জন্য যাচ্ছে, তাই আমার মেজদি খুব তাড়াতাড়ি একটা সোয়েটার বুনে দিয়েছিল। আর মেজদা বেশ কষ্টে টাকা জমিয়ে একটা নতুন প্যান্ট কিনে দিয়েছিল। আর একটা বোধহয় দাদার প্যান্ট দর্জির দোকানে আমার মাপে করে নেওয়া হয়েছিল। বাঁকুড়ায় প্রথম যেদিন গিয়েছিলাম, সেইদিন রাত্রে বাঁকুড়া থেকে দশ বারো কিমি দূরে, ঝাঁটিপাহাড়ির এক গ্রামে ছিলাম। জীবনে সেই প্রথম জেনেছিলাম, “ ঠাণ্ডায় হাড় কাঁপানো” কাকে বলে। সেই জন্যই বোধহয় দাদা তার সখের কোট আমাকে দিয়ে দিয়েছিল। অনেক বড় বড় মানুষের জীবনে আমার থেকেও অনেক বেশি দুর্দশা ছিল, পড়েছি। তাঁদের কেউ কেউ লিখেছেন, তাঁদের মা কিংবা ঠাকুমা নিজে না খেয়ে, একটাই রুটি ছেলে বা নাতিকে খাইয়েছেন। আমার মেজদা, আমাকে মানুষ করার জন্য কি কি আত্মত্যাগ করেছিলেন, আমি সব জানতেও পারিনি। আমার জীবনে সবথেকে বড় ব্যর্থতা, সেই দাদার মৃত্যুর সময় আমি তাঁর পাশে থাকতে পারিনি। সে এক চুড়ান্ত লজ্জার , চুড়ান্ত অসহায়তার কাহিনী।

 কোট এর গল্পে সেই সব কথা নাই বা বললাম। দাদার সেই কোট আমি বহু বছর গায়ে দিয়েছি। কিন্তু আমার যখন নিজের পয়সায় একটার জায়গায় দুই তিনটা কোট কেনার ক্ষমতা হয়েছে, তখন হয়তো সারা বছরে একদিনও কোট গায়ে দেওয়া হয়নি। কলেজে সেই কোট গায়ে কোনোদিন ক্লাশে যেতে পারিনি। কেন? এতদিন পরে ঠিক কারনটা মনে করে লেখাও সম্ভব নয়। তবে মনে হয়, তখন কোন ছাত্রকে কোট গায়ে দিয়ে ক্লাশে যেতে দেখিনি। কোন শিক্ষককেও সম্ভবত না। কোট গায়ে দেওয়া ছাত্র, ব্যপারটা একটু ব্যাতিক্রমী ছিল ; সেটা অনেক বছর পর এক দাদার কথায় বুঝেছিলাম। বোধহয় সেকেন্ড ইয়ারে পড়ার সময়, সরস্বতী পূজার ভাসানে আমি কোট গায়ে দিয়ে বেড়িয়েছিলাম। তখনকার মেইন হোষ্টেল ছিল কেন্দুয়াডিহিতে। পরে সে হোষ্টেল ফার্মেসি কলেজকে ছেড়ে দেওয়া হয়। কলেজের প্রধান পূজা ঐ মেইন বা ওল্ড হোস্টেলে হত। ওখান থেকে বাদ্যি বাজনা বাজিয়ে শোভাযাত্রা করে, এখনকার গোবিন্দনগরের সব হোষ্টেল ঘুরে তারপর হত ঠাকুরের ভাসান। আমি বোধহয় তখন ফাইন্যাল ইয়ার, বা পাশই করে গিয়েছি। ঐ দাদার সাথে ভালো করে আলাপ হল। উনিই বলেছিলেন, তোকে সরস্বতী পূজার ভাসান এর সময় কোট গায়ে দিতে দেখেছিলাম। অর্থাৎ একটি ছাত্র কোট গায়ে দিয়েছে, এটা বেশ চোখে পড়ার মত ব্যাপার ছিল। ঐ কোট নিয়ে আর যে কথাটা আজ প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর পরও মনে আছে; আমি আমাদের গ্রামের এক সান্ধ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখতে গেছলাম। আমার স্কুলের বন্ধু দুই তিন জনের সাথে পিছনে দাঁড়িয়ে গান শুনেছিলাম। আমাদের মাধ্যমিক ব্যাচের একমাত্র ছাত্রী সুনন্দা গান গাইছিল। পরে বন্ধুদের কাছে বলেছে, আমাকে স্টেজ থেকেই লক্ষ করেছে। বোধহয় আমার সাথে কথা বলার ইচ্ছা থাকলেও, সামনে এগিয়ে আসতে দ্বিধা করে আসতে পারেনি। সেটা শুধু ঐ “কোট গায়ে দেওয়া বাবু হয়ে গেছে” বলেই। তারপর আর কোনদিন সুনন্দাকে আমি দেখিনি।

ডাক্তারী পড়া শেষই করতে পারতাম না, মেজ বৌদি তাঁর গয়না বন্ধক রেখে শেষ বছরের টাকা জোগাড় করে না দিলে। ছয়শ টাকার হাউস স্টাফ, তারও দেড়শ টাকা করে মাসে ঐ বন্ধক রাখা গোল্ড লোন পরিশোধ করতে ব্যাংকে জমা দিতে হয়। সেই দুর্দশার দিনেও ঐ ময়ূরকণ্ঠী কোট গায়ে একটা চাকরীর ইন্টারভিউ দিতে মেদিনীপুরে এসেছিলাম। মাত্র সাত মাস করেই সেই অতি সাধারণ, দাতব্য প্রতিষ্ঠান এর চাকরী ছেড়ে কলকাতায় চলে এসেছিলাম। কিন্তু সেই দুর্দিনে ঐ চাকরীটাও বেশ দরকার ছিল। কিন্তু ঐ কোটের ব্যপারটা যে আজও মনে আছে, তার দুটি বিশেষ কারণ আছে। কলকাতার তখনকার দিনের দাপুটে এক বয়স্ক ডাক্তারবাবু আমার ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন। পরে ওনার সাথে কাজ করার সময় উনি আমাকে জানিয়েছিলেন, কোট টাই পরে আসা ছেলেটাকে দেখেই ওনার খুব ভালো লেগেছিল। পরবর্তী কালে কলকাতার শেরিফ হওয়া সেই ডাক্তারবাবু বহু বছর আগেই গত হয়েছেন। কিন্তু আমার প্রথম “ বস” , আমার পরবর্তী অনেক সত্যি বসের থেকে অনেক বেশী স্মার্ট ছিলেন, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

আমার প্রথম বস

 ঐ কোট গায়ে ইন্টারভিউ দিতে আসার ব্যপারটা আরও একজনের চোখে পড়েছিল। আমি হোষ্টেল ছেড়ে চলে আসার কথা বলতে গেছলাম, আমাদের খুব প্রিয় জয়ন্ত বসু স্যারকে। স্যার বললেন, আপনাকে কোট টাই পরে রিক্স করে স্টেশনের দিকে যেতে দেখেই বুঝেছিলাম, কোথাও ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছেন। ঐ প্রথম কোট নিয়ে অনেক গল্প জমে ছিল। এখন আমি,  কোটের কুট কচালী “ কেন শিরোনাম দিয়েছি, সেটাই বলি। ঐ যে সত্যি বসের উল্লেখ করেছি, তাঁদের নিয়ে কিছু বলি। আমার প্রথম সরকারী চাকরীর বস, মানে সেই জেলার CMOH সাহেব এখন আর ইহ জগতে নেই। উনি বেশ কবি কবি স্বভাবের মানুষ ছিলেন; আমি যতোদিন ওনার জেলায় কাজ করেছি, কোনোদিন ওনাকে রাগতে দেখিনি। আর যা দেখিনি, সেটা হল, ওনাকে কোনোদিন কোট গায়ে দিতে দেখিনি। আর সেই জন্যই CMOH অফিসে কোনোদিন কোট গায়ে দিয়ে যাইনি। অবশ্য তার অনেক আগেই আর এক CMOH কে দেখেছি। আমি তখন সিংহের মত কেশর ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াই। চোখ অপারেশনের শিবিরে রুগী দেখা বা সার্জেন হয়ে যাওয়া, সব সময় কোট টাই পরে “ Lion” হয়ে যাই। কোটের কলারে Lions pin লাগালেই বেশ নিজেকে সিংহ সিংহ মনে হয়। শহর থেকে মাইল পনের কুড়ি দূরের এক স্কুলে চোখ অপারেশন এর শিবির করা হয়েছে। সেই শিবিরে আমিই প্রধান সার্জেন। শিবির উদ্বোধন করতে গিয়ে, স্টেজে আমার পাশেই বসেছেন, জেলার CMOH. পুরো সময় যেভাবে আমার নতুন ব্লেজারটি পর্যবেক্ষণ করলেন, ( ওনার সুনাম অনুযায়ী) আমাকে যে সন্ধ্যায় একবার

ওনার বাংলোয় দেখা করতে বলেননি, সে শুধুই আমি তখন সরকারী চাকরী করতাম না বলেই। কিন্তু চাকরী না করেও যে, চাকরী করা সরকারী ডাক্তারদের ঈর্ষার কারণ হয়েছিলাম, শুধু ঐ কোট টাই পরে চেম্বারে যাওয়ার কারনে। মেদিনীপুর থেকে বালিচকে যেতাম , সপ্তাহে একদিন করে। খুব ভালো কিছু প্র্যাকটিস ছিল না। একই নার্সিং হোম এ যেতেন একজন স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ আর একজন ডেন্টিস্ট। ওরা দুজনেই আমার থেকে বয়সে বড়। একদিনই কি একটা যোগাযোগ হয়েছিল, আমরা তিনজনই এক সময়ে ওখানে হাজির। ঐ দুইজন, আমার কোট টাই বাঁধার ব্যাপারটাকে নিয়ে নিজেদের মধ্যে বেশ ট্যারা বাঁকা আলোচনা শুরু করে দিল। আর সেটা আমাকে পরোক্ষে শোনানোর জনই।

জুনিয়ার ডাক্তারদের আন্দোলন এর সময় “ শিরদাঁড়া” কথাটাই একটা বিরাট রাজনৈতিক অভিঘাত নিয়ে এল। অন্তত পঁচিশ বছর আগেই আমি আমার জুনিয়রদের বলতাম,’ সরকারী চাকরী করতে এসেছো, শিরদাঁড়াটি বাড়ীতে বাবার কাছে রেখে আসতে হবে!’ অনেক বড় বড় “হনু” দেখেছি , ঐ চাকরী করতে গিয়ে। মুখে স্বীকার করতো না, কিন্তু বেশ বোঝা যেত, শিরদাঁড়াটি বাড়িতে রেখেই এসেছেন। আমিও আমার ঐ অঙ্গটি এবছরই একত্রিশে মার্চ বিকেলে আবার শরীরে জুড়ে নিয়েছি। যে কথা থেকে অনেকটা সরে আসতে হল; সেই প্রথম সরকারী চাকরীর বসকে দেখার পর থেকেই, সরকারী আপিসে কোট গায়ে দিয়ে যেতে কুন্ঠা হতে শুরু করে। অবশ্য নিজে একটা “ নিধিরাম সর্দার” আমলা থাকার সময় মাঝে মাঝে আপিসে কোট গায়ে দিয়ে যেতাম। (আমার “ নিধিরাম সর্দারের আমলাগিরি” লেখাটা আজই সকালে চোখে পড়ল। নতুন কিছু খবর দিয়ে ওটা আবার আপনাদের পাঠার্থে দেব। ) পরেও বেশ কয়েকটি জেলার বস আর হাসপাতালের বসের কাছে কাজ করার সৌ অথবা দুর্ভাগ্য হয়েছে। সব সময়ই মনে হয়েছে, বসই তো কোট গায়ে আসেন না, আমি কোট গায়ে দিয়ে গেলে সেটা ভালো দেখায় না। অবশ্য শীত কালে বনের মোষ তাড়ানোর জন্য গ্রামে গঞ্জে গেলে, কোট গায়ে দিয়েই যেতাম। সেখানে তো আমিই বস। আসলে কোট টাই পরে সাহেব সেজে না গেলে, শ্রোতারা অনেক সময় সাপুড়ে আর সাপ কামড়ের  ডাক্তার আলাদা করতে পারে না। অবশ্য গ্রামের আধা শিক্ষিত মানুষ বলে নয়, অনেক ডাক্তারকেও দেখেছি, অন্যদের কাছে বলে , “ মজুমদার তো বন জঙ্গলে সাপ ধরে বেড়াচ্ছে!” আমার এই বিষয়টাকে বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা বহু বছর আগেই “ Neglected Tropical Disease” বলে চিহ্নিত করেছে।

সাপ কামড়ের অনুষ্ঠান করতে , কোট গায়ে

আমরা যারা এর সাথে যুক্ত, তারাও যে “ অবহেলিত” সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু আমার এই মোষ তাড়ানোর কাজের জন্যই, বার দশেক দূরদর্শনে অনুষ্ঠান করেছি। ওদের ওখানে বসে বলার সময় কোট গায়ে দিয়ে বসলে কিছু কাজের সুবিধা হয়। ওদের কলার মাইক্রোফোনটি কোটের ভেতর দিয়ে নিয়ে, টাই এর সাথে আটকানো যায়। এ ছাড়াও, ঐ যে বললাম, নিজেকে সাপুড়েদের থেকে আলাদা বোঝাতেও কোট টাই পরে অনুষ্ঠান করতে ইচ্ছা করে। সব শেষ যেদিন দূরদর্শনে অনুষ্ঠান করতে গেছলাম, আমরা সাথে আরও দুজন বেশ বড় ডাক্তারবাবু ছিলেন। আমি আমার দশ বারো বছর অনুষ্ঠান করার অভ্যাস মত, কোট টাই পরেই গিয়েছি। আসলে, একেবারে শীতকাল না হলে, ব্যাগে ভরে নিয়ে যাই; ওখানে পোশাক পাল্টে নেওয়ার সুযোগ আছে। ঐ দুই বড় ডাক্তারবাবুর একজন একটি মেডিক্যাল কলেজের বিভাগীয় প্রধান। আর অন্যজন, রাজ্যের স্বাস্থ্য দপ্তরের সর্বোচ্চ পদাধিকারী। বিভাগীয় প্রধান তো আমাকে ব্যাগ থেকে কোট টাই বের করে পরতে দেখে একটু অপ্রস্তুত হয়েই বললেন, আমি এখানে বলতে এলে এই কালো, হাতকাটা জ্যকেটটাই পরি। কিন্তু রাজ্যের সর্বোচ্চ পদাধিকারী একটি হাফ হাতা জামা গায়েই হাজির হয়েছিলেন। অত্যন্ত সম্মানীয় পদে আসীন মানুষ, তাই কিছু বলতেও পারলাম না। বলা দরকার ছিল, স্যার, আপনি একটু কোট টাই পরেই এসব অনুষ্ঠানে আসবেন।

সব শেষে আমার আর এক বসের মানসিকতা বলেই কোটের কুট কচালী বন্ধ করতে চাই। আমার এই বস, মূলত দূরদর্শনে অনুষ্ঠান করেই বেশ বিখ্যাত হয়েছিলেন। ওনার সাথে দেখা হওয়ার অন্তত পনের বছর আগে থেকেই ওনার নাম চিনি। আমারও ধারণা ছিল, উনি একজন বিশাল জ্ঞানী মানুষ। একসাথে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, আমরা যা বুঝতে না পেরে ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম, উনি সেটা আমাদের থেকেও কম জানেন। সেসব কথা প্রকাশ্যে বলাও নিম্ন রুচির পরিচয় হবে। উনি নিজে কিন্তু কোট টাই পরে, বেশ ফিটফাট হয়ে আসতে পছন্দ করতেন। আমি কোনদিন ওনার দপ্তরে কোট গায়ে যাইনি। সেই প্রথম CMOH থেকেই ঐ অভ্যাসটি রপ্ত করেছিলাম। একবার ওনাকে নিয়ে হাবরায় একটি শিবিরে যাবো। উনি বাইরে চেম্বার করে , এদিক থেকেই গাড়ীতে উঠবেন। আমি সকাল সকাল কোট টাই পরে, ওনাকে নিতে একটি নার্সিং হোমে হাজীর হয়েছি। গাড়ী আসতে মিনিট দশেক দেরী। তার মধ্যে উনি আমার কোটটি খুঁটিয়ে দেখেছেন। বললেন, তোমার কোটটা বেশ সুন্দর। আমি জানালাম, ওটা পঁচিশ বছরের পুরনো। ভালো কথা। এটা কিন্তু মেজদার সেই ময়ূরকণ্ঠী কোট নয়। এটা আমি ১৯৯২ সালে , কলকাতার একটি নামি দোকান থেকে কিনেছিলাম; আজও বেশ ভালো আছে। এই বসের পরবর্তী একটি ব্যাপারে একটি মন্তব্য আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে যে, সেদিন উনি আমার কোটের প্রশংসা করলেও, আসলে উনি আমার ঐ স্মার্ট ড্রেস পছন্দ করেননি। এই ব্যাপারটি আমার ভ্রাতৃপ্রতীম পাঠকদের ভবিষ্যতে মাথায় রাখতে বলছি। উচ্চ পদের বেশ কিছু মানুষ, কতোটা প্রতিহিংসা পরায়ণ হতে পারেন, এই একটি মন্তব্যেই পরিষ্কার। বাম আমলের থেকেই বি এস সি, এম এস সি করা অপ্টোমেট্রিস্ট দের দাবী ছিল, তাঁদের সরকারী চাকরী দিতে হবে। এখনও কিছু অপ্টোমেট্রিস্ট সরকারি হাসপাতালের চাকরীতে অছেন; এনারা সবই ডিপ্লোমা করে চাকরীতে যোগ দিয়েছিলেন। সরকারি ভাবেই অনেক বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে অপটোমেট্রির ডিগ্রী, মাষ্টার্স কোর্স চালু করা হয়েছে। কিন্তু আজও ওদের জন্য কোন সরকারী চাকরীর ব্যবস্থা হয় নি। ওদের একটি প্রতিনিধি দলের সাথে আলোচনা করার জন্য একটি কমিটি করে, দায়িত্ব দেওয়া হয় আমার ঐ বসকে। উনি পরদিন আমাকে বলেছিলেন, “ বাপরে , সব একেবারে কোট টাই পরে সাহেব সেজে এসেছে। এদের দিয়ে কি কাজ হবে! আমি একেবারেই না করে রিপোর্ট দিয়ে এলাম।” এত বছর পর বেশ বুঝতে পারছি, সরকার আদৌ এদের জন্য কিছু করতে চায় না। কিন্তু ঐ ‘ কমিটির রিপোর্ট ‘ দেখিয়ে সব সম্ভাবনায় জল ঢেলে দিয়েছে। অর্থাৎ ওদের শিক্ষা, ওদের যুক্তি যুক্ত দাবী, সরকারি হাসপাতালের কাজের জন্য ওদের বাস্তব প্রায়োজন, এসবের থেকেও ওদের পোশাক আসাক বেশী বিবেচ্য ছিল। তাই স্মার্ট আর ওভার স্মার্ট এর সুক্ষ্ম তফাৎ বুঝে পোশাক পরাটা খুব জরুরী। অন্তত একটি ভালো খবর দিয়ে এই প্রসঙ্গ শেষ করি। বছর পাঁচেক আগে আমার নিজের কন্যা, বিদ্যুৎ ভবনে ইঞ্জিনিয়ার এর চাকরীর ইন্টারভিউ দিতে গেছল। আমি নিজে ওকে, শাড়ির উপর আমার সেই ১৯৯২ সালের কেনা, নেভী ব্লু ব্লেজার পরে যেতে বলেছিলাম। ও সেই চাকরী বছর দুই করে ছেড়ে দিয়ে, কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরি নিয়েছে। আমার পরের দুটি কোটের একটি, কলকাতার নামকরা দোকানে তৈরী। কিন্তু আর একটি করেছেন, আমার প্রিয়, মুস্তাফা দর্জি।




No comments:

Post a Comment