ঢেউ ভাঙছে, ঢেউ গড়ছে। আমার গলায় ঘামাচিরা বিদ্রোহ করছে৷
কার বাচ্চা চিল্লাচ্ছে। কারা সব ঝগড়া করছে, কেউ বা বিস্কুট খাচ্ছে, "ঘিয়ে
ভাজা" শীর্ণ লোম উঠে যাওয়া কুকুর করুণ দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে৷
পৈতে
পরা দোকানী চা বানাচ্ছে৷ পৈতেটা মেনশন করলাম কারণ ব্রাহ্মণত্ব ঘোচে না।
[যখন কোনো ব্রাহ্মণ ছোটো দোকান চালায় তখন মনে হয় একদিন তোর বাবার বাবার
বাবা ব্রাহ্মণ হওয়ার গর্বে না জানি কত লোককে ছোটোলোক বলেছে। ]
এটা
ওল্ড দীঘার সী হক হোটেলের পিছনের দিক। এখান থেকে সমুদ্র দেখা যায়। ঘরে
বসেই। হোটেলের বাইরে একটা ছোটো চায়ের দোকান। লিকার চা সাত, দুধ চা আট৷ আমরা
মা তে মেয়েতে চিনি কম হালকা আদা দিয়ে দুকাপ চা খেয়ে (পান করে) বললাম
"বাহ"।
তথাকথিত সস্তার পাতা দিয়ে এত ভালো লিকার চা আমিও বানাতে পারব না (মায়ের ব্যাপারটা জানিনা)। আমরা
টোটাল চার কাপ চা খেয়ে, দাম মিটিয়ে ডিম টোস্ট দর করে দশ পা দূরে গিয়ে একটা
জায়গায় বসলাম। যেখানে গিয়েছিলাম, বসে ভালো লাগেনি। ব্যাক টু
চায়ের দোকান সেখানে কনক্রিট পেরিয়ে কালো কালো বোল্ডারের উপর গিয়ে বসলাম।
সেখানে বোল্ডার অনুভূমিক রয়েছে।
ডিম টোস্ট, একটা দুধ চা, একটা লিকার চা। বসে
আছি লিকার চা এল। মা গুণগুণ করে গান করছে। আমি সদ্য ঘটা একটি জন্ডিস কেসের
কথাটা মাকে বিশদভাবে জানাচ্ছি। ওমা! কী সুন্দর ডিম ভাজার গন্ধ। আমি নাচতে
নাচতে চলে গেলাম৷ ভদ্রলোক বললেন আমি দিয়ে আসব৷ বাহ্ হোটেল নাকি!
একদিকে
ছেড়ে রাখা চটি, জুতো, তারপর চায়ের কাপ, মা মেয়ে, বোল্ডার, বালি আর অনন্ত
বিস্তৃত সমুদ্র। " কূল নাই, কিনার নাই"৷ ঠান্ডা হাওয়া। মাকে বলছিলাম কাছেই
বৃষ্টি হচ্ছে৷
ভেসে আসা ডিম ভাজার গন্ধ থালায় এসে হাজির, হাজির ঘন দুধে কম মিষ্টি একটা দারুণ চা।
ভদ্রলোক নিজে এসে বললেন "আপনারা
মা মেয়ে তো? এক ছাঁচে তৈরি মুখ। দেখুন দিদি এই যে একটা সন্ধে আপনারা
সমুদ্রের পারে এই কালো পাথরের উপর বসে চা খেলেন, ডিমটোস্ট খেলেন --এটাই
একটা গল্প হতে পারে। বাড়িতে ফিরে বলতে পারবেন একটা সন্ধে কাটিয়েছিলাম।"
কী
আর বলব! চুপ করে হাসছিলাম। ভদ্রলোকের বাড়ির কথা, বৌ - ছেলে - মেয়ের কথা
বললেন, বললেন নির্ভয়ে বসে থাকুন দশটা অবধি৷ উনি দরজা বন্ধ করছিলেনই। হঠাৎ
চায়ের কাপে এক ফোঁটা জল পরল৷ জল পরল আমার কানে। মায়ের চশমায়, আামদের জুতোয়,
কালো পাথরে...
ভদ্রলোক চায়ের গ্লাস আর থালা সব তুলে নিতে এসে বললেন "এবার উঠে পড়ুন, বৃষ্টি নামবে "।
বঙ্গোপসাগরকে বাঁহাতে রেখে আমরা পূর্ব থেকে পশ্চিমে হেঁটে যাচ্ছি৷ দমকা হাওয়ায় কারেন্ট চলে যায়। আকাশে চাঁদ নেই, তারা নেই। কালো সমুদ্র তাতে সাদা ঢেউ হাতে হাত ধরাধরি করে এগিয়ে আসছে। কালোপাথরে কম্পাস দিয়ে মা ও মেয়ের নাম লিখে আসিনি৷ তবুও মুহূর্ত তৈরি হয়, বিন্দু বিন্দু মুহূর্ত দিয়ে একটা সুন্দর জীবন তৈরি হয়৷ দোকানওয়ালার নাম জিজ্ঞেস করা হয়নি৷ আবার যাবো। আবার দেখা হবে৷ হয়ত চিনতে পারবে৷ হয়ত পারবে না তবুও মুহূর্তরা এভাবেই গড়ে ওঠে।
লেখিকা - সাওনি মুখার্জি
shaonimukherjee21@gmail.com
No comments:
Post a Comment