...শুভ্র কান্তি দাস
রোজ সকালে প্রায়
জোর করে ঘুম থেকে উঠে কোনো রকমে বাজারে। আর বাজারে গিয়ে রোজই কারো না কারোর সঙ্গে খটামটি লেগেই যায়। হবে নাই বা কেন
? তখনও ঠিক মতো ঘুমের ঘোর
কাটেনি আর তার মধ্যেই বাজারে গিয়ে বিরক্তিকর দর কষাকষি। বাড়ি ফিরে মেয়ের পড়াশোনা
নিয়ে হাজার রকমের অভিযোগ। তারপর কোনো রকমে নাকে-মুখে গুঁজে অফিস। বিকেলে আবার
ক্লান্ত শরীরে বাসে ধস্তাধস্তি করে বাড়ি ফেরা। আর বাড়ি ফিরে আবার গিন্নির সঙ্গে
কিছু না কিছু নিয়ে ঝামেলা অশান্তি। এক্কেবারে একঘেয়ে হয়ে উঠেছে জীবনটা। মেজাজটা
হয়ে গেছে একদম কোষ্ঠ-কাঠিণ্য হওয়া ষাটোর্ধ
বুড়োর মতো খিটখিটে। আর পারা যাচ্ছে না। একটু বদল চাই। ভাবলাম সপরিবারে একটু
বেড়িয়ে আসি। কিন্তু বেড়াতে গেলেও তো আবার সেই গিন্নির হুকুমদারি অথবা ন্যাকামো
মাখা বাজে আবদার। ধুরঃ ছাই! কিচ্ছু ভাল্লাগছে না।
সেদিন দুপুরে
সৌরভ ফোন করেছিল। সৌরভ আমার পুরনো অফিস কলিগ। ওকে আমি ভাই ডাকি। ও এখন বিষ্ণুপুরে
থাকে। বাঁকুড়া জেলা। ওর এখন বিষ্ণুপুরেই পোস্টিং। আমার থেকে অনেক ছোটো ও, এখনও অবিবাহিত। বিষ্ণুপুরে একটা মেসে থাকে।
কথায় কথায় বলল একবার বিষ্ণুপুর বেড়াতে যাওয়ার জন্য। বলল, ওর ওখানে ঘোরার অনেক জায়গা আছে। আমার মাথায়
যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল।
তরিঘরি বসের কাছে
চলে গেলাম ছুটির জন্য। ছুটির কথা বলতে বস এমনভাবে আমার দিকে তাকালেন, মনে হল যেন আমি ওনার হৃদপিন্ড চেয়েছি। আসলে
কয়েকদিন আগেই ওনার সঙ্গে আমার একটু মন কষাকষি হয়ে গেছে। কিন্তু তবুও তাছ্যিলের
দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন যে কবে আর ক'দিনের ছুটি লাগবে। আমি বেশ আমতা আমতা করে বলে
ফেললাম যে, "না মানে আসলে
আমার স্ত্রী কি যেন একটা বলছিল, ওর এক আত্মীয়ের
বাড়িতে কি যেন একটা অনুষ্ঠান আছে"। এবার বস জানতে চাইলেন তারিখটা কবে। আমি
সব গুলিয়ে ফেলে বলে ফেললাম "আমি একটু স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করে বলছি স্যার
"।
মাসটা তখন
ডিসেম্বর চলছে। বাইরে বেরিয়ে মোবাইল ফোনে ক্যালেন্ডার দেখলাম। সামনেই বড়ো দিন।
দেখলাম ২৪ শে ডিসেম্বর রবিবার, ২৫ শে ডিসেম্বর
সোমবার এমনিতেই ছুটি। ভাই সৌরভকে ফোন করে একটু আলোচনা করে ঠিক করলাম যে তাহলে আর
একটা দিন, মানে শুধু ২৬ শে
ডিসেম্বর দিনটা ছুটি নিলেই হয়ে যাবে। আবার গেলাম বসের ঘরে। মাত্র একদিন ছুটি
চাইলাম বলে বস তো এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন।
এবার বাড়িতে
কিছু একটা বলতে হবে। বললাম অফিসের কাজে দু'দিনের জন্য বাঁকুড়া যেতে হবে। আমার বউ আমার বসকে দু'একটা গালাগাল দিল মাত্র। কারণ ছুটির দিনে ওদের
নিয়ে কোথাও না কোথাও যেতেই হতো। আর কোথাও না হলে নিদেন পক্ষে শ্বশুর বাড়ি তো আছেই।
যাইহোক, দুই তরফেরই ছুটি মঞ্জুর।
সালটা ছিল ২০১৭,
ডিসেম্বর মাসে ঠান্ডাও
ভালোই পড়েছে। বউ তো নিজে থেকেই শীতের পোশাক ঠিকঠাক মতো গুছিয়ে দিল। ২৩ শে
ডিসেম্বর শনিবার। সেদিন সব জিনিসপত্র গুছিয়ে বাইক নিয়ে অফিসে বেরোতে দেখে বউয়ের
মুখ-চোখের প্রশ্নটা বুঝতেই পারলাম আর তাই হঠাৎ বাইক নিয়ে অফিস যাওয়ার কারণ
স্বরূপ বলে দিলাম যে অফিসের কাছে যে দোকান থেকে বাইক সারাই সেখানে সার্ভিসিং-এর
জন্য রেখে যাবো। এসব বুঝিয়ে দিলাম তো ঠিকই, কিন্তু বউয়ের মন থেকে সন্দেহ দূর করতে পারিনি।
তবে আমার তখন একটাই কথা মনে হচ্ছিল - "একবার পালাতে পারলে বাঁচি"।
তাড়াতাড়ি অফিস
থেকে বেরিয়ে পড়লাম। এবার বাইক চালিয়ে বাঁকুড়ার দিকে। বিয়ের আগে খুব ইচ্ছে ছিল
যে, বাইক নিয়ে দূরে দূরে
বেড়াতে যাব। দু'একটা ছোট্ট ভ্রমণ
করেছি। এবারে আপাতত বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে ভাই সৌরভের কাছে। আজকে রাতে ওর কাছেই ওর
মেসে থেকে যাব। কালকে কোথায় যাব সেটা কাল সকালেই ঠিক করব।
অন্ধকার আমার
খুবই পছন্দের। আর জঙ্গলের নিস্তব্ধতা উপভোগ করতে খুব ভালোবাসি। আজ দুটোই একসঙ্গে
পেয়ে গেলাম। লোভ সামলাতে পারলাম না। রাত তখন প্রায় সাড়ে আটটা। দাঁড়িয়ে পড়লাম
জয়পুর জঙ্গলের পথে। মাঝে মাঝে একটা দুটো গাড়ি সেই নিস্তব্ধতা ভেঙে দিলেও শহরের
নিয়ন আলোর বদলে জোনাকির আলো আর ঝিঁঝি পোকার ডাকে একটা মায়াময় পরিবেশ তৈরি
হয়েছিল, মনে হয় আমার
জন্যই ওরা অপেক্ষা করেছিল। সম্বিত ফিরতে মনে পড়লো বিষ্ণুপুরে আমার জন্য আমার সৌরভ
অপেক্ষা করে আছে। তাই আবার বাইক চালু করে দিলাম।
জয়পুর ফরেস্ট
থেকে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বিষ্ণুপুর পৌঁছে গেলাম। ভাইয়ের মেসের কাছে গিয়েই একটা
বাড়তি পাওনা পেলাম। এখানে এখন "বিষ্ণুপুর মেলা" চলছে। বিরাট মেলা ,
৩০ বছরের পুরোনো। কোনো
রকমে মেসের ঘরে জিনিস পত্র রেখে মেলায় চলে গেলাম। এই মেলায় কলকাতা থেকে এবং
মুম্বই থেকে বিভিন্ন গায়ক ও অভিনেতা আসেন। আজকে এসেছে জিত গাঙ্গুলি। আর একটা নতুন
জিনিস দেখলাম মেলায় , চপ শিল্প। প্রচুর
চপের দোকান , অনেক রকমের চপ
বিক্রি হচ্ছে। জিত গাঙ্গুলির গান শুনে মেলা থেকে চপ আর আমার প্রিয় জিলিপি খেয়ে
মেসে ফিরে এলাম।
২৪ শে ডিসেম্বর,
রবিবার। সকালে ঘুম থেকে
ওঠার কোনো তারা নেই, বাজারে যাবার
বালাই নেই। অতএব বেলা পর্যন্ত ঘুম। প্রায় নটা নাগাদ সৌরভের ডাকে ঘুম ভাঙল। মুখ
হাত ধুয়ে দুই ভাই বেড়িয়ে পড়লাম বিষ্ণুপুর দেখতে। বিষ্ণুপুর সম্পর্কে আগে
শুনেছিলাম অনেক। আজ স্বচক্ষে।
পুরনো বাংলার
ইতিহাস। সেই টেরাকোটার, মানে পোড়া মাটির
ভাষ্কর্য। কিছু কিছু ভগ্ন প্রায়, আর কিছু কিছু বেশ
ভালো অবস্থাতেই আছে। কি নিখুঁত কাজ। সত্যি, নিজের চোখে না দেখলে হয়তো বুঝতেই পারতাম না যে
এতটা সুন্দর। সারাদিনটা কিভাবে কেটে গেল, বুঝতেই পারিনি।
সৌরভের মেসে একটি
সাঁওতাল ছেলে থাকত। বিকেলের দিকে ওকে সঙ্গে নিয়ে তিনজন মিলে বিষ্ণুপুর থেকে
কিছুটা দূরে একটা সাঁওতালী গ্রামে বেড়াতে গেলাম। ওই গ্রামে সাঁওতাল ছেলেটির
আত্মীয় আছে। সেখানে গিয়ে ওদের সঙ্গে বেশ ভালোই বন্ধুত্ব জমে উঠেছিল নিমেষে। ওরা
নিজেরা সাঁওতালী ভাষায় কথা বললেও বাংলা বেশ ভালোই জানে।
নতুন বন্ধুদের
সঙ্গে গ্রামে ঘুরতে ঘুরতে চলে গেলাম ওদেরই একজনের বাড়িতে। সেখানে মহুয়া পাওয়া
যায়। মহুয়া সম্পর্কে শুনেছিলাম আগে, কিন্তু এর আগে মাত্র একবার মহুয়া ফলটাই শুধু দেখেছিলাম। কিন্তু মহুয়ার রস
খাওয়ার সুযোগ হয়নি কখনো। তাই এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম মহুয়া খেতে।
তখন রাত নেমে
এসেছে। আমরা জনা দশ-বারো বন্ধু এক জায়গায় জমায়েত। সকলেই মহুয়ার মিষ্টি নেশায়
নেশাতুর হয়ে বিভিন্ন গল্পে মশগুল। আমি শুধু নিস্তব্ধ নিরিবিলি রাত্রির মোহে বিভোর
হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে স্বস্তির খোঁজ করে চলেছি। বাড়ির কোনো অশান্তি নেই,
অফিসের কোনো ঝামেলার
বালাই নেই, ফোনে নেটওয়ার্ক
না থাকায় ফোনে বিরক্ত হওয়ারও কোনো বালাই নেই। ওই গ্রামের মানুষেরা একেবারে
অনুন্নত। কিন্তু আদর আপ্যায়নে শহুরে বিলাসিতাকে হার মানায়। নতুন বন্ধুরা সেই
রাতে সেখানেই থেকে যাওয়ার জন্য খুব জোরাজুরি করেছিল। কিন্তু আমার আর সৌরভের পরের
দিনের গন্তব্য আগে থেকেই ঠিক ছিল বলে ওখানে রাতের খাবার খেয়ে বিষ্ণুপুরের মেসে
ফিরে গেলাম।
আগের রাতে ঠিক
করা গন্তব্যের জন্য সূর্য ওঠার আগেই বেড়িয়ে পড়লাম। "মুকুটমণিপুরের"
উদ্দেশ্যে। বিষ্ণুপুর থেকে ৬৯ কিলোমিটার রাস্তা। আবার জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে
যাত্রা। মাঝপথে পেয়ে গেলাম শীতকালের মনোরম জিনিস, খেঁজুরের রস। খেঁজুরের গুড় জাল দেওয়া দেখতে
দেখতে দু-গ্লাস করে রস খেয়ে আবার যাত্রা শুরু।
মুকুটমণিপুর
পৌঁছে গেলাম সকাল আটটা-সারে আটটা নাগাদ। মুকুটমণিপুরের কংশাবতী নদীর ড্যাম। ওখানে
পৌঁছে দেখি প্রচুর ভীড়। ২৫ শে ডিসেম্বর তো, তাই পিকনিকের ভীড় আর তার সঙ্গে খুব জোরে জোরে
মাইক বাজছে। ভালো লাগলো না ব্যাপারটা। আসলে এসবের থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই পালিয়ে
এসেছি। দূর থেকে দেখতে পেলাম ড্যামের বাঁধের উপর একটা সুন্দর রাস্তা, আর রাস্তাটা প্রায় ফাঁকা। দেরি না করে চলে
গেলাম বাঁধের উপর।
কেক ছাড়া কি
বড়দিন পালন হয় ? তাই সঙ্গে করেই
কেক নিয়ে এসেছিলাম। মুকুটমণিপুরের বাঁধের ওপর হয়ে গেল কেক খাওয়া পর্ব, মানে বড়ো দিন পালন। ড্যামটা ভীষণ সুন্দর।
ড্যামের জলে দূর থেকে কিছু পরিযায়ী পাখি দেখা যাচ্ছে। আমরাও ড্যামের জলে স্নান
সেরে নিলাম। মুকুটমণিপুরের ড্যামটা সুন্দর হলেও আশেপাশের পরিবেশটা পছন্দ হল না।
সেই ঘিঞ্জি লোকালয়, জোরে মাইকের
শব্দ। তাই বাঁধের ওপর মুড়ি আর চা খেয়ে আবার বেড়িয়ে পড়লাম।
ম্যাপ দেখে ঠিক
করলাম মুকুটমণিপুর থেকে জঙ্গলের পথে ঝিলিমিলি হয়ে দলমা পাহাড়ের দিকে যাব।
ঝিলিমিলির দিকে
যাওয়ার সময় জঙ্গলের পথে একটা ওয়াচ টাওয়ার পেলাম। টাওয়ারের ওপর থেকে জঙ্গল দেখতে
বেশ ভালোই লাগছিল। বেশ খিদে পেয়েছিল। টাওয়ারের ওপর ছাতু দিয়ে লাঞ্চ সেরে ফেললাম।
ওখান থেকে আরও কিছুটা রাস্তা যাওয়ার পর ঝিলিমিলি পৌঁছালাম। এখানে একটা অভ্র - এর
খনি আছে। তবে এই খনি থেকে এখন আর অভ্র - এর আকরিক পাওয়া যায় না। ধ্বংসাবশেষও
প্রায় নিশ্চিহ্ন। কিন্তু এই খনির পাশাপাশি একটা ড্যাম আছে , 'তালবেড়িয়া ড্যাম'। এই ড্যামটা ছোটো হলেও খুব সুন্দর। এখানেও
সেদিন পিকনিকের মজলিশ চলছে। ড্যামের সামনে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম।
ঝিলিমিলি থেকে
ঝারখন্ডের দলমা পাহাড় আরও প্রায় ৮০ কিলোমিটার মতো। এদিকে বিকেল গড়িয়ে এল। ফোনে
নেটওয়ার্ক পাচ্ছিলাম না বলে ম্যাপ ঠিক মতো দেখতে পারিনি। GPS-ও কাজ করেনি। তাই ঝিলিমিলি থেকে বেরিয়ে দলমা
পাহাড়ের দিকে যাওয়ার রাস্তা ঠিক করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে
কিছুটা অনিশ্চয়তা নিয়েই এগিয়ে গেলাম। তখনই বুঝতে পেরেছিলাম যে দলমা পাহাড় পৌঁছাত
সন্ধ্যে হয়ে যাবে। তবে থেমে যাইনি। এগিয়ে চললাম। পাখি, পাহাড় আর সূর্যাস্তের খেলা দেখতে দেখতে বিকেল
পাঁচটার পর কালিমন্দির নামে একটা জায়গায় পৌঁছালাম। আসলে ওখানে একটা কালিমন্দির
আছে। সেই জায়গাটা থেকে একদিকে ৬ কিলোমিটার দূরে 'জামসেদপুর' আর তার উল্টো দিকে দলমা পাহাড়ের রাস্তা। ওখানে
একটা চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে চা খাওয়ার ছুতোয় জিজ্ঞেস করলাম আমাদের গন্তব্যের কথা।
চায়ের দোকানদার বলে বুঝিয়ে দিলেন আমাদের। আর একজন অন্য গাড়ির চালক ওনার গাড়ির
পিছনে যেতে বললেন। প্রায় ১১ কিলোমিটার যাওয়ার পর ঐ গাড়ির চালক ডানদিকে জঙ্গলের
রাস্তা দেখিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। যখন দলমা জঙ্গলে ঢুকলাম তখন পুরোপুরি সন্ধ্যে হয়ে
গেছে। একটু এগোতেই কয়েকজন শেয়াল পন্ডিত আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে গেল আর তারপর
থেকেই পাহাড়ের রাস্তা শুরু। ঘন জঙ্গলে পাহাড়ের রাস্তা আর তার উপর রাস্তাও ভীষণ
খারাপ। একটা বেশ গা ছমছমে পরিবেশ। পাহাড়ে ওঠার রাস্তা মানেই খাড়া রাস্তা। খুব
কষ্ট করেই বাইক চালিয়েছি। প্রচুর প্যাঁচা আর ঝিঁঝি পোকার ডাকে শুনে আর স্বচক্ষে
দুটো রাতচড়া পাখি দেখে গাড়ি চালানোর কষ্টের কথা ভুলেই গেছিলাম। প্রায় ১৬-১৭
কিলোমিটার রাস্তা উপরে উঠে ফরেস্ট অফিসের
একটা বাংলো মতো দেখতে পেলাম। কিন্তু ওইটুকু রাস্তা যেতে প্রায় এক ঘণ্টার বেশি
সময় লেগে গেল। চায়ের দোকানে শুনেছিলাম ওখানে ট্যুরিস্ট লজও আছে। কিন্তু খোঁজ
নিয়ে জানতে পারলাম যে ওখানে কোনো ট্যুরিস্ট লজও নেই আর ফরেস্ট বাংলোয় থাকারও
অনুমতিও নেই। খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। ভাবলাম এত কষ্ট করে এত দূর্গম রাস্তায়
আবার নীচে ফিরে যেতে হবে ? তখন ফরেস্ট
অফিসের একজন বললেন যে আরও পাঁচ কিলোমিটার উপরে একটা শিব মন্দির আছে। ওখানে গেলে
একটা ব্যবস্থা হতে পারে। শুনেই আর দেরি না করে আরও পাঁচ কিলোমিটার উপরে উঠে গেলাম।
হ্যাঁ , ওখানে বহু প্রাচীন এক শিব
মন্দির আছে। ওখানে একজন সাধুকে দেখতে পেলাম। ওনাকে আমাদের মন্দিরের কোথাও থাকতে
দেওয়ার কথা বলতে উনি সম্মতি জানালেন এবং রাতের খাবারের ব্যবস্থাও মন্দিরেই হয়ে
যাবে বলে আশ্বস্ত করলেন। আমরা নির্দ্বিধায় মন্দিরে থেকে গেলাম।
দলমা পাহাড়ের
মন্দিরে থাকার অনুমতি পেয়ে জিনিসপত্র বাইক থেকে নামিয়ে সাধুবাবাদের দেখিয়ে দেওয়া
স্থানে রেখে দিলাম। বাইকটাও একটা সুরক্ষিত জায়গায় রেখে প্রথমেই মন্দিরের একটা
পূজা গৃহে ঢুকলাম। ওখানে কিছুক্ষণ থাকতেই বুঝতে পারলাম যে দলমা পাহাড়ের একেবারে
চুড়ায় ওই নিঃঝুম জঙ্গলে তখন দলমা বাবা , মানে বাবা ভোলানাথ , পাঁচ - ছয় জন
সাধুবাবা আর আমরা দুজন ছাড়া আর কোউই নেই। এইরকম নিঃঝুম নিস্তব্ধতাই তো চেয়েছিলাম।
এই না হলে অ্যাডভেঞ্চার ? আমি আর সৌরভ
দুজনে মন্দিরের আশেপাশে ঘুরে সেই মায়াময় পরিবেশ উপভোগ করতে লাগলাম। জনমানবহীন
নিস্তব্ধতায় উপর থেকে মিষ্টি চাঁদের আলো আর ঝকঝকে তারামন্ডলী পরিবেশকে আরও
আকর্ষণীয় করে তুলেছে। পাহাড়ের ওপর ঠান্ডাও লাগছিল খুব। আশা করছিলাম কোনো জীব -
জন্তুর দ্যাখা পাওয়ার। কিন্তু সেই সৌভাগ্য হল না। কিন্তু একটা দারুণ জিনিস দেখতে
পেলাম। পাহাড়ের ওপর থেকে নীচে পুরো জামসেদপুর শহরের আলো , যেন মিটিমিটি তারাদের মেলা সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
একজন সাধুবাবা
আমাদের খেতে ডাকতেই মন্দিরের রান্নাঘরে প্রবেশ করলাম। খেতে বসে একজন সাধুবাবার
সঙ্গে কথা বলছিলাম মন্দিরের বিভিন্ন বিষয়ে। শুনলাম এই মন্দিরের সৃষ্টি কবে হয়েছে
তা কেউই জানে না। এখানে 'শিবরাত্রি'তে সাত দিন ধরে মেলা হয় , প্রচুর ভক্ত সমাগম হয়। 'ভোলে বম' অনুষ্ঠানে হয় প্রায় দের মাস ধরে। প্রচুর ভক্ত
ওই সময় আসে ও বিরাট মেলা হয়। তারপর আমি জীব - জন্তুর কথা জানতে চাইলে শুনলাম ওই
জঙ্গলে হাতি প্রচুর আছে , কিন্তু হাতির পাল
এখন বাঁকুড়ার দিকে নেমে গেছে। কয়েক মাস পরে ফিরবে। এছাড়া খরগোশ , হরিণ , ময়ূর , বুনো দাঁতাল শূকর
, সজারু আরও অনেক রকমের
পাখি আছে। আমি বেশ কিছুক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছিলাম যে মন্দিরে আশ্রিত পাঁচটা কুকুর
মাঝে মাঝেই খুব চিৎকার করতে করতে ছুটে যাচ্ছে। এর কারণ জানতে চাইলে সাধুবাবা বললেন
'সাহী', মানে 'সজারু' চলে আসছে ,
তাই তাদের তাড়িয়ে দিতে
কুকুর ওভাবে চিৎকার করে ছুটছে।
আমাদের সামনেই এক
সাধুবাবা দুধ খাচ্ছিলেন। আমি দুধ খেতে বড্ড ভালোবাসি। ওই কনকনে ঠান্ডার মধ্যে একটু
গড়ম দুধ হলে তো মন্দ হয় না। তবে সরাসরি দুধ খাবার কথা বলতে পারলাম না।
ইনিয়ে-বিনিয়ে গল্প করতে করতে মন্দিরে দুধের জোগান নিয়ে কথা বলতে সাধুবাবা
জানালেন , আগে অনেক দূধ হতো
, কিন্তু এখন অনেক কম হয়।
দূধের জোগান কমে যাওয়ার কারণ শুনতে শুনতে হাড় হিম হতে শুরু করল। সাধুবাবা বললেন,
"গত বছর বারোটা গরু নিয়ে
গেছে"। কে গরু নিয়ে গেছে জানতে চাইলাম। উত্তর শুনে চক্ষু চড়কগাছ। "গত
বছর বারোটা গরু নিয়ে গেছে"- এই কথা শুনে আমি বেশ উত্তেজিত গেলাম। একটু ভয়ে
ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম যে এই জঙ্গলে বাঘ আছে কিনা আর মন্দিরের এখানে আসে কিনা।
সাধুবাবা জানালেন , "হ্যাঁ ... এখানে
বাঘ এবং চিতাবাঘ সবই আছে। প্রায় দিনই রাতে এখানে ঘুরে ফিরে চলে যায়। কখনও কখনও
কিছুক্ষণ বিশ্রামও নেয়। তবে দিনের বেলায় ট্যুরিস্টদের চেঁচামেচি আর গাড়ির
আওয়াজের জন্য এখানে আসে না।" এই কথাটা শুনতে শুনতে আমাদের রক্ত ততক্ষণে
হিমাঙ্কের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। তখন মনে মনে ভাবলাম , যে অন্ধকার জঙ্গলের পথে আমরা একটু আগেই এখানে
এসেছি , সেটা বাঘেদের
স্বাচ্ছন্দ্যের চারনভূভি। কোনো রকমে খাওয়া শেষ করে বাইরে কাছাকাছি ভয়ে ভয়েই
একবার ঘুরে এসে শুয়ে পড়লাম।
মন্দিরের
রান্নাঘরে আমাদের শোবার ব্যবস্থা হয়েছে। সারাদিনের ক্লান্তির কারণে সৌরভ প্রায়
সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু আমি রোমাঞ্চটা আর একটু উপভোগ করার জন্য আরও
কিছুটা সময় জেগে ছিলাম। যদি একবার বাঘ মামার দ্যাখা পাই। কিন্তু ক্লান্তি জর্জরিত
শরীর আর বেশিক্ষণ থাকতে পারল না। ঘুমানোর আগে শেষবারের মতো একবার বাথরুমের জন্য
বাইরে বেরোতে হল। বেড়িয়েই হাল্কা বাল্বের আলোতে দেখি এক্কেবারে আমার সামনে একটা 'সজারু'। আমি একটু এগোতেই ও একটু দূরে সরে গিয়ে একটু অন্ধকারে চুপচাপ বসে থাকল আমিও
খানিকক্ষণ ছিলাম। অন্ধকারে ওর ছবি তুলতে পারিনি। খুব ঠান্ডা ও ভীষণ জোরে হাওয়া
বইছিল বলে এবার ঘরে ঢুকে শুয়ে পড়লাম।
একটুখানি চোখটা
লাগতে হঠাৎ দরজার বাইরে একটা শব্দ শুনে চমকে উঠে পড়লাম। মনে হল জল খাওয়ার শব্দ।
হৃদকম্পন বেড়ে গেল। সাধুবাবার কথাটা মনে পড়ে গেল। তেনারা নাকি রোজই আসেন এখানে।
তবে কি ....
নাঃ! আর কৌতুহল
ধরে রাখতে পারলাম না। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম। মৃদু আলোয় বেশ বুঝতে
পারলাম যার কথা ভাবছিলাম, সে নয়। আমাদের
ঘরের, মানে মন্দিরের রান্নাঘরের
বাইরে বাসন রাখা ছিল, জল দিয়ে ভিজিয়ে।
গোয়াল ঘর থেকে একটা গরু এসেছে জল খেতে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। কিন্তু একটু
নিরাশও হলাম। তেনার দেখা পেলাম না। ঘুমিয়ে পড়লাম।
২৬শে ডিসেম্বর
আমার জন্মদিন। সৌরভের ডাকে ঘুম ভাঙতে ঘড়িতে দেখলাম ভোর সাড়ে পাঁচটা। আমরা কোথাও
বেড়াতে গেলে ভোরবেলাটা নষ্ট করি না। কারণ ভোরের প্রথম আলো প্রকৃতির বিভিন্ন রঙকে
ধিরে ধিরে প্রষ্ফুটিত করে। তাই প্রকৃতির সাথে থেকে সেই দৃশ্য থেকে বঞ্চিত হওয়ার
কোনো মানেই হয় না। দুজনে বাইরে বেরিয়েই আবার ঘরে ঢুকে পড়লাম। বাইরে ভীষণ ঝোড়ো
হাওয়া চলছে , একেবারে কনকনে
ঠান্ডা। কিন্তু মন তা মানতে চাইল না। যথাযথ শীতের পোশাক পরে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমেই
জঙ্গলের একটু ভিতরে একটা বড় পাথরের উপর বসে সূর্যদয়ের শোভনীয় মূহুর্ত বেশ আয়েশ
করে গায়ে মেখে নিলাম। সঙ্গে ছিল বহু রকমের পাখির মিষ্টি সুরের ডাক। সূর্যের নতুন
কিরণের সঙ্গে আমার সত্যিই যেন এক নতুন জন্ম হল। এরকম জন্মদিন আমার জীবনে প্রথমবার।
এক পাহাড়ীয়া
ভোরে ,
গভীর জঙ্গলে ,
লুকায়ে কুয়াশা
মাখি
আসিল জনম লগন
যতনে রাখিব ।
এ জীবনে ক্ষণে
ক্ষণে
স্মরণ করিব এ
ক্ষণ
যতনে রাখিব।
আশেপাশে বেশ
কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে আবার মন্দিরের কাছে এসে দেখলাম একটা গুহা আছে
মন্দিরের একেবারে গায়ে। ওই গুহার ভিতরেই রয়েছেন শিবলিঙ্গ , দলমা বাবা। আর ওই গুহার পাশ থেকে আরও একটি
সিঁড়ি উঠে গেছে। কৌতুহলী মনে উপরে উঠে আরও একটি মন্দির দেখতে পেলাম। সেখানে
অধিষ্ঠিত আছেন স্বয়ং বজরংবলী। ওখানে একটা ওয়াচ টাওয়ার আছে। ওখানে কিছুক্ষণ ঘুরে ফিরে দলমা মন্দিরের
নীচে নেমে ঘুরতে ঘুরতে আরও একটা মন্দির পেলাম। সেটা দলমা মাতার মন্দির। এবার ঘড়ির
দিকে তাকাতে মনটা খারাপ হতে লাগলো। আমরা তো সময়ের হাতে বন্দি । তাই এবার ফেরার
রাস্তা ভাবতে শুরু করলাম।
সেদিন দলমা
পাহাড় থেকে ফেরার ইচ্ছা একেবারেই ছিল না। তাই সকাল নটার মধ্যে বেরোনোর কথা
সত্ত্বেও ফিরতি যাত্রা শুরু করলাম বেলা সাড়ে এগারোটায়। কর্তব্য আর সময়ের
পিছুটানে শেষ পর্যন্ত পাহাড় থেকে নামতেই হল। দলমা বাবাকে বিদায় জানিয়ে যাত্রা
শুরু করলাম ঠিকই , কিন্তু মনটা রেখে
এলাম দলমা পাহাড়ের মধ্যেই। খুব ধীরে ধীরে বাইক চালিয়ে নীচে নামছিলাম। কারণ
জঙ্গলের শোভনীয় দৃশ্য আর নিস্তব্ধতা উপভোগ করার আশ কিছুতেই যেন মিটতে চাইছিল না।
অনেকটা নীচের
দিকে নামতে জঙ্গলের একটু ভিতরের দিকে তাকাতেই বাইক থামিয়ে দিলাম। একদল হরিণ লাঞ্চ
করতে ব্যাস্ত। আমরা একেবারে পায়ের শব্দ না করার চেষ্টা করছিলাম , কিন্তু শুকনো পাতার ওপর একটু তো শব্দ হবেই।
সঙ্গে সঙ্গেই হরিণের দল সতর্ক হয়ে কান খাড়া করে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। আমরা বেশি এগিয়ে না গিয়ে তৎক্ষণাৎ ওদের
ক্যামেরা বন্দি করা শুরু করে ফেললাম। তবে খুব ধীরে ধীরে আরও একটু ভিতরে ঢুকে খুব
ভালো ভাবে ওদের লাঞ্চ দেখলাম অনেকক্ষণ। ছবি তোলার সময় একবার মনে হচ্ছিল যেন ,
ওরা সদলবলে ছবি তোলার
জন্যই আমাদের দিকে পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হরিণের দলের সঙ্গে বেশ কিছুটা সময়
কাটিয়ে মনে আর একটু শান্তি নিয়ে পাহাড় থেকে নেমে এলাম।
এবার কলকাতা
অভিমুখে যাত্রা। আমাদের বিদায় মূহুর্তে সূর্যদেবও মুখ ভার করে ফেললেন। জামসেদপুর
হয়ে ফিরলে হয়ত ভালো হতো। কিন্তু সোরভকে বিষ্ণুপুরে নামাতে হবে। তাই প্রথমে
বিষ্ণুপুর আর তারপর আমার শহর। আমি বাড়িতে সেদিন পৌঁছেছি রাত সাড়ে দশটা নাগাদ।
আমার ফোনে
নেটওয়ার্ক ছিল না বলে আমার এক কলিগ আমার বউয়ের ফোনে যোগাযোগ করেছিল। তাই
ব্যাপারটা আগে থেকেই বাড়িতে জানাজানি হয়ে গেছিল, এই কথাটা আমি ফেরার দিন যেখানে ফোনের নেটওয়ার্ক
পেয়েছি সেখান থেকে যখন বাড়িতে ফোন করেছিলাম তখনই জানতে পেরেছি। তাই একটা
বিষ্ফোরণের ভয় নিয়েই বাড়ি ঢুকলাম। কিন্তু বাড়ির পরিবেশ আদৌ সেরকম ছিল না। বরং
খাবার টেবিলে ফ্রায়েড রাইস, কষা মাংস আর
জন্মদিনের পায়েস পেলাম। তার বিনিময়ে প্রায় অর্ধেক রাত পর্যন্ত বউ আর মেয়েকে তিন
দিনের পুরো গল্পটা শোনাতে হয়েছে এবং আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই সপরিবারে আবার দলমা
পাহাড়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিতে হয়েছে।
subhrakanti26@gmail.com
সুন্দর।
ReplyDelete