
...সৌপ্তিক দাস
ব্রহ্মপুত্র তীরবর্তী গুয়াহাটি শহর উত্তর পূর্ব ভারতের
প্রবেশপথ। গুয়াহাটি অতি প্রাচীন জনপথ। অতীতে এর নাম ছিল প্রাগজ্যোতিষপুর এবং অসমের
নাম ছিল কামরূপ। বর্তমান “গুয়াহাটি” নামটি এসেছে গুয়া অর্থাৎ সুপারি এবং হাট
অর্থাৎ বাজার থেকে। সুপারির ব্যবসার একটা বড় কেন্দ্র ছিল এই গুয়াহাটি। আমরা কয়েক
বছর আগে এই গুয়াহাটি এবং কাজিরাঙ্গা ও শিলং ঘুরে এসেছিলাম।
দিন
টা ছিল শনিবার। আগের দিন রাতে সব ব্যাগ প্যাক করা শেষ। তাই সেদিন তাড়াতাড়ি দুপুরের খাবার খেয়ে নেওয়া হল। সাথে নেওয়া হল সকাল থেকে তৈরী করা রাতের খাবার, রুটি আলুভাজা আর মিস্টি। ১২.৪৫ নাগাদ ট্যাক্সি ভাড়া করে রওনা দিলাম হাওড়ার উদ্দেশ্যে। ২.১৫ এর মধ্যে পৌছে ও গেলাম। এদিকে দলের বাকি রাও আস্তে আস্তে চলে এলো স্টেশনে। ঠিক ৩.৫০ এ আমাদের যাত্রা শুরু হল। গন্থব্য গুয়াহাটি। প্রথমে ধীর
গতিতে চলতে লাগলো ট্রেন। তারপর যত গতি বাড়তে থাকলো ততোই আমাদের গল্প করতে করতে কেটে গেল সময়। রাতের খাবার সময় দেখলাম
সবাই খাবার নিয়ে এসেছে। আমাদের রুটি আলুভাজার সাথে দেখা গেলো পরোটা আলুরদম আর মাংস
ও আছে অন্যদের ব্যাগে। তাই সবাই ভাগ করে খেয়ে নিলাম। জমে
গেলো রাতের খাবার। এবার রাত ১০.৩০ এর মধ্যে যে যার বাঙ্কে উঠে
পড়লাম। আমার বার্থ ছিল উপরে, উপর থেকে আশপাশ দেখতে দেখতে কখন যে
ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম টের ও পাইনি।
পরদিন
সকালে বেশ ভোরেই ঘুম ভাঙ্গলো
আমার।
৬টার সময়ে
ঘুম থেকে উঠে আপার বার্থ থেকে সব দেখতে থাকলাম। মা অনেকবার বলা সত্ত্বেও চা খেলাম না তার কারণ বাথরুমে যাতে না যেতে হয়। কারণ লং ডিস্টেন্স জার্নি তে বাথরুমের অবস্থা আজও শোচনীয়। যাইহোক ট্রেন একটু লেটে চলছিল। তাই ১০.২০ নাগাদ আমরা লটবহর নিয়ে নামলাম গুয়াহাটি স্টেশনে। বলে রাখা ভালো, শিলং ও কাজিরাঙ্গার হোটেল বুক থাকলেও গুয়াহাটি তে রুম খুঁজতে হয় আমাদের। শেষে অনেক খুঁজে
একটা হোটেল পাওয়া গেলো। আমাদের হোটেল প্রিন্স স্টেশন থেকে কিছুটা দূরে ছিল। যে
যার ব্যাগপত্র নিয়ে রওনা দিলাম হোটেলের দিকে। আমরা সবাই যখন হোটেলে থিতু হলাম তখন প্রায় ১১.৪০ বাজে। হোটেলে খোঁজ নিয়ে জানা গেলো কাছেই পল্টন বাজারের কাছ থেকে বাস পাওয়া যায় কামাক্ষা মন্দিরে যাওয়ার জন্য।
সেইমতোই যাওয়া হবে ঠিক করে ধীরে ধীরে সবাই স্নান করে নিলাম
আমরা। আজ আমাদের লিস্টে ছিলো দুপুরের খাবার সেরে কামাক্ষা মায়ের মন্দির দর্শন ও পুজো দেওয়া। সেইমতন
কাছাকাছি একটা হোটেল থেকে দুপুরের খাবার খেয়ে আমরা চলে এলাম পল্টন বাজারের কাছে।
এখান থেকেই বাস পাওয়া যায়। আমরা বাস ধরে চললাম। বাস যেখানে নামালো সেখান থেকে
মন্দিরের নিজস্ব বাস সার্ভিস আছে। সেই বাসে করে যখন মন্দিরে পৌঁছালাম তখন বিকেল
হয়ে গেছে। মা কাকিমারা পুজো দিতে লাইন দিলো। আমি আর বাবা ব্যস্ত হয়ে পড়লাম ছবি তুলতে। সুন্দর এই মন্দির।
আর তার থেকেও বেশি সুন্দর এদের ব্যবস্থাপনা। মন্দির চত্ত্বরে যেমন বাঁদর তেমনি
কুকুর। তারা তাদের মতোই আছে। এমনকি মন্দিরের অনেক পুরোহিতের সাথে তারা খেলায় মত্ত।
মন্দির চত্ত্বর টা খুব বড়। আর খুব ঠান্ডা। এই মন্দিরটি কোচবিহারের মহারাজা
নরনারায়ণের উদ্যোগে তৈরি হয়েছিল। মন্দিরের গর্ভগৃহে সিংহাসনে আসিন অষ্টধাতুর কামাক্ষা দেবীর মূর্তি। এটা একটা সতীপিঠ। এখানে
নাকি সতীর যোনী পড়েছিল। পুজো দেওয়া হলে সবাই আমরা লাল চেলি নিলাম। এই চেলি নাকি খুব আশীর্বাদী।
আমরা যখন মন্দির ছাড়লাম তখন সন্ধ্যা নেমে গেছে। তাই কাছের
চা দোকানে একটু গলা ভিজিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। পল্টনবাজারে নেমে বাকিরা
ঘরে ফিরে গেলেও বাবা, আমি আর একজন কাকু গেলাম গাড়ি বুক করতে। পরদিন সকাল থেকেই
শুরু হবে আমাদের আসল জার্নি। গাড়ি বুক করতে গিয়ে দুটো গাড়ির কথা বলায় তারাই জানালো
১২ সিটের টেম্পো
ট্রাভেলারের কথা। তাতে মজা নাকি আরো বেশি হবে। সেইমতন গাড়ি বুক করে বাড়ি ফিরলাম।
আজ একটু তাড়াতাড়ি শুতে হবে। কারণ কাল অনেক সকালে উঠে অনেকটা জার্নি করতে হবে।
পরদিন আমাদের
যাত্রা ছিল কাজিরাঙ্গার উদ্দেশ্যে। সকাল ৯টার মধ্যেই আমরা প্রাতঃরাশ সেরে তৈরী হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু গাড়ি আসতে দেরী করায় আমাদের দেরী হয়ে যাচ্ছিল। অবশেষে গাড়ি করে বেড়িয়ে পরলাম আমরা সকাল ৯.৩০ নাগাদ। আজ প্রায় ৬.৩০ ঘন্টার পথ। বাসে উঠেই বাবা বসল ড্রাইভারের পাশে। যাবতীয় জিনিস ও জায়গার আলোচনা করবে বলে। তারপর মা, কাকা, কাকিমারা। আর সব শেষে আমরা। গাড়ি ছিল নন এসি। তবে দুঃখের বিষয় কোনো টিভি নেই। অগত্যা সাথে থাকা পেন ড্রাইভের গান ই চালানো হলো। আর চলতে থাকলো গাড়ি।
গুয়াহাটি থেকে প্রায় ১৬কিমি দূরে জোরবাট নামে একটি জায়গা
আছে। সেখান থেকে রাস্তা দুই ভাগে ভাগ
হচ্ছে। একদিক যায় কাজিরাঙ্গার দিকে আর একদিক শিলং এর দিকে। আমাদের রাস্তা বাঁ দিকে
বাঁক নিলো। রাস্তা ভালো থাকার দরুন গাড়ির স্পিড ছিল অনেক। দুই ধারের মনোরম পরিবেশ
মন ভুলিয়ে দেয়। দেখতে দেখতে দুপুর হয়ে আসায় সবার পেটেই তখন ছুঁচো কবাডি খেলছে।
অগত্যা গাড়ি থামিয়ে রাস্তার পাশেই এক ধাবায় দুপুরের খাবার খাওয়া হলো। যতই
কাজিরাঙ্গার দিকে আমরা এগোচ্ছিলাম ততই সবুজের আধিক্য ঘটছে দেখে মনটা ভালো লাগছিলো।
হটাৎ
দেখলাম একজায়গায় দুটো গাড়ি দাঁড়িয়ে আর ৮, ১০ জন লোকের ইতিউতি চলাফেরা। কি হয়েছে জানার জন্য গাড়ি
থামাতেই যে কথাটা কানে এলো তা হলো একশৃঙ্গ গন্ডার দেখা যাচ্ছে। আমরাও নেমে পরলাম
দেখবো বলে। রাস্তার পাশে একটা ছোট ভিউ পয়েন্ট। দুরবীন দিয়ে দেখা যায় গন্ডার, আর যে লোকটার দূরবীন সে কিছু রোজগার করে। আমরাও সবাই মিলে দেখলাম। আমি আবার
পাকামি মেরে দূরবীনের সামনে মোবাইল রেখে ছবিও তুললাম।
আবার গাড়ি চলতে শুরু করলো। এবার আর কোথাও থামা নয়। সন্ধ্যা
নামতে শুরু করেছে। ৫টা নাগাদ এসে গেলাম হোটেল শান্তি লজে । জায়গাটা
বেশ নিরিবিলি আর মনোরম। পোঁছে শুনলাম পরের দিনের কাজিরাঙ্গা সাফারির জন্য হাতি বা
জিপ বুক তখনি করতে হবে। তাই শুনে বাবা আর এক কাকু পরের দিনের জঙ্গল সাফারির
ব্যাপারে কথা বলতে গেলো। এদিকে আমাদের দুটো বেড রুম বুক করা ছিল। আমরা
তাই যে যার ঘরে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে রেডি হতে শুরু করলাম কারণ এখানে প্রতিদিন
সন্ধ্যেবেলায় একটু দূরে অনুষ্ঠান হয়। রেডি হয়ে গাড়িতে উঠে বাবার মুখে শুনলাম যে
আমাদের জঙ্গল সাফারি হবে হাতির পিঠে করে। আমার ব্যাক্তিগত ভাবে জিপটাই লক্ষ্য
থাকলেও মেজরিটি জিতে গেল। এদিকে আমাদের গাড়ি চলেছে অনুষ্ঠান মঞ্চের দিকে। আমরা যখন
সেখানে এসে পৌঁছালাম তখন সবে মঞ্চ সাজানো চলছে তাই আমরা তাড়াতাড়ি করে টিকিট কেটেই
সামনের সিটগুলো কব্জা করলাম। নির্দিষ্ট সময়ে অনুষ্ঠান শুরু হল। প্রথমে একক সঙ্গীত
ও নাচ হওয়ার পর দলগত নাচ শুরু হল। আঞ্চলিক ছেলে মেয়েরা নাচে অংশ নিচ্ছিল। আমরা
ভাবছিলাম আসামে বসে আছি অথচ গায়ক ভুপেন হাজারিকার কোনো গান হবেনা? ভাবছি এই কথা,
তার মধ্যেই শুরু হল সেই বিখ্যাত গান “বিস্তীর্ণ দুপারে......”। প্রথমে
বাংলায় শুরু হলেও ধীরে ধীরে অসমীয়া ভাষাতেও গাওয়া হল সেই গান। শেষ নাচের সময় তারা
আমাদের মা কাকিমাদের ডেকে নিল তাদের সাথে পা মেলানোর জন্য। খুব সুন্দর ভাবে শেষ হল
অনুষ্ঠান।
আজ রাতে তাড়াতাড়ি খেয়ে শুতে হবে কারণ পরদিন সকালে ৪টের
মধ্যে জঙ্গলে ঢুকতে হবে। সেইমতো আমরা রাতের খাবার খেতে চললাম। খাবার হোটেল থাকার হোটেল থেকে মিনিট ২ দূরে। কিন্তু এই সুদুর আসামে এসেও ডাল ভাত খাওয়াটা মেনে নেওয়া যায়না। সুতরাং অসমীয়া
খাবার ট্রাই করতে হবে। তাই আমরা অসমীয়া
থালি বললাম। থালি আসার পর আমিতো অবাক। কি নেই সেখানে। ভাত রুটি তো আছেই তার সাথে প্রায় ৭, ৮ রকমের পদ। দুই রকমের আলুর তরকারি, দুই রকমের সব্জির তরকারি, পাঁপড়, মিষ্টি, আরও অনেক কিছু। পেট ভরে খেয়ে এসে বিছানাতে পিঠ দেওয়া মাত্রই গভীর ঘুম এসে গেলো। সারাদিনের পরিশ্রমের পর শান্তির ঘুম সবারই প্রিয়।
পরদিন ভোর
বেলায় বাবার হাঁকডাকে ঘুম ভাঙলো
সবার।
তখন ঘড়ি বলছে ৩টে ১৫। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পরলাম আমরা। যদিও চোখে তখনো ঘুম লেগে আছে কিন্তু জঙ্গলে গণ্ডার দেখবো এই আনন্দে কিছুক্ষণ পরই সব ঘুম যেন উধাও হয়ে গেলো। আগে থেকেই ঠিক ছিল আমরা হাতির পিঠে চড়ে ঘুরবো। সেই জায়গায় পৌঁছে দেখি বড় বড় সব হাতি ইতিউতি ঘুরছে। লাইন দিয়ে আমাদের দাঁড়াতে হলো। সামনেই ১টা উঁচু প্ল্যাটফর্ম। সেখানে উঠে
হাতির পিঠে উঠতে হবে। ১টা হাতির পিঠে ৪ জনের বসার জায়গা। একটা খোপের মতো করা। আমরা
উঠে পরলাম তাতে। দুলকি চালে চলা শুরু হলো। অনেকটা পথ পার হয়ে অবশেষে দেখা পেলাম
সেই মুর্তিমানের। বিখ্যাত এক শৃঙ্গ গন্ডার। অবশ্য চোরাশিকারীদের জন্য এরাও বিপন্ন আজ। এই ভদ্রলোক একদম আমাদের মুখোমুখি এসে গেছিল। এদিকে হাতি
বাবাজি হাঁটছে আর এদিক ওদিক থেকে কলাগাছ খেয়ে চলেছে। আর কিছু পরে দেখি আমাদের
সামনের হাতি বাবাজি মলত্যাগ ও করলো। আমরা সেবার আরও দুটো গন্ডার আর কিছু বুনো মোষ
দেখতে পেয়েছিলাম। সাফারি শেষ করে যখন ঘরে এলাম তখন ৬
টা বেজে গেছে। আস্তে আস্তে সবাই স্নান ঘরের দিকে পা
বাড়ালো। কারণ আমরা আজই কাজিরাঙ্গা ছেড়ে শিলং
এর উদ্দেশ্যে রওনা দেবো।
সকালের টিফিনে ছিল গরম
গরম লুচি আর ছোলার ডাল। তাই খেয়েই বেড়িয়ে পরলাম। আজ আমাদের জোরবাট এসে শিলং এর
রাস্তা ধরতে হবে। এদিকে আমাদের বাসের
একটা কাঁচ ভাঙ্গা থাকায় আমাদের
জোরবাটে সেটা ঠিক করাতে হতো। কারণ শিলং এ নভেম্বর মাসে খুব ঠাণ্ডা
থাকে। সেইমতন জোরবাট
পৌঁছে ড্রাইভার সারাতে লেগে গেলো আর আমরা হাতের সদব্যবহার করতে লাগলাম। সেদিন মিক্স ফ্রাইডরাইস আর চিলি চিকেন
খাওয়া হয়। যথারীতি আমার প্লেটের কিছু খাবার অতিরিক্ত থাকায় সেটা প্যাক করে নেওয়া
হয়।
ইতিমধ্যে বাস চলে আসায় আমরা রওনা দি শিলং এর উদ্দেশ্যে।
দুরত্ব অনেকটা হওয়ায় আমাদের পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে আসে। আমরা যখন শিলং শহরে পৌঁছালাম তখন ঠাণ্ডা যথেষ্টই। তবে শিলং এ হোটেল
রাজতিলকে আমাদের ২টো ঘরই খুব বড় ছিলো। সেদিন আর কোথাও যাওয়ার ছিলো না। রাতে সবাই খেতে গেলেও ঠান্ডার
জন্য আমি যাইনি। দুপুরের প্যাক করা খাবার দিয়েই আমার রাতের খাবার হয়ে যায়।
পরদিন
আমাদের যাত্রা মৌসিনরামের উদ্দেশ্যে। এই রাস্তাতেই আছে চেরাপুঞ্জি, মসমাই কেভ, সেভেন সিস্টার ফলস, নোহকলিখাই ফলস, চেরাপুঞ্জি ভিউ পয়েন্ট।
তাই সকাল বেলা রেডি হয়ে বাইরে এসে দেখি বাস তখনও আসেনি। কি করব ভাবছি এমন সময় বাবা বলল কাছেই এক স্টল থেকে সকালের টিফিনটা
করে নেওয়া যাক। সেইমতো কিছুটা এগিয়ে এসে আমরা পেট
পুজো করে নিলাম। বাস এলো ৯টায়। শুরু হলো আমাদের যাত্রা। গান চালিয়ে হুল্লোড় করতে
করতে চললাম আমরা। দুদিকের রাস্তা মনোরম। চেরাপুঞ্জি ৫৬কিমি দূরে। এই রাস্তায় দেখলাম কিছু উপজাতি গ্রাম। দেখতে পেলাম অনেক খাসি
মানুষকে। কেউ কাজ করছে তো কেউ দোকান দিয়েছে। বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা স্কুল
যাচ্ছে। সকলের মনেই আনন্দ, আর সেটা তাদের চোখে মুখে স্পষ্ট দেখা
যাচ্ছে। যেন অনাবিল আনন্দ।
১৯৭২ সালের ২১ জানুয়ারি গারো, খাসি, জয়ন্তিয়া নিয়ে তৈরি হয় নতুন রাজ্য মেঘালয়
অর্থাৎ মেঘের আলয় বা ঘর আর সেই মেঘালয় রাজ্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় স্থান শিলং। ইংরেজরা এর নাম দিয়েছিল “স্কটল্যান্ড অফ দি ইস্ট”। আমাদের প্রথম
হল্ট ছিল সেভেন সিস্টার ফলস। পাশাপাশি সাতটি
ঝর্ণা উপর থেকে নিচে ঝরে পরছে। তবে দুঃখের বিষয় সেই সময় ঝর্ণা গুলি সব শুকিয়ে গেছিলো। তারপর আমরা
চললাম মৌসিনরামের উদ্দেশ্য। বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয় এখানে। তবে বর্ষাকাল ছাড়া অন্য সময়ে এলে বোঝাই যাবেনা সে কথা।
এবার মৌসিনরাম ছেড়ে আমরা এগিয়ে চললাম চেরাপুঞ্জির দিকে। পথে এলাম
নোহকলিখাই ফলস এর সামনে। এই জলপ্রপাতটি এশিয়ার দ্বিতীয় ও বিশ্বের
চতুর্থ উচ্চতম জলপ্রপাত। ফলসের সামনেই থাকা খাওয়ার হোটেল। সেখানেই আমরা দুপুরের
খাওয়া সারলাম। হোটেলের পিছনের ব্যালকনিতে এসে দেখলাম ফলসের অপরূপ শোভা। উঁচু থেকে
নামছে জলধারা। এরপর
আমাদের যাত্রা চেরাপুঞ্জি ভিউ পয়েন্ট। এই ভিউ পয়েন্টে এসে চোখের সামনে বাংলাদেশ
দেখা যায়। বাংলাদেশের সিলেট শহর। নিচেই ঘাট থেকে নৌকায় সিলেট শহরের সামনে দিয়ে
ঘুরে আসা যায়।
এবার ফিরতে হবে হোটেলের উদ্দেশ্যে। তাই বাসে উঠে পরলাম।
রাস্তায় সবাই ঘুমে কাদা। গাড়ি যখন পুলিশবাজার ঢুকলো তখন প্রায় ৬টা। সন্ধ্যাটা গল্প
করে কাটিয়ে রাত ৯টায় খাবার খেয়ে নিলাম আমরা। কাল যাওয়া হবে মাওলিনং এর দিকে।
পরদিন আমরা মাওলিনং এর দিকে যেতে
যেতে আরো অনেকগুলো স্থান আমরা দেখে নিয়েছিলাম। সকাল ৯.৩০ নাগাদ পুলিশ বাজারের সামনেই সকালের টিফিন খেয়ে আমরা রওনা দিলাম। শিলং থেকে বাস ছেড়েই আমাদের প্রথম হল্ট ছিল শিলং পিক। শহর
থেকে ১০কিমি দূরে। এই রাস্তার অনেকটাই সংরক্ষিত এলাকা। বিমানবাহিনীর এলাকা। তাই
আমাদের পাসপোর্ট জমা রাখতে হয়েছিলো আর ওই এলাকাতে ছবি তোলাও বারণ। এখান থেকে পুরো
শিলং শহর কে দেখা যায়। বলতে গেলে পুরো বার্ডস আই ভিউ। আমরা কিছুক্ষণ থাকলাম, চিপ্স কিনলাম। পুরো শিলং শহর কে পিছনে রেখে ছবিও উঠলো।
এখানে একটা ওয়াচ টাওয়ার আছে। পুরো শহর কে দেখার জন্য।
এবার আমাদের এগিয়ে চলার পালা। পরবর্তী জায়গা এলিফ্যান্ট
ফলস। ১২কিমি দূরে। এই ফলসের বৈশিষ্ট্য হলো ফলসটা দুই ধাপে নেমেছে। এর পূর্ণাঙ্গ রূপ দেখতে নিচে নামতেই
হবে। লোকাল অনেকেই ছুটির দিনে পিকনিক করতেও আসে এখানে। এবার আর থামা নয়। এবার সেই মাওলিনং এ গিয়ে থামা। শিলং থেকে
৯০কিমি দূরে এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম মাওলিনং। দুপুর নাগাদ আমরা মাওলিনং এ
এসে পৌঁছালাম। এখানেই দুপুরের খাওয়া হবে। তবে একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম যে সব
দোকানেই মেয়েরা চালাচ্ছে। এমনকি আমরা যে হোটেলে খেলাম সেখানেও মেয়েরাই সব। বিভিন্ন
বয়সের মেয়ে বিভিন্ন কাজ করছে। কেউ রান্না তো কেউ খাবার দিচ্ছে। সব
বাড়ির সামনেই বেতের তৈরি তিনকোনা ঝুরি। পুরো গ্রামে বিভিন্ন ধরনের অর্কিড। এখানে
খাসি ছেলেমেয়েদের জামা কাপড় পড়ে ছবিও তোলা যায়। আমাদের অনেকে ছবিও তুললো। এবার
আমাদের শিলং ফেরার পালা। তবে তার আগে আমরা যাবো লিভিং রুট ব্রিজ দেখতে। এই ব্রিজ
পুরো গাছের শিকড় দিয়ে তৈরী। সেইজন্য এই ব্রিজ ব্যবহারের জন্য নয়।
লিভিং রুট ব্রিজ দেখে আবার আমরা শিলং এ ফিরে এলাম। আজ খুব
শখ করছিল মোমো খাওয়ার। এখানে দেখলাম মোমোর সাইজ খুব ছোট। বেশ অনেকগুলো দেয়। আর
সাথে ঝাল চাটনি। রাতে ডিনারে গিয়ে শুধু নিরামিষ খেয়েই ফিরে এলাম। মন খুব খারাপ।
এবার যে ফিরতে হবে আমাদের।
পরদিন সকাল সকাল রওনা দিলাম আমরা। আজ অনেকটা পথ অতিক্রম করে গুয়াহাটি ফিরবো আমরা। আমরা ঠিক করেছিলাম শিলং এর স্টেট মিউজিয়াম দেখে গুয়াহাটি ফেরার পথে উমানন্দ মন্দির
ও বশিষ্ঠ আশ্রম দেখে নেব। সেটা আমাদের ড্রাইভারকে বলায় সে বেঁকে
বসলো। শেষ অবধি অনেক কষ্টে রাজি হল কিন্তু একটু দূরত্ব থাকায় উমানন্দ মন্দিরে সে নিয়ে
যাবেনা। যাই হোক, শিলং ছাড়ার সময় আমরা গেলাম স্টেট মিউজিয়ামে। ৭ তলার এই মিউজিয়ামের প্রতিটি তলায় ছড়িয়ে আছে অসংখ্য নিদর্শন। মেঘালয়ের ইতিহাস, সেখানকার লোকজন, আদিবাসী, উপজাতি জনগোষ্ঠীর অনেক নিদর্শন পাওয়া যায় এখানে। আর সবচেয়ে বড় পাওনা স্কাই ওয়াক। সেখানে গিয়ে পুরো শিলং শহরের আর একটা
বার্ডস আই ভিউ পাওয়া যায়।
অনেকটা পথ অতিক্রম করে আমরা গুয়াহাটি
ঢুকলাম। এবার আমরা যাব বশিষ্ঠ আশ্রম দেখতে। এক রাজার শাপে দেহহীন বশিষ্ঠ মুনি ব্রহ্মার উপদেশে এখানে ভগবান বিষ্ণুর তপস্যা
করেন। এর ফলস্বরূপ তিনটি জলধারার উৎপত্তি হয়। যা পরে মিলিত হয়ে বশিষ্ঠ গঙ্গা নামে
পরিচিতি পায়। এই স্থান থেকে আমরা গিয়ে পৌঁছালাম গুয়াহাটির
ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘে। একটা রাত কাটিয়ে পরদিন বিকেলে ভারাক্রান্ত
মনে এই শহরকে বিদায় জানিয়ে আমরা লোকপ্রিয় গোপীনাথ বরদৌলী বিমানবন্দর থেকে উঠে বসলাম
কলকাতা গামী বিমানে।
souptik.25@gmail.com
কলকাতা
No comments:
Post a Comment