1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, January 1, 2020

জোড়া টিয়া


                                                                                               ...রাহাত ইবনে মাহবুব
          জংধরা একটা লোহার খাঁচা।তাতে দুইটা পাখি।টিয়াপাখি।একটা ছেলে,একটা মেয়ে।আমি ঘুমঘুম চোখে তাকিয়ে আছি তাদের দিকে।কিন্তু তারা আমার দিকে পাছা ফিরিয়ে বসে আছে।সম্ভবত আমাকে অপমান করার চেষ্টা করছে।কিন্তু আমি তো অপমানিত বোধ করছি না।ব্যাপারটা নিশ্চয় তারা ধরতে পারেনি।পারলে আর পাছা ফিরিয়ে বসে থাকতো না।মুখ ফিরিয়ে বসতো।তবে ব্যাপারটা তাদেরকে বললে হয়তো বুঝে যাবে।কারণ তারা কথা জানে।অবিকল মানুষের মত কথা।তাদের আগের মালিক অনেক কষ্ট করে শিখিয়েছে।এখানে আমার কোন কৃতিত্ব নেই।সব ক্রেডিট আগের মালিকের।
         পাখি দুইটাকে কিনেছি একটা বিশেষ কারণে।ইতির জন্মদিনে উপহার দেয়ার জন্যে।পাখি তার অতি পছন্দের।তবে অবশ্যই মুক্ত পাখি।খাঁচার পাখি খুব একটা পছন্দ না।মেয়েমানুষের মন এমনিতেই খুব নরম থাকে।ইতির মন তুলনামূলক একটু বেশিই নরম।অবলা জন্তু-জানোয়ারের কষ্ট তার সয় না।তাদেরকে কষ্ট পেতে দেখলেই সে কেঁদে ফেলে।ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে কিছুক্ষণ।তারপর আবার সবকিছু স্বাভাবিক।পানি মুছতে মুছতে সাথের জনকে বলে,আমি ঠিক আছি।
        ঢাকা শহরে হাজার তিনেকের কমে জোড়া টিয়া পাওয়া মুশকিল।কিন্তু আমি পেয়েছি।মাত্র পাঁচশো টাকায় মুমিন সাহেবের জোড়া টিয়া কিনে ফেলেছি আমি।মুমিন সাহেব আর আমি একই বিল্ডিংয়ে থাকি।শুধু ইউনিট আলাদা।তিনি থাকেন আমার সামনের ইউনিটে।আর আমি থাকি তার সামনের ইউনিটে।
         ব্যাংকার ছিলেন।পোস্ট ভালো ছিল।বেতনও ভালো ছিল।কিন্তু হুট করেই চাকরিটা ছেড়ে দিলেন তিনি।বললেন,চাকরি-বাকরি আর ভাললাগে না।অন্যের অধীনে খেটেখুটে নিজেকে কৃতদাস কৃতদাস মনে হয়।গ্রামের বাড়ি গিয়ে ব্যবসায় বসবো।বৌ-ছেলেপুলে নিয়ে শান্তিতে দিন কাটাবো।জীবন মানেই স্বাধীনতা।অন্যের অধীনে খেটে মরবো কেন?
ভদ্রলোক আমাকে ভালোবাসতেন খুব।কেন বাসতেন আমি জানিনা।কখনো জানার আগ্রহও হয়নি।একবার তিনি বললেন,অন্তু সাহেব,আপনাকে আমার ভালোলাগে।বড় আপন আপন মনে হয়।
আমি হাসতে হাসতে বললাম,ভালো তো।তিনি বললেন,কেন লাগে শুনবেন?
আমি বললাম,না,আগ্রহ নেই।
ভদ্রলোকের মুখ কালো হয়ে গেল।সম্ভবত তিনি আমার থেকে এমনটা আশা করেন নি।না করলেই কী?মানুষের সব আশা পূর্ণতা পায়না।এটাই নিয়ম।
মুমিন সাহেব বাসা ছেড়ে যাওয়ার সময় তার শখের জোড়া টিয়া আমার কাছে পানির দরে বেচে দিয়ে গেলেন।আর বললেন,অন্তু সাহেব,আপনাকে আমার খুব ভালোলাগে।কেন লাগে সেটা বলবো না।আপনি জানতে চাইলেও না।
আমি তার কথার পিঠে কোন কথা বললাম না।হাত নেড়ে বিদায় জানালাম শুধু।

দুুই.

মুমিন সাহেবের জোড়া টিয়া বদের হাড্ডি।তারা আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকাতেই চাইনা।সবসময়ই পাছা ফিরিয়ে রাখে।সপ্তাহ ধরে তাদের জোড়া পাছা দেখতে দেখতে আমার চোখের পাওয়ার পঞ্চাশ কমে গেছে।
মনে হয় এরা আমাকে মালিক হিসেবে মেনে নিতে পারছে না।মুমিন সাহেব এদের পিছনে দীর্ঘদিন খেটেছেন।পোষ মানিয়েছেন।কথা শিখিয়েছেন।তার মধ্যবয়স্ক মুখটা এদের হৃদয়ে এতদিনে আঁকা হয়ে গেছে।এটা মুছতে একটু সময় তো লাগবেই।
মেয়েমানুষেরা বেশি প্রাণী প্রেমি হয়।তাদের ভেতর প্রাণী বশীকরণের অসাধারণ ক্ষমতা থাকে।সুতরাং টিয়া দুইটার হৃদয় থেকে ইতি মুমিন সাহেবের মুখটা মুছে সহজেই তার মুখটা আঁকতে পারবে।এবং খুব তাড়াতাড়িই পারবে।তাই এই ইস্পাত-কঠিন কর্মটা আমি তার জন্যে ফেলে রেখেছি।

তিন.

পাখি দুইটার উপর আমি যারপরনাই বিরক্ত।শালারা পাছার দিক পরিবর্তন করছে না।তাই খাঁচাটা বারান্দায় ফেলে দরজা আটকে দিয়েছি।চোখে সামান্য ঘুম ছিল।এখন নেই।বিরক্তির চোটে কেটে গেছে।সব দোষ জোড়া টিয়ার।
বিছানায় শুয়ে বই হাতে নিলাম।সুকুমার রায়ের ছড়ার বই।রম্য ছড়া।ছোট বই।শেষ করতে বেশিক্ষণ লাগলো না।ঘড়িতে সময় দেখলাম।রাত এগারোটা সাত।আর তিপ্পান্ন মিনিট।এরপর তারিখ বদলে যাবে।নতুন তারিখ আসবে।আর এই নতুন তারিখটাই ইতির জন্মতারিখ।পার্টির আয়োজন করা হয়েছে।ঠিক বারোটায়।আমি সেখানে আমন্ত্রিত অতিথি।ইতিই আমন্ত্রণ জানিয়েছে।কিন্তু আমি যাবো না।ইতির বাপজান কঠিন মানুষ।আমাকে তিনি একেবারেই সয্য করতে পারেন না।আমাকে দেখলেই তার শরীরের প্রতিটা পশমের গোড়ায় আগুন লেগে যায়।সুতরাং,সেখানে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।আগামীকাল ভোরে তাদের বাসার দারোয়ানের কাছে উপহারটা বুঝিয়ে দিয়ে আসবো।সে জায়গামতো পৌঁছে দেবে।দারোয়ান ব্যাটা মানুষ ভালো।সেও আমাকে মুমিন সাহেবের মত ভালোবাসে।কেন বাসে জানি না।জানার আগ্রহও নেই।
বারোটা বেজে গেছে।ঘুম আসছে না।আসার কোন লক্ষণও নেই।ইতির সাথে কথা বলা যেতে পারে।তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানো দরকার।না জানালেও সে কিছু মনে করবে না।তারপরও জানানো দরকার।ইতিকে ফোন করলাম।টিট টিট করে লাইন কেটে গেল।ফোন বন্ধ।মানে তার মেজাজ খারাপ।মেজাজ খারাপ করলেই ফোন বন্ধ করে রাখে সে।মোবাইলটা বালিশের পাশে রেখে ঘুমানোর আখেরি চেষ্টাটা করলাম।আখেরি চেষ্টায় কাজ হলো।চোখের পাতা কেমন ভারী ভারী ঠেকছে।মানে ঘুম আসছে।কিছুক্ষণের মধ্যে চলেও এলো।ঘুমের ভেতরই ডোরবেল বেজে উঠতে শুনলাম।ঘুম ভেঙে গেল।মেজাজ চড়ে গেল।বিরক্তি নিয়ে উঠে বসলাম।মনে মনে খুঁজতে লাগলাম কে বা কারা এতো রাতে আমার কাছে আসতে পারে।অনেক খুঁজেও মস্তিষ্কের কাছ থেকে কোন সাড়া পেলাম না।গুগলে খুঁজে দেখলে কেমন হয়?কাজ হবে?হবে না।
অধীক রাতেরবেলা সাধারণত চোর-পুলিশরা ডোরবেল বাজায়।কিন্তু আমার এখানে চোর আসবে না।কারণ আমি হতদরিদ্র।পুলিশও আসবে না।কারণ আমি নিরপরাধ,মাসুম।চিন্তা করতে করতে দরজা খোলার কথা ভুলে গেলাম।ডোরবেল আবার চেঁচিয়ে উঠে মনে করিয়ে দিল।উঠে গিয়ে খুলে দিলাম দরজা।বাইরে ইতি দাঁড়িয়ে।তার মুখে হাসি।হাতে কেকের বাক্স।তাকে দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠলাম আমি।এই মেয়ে তো সাংঘাতিক!এতো রাতে মগবাজার থেকে মিরপুর চলে এসেছে।

চার.

খাটের উপর আমি আর ইতি মুখোমুখি বসা।ইতি নখ দিয়ে বিছানার চাদর ছেঁড়ার চেষ্টা করছে।কিন্তু পারছে না।পারার কথাও না।বিছার চাদর যথেষ্ট মোটা।এই জিনিস নখ দিয়ে ছেঁড়া সম্ভব না।
আমাদের দু'জনার মাঝ বরাবর একটা চারকোণা উন্মুক্ত কেক।ক্রিমি কেক।উপরে কারো নামটাম লেখা নেই।অথচ থাকা উচিত ছিল।
কেকের চারকোণায় ছোটছোট চারটা মোম জ্বলছে।দেখতে সুন্দর লাগছে।ইতি ফুঁ দিয়ে আমাকে মোম নিভাতে বললো।আমি বললাম,জন্মদিন তোমার।মোম নিভাবে তুমি।
সে বললো,আমি বলছি,তুমি নিভাবে।
আর কথা বাড়ালাম না।মেয়েমানুষেরা সাধারণত এক কথার হয়।তারা যেটা বলবে সেটাই।অপর কারো কথা বা মতের তোয়াক্কা তারা করে না।লম্বা একটা ফুঁ মেরে চারটা মোম একসাথে নিভিয়ে ফেললাম।কেক কাটা হলো।খাওয়া হলো।খাওয়া শেষ করে ইতিকে বললাম,তোমার অনুষ্ঠানের খবর কী?
ইতি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,হয়নি।আগামীকাল ভাইয়া তার ধলা চামড়ার বউ নিয়ে দেশে আশছে।তারা এলে পরে হবে।
'ভালো তো।তুমি একটা বিনা বেতনের পার্টটাইম জব পাবে।'
'বুঝলাম না।বুঝিয়ে বলো।'
'না বোঝার কিছু নাই।তোমার ভাবি হচ্ছে বিদেশি রমণী।সে তো আর বাংলা জানে না।তুমি তাকে বাংলা শিখাবে।এটাই...।'
আমার কথা শুনে সে মাথা খারাপের মতো করে হাসতে লাগলো।হাসতে হাসতেই বললো,আমার গিফট কই?
আমি বারান্দা থেকে খাঁচাসমেত পাখি দুইটা এনে তার সামনে রাখলাম।জোড়া টিয়া দেখে সে আনন্দে চিৎকার জুড়ে দিল।মেয়েদের এই একটা বদ অভ্যাস।কোনকিছুকেই তারা সাধারণভাবে নিতে পারে না।ভালো-খারাপ যা-ই হোক না কেন,অল্পতেই চিৎকার চেঁচামেচি করে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে ফেলে।যত্তসব ন্যাকা!

পাঁচ.

উপহার হিসেবে জোড়া টিয়া ইতির মন জয় করে ফেলেছে।এখন দুনিয়ার সবকিছু ভুলে টিয়া নিয়ে মেতে আছে সে।তাদের সাথে কথা বলছে।তাদেরকে মরিচ খাওয়াচ্ছে।তারাও সুবোধের মতো কপাকপ মরিচ সাবাড় করে যাচ্ছে।
টিয়াদের সাথে দীর্ঘ সময় কাটিয়ে ইতি বললো,চলো ছাঁদে যায়!
আমি গম্ভীর মুখে বললাম,ছাঁদ তালা মারা।চাবি বাড়িঅলার কাছে।
সে বললো,অসুবিধা নাই।আমার পার্সে ক্লিপ আছে।ক্লিপ দিয়ে খুলে ফেলবো।
আমি পরাস্ত সৈনিকের ভঙ্গিতে বললাম,চলো,যাই তাহলে।
ঘর থেকে বের হওয়ার সময় পাখি দুইটাও আমাদের সাথী হলো।
ইতি তার ক্লিপ কারিশমায় টুকুস করে তালা খুলে ফেললো।(এই মেয়ে ছোটকালে চুরিচামারি করতো মনে হয়।)আমরা ছাঁদে প্রবেশ করলাম।চমৎকার পরিবেশ।মেঘমুক্ত আকাশ।চাঁদনি রাত।চারদিকে জোছনা থৈ থৈ করছে।আমি চাঁদের দিকে তাকিয়ে হা করে জোছনা গিলতে লাগলাম।ইতি আমার কানে কানে বললো,টিয়া দুইটা ছেড়ে দেই?এদেরকে আটকে রাখতে ভালোলাগছে না।আমি মাথা নেড়ে তার কথায় সম্মতি জানালাম।ছাঁদের মাঝ বরাবর গিয়ে জোড়া টিয়া মুক্ত করে দিল সে।ছাড়া পেয়েই সাথে সাথে উড়ে গেল না তারা।ইতির মাথার উপর বৃত্তাকারে ঘুরতে লাগলো।তাদের দিকে তাকিয়ে আনন্দের আতিশয্যে কেঁদে ফেললো সে।এটাও মেয়েমানুষের একটা বদ অভ্যাস।তারা সুখেও কাঁদে,দুঃখেও কাঁদে।চক্ষুজল বিসর্জন ছাড়া তাদের সুখ-দুঃখ হজম হয়না।
ইতি কাঁদছে।আমি দেখছি।কিন্তু থামাচ্ছি না।আসলে সুখের কান্না বলেকয়ে থামানো যায় না।থামানো যায় শুধু দুঃখের কান্না।
mahbubrahat1@gmail.com

1 comment: