1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, January 1, 2020

ছেঁড়া মলাটের আড়ালে


                                                          ...রাজর্ষি বর্ধন



          সা-সার বইগুলোর দিকে চোখ বোলাতে বোলাতে চলে রাজন্যা, মাঝে-মাঝে কোন একটা বিশেষ বইকে লক্ষ্য করে থমকে দাঁড়াচ্ছে কেমন মৃত সৈনিকের মতো পড়ে আছে বইগুলো ! যেন বহুবছরের হরেকরকম অম্ল-মধুর কিংবা তিক্ত অভিজ্ঞতার সাক্ষ্য বহন করে একরকম ক্লান্ত, অবসন্ন হয়ে পড়েছে, যা প্রকাশ পাচ্ছে তাদের বাহ্যিক জীর্ণতায় এবং মলিনতায় !

          একপাশে পার্ক করা আছে তাদের গাড়িটা, তার ভেতরে এসির মধ্যে বসে বিরক্ত হয়ে উঠছে রাজন্যার স্বামী অগ্নিদেব বউয়ের এই হঠাৎ পাগলামিতে যে সে যথেষ্ট বিব্রত তা বেশ পরিষ্কার ! খাবি খাওয়া মাছের মতো সে ছটফট করলেও নিজের সংস্কৃতমনস্ক বউয়ের কাছে তা প্রকাশ করতে পারছে না ! তাই সে গাড়ির মধ্যে বসে একবার রাজন্যার দিকে, একবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে ! তবে তার এতো দুশ্চিন্তারও কোন কারণ ঘটেনি, তাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছাবার নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই তারা রওনা দিয়েছিল, এবং তার কাছাকাছিও চলে এসেছে ! সুতরাং এখন যে সময় নষ্ট হচ্ছে, সে কথাও বলা যাচ্ছে না ! তাই বউকে কোনরকম তাড়া দেওয়ার চেষ্টা সে করে না, কিন্তু গাড়ির ভেতরে বসে উস্মা ছড়াতে থাকে !
          রাজন্যার চোখ এখনও সারি দিয়ে শোয়ানো বইগুলো থেকে সরেনি মেডিক্যাল কলেজের উল্টোদিকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দারভাঙ্গা বিল্ডিঙের লাগোয়া ফুটপাথ থেকে সে বই কেনেনি বহুদিন ! শেষ বোধহয় কিনতে এসেছিল কলেজে পড়াকালীন সে প্রেসিডেন্সির অর্থনীতির ছাত্রী ছিল, তখনও প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি হয়নি কলেজ ছুটি হলে সে দিনে একবার এই ফুটপাথে আসতই, আর এই পুরনো বইগুলোকে উলটে-পাল্টে দেখত ! বই যে খুব কিনত তা কিন্তু নয়, কিন্তু এই পুরনো বইগুলোকে উল্টে-পাল্টে দেখার মধ্যে একটা আনন্দ ছিল ! সে আনন্দ নতুন বই হাতে নেওয়ার থেকে আলাদা ! সেখানে বইয়ের পাতার সুগন্ধ নেওয়ার পুলক হয়ত নেই, কিনত এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ আছে নিঃসন্দেহে ! রোমাঞ্চ, পুরনো স্মৃতি হাতড়ানোর ! মলিন, হলদেটে, উইপোকায় কাঁটা পাতাগুলোর মধ্যে যেন অনেক ভালোবাসা, অনেক অহ ংকার, অনেক মান-অভিমানের পরশ লাগানো থাকে ! কতো কান্নাহাসির, সুখ-দুঃখের দলিল যেন এই পুরনো বইগুলো ! “বুবুনকে পাঁচ বছরের জন্মদিনে জ্যাঠামশাইয়ের ছোট্ট উপহার,” “শ্রীমতী হাসিরানী দাসকে বনগ্রাম মোক্ষরাণী বালিকা বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত আবৃতি প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকারের জন্য-“,”শুভেন্দু ও মৌসুমির বিবাহের প্রীতি উপহারস্বরূপ, অমিত,১৯৭৮”- এরকম কতো কিছুই লেখা থাকতে দেখা যায় বইগুলোর প্রথম পাতাতে এ যেন এক আশ্চর্য টাইমট্র্যাভেল ! লেখাগুলো পড়ার সাথে-সাথে সেই ঘটনাগুলি যেন চোখের সামনে ফুটে ওঠে ! স্কুলের আবৃতিতে প্রথম পুরস্কার পাওয়া, বিয়ের উপহার হিসেবে সঞ্চয়িতাপাওয়া, কিংবা……কিংবা শীতের বিকেলে প্রেমিকার হাতে তুলে দেওয়া কলেজ-পড়ুয়া ছেলেটার  টিউশনির টাকা জমিয়ে কিনে দেওয়া বুদ্ধদেব বসুর শ্রেষ্ঠ কবিতাবইখানি !পেছন থেকে গাড়ির হর্নের জোড়াল শব্দ কানে আসে অগ্নিদেব অধৈর্য হয়ে উঠছে ! তার বিজনেসম্যান স্বামীর এইসব বিষয়ে আগ্রহ কম সে জানে পুরনো বই কেন, খবরের কাগজ আর বিজনেস জার্নাল বাদে আর কিছু পড়ে বলে মনে হয় না ! সে নিশ্চয়ই রাজন্যার এই হঠাৎ রাস্তায় নেমে ব্যয়ী দেখাটাকে ভালো চোখে দেখছে না, বরং বউয়ের খামখেয়ালিপনা তাকে মুখ বুজে বরদাস্ত করতে হচ্ছে ! ভাবছে, ফুটপাথে নেমে এই পুরনো, ময়লা বই দেখাটা এতো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল কেন রাজন্যার কাছে, যখন সে একটা অন্য কাজে বেরিয়েছে ! তারা চাইলেই কাজের শেষে কোন শপিং মলের ঝা চকচকে বুক স্টোরে গিয়ে বই দেখতে পারে, সেখানে রাজন্যা যতক্ষণ ইচ্ছে বই দেখুক, অগ্নিদেব কোন আপত্তি করবে না ! কিন্তু এই হঠাৎ রাস্তায় নেমে ব্যয়ী দেখাটা তার অস্বাস্থ্যকর আর বিশৃঙ্খল লাগছিল !
          আসলে তারা মহাজাতি সদনে যাচ্ছিল। আজ সেখানে রাজন্যার একটা আবৃতির অনুষ্ঠান রয়েছে। ধর্মতলায় অগ্নিদেবের অফিসে একটা ছোট্ট কাজ মিটিয়ে তারা গাড়িতে করে মহাজাতি সদনের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিল। কলেজ স্ট্রিটে উঠেই মেডিক্যাল কলেজ পেরবার সময় রাজন্যার সেই ফুটপাথের দিকে নজর পড়ে, সঙ্গে-সঙ্গে গাড়ি থামিয়ে সেখানে নেমে পড়ে ! বুউয়ের এই আচরণে অগ্নিদেব যথেষ্ট অবাক হলেও কোন প্রতিবাদ করে না ! রাজন্যার অনুষ্ঠান শুরু হবে পাঁচটায়, এখন সবে পৌনে চারটে বাজছে, হাতে সময় আছে প্রচুর ! এতো তাড়াতাড়ি যাওয়ার একটাই উদ্দেশ্য ছিল, রাজন্যার নিজের পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করা আর আড্ডা মারা!  তাই অগ্নিদেব বিশেষ আপত্তি করেনি। কিন্তু আধঘণ্টা পেরিয়ে গেলো, রাজন্যার এখনও বই দেখার পর্ব মিটল না দেখে  অধৈর্যয় হয়ে উঠল অগ্নিদেব ! একটানা গাড়ির মধ্যে বসে থাকতেও তার অসহ্য লাগছিল ! নেহাত ডাক্তারের বারণ আছে, নইলে সে গাড়ি থেকে নেমে সিগারেট ধরাত ! বিকেলের কলেজস্ট্রিটে ব্যস্ততা বাড়ছে, কলেজপড়ুয়া ছেলেমেয়েদের যাতায়াত নজরে আসছে, তারই মধ্যে রাজন্যার বইয়ের পাতা উলটনো চলছে !
           কত ভালো-ভালো, দুষ্প্রাপ্য বই সামনে পড়ে রয়েছে অনাদরে, রাজন্যা এক-একটা তুলে উলটে-পাল্টে দেখতে লাগল। বেশীরভাগই মলাট ছেঁড়া, কিছু বই বাঁধানো। রবীন্দ্র রচনাবলীর পুরো সেট দেখতে পাচ্ছে, দেখা যাচ্ছে বিভুতি রচনাবলিগুলোকে, রয়েছে কাশীদাসি মহাভারত, রয়েছে পুরনো সব শারদ সংখ্যা ! পড়াশুনোর বই রয়েছে অনেক- নেসফিল্ডের গ্রামার বইয়ের পুরনো এডিশন, মাধ্যমিকের টেস্ট পেপার, জয়েন্টের কোশ্চেন ব্যাঙ্ক, পুরনো বইয়ের বইচিত্রও কম না ! হঠাৎই তার চোখ পড়ল একটা বইয়ের প্রতি! অনেক বইয়ের ভিড়ে চাপা পড়ে রয়েছে, শুধু ফাঁক থেকে নামটুকু দেখা যাচ্ছে- জীবনান্দ দাশের কাব্যগ্রন্থ “ঝরা পালক !” মলাটটা যেন খুব চেনা লাগছিল, সে উপরের মোটা-মোটা বইগুলোকে সরিয়ে সেই বইটাকে বের করে আনল। বইটা উইয়ে কেটেছে, হার্ড বাইন্ডিঙের মলাট খুলে গেছে, ভেতরের পাতাগুলো সব আলগা হয়ে এসছে ! মলাট উলটে প্রথম পাতা দেখার পরই বিদ্যুৎপৃষ্ঠের মতো হয়ে উঠল রাজন্যা ! পাতার একটা কোনে নীল কালিতে সুন্দর করে লেখা- “রাজন্যাকে দিলাম- অরুন, ১৯৯৪ !”
          সঙ্গে-সঙ্গে, কালের গাড়িতে উঠে হু হু করে পেছন দিকে ছুটতে লাগল তার স্মৃতি ! চোখের সামনে ভেসে উঠল প্রেসিডেন্সির করিডর, ভেসে উঠল কফিহাউসের জমায়েত ! সোনালী সেইসব দিনের টুকরো-টুকরো ছবি ! কলেজের বন্ধুরা, গান, কবিতা, আবৃত্তি- আর অরুন ! আজ বারবার মনে আসতে লাগল সেই সব সোনালী দুপুরের কথা, যখন তারা ট্রামরাস্তা ধরে হাত ধরাধরি করে হেঁটে জেত,কফি হাউসের আড্ডা থেকে বেরিয়ে ! কলেজস্ট্রিটের ব্যস্ততার মধ্যে অরুন হাঁটতে-হাঁটতে নিজের স্বরচিত কবিতা শোনাত ! কবিতা লিখত অরুন, নিজে একটা লিটিল ম্যাগিজিন চালাত সেই কলেজে পড়াকালীন ! তার প্রিয় কবি ছিল জীবনান্দ দাশ, প্রেমিকা রাজন্যাকে সেই কবির সব বইই উপহার দিয়েছিল, শেষ ছিল এই বইটা- “ঝরা পালক !” আজ অরুনও সেই পালকের মতো ঝরে গেছে কোথায়, হারিয়ে গেছে তার কবিতার ধূসর পাণ্ডুলিপি !  এতো কবিতা সে শুনিয়েছিল রাজন্যাকে, তবু একটা কবিতাও তার আজ মনে নেই ! সেই চাইলেও অরুনের কোন কবিতা আবৃত্তি করতে পারবে না ! তার আর অরুনের বনলতা সেন হয়ে ওঠা হয়নি ! তাই আজ বছর কুড়ি পরে, স্মৃতির অতলে ডুবে গিয়ে রাজন্যা নিজেকে বড় অসহায় মনে করছে !
“হোয়াট দ্য হেল আর ইউ ডুয়িং দেয়ার ! দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে কি তামাশা করছ ! আমাদের যে একটা যায়গায় যেতে হবে হ্যাভ ইউ ফরগটেন ! সেসব ভুলে গিয়ে রাস্তা দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে সাহিত্য মারাচ্ছ ! ইডিয়ট !” বিকেলের নিস্তব্ধতাকে খান-খান করে দিয়ে অগ্নিদেবের কথাগুলো ধেয়ে এলো ! রাস্তার পথচারীরা, এমনকি ফুটপাথের ব্ইবিক্রেতারাও হকচকিয়ে উঠল ! অগ্নি গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে, চারপাশের সবাই তাদের দিকে দেখছে, সে দৃশ্যটা ঝাপসা হয়ে উঠল রাজন্যার চোখের সামনে ! সে বুঝল, তার জীবন থেকে এখন কবিতা বিদায় নিয়েছে, বিদায় নিয়েছে বিকেলের লালচে হয়ে আসা আলো ! জীবনের সেই মধুর সব স্মৃতি আজ পুরনো বইয়ের পাতার মতো হলদেটে, মলিন হয়ে গেছে ! তার চোখ থেকে টপটপ করে জলের ফোঁটা হাতে ধরে থাকা বইয়ের প্রথম পাতার এককোণে নীল ফাউন্টেন পেনে লেখা অক্ষরগুলোকে ভিজিয়ে দিতে লাগল......

rajarshib25@gmail.com
কলকাতা 

No comments:

Post a Comment