...সিদ্ধার্থ সিংহ
নিমেষের মধ্যে
চিঠিটা পড়ে ফেলল প্রতাপ। আবার অনেক দিন পরে বৃন্দাবনার চিঠি পেল সে।সেই কবে থেকে ওর
সঙ্গে তার পরিচয়। প্রতাপ তখন সবেমাত্র স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েছে কি পেরোয়নি। ওর
বাবা বলতেন, আর কিছু না কর,
প্রত্যেক দিন সকালে উঠে খবরের
কাগজটা পড়বি। ওটা তো আর মুখ দেখার জন্য রাখি না। তোর জন্যই রাখি। আমি তো চায়ের
দোকানেই পড়ে নিই। আর চোখ দিয়ে পড়তে যদি কষ্ট হয়, অন্তত রেডিওটা খুলে একটু খবরটা শুনবি। তা হলেও
দেখবি গোটা পৃথিবীটা তোর হাতের মুঠোয়।
তখন সবেমাত্র
টিভি এসেছে। সাদাকালো। কার কার বাড়িতে টিভি আছে সেটা ছাদের ওপর অ্যান্টেনা দেখেই
বোঝা যেত। এবং যাঁদের বাড়িতে টিভি থাকত, তাঁদেরকে বড়লোক মনে করা হত।
আশপাশের কারও
বাড়িতে টিভি থাকলে শনি-রবিবার সবাই গিয়ে ভিড় করতেন সিনেমা দেখার জন্য। কেউ কেউ
যেতেন চিত্রাহার দেখতে। আর যাঁদের বাড়িতে টিভি থাকত, সেই বাড়ির মেয়ে-বউরা ওই দু'দিন একেবারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠতেন। কারণ, তাঁরা নিজেরাই ঠাঁই পেতেন না ঘরে। দরজা কিংবা
জানালার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে হত। আর পাড়া-প্রতিবেশী যাঁরা আসতেন,
তাঁদের ফাইফরমাস খাটতে
হত।তখনও বোতলে করে
জল খাওয়ার চল শুরু হয়নি। একজনকে জল দিলেই আর একজনের তেষ্টা পেয়ে যেত। আর কেউ জল
চাইলে গৃহস্থ বাড়ির লোকেরা তাঁকে না করেন কী করে! ফলে আবার গ্লাসে করে জল আনতে
ছুটতে হত।
বাড়িতে কেউ এলে
তাঁকে তো আর চা না খাইয়ে ছাড়া যায় না। লোকে কী বলবে! তাই সিনেমার শেষে
চা-বিস্কুটের ব্যবস্থাও করতে হত।তখন টিভি না
থাকলেও রেডিও থাকত সবার ঘরে। খারাপ হলে আজ সারাচ্ছি, কাল সারাচ্ছি করে ফেলে রাখলেও
ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের খেলার আগে বাড়ির ছেলেরা নড়েচড়ে বসতেন। রেডিও সারানোর
ধুম পড়ে যেত। এই একই ছবি দেখা যেত মহালয়ার আগেও। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চণ্ডীপাঠ
শোনার জন্য।
প্রতাপদের
বাড়িতেও বেডিও ছিল। বারবার ডেকেও ছেলে বিছানা ছেড়ে না উঠলে ওর বাবা ওর কানের
কাছে ফুল স্পিডে রেডিও চালিয়ে দিতেন। যাতে বালিশে কান চাপা দিয়ে রাখলেও, তার কানে গিয়ে খবরটা ঢোকে।
ও শুয়ে শুয়েই
খবর শুনত। তার পর মুখ-টুখ ধুয়ে সকালের খাবার খেতে খেতে বাবার নির্দেশে ওকে
আগাপাশতলা পড়তে হত খবরের কাগজটা। এমনকী বিজ্ঞাপনও বাদ দিত না।
সেই কাগজেই একদিন
ক্লাসিফায়েড বিজ্ঞাপনের পাতায় 'পত্রপত্রিকা'
নামের একটি ছোট্ট হেডিংয়ে
চোখ আটকে গেল প্রতাপের। ও দেখল, সেখানে লেখা
রয়েছে--- শারদীয়া 'রূপসী'তে জবাবি খামে লেখা পাঠান। সম্পাদক : বৃন্দাবন
কর। কৃষ্ণনগর, নদীয়া।
প্রতাপ তখন বেশ
কয়েকটা কবিতা লিখে ফেলেছে। তার দিনকতক আগেই ক্লাসে নোটিস পড়ে শুনিয়ে গিয়েছিলেন
অবনী স্যার--- প্রতি বছরের মতো এ বছরও আমাদের বিদ্যালয়ের বার্ষিক পত্রিকা প্রকাশিত
হবে। যারা যারা লেখা দিতে চাও, তারা আগামী
শনিবারের মধ্যে টিচার্স রুমে এসে অবনি স্যার কিংবা শ্যামল স্যারের কাছে লেখা দিয়ে
যাবে। গল্প, কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ কিংবা 'আমার কাছে আমার
স্কুল', নিয়ে যে কোনও একটা লেখা।
লেখা যেন খুব বেশি বড় না হয়।
প্রতাপের ক্লাসে
পড়ত কার্তিক। একেবারে কার্তিক ঠাকুরের মতোই দেখতে। কিন্তু একটু ভিতু টাইপের। ওর
খুব ভাল বন্ধু। দু'দিন পরে জমা
দেওয়ার জন্য ও একটা গল্প নিয়ে এসেছিল। কিন্তু স্যারের কাছে একা যেতে সাহস
পাচ্ছিল না। তাই প্রতাপকে বলেছিল, চল না আমার সঙ্গে
টিচার্স রুমে, ম্যাগাজিনের জন্য
স্যারকে একটা লেখা দেব।
প্রতাপ গিয়েছিল
এবং ওকে লেখা দিতে দেখে ওরও ইচ্ছে হয়েছিল একটা লেখা দেবার। কিন্তু কী লিখবে সে?
গল্প? সে তো অনেকখানি লিখতে হবে! তার চেয়ে বরং কবিতা
লেখাই ভাল। কম খাটুনি।
ম্যাগাজিনে
দেওয়ার জন্য 'ডাল'-এর সঙ্গে 'হাল', 'বই'-এর সঙ্গে 'কই', 'হাত'-এর সঙ্গে 'ভাত' মিলিয়ে মিলিয়ে কবিতা লিখতে শুরু করল ও। আর এক-একটা লেখা শেষ হলেই সেটা
কার্তিককে দেখানোর জন্য ছটফট করত। স্কুল শুরু হওয়ার অনেক আগেই চলে আসত। কিন্তু
কার্তিক তো জানত না, তার বন্ধু তাকে
কবিতা দেখানোর জন্য আগে থেকে এসে স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ও ওর সময় মতো যখন
আসত, তখন গেট বন্ধ হয়-হয় আর
কী! তাই দু'জনেই তাড়াহুড়ো
কপে ঢুকে পড়ত স্কুলে। প্রতাপের আর কবিতা দেখানো হত না। টিফিনের সময় সবাই যখন খেলত,
একসঙ্গে জড়ো হয়ে গল্প
করত। তখন কার্তিককে নিয়ে স্কুলের মাঠের এক কোণে গিয়ে প্রতাপ ওর সদ্য লেখা কবিতা
শোনাত। ওর মনে হত, ও যখন গল্প
লিখেছে, মানে অতগুলো পাতা লিখেছে,
তখন এই ক'টা লাইন কেমন হয়েছে, ও কি আর বুঝবে না! ভীষণ গুরুত্ব দিত ওকে।
কার্তিক এক-একটা
কবিতা শুনত আর বলত, এইটা ঠিক ভাল
লাগছে না রে, এখনও তো লেখা জমা
দেওয়ার অনেক সময় আছে। তুই আর একটা লেখ... এই ভাবে স্কুল-ম্যাগাজিনে লেখা দেওয়ার
শেষ দিন যত ঘনিয়ে আসতে লাগল, কার্তিক একটার পর
একটা কবিতা নাকচ করে দেওয়ায় এবং 'আমি লেখা দেবই'
একবগ্গা জেদ ধরে ধাকায়
প্রতাপও লিখে যাচ্ছিল কবিতার পর কবিতা। এই ভাবে ওর লেখার সংখ্যা একটা-একটা করে
প্রতিদিনই বাড়তে লাগল। প্রতাপের মাথায় তখন একটাই চিন্তা, কার্তিকের লেখা ছাপা হবে, আর আমারটা হবে না!
কার্তিকের লেখাটা
ছাপা হয়েছিল স্কুল ম্যাগাজিনে। আর কতগুলো কবিতার মধ্যে থেকে বেছে-বুছে প্রতাপের
যে দুটো কবিতা ম্যাগাজিনে দিতে বলেছিল কার্তিক, একসঙ্গে গিয়ে দিয়েও এসেছিল অবনীর স্যারের
হাতে, সেটা আর ছাপা হয়নি।
খুব মন ভেঙে
গিয়েছিল প্রতাপের। কেন ছাপলেন না স্যার! লেখাটা কি ভাল হয়নি! কার্তিক বেছে
দিয়েছে, তাও! নাকি স্যার
ঠিক বুঝতে পারেননি! নাকি ভেবেছেন, আরও অনেকের মতো
আমিও বাড়ির বড় কাউকে দিয়ে লিখিয়ে এনেছি! হাজার একটা ভাবনা মাথার মধ্যে ঘুরপাক
খাচ্ছিল। কিন্তু স্যারকে জিজ্ঞেস করার সাহস হয়নি ওর।
সেই লেখা ক'টা খাতার পাতাতেই থেকে গিয়েছিল। ভেবেছিল,
আর কোনও দিনও বোধহয় এগুলো
ছাপা হবে না। তাই আর নতুন করে কিছু লেখেওনি। ঠিক এমন সময় চোখে পড়ল খবরের কাগজের
এই 'পত্রপত্রিকা'র
বিজ্ঞাপন।
ওখানে লিখে
দেওয়া নিয়ম অনুযায়ী সাদা কাগজের এক পিঠে, বাঁ দিকে মার্জিন রেখে, আলাদা আলাদা পাতায় গোটা গোটা অক্ষরে দুটো
কবিতা কপি করেছিল সে। একটা পছন্দ না হলে যাতে অন্যটা পছন্দ হয়। তার পর কবিতার নীচে
নিজের নাম ঠিকানা লিখে, জবাবি খাম-সহ
পোস্ট করে দিয়েছিল 'রূপসী' পত্রিকায়। বৃন্দাবন করের নামে।
সপ্তাহখানেকও
কাটল না। কবিতার সঙ্গে পাঠানো তার নিজের হাতে লেখা নাম-ঠিকানাওয়ালা সেই জবাবী খাম
এসে পৌঁছল। তার থেকে বেরোল ছাপানো একটা চিঠি। যার মোদ্দা কথা--- ত্রৈমাসিক রূপসী
পত্রিকার আগামী শারদীয়া সংখ্যা খুব শীঘ্রই প্রকাশিত হবে। সেখানে বাঘা বাঘা সব
কবি-সাহিত্যিকরা লিখছেন। তাঁদের পাশাপাশি মাত্র কয়েক জন তরুণের লেখা ছাপা হবে।
আপনার লেখা 'আকাশ' নামের কবিতাটি সম্পাদক মণ্ডলীর বিচারে মনোনীত
হয়েছে। আপনি বাৎসরিক গ্রাহক চাঁদা মাত্র দশ টাকা এম. ও. যোগে সম্পাদকের নামে
পাঠিয়ে দিন। পত্রিকা বেরোলে আপনাকে ডাকযোগে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। বছরে চারটে
সংখ্যা বেরোয়। আমরা একমাত্র গ্রাহকদের লেখাকেই বিশেষ ভাবে গুরুত্ব দিয়ে ছাপি।
প্রতাপ খুব খুশি।
স্যার তার লেখা বুঝতে পারেননি। তাই তার কবিতা স্কুল ম্যাগাজিনে ছাপা হয়নি। তাতে
কী হয়েছে! কার্তিক তার কবিতা ঠিক বুঝতে পেরেছিল। ওই বেছে দিয়েছিল তার দুটো কবিতা।
না, সেগুলো স্কুল ম্যাগাজিনে ছাপা হয়নি দেখে ওই
কবিতা দুটোই ও রূপসীতে পাঠিয়েছিল। আর দ্যাখো, সে লেখা ওখানে পৌঁছতে না পৌঁছতেই কেমন মনোনীত
হয়ে গেল! স্কুলের ম্যাগাজিনে ছাপা হয়নি তো কী হয়েছে? অত দূরের একটা কাগজে তো আমার লেখা ছাপা হতে
চলেছে! প্রতাপ খুব খুশি।
টিফিনের পয়সা
বাঁচিয়ে একটু একটু করে বেশ কিছু টাকা ও মাটির ঘটে জমিয়েছিল। নাড়ালেই ঝনঝন করে
শব্দ হয়। হাতে নিলে বোঝা যায় বেশ ভারী। দশ টাকা কেন? তার থেকে বেশিই হবে।
এত বড় একটা
সুযোগ তার সামনে যখন এসেছে, দশ টাকার জন্য কি
তা হাতছাড়া করা যায়! কাউকে কিছু না বলে চুপিচুপি ভরদুপুরে ঘরে ঢুকে ও ছিটকিনি
তুলে দিয়েছিল। তার পর সেই ঘটটা আলমারির ভেতর থেকে বের করেছিল। ঠাকুমার পাকা চুল
তোলার শোন দিয়ে টেনে-টেনে একটার পর একটা পাঁচ পয়সা, দশ পয়সা, কুড়ি পয়সা, সিকি, আদুলি বের করেছিল। সেই খুচরোগুলো মুদিখানার দোকানে দিয়ে আস্ত একটা দশ টাকার
নোট করিয়ে নিয়েছিল। তার পর পোস্ট অফিসে গিয়ে সেই টাকা মানি অর্ডার করে দিয়েছিল
বৃন্দাবন করের নামে।
দুই
পোস্ট কার্ডের
দাম মাত্র পনেরো পয়সা। যে সব সম্পাদক জবাবি খাম পাঠাতে বলেন না, তাঁরা লেখা পেলে সাধারণত পোস্ট কার্ডেই জানান
মনোনীত হয়েছে কি না। কিন্তু বৃন্দাবন ঠিক করেছিল, না, যখন করছি, তখন ভাল ভাবেই
করব। চিপ কিছু করব না। অন্যান্যদের মতো তাই পোস্ট কার্ডের এক দিকে লাল বা নীল রঙে,
যাকে পাঠাব, তার নাম লেখার জায়গাটুকু ছেড়ে, কবিতার নাম লেখার জায়গাটায় একটা বড় ড্যাস
চিহ্ন দিয়ে মনোনীত / অমনোনীত লিখে ছাপাব না। সবাই এটা করে। ওই ড্যাসের জায়গায়
কবিতার নামটা বসিয়ে দেয়। আর মনোনীতর পরে 'টিক' চিহ্ন দিয়ে দেয়। 'অমনোনীত' লেখা থাকলেও, কোনও সম্পাদকই ওই শব্দটার উপরে 'টিক' দেওয়ার সাহস দেখায় না। যদি কেউ চ্যালেঞ্জ করে, 'কেন ওটা অমনোনীত হল জানান', তখন তাঁরা আমতা আমতা করবেন বা কায়দা করে এড়িয়ে
যাবেন। কোনও কথা গুছিয়ে বলতে পারবেন না
তাই নিয়মাবলিতে
যতই লেখা থাক বাঁ দিকে মার্জিন রেখে লিখবেন, এটা এমন করে লেখেন, যেন লেখাটার যেখানে যেখানে ভুল আছে, তাঁরা সেটা কেটেকুটে সংশোধন করে ওখানে লিখবেন।
যতই বলা থাক, সম্পাদকের সম্পূর্ণ
স্বাধীনতা থাকবে সংযোজন, সংশোধন ও
পরিমার্জনের। কিন্তু কোনও সম্পাদকই তা করেন না। যতই বলুন, সম্পাদকমন্ডলীর বিচারই চূড়ান্ত। আসলে
সম্পাদকমন্ডলী বলে আদৌ কিছু নেই। সব ওই একজনই।
বৃন্দাবন তাই
ছাঁট কাগজ কিনে এনে তার রূপসীতে লেখার নিয়মাবলি ছাপিয়েছিল। ইচ্ছে ছিল, নীল কালিতে ছাপবে। কিন্তু সেই সময় একজনের
বিয়ের কার্ড লাল কালিতে ছাপা হচ্ছিল, ওটা নামিয়ে মুছেটুছে নীল কালি দিয়ে ছাপতে রাজি হননি প্রেসের মালিক। তাতে
নাকি অনেক কালী নষ্ট হয়। তাই যখন যে কালীতে ছাপা হয়, তখন সেই রঙে ছাপার অর্ডারগুলোই পর পর ছাপা হয়।
বৃন্দাবনের তাড়া ছিল বলে অগত্যা ওই লাল কালিতেই নিয়মাবলি ছেপে নিয়েছিল সে। ঠিক
করেছিল, যাঁরা কবিতা, গল্প পাঠাবেন, তাঁরা লেখার সঙ্গে উত্তর পাওয়ার জন্য নিজের
নাম-ঠিকানা নেখা একটা জবাবি খাম পাঠাবেন। তাতেই ও এই চিঠিটা ভরে তাঁদের পোস্ট করে
দেবে।
না, পঞ্চাশ বা একশো কপি নয়, যেহেতু এগারোশো কপি পর্যন্ত ছাপতে প্রেস একই
টাকা নেয়, বেশি ছাপতে গেলে
শুধু কাগজটাই একটু বেশি কিনতে হয়, এই যা...
বৃন্দাবন তাই ছোট ট্রেডেল মেশিনে একেবারে এগারোশো কপি ছাপিয়ে নিয়েছিল। ভেবেছিল,
পঞ্চাশ বা একশো যাই ছাপি
না কেন, ফুরিয়ে গেলেই তো আবার ছাপতে
হবে। কেউ তো তার জন্য গ্যালি ধরে রাখবে না। আবার কম্পোজ করতে হবে। আবার প্রুফ
দেখা। আবার খরচ। পরে ছাপতে গেলেও তো কাগজ কিনতে হবে। তা, সেই কাগজটা একটু আগে একবারে কিনে নিলে ক্ষতি কী?
এ তো আর কাচা আনাজ নয় যে,
দু'দিন রাখলেই পচে যাবে! তার চেয়ে বরং কাগজের পিছনে
একটু বেশি টাকা ইনভেস্ট করে একেবারে ছেপে নিলেই ল্যাঠা চুকে যায়।
একবার যখন রূপসী
বের করা শুরু করেছি, এ তো আর বন্ধ করব
না। তিন মাস পর পর বেরোবেই। তার পর যদি দেখি দারুণ ভাবে চলছে, তা হলে দ্বিমাসিক করব। মাসিক করব। তার পর দরকার
হলে পাক্ষিক এবং তারও পরে সাপ্তাহিক। তার পরেও যদি দেখি লোকে চাইছে, তখন না-হয় দৈনিকের কথা ভাবব। আপাতত চিঠিগুলো
তো একটু বেশি করে ছাপিয়ে রাখি, নাকি...
কিন্তু না,
বিজ্ঞাপন দেখে যত লোক
কবিতা পাঠাবে বলে বৃন্দাবন ভেবেছিল, তার টেন পার্সেন্ট লোকও কবিতা পাঠায়নি। তার পর যাদের সে মনোনয়নের চিঠি
পাঠিয়েছিল, তাদের দশ ভাগের
এক ভাগও গ্রাহক চাঁদা পাঠায়নি। ফলে 'নিজের পকেটের পয়সা দিয়ে তো আর পরের কবিতা ছাপ়ব না', এটা ঠিক করে যারা গ্রাহক চাঁদা পাঠায়নি,
একটা সময়য়ের পর তাদের
কবিতা 'ছাপার জন্য' ফাইল থেকে বের করে 'আপাতত বাতিল' ফাইলে ঢুকিয়ে দিয়েছিলে সে।
কিন্তু যখনই আবার
কোনও মানি অর্ডার তার কাছে এসে পৌঁছত, সে সেই 'আপাতত বাতিল'
ফাইল ঘেঁটে ঘেঁটে বার করত
গ্রাহক চাঁদা পাঠানো সেই কবির কবিতা। কিন্তু এত কম কবি চাঁদা পাঠিয়েছিল যে,
তাদের কবিতাগুলো একসঙ্গে
জড়ো করে ছাপলেও তিন পাতার বেশি কিছুতেই হবে না! সে তাই অপেক্ষা করছিল, আর কার গ্রাহক চাঁদা আসে! আর কার গ্রাহক চাঁদা
আসে!
হঠাৎ ওর মনে হল,
আচ্ছা, গ্রাহক চাঁদা ছাড়া রূপসীর খরচ আর কী ভাবে
জোগাড় করা যায়! এটা নিয়ে দু'-চার জনের সঙ্গে
আলাপ-আলোচনাও করেছিল সে। একজনের বুদ্ধি মতো, কাগজটার মান আরও বাড়ানোর জন্য, পাশের পাড়ার নবীন সাঁধুখাকে পত্রিকার সভাপতি
করেছিল সে। তাঁকে সভাপতি করার একমাত্র কারণ, তিনি স্কুল শিক্ষক। বৃন্দাবন ঠিক করেছিল,
ওঁর নামের পাশে শুধু
শিক্ষকই নয়, উনি যে সত্যি
সত্যিই একজন স্কুল শিক্ষক এবং এ রকম একজন শিক্ষিত মানুষ যে তাদের প্রত্রিকার মাথার
ওপরে আছেন, সেটা দেখানোর
জন্যই উনি কোন স্কুলের শিক্ষক, সেই নামটাও দিয়ে
দেবে।
আরও একটা বড়
কারণ, উনি যে পাড়ায় থাকেন,
সেই পাড়ার দুর্গাপুজোর
প্রেসিডেন্ট তিনি। আর প্রেসিডেন্ট বলেই, প্রতি বছর একটা লামসাম টাকা সেই পুজোয় তিনি দেন।
তাঁকে সভাপতি
করলে তিনি রূপসীকে সামান্য হলেও, নিশ্চয়ই কিছু না
কিছু টাকা দেবেন। এই ধারণা তার বদ্ধমূল ছিল। তখনই সে ঠিক করেছিল, এই ভাবে যদি আরও দু'-চার জনকে সভাপতি বা উপদেষ্টা কিংবা সম্পাদক
মণ্ডলীর প্রধান করা যায়, তা হলে তাঁদের
কাছ থেকে যে আর্থিক সাহায্য পাওয়া যাবে, তাতেই রূপসীটাকে খুব ভাল ভাবেই বের করা যাবে।
লেখার তো কোনও
অভাব নেই। প্রচুর লেখা আছে। শুধু মনোনীত নয়, আপাতত বাতিল, বাতিল এবং অমনোনীত লেখাগুলো তো ছাপা যেতেই
পারে। তার ভাল লাগেনি মানেই যে ওই লেখাগুলো একদম পাতে দেওয়ার মতো নয়, তা তো নয়। ওই লেখাগুলো অন্য কারও ভাল লাগতেই
পারে। তাই বৃন্দাবন উঠেপড়ে লেগেছিল, এক একটা উপদেষ্টা, সভাপতি, শুভাকাঙ্খী, সম্পাদকমণ্ডলীর উপদেষ্টা জোগাড় করার জন্য। এবং
একদমই যে কাউকে পাচ্ছিল না, তাও নয়। পাচ্ছিল,
তবে তার জন্য বৃন্দাবনকে
একটু ছোটাছুটি করতে হচ্ছিল।
তিন
দিন যায়। সপ্তাহ
যায়। মাস যায়। পুজোর আর মাত্র আর ক'দিন বাকি, এখনও রূপসী এল
না! তা হলে কি পোস্ট অফিস থেকেই হারিয়ে গেল! হারাতে পারে! প্রতিদিন এত চিঠি আসে,
সব কি আর ঠিক ঠিক
জায়গায় পৌছয়! ওর বাবা 'সোভিয়েত দেশ'-এর গ্রাহক ছিলেন। ডাকযোগে আসত। আবার মাঝে মাঝে
এক-একটা সংখ্যা আসতও না। পোস্টম্যানকে জিজ্ঞেস করলে বলতেন, তা হলে হয়তো মাঝপথেই কোথাও খোয়া গেছে!
কখনও কখনও আবার
মাসের প্রথম সপ্তাহের জায়গায় শেষ সপ্তাহে এসে পৌঁছত। শুধু আমাদের ক্ষেত্রে নয়,
নিশ্চয় এই রকম আরও
অনেকের ক্ষেত্রেই হত।
এ বার হয়তো তার
ওপরেই সেই কোপটা এসে পড়েছে। রূপসী পত্রিকার সম্পাদক নিশ্চয়ই পোস্ট করেছিলেন,
কিন্তু তার কাছে এসে
পৌঁছয়নি। কেমন দেখতে হয়েছে পত্রিকাটি! কোন পাতায় ছাপা হয়েছে তার কবিতা! ছাপার
হরফে তার নামটা কেমন দেখাচ্ছে!
একবার চাক্ষুষ
করার জন্য প্রতাপ এ পত্রিকার স্টলে যায়। ওই পত্রিকার স্টলে যায়। দেখে শুকতারা
বেরিয়েছে। ঘরোয়া বেরিয়েছে। যারা বিজ্ঞাপন করে--- প্রসাদ একাই একশো। সেই প্রসাদ
বেরিয়েছে। কিশোর ভারতী বেরিয়েছে। আনন্দবাজার বেরিয়েছে। অমৃতবাজার বেরিয়েছে।
যুগান্তর বেরিয়েছে। দেশ বেরিয়েছে। বেরিয়েছে আরও অনেক অনেক কাগজ। প্রতাপ তন্ন
তন্ন করে সে সব দেখে। ওই সব পত্রিকার তলায় আবার রূপসী চাপা পড়ে যায়নি তো! তুলে
তুলে দেখে। তা হলে কি স্টলে আসা মাত্রই বিক্রি হয়ে গেছে সব ক'টা রূপসী!
'রূপসী'র আর দেখা পাওয়া গেল না। পুজো চলে গেল।
ভাইফোঁটা চলে গেল। বড়দিন চলে গেল। ফার্স্ট জানুয়ারিও পার হয়ে গেল। সামনেই
সরস্বতী পুজো। এত হাতছানির মধ্যেও হঠাৎ হঠাৎ রূপসীর জন্য মনটা যেন কেমন খচখচ করে
উঠত প্রতাপের। এর মধ্যে কতগুলো পোস্ট কার্ড যে ও ছেড়েছে, ওর নিজেরও তা মনে নেই। কিন্তু প্রত্যুত্তরে ও
প্রান্ত থেকে একটা লাইনও আসেনি।
তা হলে কি কেউ
তার পেছনে লেগেছে! চক্রান্ত করছে তাকে আটকানোর! কে হতে পারে! কারা! ঠিক সে সময়ই
লেটার বক্স থেকে সে একদিন দুপুরবেলায় উদ্ধার করল একটা ছাপানো পোস্ট কার্ড। তাতে
রূপসী পত্রিকার সম্পাদক বৃন্দাবন কর লিখেছে--- ত্রৈমাসিক রূপসী পত্রিকার শারদীয়া
সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। কলকাতায় আমাদের প্রধান এবং একমাত্র বিক্রয়কেন্দ্র---
তপন পুস্তক ভান্ডার। আপনি এই চিঠি দেখিয়ে আপনার লেখক-কপিটি সেখান থেকে সংগ্রহ করে
নিন। সঙ্গে বড় বড় হরফে সেই তপন পুস্তক ভাণ্ডারের ঠিকানা। নীচে বিঃ দ্রঃ করে
জানিয়ে দিয়েছেন, প্রত্রিকাটি
স্ফীত এবং লোভনীয় হয়েছে। প্রচুর চাহিদা। আমরা সাপ্লাই দিয়ে কুলোতে পারছি না।
হয়তো আবার ছাপাতে হবে। ডাকযোগে পাঠালে যদি খোয়া যায়, আমরা আর আপনাকে কোনও কপি দিতে পারব না। তাই এই
পদ্ধতি নিতে বাধ্য হলাম।
তা হলে এই রোজ
রোজ সকাল দুপুর বিকেলে লেটার বক্সে উঁকি মারাটা তার বিফলে গেল না! ভাগ্যিস এই
চিঠিটা মাঝপথে খোয়া যায়নি! আচ্ছা, পত্রিকাটা নিয়ে
আসার পর প্রথমে কাকে দেখাবে সে! কার্তিককে? বাবাকে? নাকি, যাঁকে স্কুল ম্যাগাজিনে ছাপার জন্য লেখা দেওয়ার পরও যিনি ওর লেখা ছাপেননি,
সেই অবনী স্যারকে?
নাকি আর কে কেমন লিখল,
সেটা না পড়ে পত্রিকাটি
হাতছাড়া করা ঠিক হবে না!
পর দিনই
সকাল-সকাল স্নান-টেনান সেরে সে বেরিয়ে পড়ল শিয়ালদার উদ্দেশ্যে। তাড়াতাড়ি না
গেলে হয়! তপন পুস্তক ভাণ্ডার নিশ্চয়ই হেঁজিপেঁজি দোকান নয়। বিশাল ব্যাপার। গমগম
করছে সারাক্ষণ। লট লট পত্রিকা ঢুকছে। আর নিমেষেই তা ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে যাচ্ছে
হকারেরা। ভিড়ের পেছনে তাকে কতক্ষণ
অপেক্ষা করতে হবে, আগে থেকে কি কিছু
বলা যায় নাকি!
সে যখন এই চিঠি
দেখাবে, তখন তো অবাক হয়ে যাবে
ওরা। এইটুকু একটা ছেলে রূপসীতে লিখেছে! তাও আবার যে সে সংখ্যায় নয়, একেবারে খোদ শারদীয়ায়! তাকে কোল্ড ড্রিংস সাধবে,
নাকি চা! গোঁফের রেখাই তো
এখনও স্পষ্ট হয়নি, তাকে কি সিগারেট
অফার করবে? করলে, বিনয়ের সঙ্গে সে কী ভাবে ফিরিয়ে দেবে সে-সব?
ফেরালে আবার আনস্মার্ট
ভাববে না তো!
বাস থেকে নেমে
একে তাকে জিজ্ঞেস করতে করতে সে যখন বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিট ধরে তপন পুস্তক
ভান্ডারের সন্ধান পেল, সিগারেটের
দোকানের লোকটা আঙুল তুলে দেখিয়ে দিল, ওই তো, ওটা। সে তখন
একেবারে আকাশ থেকে পড়ল। এটা!
শিয়ালদা ব্রিজের
নীচ দিয়ে গলে একটু গেলেই কাদা প্যাচপেচে বাজার। এখানে শাক-সবজি পাইকারি বেচাকেনা
হয়। হরদম লরি ডুকছে। বেরোচ্ছে। জল-কাদা আর শুধু গাদা গাদা লোকের ঠেলাঠেলিতে নরক
হয়ে উঠেছে গোটা এলাকা। তারই এক দিকে সার সার দোকান। কিন্তু এই দোকানটা তো বিশাল
বড়। একেবারে ঝাঁ-চকচকে। এত বড় দোকানে তার লেখা ছাপা হওয়া পত্রিকা রয়েছে!
তাকে হাঁ করে
কাপড়ের দোকানটার ওপরে বড় সাইন বোর্ডটা পড়তে দেখে সেই সিগারেটের দোকানের লোকটা
বললেন, ওটা নয়, ওটা ওটা।
ও পাশেরটা দেখে
আরও চমকে উঠল। এটা তো আরও ঝকঝকে। দিনের বেলাতেই যারা এত লাইট জ্বালায়, তা হলে তাদের বিক্রি কত! কিন্তু সামনে তো লেখা
রয়েছে--- পুরানো সোনা রূপা ন্যায্য মূল্যে খরিদ করা হয়। তার মানে এটা সোনা-রুপোর
দোকান। অর্থাৎ ওই সম্পাদক তাঁর পত্রিকায় বেরোনো সব ক'টা লেখাকেই সোনা-রুপো মনে করেন! মনে করেন হিরে,
পান্না চুনি! সেই জন্যই
তাঁর পত্রিকাটিকে তিনি এই রকম একটা দোকানে বিক্রির জন্য রেখেছেন। বাঃ, দারুণ তো!
সিগারেটের
দোকানের লোকটা তখন বললেন, কোথায় দেখছেন।
ওটা নয়। ওটা নয়। ওপরে তাকালে হবে? নীচে তাকান,
নীচে।
প্রতাপ নীচে
তাকাল। দেখল, পর পর দুটো দোকানের
প্রশস্ত প্রবেশ পথের মাঝখানে, ফুটপাথের ওপরে দু'হাত দিয়ে জড়িয়েও নাগাল পাওয়া যাবে না এত মোটা,
গোলাকার, লাল রঙের যে থামটা ওপরের গাড়ি-বারান্দাটাকে
ধরে আছে, সেই থামে হেলান
দিয়ে বসে আছেন খ্যাংরা কাঠি মার্কা একজন বয়স্ক লোক। তেল চিটচিটে জামাকাপড়। তার
মাথার ওপরে পেরেকে ঝোলানো ঝরঝরে হয়ে যাওয়া, যেন গত শতকের পুরনো টিনের একটা হাতখানেকের
সাইনবোর্ড। রঙের চটা উঠে গেলেও পড়া যাচ্ছে--- তপন পুষ্তক ভান্ডার। তপন বানানটা
ঠিক থাকলেও, পুস্তকের দন্ত্যস'য় ত'য়ের জায়গায় মূর্ধন্য'য় ষ'য় ত আর ভাণ্ডারের মূর্ধন্যয় ড'য়ের জায়গায় দন্ত্যন'য় ড'য়।
লোকটার সামনে বেশ
কয়েক হাত ছড়িয়ে খবরের কাগজ পাতা। তার ওপরে ছড়ানো ছেটানো খানকতক পুরনো বাজারি
ম্যাগাজিন। থরে থরে রাখা আদর্শলিপি, ধারাপাত, খোকনের ছড়া,
কিশোরকুমারের হিট গান,
লতাপাতার গুণ, বেণীমাধব শীলের পঞ্জিকা-মার্কা নানান বই।
রয়েছে হলুদ সেলোফেন পেপারে মোড়া পিন আপ করা সেই সব নিষিদ্ধ বইও। তারই এক কোণে
রূপসী।
লোকটাকে বৃন্দাবন
করের পাঠানো সেই পোস্ট কার্ডটা দিতেই তিনি তার ওপরে লাল কালি দিয়ে একটা টিক মেরে,
সই করে ডেট দিয়ে এক কপি
রূপসী তার দিকে এগিয়ে দিলেন। প্রতাপ সেই কপিটা নিয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে পাতা উল্টে
উল্টে দেখতে লাগল। চলতি ম্যাগাজিনের মতো চৌকো সাইজ। লালচে ম্যাড়মেড়ে হয়ে যাওয়া
নিউজ প্রিন্টের পাতা। পুরো পত্রিকাটাই খাওয়া-খাওয়া হরফে ছাপা। আগাগোড়া অত্যন্ত অযত্নের ছাপ। হাতে গোনা
যায় এমন কয়েকটা পাতার একদম চটি একটি পুস্তিকা। তার চেয়েও হতশ্রী প্রচ্ছদ। যেমনি
তার নকশা তেমনি তার রং। কোনও সূচিপত্র নেই। একটা একটা করে পাতা উল্টে শেষের দিকে
নিজের লেখা কবিতাটা দেখতে পেল সে। আছে আছে, লেখা আছে। ছাপার অক্ষরে পুরো কবিতাটায় চোখ
বোলাতে ইচ্ছে করল তার। কিন্তু একজন সাহিত্যিক স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে এই ভাবে নিজের
লেখা পড়বে! কেমন দেখায় না! লোকে জানতে পারলে কী বলবে!
তাই সেই বইটা অতি
সাবধানে গোল করে মুড়ে, যাতে বইটার না
লাগে এমন আলতো ভাবে ধরে, ওখান থেকে সরে
গেল বেশ কিছুটা দূরে। তার পর ফুটপাথের একধারে একটা গাড়ি-বারান্দার নীচে দাঁড়িয়ে
তার নিজের লেখা কবিতাটা দেখতে লাগল সে। লাইনের পর লাইন যতই এগোতে লাগল, খানিক আগে পাওয়া আনন্দটা এক-একটা করে ধাপ নেমে,
ধীরে ধীরে কোথায় যেন
মিলিয়ে গেল! এত বানান ভুল! দোকানের ওই লোকটাকে গিয়ে বলব! লোকটাকে বলে কী হবে?
ওঁর কী দোষ! তিনি তো
বিক্রি করতে বসেছেন! তিনি তো আর ওই পত্রিকার কেউ নন! তা ছাড়া, কিছু বললে উনি যদি আবার বৃন্দাবন করকে বলে দেন,
তখন? আর ছাপা হবে তার লেখা? বানান ভুল একটু-আধটু আছে ঠিকই, দোকানও ছোট, সেটাও মানি, কিন্তু তা বলে রূপসীর বিক্রি কি কম? নিজের চোখেই তো দেখলাম, দুটো না তিনটে কপি পড়ে আছে। একশো কপির কম
নিশ্চয়ই আনেননি! তার মানে, অতগুলো বিক্রি তো
হয়েছে। আচ্ছা, ক'টা বিক্রি হয়েছে এ ক'দিনে? লোকটাকে কি জিজ্ঞেস করব!
গুটি গুটি পায়ে
আবার তপন পুস্তক ভাণ্ডারের সামনে এসে দাঁড়াল প্রতাপ। লোকটা তখন এক টুকরো ময়লা
কাপড় দিয়ে বইগুলোর ওপর বাড়ি মেরে মেরে ধুলো ঝাড়ছেন। প্রতাপকে দেখে তিনি মুখ
তুললেন।
প্রতাপ বলল,
একটু আগে একটা রূপসী
পত্রিকা নিয়ে গেলাম না... সেটা কেমন বিক্রি হচ্ছে দাদা? লোকটা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
প্রতাপ ইতস্তত
করে বলল, না মানে, ওই ক'টা দেখছি তো, তাই আর কি জানতে
চাইছিলাম, পরে এলে পাব কি
না...
--- পাবেন, বলেই লোকটা ফের বই ঝাড়তে লাগলেন।
--- ও, স্টকে আরও আছে?
লোকটা ঝুঁকে কাজ
করছিলেন। এ বার টানটান হয়ে বসলেন। --- পাঁচ কপি করে দেয়। এ বারও তাই দিয়েছিল।
এর আগে আপনার মতোই আর একজন এসে চিঠি দেখিয়ে এক কপি নিয়ে গেছে। উনি নাকি কী
লিখেছেন! আর যদি কেউ নেয়, ওই চিঠি দেখিয়েই
নেবে। পয়সা দিয়ে এই বই কেউ কেনে না।
--- সে কী! তা হলে
আপনার...
--- আসে, ছেলেগুলো খারাপ না। কলকাতায় এলে দেখা করে
যায়। চা-টা খাওয়ায়। তা ছাড়া যে ক'টা বই দেয়, তা তো আর
ফেরত-টেরতের বালাই নেই। তাই...
মাথা নিচু করে
ধীর পায়ে শিয়ালদহ ব্রিজের তলা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাসস্টপেজে এসে দাঁড়াল
প্রতাপ। বাসে উঠল। দুপুরের বাস, তেমন ভিড় নেই।
আরামসে পাঁচ জন বসা সিটটায়, বাসে আর কোনও সিট
খালি না থাকলে ছ'জনই বসে। ছ'জন বসলে ছ'জনেরই কষ্ট হয়। ও জানে, ওই সিটটার কাছে গেলে অসুবিধে হলেও পাঁচ জনই
নিজেরা চাপাচাপি করে ওকে বসার জায়গা করে দেবে।
প্রতাপ তবু গেল
না। মাঝখানের রডটায় হেলান দিয়ে ও রূপসীর পাতা ওল্টাতে লাগল। ওর হঠাৎ মনে হল,
আচ্ছা, বাসের কেউ কি তাকে দেখছে! এখানে এতগুলো লোকের
একজনও কি রূপসী পড়েননি!
চার
বৃন্দাবনকে ডেকে
ওর বাবা বললেন, কী ব্যাপার রে,
কী করছিস তুই? তুই নাকি ইলেক্ট্রিকের দোকানে গিয়ে বলেছিস,
তুমি আমাদের কাগজে
বিজ্ঞাপন দাও। ফুল পেয়ে পঞ্চাশ টাকা। কিসের কাগজ?
--- এমনি সাহিত্যের
কাগজ।
---সাহিত্যের কাগজ
মানে? তুই কি আবার
সাহিত্য-ফাহিত্য করছিস নাকি?
--- না, ফাহিত্য করছি না। আবার ঠিক সাহিত্যও না। সাহিত্যের
মতো...
ওর বাবা একটু গলা
চড়িয়ে বললেন, এ সব ভূত একদম
ঘাঢ় থেকে নামা। কত লোক দেখলাম। এ সব করে কিচ্ছু হয় না। শেষ বয়সে না খেয়ে মরতে
হয়। শুনিসনি, কত বড় বড়
সাহিত্যিক না খেতে পেয়ে মরেছে। যেটা করছিস, সেটা মন দিয়ে কর। পড়াশোনা ঠিক মতো কর।
--- কেন, আমি কি পড়াশোনা করছি না?
--- কী করছিস সে তো
দেখতেই পাচ্ছি। ইলেক্ট্রিকের দোকানের লোকটা ডেকে বলছে, আপনার ছেলে তো ওদের কাগজের জন্য বিজ্ঞাপন চেয়ে
গেল...
একটু বিরক্ত হয়ে
বৃন্দাবন বলল, চেয়েছি। হ্যাঁ,
চেয়েছি। ওনার যদি দিতে
ইচ্ছে না হয়, দেবেন না। সেটা
সরাসরি উনি আমাকে বলবেন। আমি তো আর ওনার
কপালে রিভলভার ঠেকিয়ে বলিনি, আপনাকে বিজ্ঞাপন দিতেই হবে। দিলে ওনারই লাভ। লোকেরা জানতে পারবেন যে, উনি বাড়ি বাড়ি গিয়েও ইলেকট্রিক ওয়্যারিংয়ের
কাজ করেন। এতে ওনারই লাভ।
--- ওনার লাভ তোকে
দেখতে হবে না। তুই তোর লাভটা দেখ। চাকরির জন্য যে পরীক্ষাগুলো দিচ্ছিস, তার জন্য একটু বেশি করে মন দিয়ে পড়। যত ভাল
পরীক্ষা দিবি, চাকরির
কম্পিটিশনে তত এগিয়ে যাবি। এগুলো যদি করতেই হয়, এর জন্য প্রচুর সময় পড়ে আছে। আগে চাকরি-বাকরি
জোটা। রোজগারপাতি কর। নিজের পায়ে ভাল করে দাঁড়া। তার পর না হয় অবসর সময়ে এ সব
সাহিত্য-ফাহিত্য করবি। আমাকে যেন আর দ্বিতীয় বার কারও কাছে শুনতে না হয় যে,
তুই কারও কাছে বিজ্ঞাপন
চেয়েছিস...
বৃন্দাবন একটু
বিরক্ত হল। বলল, তুমি এমন করে বলছ,
যেন আমি কারও কাছে হাত
পেতেছি। ভিক্ষে চেয়েছি।
--- হ্যাঁ, ব্যাপারটা প্রায় সে রকমই।
--- তাই নাকি?
ঠিক আছে কাল ওকে মজা
দেখাচ্ছি। এত বড় সাহস। যখন গেলাম তখন তো ভিজে বেড়ালের মতো মিঁউমিঁউ করছিল।
দাঁড়াও, কাল ওর ব্যবস্থা
হচ্ছে।
বৃন্দাবনের বাবা
বললেন, কী করবি? হুজ্জুতি করবি?
--- না, জিজ্ঞেস করব, কেন তোমাকে এটা বলতে গেছে?
--- ও, তুই করতে পারবি, আর ওরা বলতে পারবে না, না? একদম ওমুখো হবি না। আমি যেন শুনতে না পাই। এই বলে দিলাম। ভাল বুদ্ধি দিচ্ছি,
শোন। এখনও সময় আছে,
আমি থাকতে থাকতে সব
গুছিয়ে নে। আমি চলে গেলে...
চুপ হয়ে গেল
বৃন্দাবন। বাবার মুখের ওপরে কোনও কথা বলতে পারে না সে। চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে
রইল। বাবা বললেন, তোর বন্ধুদের দেখ,
সবাই কেমন টপটপ করে চাকরি
পেয়ে যাচ্ছে। আর তুই? সারা দিন টো-টো
করে ঘুরে বেড়াচ্ছিস। কী যে করিস কে জানে!
ছেলে আর ছেলের
বাবাকে একটু জোরে কথা বলতে দেখলেই বৃন্দাবনের মা তড়িঘড়ি সেখানে এসে হাজির হন।
উনি জানেন, ছেলের এ সব
ব্যাপার উনি একদম ভাল চোখে দেখেন না। উনি চান, আর পাঁচটা ছেলে যেমন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য
আপ্রাণ চেষ্টা করছে, ও-ও করুক। ছেলেকে
নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা করেন উনি। এই চিন্তা এখন দিন দিন উদ্বিগ্নের দিকে ঝুঁকছে। সব
সময় ছেলেকে ও সব কথা বলতেও পারেন না। এখনকার দিনের ছেলে কোন কথা কী ভাবে নেবে,
কোনও ঠিক আছে? এই তো সে দিন পাশের পাড়ার ঘটনা, বাবা একটু কী যেন বলেছে, ব্যস। ঘরের ভিতর ঢুকে ছিটকিনি তুলে গলায় দড়ি
দিয়ে ঝুলে পড়েছে। এখন কিছু বলার উপায় আছে? তাই ছেলেকে নয়,
খেতে বসে সমস্ত কষ্ট
বউয়ের ওপরে উগড়ে দেন তিনি।
আর ছেলেকে কিছু
বলতে গেলেই কথায় কথায় কথা বাড়ে। বাবার গলা চড়ে। অতটা না হলেও ছেলের পারদও কম
চড়ে না। তার পর একজন রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে পরিস্থিতি শান্ত হয়। তাই
সেটা আঁচ করেই বৃন্দাবনের মা এসে ছেলেকে বললেন, তুই একটু বাইরে থেকে ঘুরে আয় তো বাবা। বলেই,
স্বামীর দিকে তাকিয়ে
বললেন, কি, তুমি কি চা খাবে নাকি?
গজগজ করতে লাগলেন
বৃন্দাবনের বাবা। --- ধ্যাৎ, ছেলেটা যা হয়েছে
না, আর পারা যাচ্ছে না।
ভাগ্যিস ততক্ষণে
বড় বড় পা ফেলে ঘরের চৌকাঠ ডিঙিয়ে বেশ খানিকটা চলে গিয়েছিল বৃন্দাবন। না হলে এই
কথার পিঠে ও নিশ্চয়ই এমন কিছু বলত,আর তা নিয়েই দু'জনের মধ্যে আবার শুরু হয়ে যেত কথা কাটাকাটি।
মাঝখান থেকে উনি বাপ-বেটার ঝগড়ার মধ্যে পড়ে চিঁড়ে-চ্যাপটা হতেন।
স্বামীর মুখের
দিকে তাকিয়ে উনি তখন বোঝার চেষ্টা করছেন, আকাশে ঘনিয়ে আসা কালো মেঘটা কেটে গেছে কি না।
বউকে ও ভাবে
মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বৃন্দাবনের বাবা বললেন, এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন? আমার মুখ দেখছ?
আমতা আমতা করে বউ
বলল, না, বলছিলাম, তুমি চা খাবে কি না...
খেঁকিয়ে উঠলেন
বৃন্দাবনের বাবা, এটা জিজ্ঞেস করার
কি আছে? দাও।
এই যে উনি 'দাও' বললেন, তাতেই যেন তাঁর
শান্তি। উনি চা খেতে রাজি হয়েছেন মানে, পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে। যাক বাবা, বাঁচা গেছে। ভাগ্যিস তখন ছেলেকে বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম! না হলে এখনও দু'জনের চলত... মনে মনে বলে, উনি বললেন, ঠিক আছে, তুমি ঘরে গিয়ে একটু পাখার তলায় বসো, আমি চা নিয়ে আসছি। বলেই, আর একমুহূর্ত না দাঁড়িয়ে তিনি সোজা ভিতরে ঘরের
দিকে চলে গেলেন।
পাঁচ
তপন পুস্তক
ভাণ্ডার থেকে রূপসী নিয়ে বাড়ি এসেই প্রাপ্তি সংবাদ পাঠিয়েছিল প্রতাপ। মাননীয়
সম্পাদক মহাশয় সমীপেষু...
দশ দিনও পেরোয়নি
ও দিক থেকে একটা পোস্ট কার্ড এসে হাজির। সেই প্রথম, আগে যে দুটো চিঠি পেয়েছিল, সেই দুটোই ছিল ছাপানো। এ বার এল খোদ সম্পাদকের
একেবারে হাতে লেখা চিঠি। এবং তার থেকেও বড় কথা, কোনও জবাবি খাম না পাঠিয়েই এই প্রাপ্তি।
সম্পাদকের চিঠি
বলে কথা, আর কালক্ষেপ
করেনি প্রতাপ। দু'পাতা জুড়ে সে
তার উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিল। লিখেছিল, রূপসী যে এত ভাল হবে, তা আমি কল্পনাও
করতে পারিনি। এমন একটা পত্রিকায় লিখতে পেরে আমি ধন্য। আপনাকে যে কী বলে সাধুবাদ
জানাব, আমি কোনও ভাষা খুঁজে
পাচ্ছি না। আপনার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ রইলাম।
এই চিঠি পাঠানোর
ক'দিন বাদেই আবার এসেছিল
বৃন্দাবন করের চিঠি।
সেই শুরু। তার পর
কত যে চিঠি চালাচালি হয়েছিল, প্রতাপ তখনই
প্রথম জেনেছিল, বৃন্দাবনদা তার
থেকে বছর পনেরো-ষোলোর বড়। প্রথম প্রথম ছড়া কবিতা লিখতেন। দু'-চারটে ছাপাও হয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ কাগজই
নাকি সদস্য হলেও নিজেদের গোষ্ঠীর বাইরের কারও কোনও লেখা সে ভাবে ছাপতে চায় না।
অথচ সদস্য করার সময় বলে, সদস্য হলেই
প্রত্যেকটা সংখ্যায় লেখা ছাপা হবে। কিন্তু উনি ওঁর অভিজ্ঞতা থেকে নাকি জেনেছেন,
মুখে যতই বলুক না কেন,
আসলে বছরে ওই একবার কি দু'বারই ছাপে।
কেন, এই সংখ্যায় ছাপলেন না? জানতে চাইলেই বলে, আসলে আপনি যে লেখাটা পাঠিয়েছিলেন, সেটা ঠিক সে রকম জুতসই হয়নি বলে ছাপতে পারিনি।
খারাপ লেখা ছাপলে শুধু পত্রিকারই বদনাম হবে না, পত্রিকার পাশাপাশি আপনারও বদনাম হবে। আর যেহেতু
আপনি আমাদের পত্রিকার লেখক-সদস্য, আমরা কখনওই চাইব
না, আপনার লেখা নিয়ে কেউ
খারাপ কোনও মন্তব্য করুক। তাই এই সংখ্যায় আপনার লেখা আমরা ইচ্ছে করেই রাখিনি। আরও
কয়েকটা লেখা পাঠান। ভাল হওয়ার দরকার নেই। ছাপার মতো হলেও পরের সংখ্যায় আমরা ছেপে
দেব।
কিন্তু এই পরের
সংখ্যাটা আর কোনও দিনই আসে না। হয় প্রথম, দ্বিতীয় বা খুব বেশি হলে তৃতীয় সংখ্যা বেরোনোর পরেই পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়।
কিংবা আজ বেরোচ্ছে, কাল বেরোচ্ছে করে
এত দিন পার করিয়ে দেয় যে, মাসিক, দ্বিমাসিক কিংবা ত্রৈমাসিক নয়, ওটা বছরে একটা কি দু'বছরে একটা সংখ্যা কোনও রকমে বেরোয়।
তাই উনি এই রূপসী
বের করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। যাতে তাঁর নিজের লেখা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের
মতো বঞ্চিতদেরও লেখা সেখানে নিয়মিত ছাপা যায়। সাহিত্যের সত্যিকারের একটা
প্ল্যাটফর্ম হয়ে ওঠে। কিন্তু তাঁর একার পক্ষে তো একটা কাগজ একদম নিয়ম করে বের করা
সম্ভব নয়। লেখা জোগাড় করা, প্রেসে ছুটোছুটি
করা, প্রুফ দেখা, ব্লক তৈরি করা, দু'-একটা বিজ্ঞাপনের জন্য এঁকে-তাঁকে ধরা, কাগজ বেরোনোর পর স্টলে স্টলে পৌঁছে দেওয়া না-হয় আমি একাই সামলালাম, কিন্তু এই বিপুল খরচ? সেটা আসবে কোথা থেকে? তাই যারা যারা এখানে লিখতে আগ্রহী, তাদের আগাম বাৎসরিক সদস্য করে তাদের চাঁদা
নিয়েই শুরু করেছি এই কর্মযজ্ঞ। আসলে একজনের কাছে যেটা পাহাড়-সমান, পাঁচ জনে মিলে সেটা ভাগ করে নিলে একটা নুড়ি
পাথরও নয়, তাই...
তিনিই লিখেছেন,
কিছু দিন আগে তাঁর একটি
দীর্ঘ কবিতা পড়ে, সেই কবিতায়
কাহিনির ঘনঘটা দেখে কে নাকি তাঁকে বলেছেন, তাঁর হাতে উপন্যাস আছে। উনি যদি উপন্যাস লেখেন, অনেক তাবড় তাবড় লেখকদের ঘুম কেড়ে নেবেন। তাই
তিনি একটু-আধটু গল্প এ দিক সে দিক ছোটখাটো লিটিল ম্যাগাজিনে লিখলেও, আসলে তাঁর পরিকল্পনা আছে বড় বড় কাগজে উপন্যাস
লেখার। তবে এই মুহূর্তে হচ্ছে না। তাঁর বাবা নাকি তাঁকে বলেছেন, ওই লেখালেখি, পত্রিকা-টত্রিকা সব পরে হবে। আগে নিজের পায়ে
দাঁড়া।
বৃন্দাবন সে সময়
লিখেছিল, আমিও ভেবে দেখলাম,
বাবার কথাই ঠিক। টাকা না
থাকলে কিছুই করা যাবে না। আর আমার কাছে যদি টাকা থাকে, কারও কোনও সদস্য চাঁদাই লাগবে না। আমি মাইনে
থেকে কিছু কিছু টাকা জমিয়েই পত্রিকা বের করতে পারব। কে কবে বাৎসরিক গ্রাহক চাঁদা
পাঠাবে সে জন্য হা-পিত্যেস করে বসে থাকতে হবে না। তাই চাকরির নানা পরীক্ষার জন্য
এখন নিজেকে তৈরি করছি। চাকরিটা পেয়ে গেলেই, ব্যস... তখন আমাকে আর কে পায়, পারলে দু'হাতে লিখব।
প্রতাপ লিখেছিল,
না, সে তো ঠিকই বলেছেন। কিন্তু একটা পত্রিকার প্রথম
সংখ্যা বেরিয়েই যদি বন্ধ হয়ে যায়, সেটা কি বাংলা
সাহিত্যের পক্ষে একটা ভয়ঙ্কর ক্ষতি নয়? যখন পত্রপত্রিকার ইতিহাস লেখা হবে, তখন গবেষকেরা কী লিখবেন? লিখবেন, রূপসী পত্রিকার আত্মপ্রকাশ সংখ্যা বেরিয়েই মুখ
থুবড়ে পড়েছিল। কেন না, স্বয়ং সম্পাদকই
পত্রিকার কথা ভাবেননি। শুধু নিজের কথা ভেবেছেন। একটা চাকরি পাওয়ার জন্য, নিজের সুখ-সাচ্ছন্দের জন্য পত্রিকাটিকে
আঁতুড়ঘরেই গলা টিপে হত্যা করেছেন। এটা শুনতে কি আপনার ভাল লাগবে? চাকরির জন্য নিজেকে তৈরি করছেন, খুব ভাল কথা। কিন্তু তার মধ্যে থেকেই একটু সময়
বের করে কি পত্রিকাটিকে মৃত্যুর হাত থেকে কোনও ভাবে রক্ষা করা যায় না? একবার ভেবে দেখবেন।
প্রতাপ ভেবেছিল,
বৃন্দাবনদা নিশ্চয়ই তার
পরামর্শ একবার ভেবে দেখবেন। এবং যতই চাপ থাক, শেষ পর্যন্ত ঠিকই রূপসী বের করবেন।
ছয়
বৃন্দাবন তখন
একটার পর একটা অবজেক্টিভ প্রশ্নের মোটা মোটা বই কিনছে। ক্যুইজের বই যেখানে যা
পাচ্ছে মুখস্ত করছে। বইয়ের জন্য পাড়ার লাইব্রেরির মেম্বার হয়েছে। মাধ্যমিকের পর
অন্যান্য ছেলেমেয়েদের মতো সেই যে টাইপ শেখার স্কুলে ভর্তি হয়েছিল, অনেক দিনের প্র্যাকটিসে যে স্পিড সে তুলেছিল,
টাইপ ছেড়ে দেওয়ায় সেই
স্পিড একদম শূন্যে এসে দাঁড়িয়েছে। তাই আবার নতুন করে ভর্তি হয়েছে টাইপের
স্কুলে। সদ্য হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা দেওয়া বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেমেয়েদের সঙ্গে।
সেখানেই আলাপ
হয়েছে তার পাশে বসে টাইপ শিখতে আসা অনন্যার সঙ্গে। নামটা শুনেই কেমন যেন চমকে
উঠেছিল সে। ভেবেছিল, যে রূপসী সেই তো
অনন্যা। প্রথম জন তার মানসকন্যা আর পরের জন তার প্রিয়... খুব ভাল লেগে গিয়েছিল
ওকে।
এক ঘন্টার ক্লাস।
ওরা একসঙ্গে ঢুকত। পরের ব্যাচের ওই সিটের কেউ না আসা পর্যন্ত প্র্যাকটিস করে গেলেও
ম্যানেজারবাবু কাউকে কিছু বলতেন না। সকলেই চেষ্টা করত একটু বেশিক্ষণ প্র্যাকটিস
করতে। কিন্তু ওদের আলাপের পর, পরের ব্যাচের কেউ
না এলেও ওদের নির্ধারিত এক ঘণ্টা পার হয়ে গেলেই
ওরা মেশিন ছেড়ে বেরিয়ে আসত। বাইরে বেরিয়ে চা খেত।
অনন্যার বাড়ি বেশি দূরে নয়। হেঁটে গেলে খুব বেশি হলে
মিনিট দশেক। বৃন্দাবন হাঁটতে হাঁটতে ওর বাড়ির কাছাকাছি অবধি এগিয়ে দিয়ে আসত।
কোনও দিন ফুচকা খেত। কোনও দিন রিকশা করে জোড়া পুকুরের বাঁধানো পাড়ে আরও অনেক
যুগলের মতো তারাও গিয়ে বসত।
হয়তো একটু হাত
ধরত। আশপাশ দেখে নিয়ে একটু গালে হাত বোলাত। কিন্তু ওই পর্যন্তই। তার থেকে বেশি
কিছু নয়। আগাম টিকিট কেটে দু'-একবার সিনেমায়ও
গেছে। পিছনের রো-য়ের একদম কোণের সিটে বসেছে। খুব বেশি হলে অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে হয়তো
কখনও এক-আধ বার চুমু খেয়েছ। হাত নিশপিশ করলেও নিজেকে ভীষণ কন্ট্রোলে রাখত
বৃন্দাবন।
বৃন্দাবনের বাবা
একদিন বলেছিলেন, রোজ রোজ এত টাকা
কোথায় পাই বল তো! একটা-দুটো টিউশনিও তো করতে পারিস। তা হলে তো তোর হাত খরচাটা চলে
যায়।
বৃন্দাবন দুটো
টিউশনি নিয়েছিল। কিন্তু কোথাও তিন মাসের বেশি থিতু হতে পারেনি। কিছু দিন পড়ানোর
পড়েই মনে হত রূপসীর কথা, তখনই তার মনের
মধ্যে একটা অদ্ভুত কষ্ট শুরু হত। মনে মনে ভাবত, আমার জন্ম কি শুধু টিউশনি করার জন্য? সামান্য ক'টা টাকার জন্য প্রতিদিন এতটা করে সময় নষ্ট
করার কোনও মানে হয়? এই সময়টা যদি
রূপসীর জন্য দিতে পারতাম, তা হলে রূপসী তো
নিয়মিত বেরোত!
এই সব ভেবে যেই
টিউশনিটা ছাড়ত, অমনি পরের মাসেই
মনে হত, এই রে! এখন চলব কী করে!
একবার যখন নেওয়া বন্ধ করছি, বাবার কাছে তো আর
হাত পাততে পারব না। ফলে, দিন কয়েকের
মধ্যেই ফের জুটিয়ে নিত আর একটা টিউশনি। বিভিন্ন বাড়িতে টিউশনি করতে করতেই ওর মনে
হয়েছিল, যারা টিউশনি করে
একমাত্র তারাই জানে, পৃথিবীতে কত রকম
ডিজাইনের বিস্কুট আছে।
টিউশনি, টাইপের ক্লাস, চাকরির পরীক্ষা দেওয়ার জন্য গাদা গাদা বই পড়া
আর অনন্যা--- এই ছিল বৃন্দাবনের সারাদিনের রুটিন।
বৃন্দাবনের বাবা
তাঁর ছেলের সারাদিনের রুটিন জানতেন। শুধু জানতেন না অনন্যার কথা। পাড়ারই একজন
তাঁকে রাস্তার মধ্যে ধরে একদিন বললেন, যে মেয়েটার সঙ্গে তোমার ছেলে ঘোরাঘুরি করে, ওই মেয়েটা কে গো?
বৃন্দাবনের বাবা
একেবারে হতবাক। --- মেয়ে?
--- হ্যাঁ মেয়ে।
প্রায়ই তো দেখি তোমার ছেলে আর ওই মেয়েটা হাত ধরাধরি করে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। যখন
যায়, তখন তো আশপাশে একবার
তাকিয়েও দেখে না, পাড়ার বড়রা
তাকে কেউ দেখল কি না! কী দিনকাল পড়ল!
--- আমার ছেলে?
কোন মেয়ের সঙ্গে?
--- মেয়েটাকে তো আমি
চিনি না। তোমার ছেলেকে প্রায়ই দেখি ওই মেয়েটার সঙ্গে। তাই জানতে চাইছিলাম... আমি
ভেবেছিলাম, তুমি বুঝি সব
জানো!
--- জানো মানে? কী জানব?
লোকটা ঢোক গিলে
বললেন, না, ওই ওদের মেলামেশার কথা।
--- কী যা তা বলছ?
তুমি নিজে দেখেছ?
--- তা না হলে আর
বলছি কেন? তাও একদিন নয়,
মাঝে মাঝেই দেখি। আজ
তোমাকে সামনে পেয়ে গেলাম তাই জিজ্ঞেস করলাম, তুমি মেয়েটাকে চেনো কি না?
--- না না। আমি চিনি
না। তা ছাড়া তুমি কাকে দেখতে কাকে দেখেছ!
--- ওমা, কাকে দেখতে কাকে দেখব কেন? তোমার ছেলেকে কি আমি চিনি না? সেই ছোটবেলা থেকে দেখছি...
--- ঠিক আছে, আমি ওকে জিজ্ঞেস করব।
--- সে তুমি জিজ্ঞেস করতেই
পারো, তোমার ছেলে। তবে আমি যে
তোমাকে বলেছি, এটা কিন্তু ওকে
আবার বোলো না।
বৃন্দাবনের বাবা
বললেন, কেন? বললে কী হবে?
--- না, আমি এ সবের মধ্যে জড়াতে চাই না।
--- এতে আবার
জড়াজড়ির কী আছে? ও যদি জিজ্ঞেস
করে তোমাকে এটা কে বলল, তখন তো আমাকে
একটা নাম বলতে হবে। আমি কি বানিয়ে বানিয়ে অন্য কারও নাম বলব নাকি? আমি মিথ্যে বলতে পারব না।
লোকটা খানিকক্ষণ
বৃন্দাবনের বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ঠিক আছে, আমার নাম বোলো। আমি তো আর মনগড়া কথা বলছি না।
আমি যা দেখেছি, তাই বলেছি। এখন
দেখছি, কারও কোনও উপকার করতে যাওয়াটাও
একটা ঝকমারি।
লোকটা চলে যেতেই
ভ্রু কুঁচকে গেল বৃন্দাবনের বাবার। লোকটা কি ঠিক বলছে! মিথ্যে বলতে যাবেই বা কেন!
তা হলে কি তাঁর ছেলে প্রেম করতে শুরু করেছে! এই সময় যদি প্রেমে পড়ে, তা হলে তো পড়াশোনা একেবারে গোল্লায় যাবে। আর
পড়াশোনা গোল্লায় যাওয়া মানেই চাকরির পরীক্ষায় পিছিয়ে পড়া। আর চাকরির
পরীক্ষায় পিছিয়ে পড়া মানেই জীবনটা গেল। সত্যিই যদি ও প্রেমে পড়ে থাকে, তা হলে ওকে কী ভাবে ওই গড্ডালিকা থেকে বের করে
আনব! কী ভাবে!
সাত
বৃন্দাবন তখন
এক-একটা পরীক্ষা দিচ্ছে আর মাঝে মধ্যে প্রতাপকে চিঠি লিখছে। কাগজ বেরোচ্ছে না।
বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। তাই প্রতাপেরও লেখা বেরোচ্ছে না। কিন্তু তাই বলে তো সে বসে
নেই। একবার যখন সাধ পেয়ে গেছে... রোজই কিছু না কিছু লিখছে। অনেক লেখা জমে গেছে।
এগুলো তো ছাপতে দিতে হবে। রূপসী বেরোচ্ছে না তো কী হয়েছে, আর কি কোনও পত্রিকা নেই, যেখানে সে লেখা দিতে পারে!
সেই পত্রিকার
খোঁজেই প্রতাপ এই স্টলে চলে যায়। ওই স্টলে যায়। পত্রপত্রিকা দেখে। চিরকুটে টুকে
নেয় সম্পাদকের নাম। ঠিকানা। ফোন নম্বর। রোজ এমনি এমনি দেখলে দোকানদার কবে তার
মুখের ওপরে কী বলে দেবেন, কোনও ঠিক আছে!
তাই মাঝেসাঝে একটা-দুটো কমদামি পত্রিকাও কিনে আনে ও। টুকে আনা ঠিকানা দেখে দেখে
সেই সব পত্রিকায় পোস্ট করে দেয় কবিতা। তার পর থেকে সেই পত্রিকার কোনও সংখ্যা
বেরোলেই পাগলের মতো উল্টেপাল্টে দেখে তার কবিতা ছাপা হয়েছে কি না। এবং যখনই দেখে,
তার লেখা বেরোয়নি,
তখনই তার মন ভারাক্রান্ত
হয়ে যায়। কিচ্ছু ভাল লাগে না। কখনও সখনও অবশ্য কবিতা বেরোয়। সঙ্গে সঙ্গে সেটা কিনে
নেয়।
কোনও কোনও
পত্রিকা আবার ডাকযোগে বাড়িতে বসেই পায়। ও এখন বুঝতে পারে, ঠিকঠাক পত্রপত্রিকায় লিখতে গেলে কোনও গ্রাহক
হওয়ার দরকার হয় না। বিজ্ঞাপন জোগাড় করে দেওয়ারও কোনও হ্যাপা নেই। সপ্তাহে অন্তত
একদিন করে পত্রিকা দফতরে বা সম্পাদকের বাড়ি গিয়ে সম্পাদককে তেল মাড়ারও প্রয়োজন
নেই। লেখা যদি ভাল হয়, এমনিই ছাপা হয়।
উল্টে টাকা পাওয়া যায়। খাতির করে। লোকে সমীহর চোখে তাকায়। আর তার চেয়েও বড় কথা,
একজন কবি বা লেখক যা চান,
সেই পাঠক, ওই সব কাগজের তুলনায় অন্তত একজন হলেও, বেশি পাওয়া যায়। আর কী চাই!
এই ভাবে বিভিন্ন
পত্রিকা ঘাটঁতে ঘাঁটতেই আধুনিক লেখালেখির সঙ্গে পরিচয় হতে থাকে তার। জানতে পারে,
এই সময়ে কারা কারা
লিখছে। লেখা নিয়ে কী কী আন্দোলন হচ্ছে। থার্ড লিটারেচর মুভমেন্ট কাকে বলে?
হাংরি জেনারেশন কী?
গদ্য কবিতা লিখতে গেলেও
ছন্দ জানা কেন জরুরি। এই ভাবেই সে যে কখন সাহিত্যের হাঁড়ির খবরও রাখতে শুরু করে
দিয়েছে সে নিজেও টের পাইনি।
সে যত লেখা পাঠাত,
তার বেশির ভাগই ছাপা হত
না। তা হলে কি পছন্দ হয়নি? কেন হল না?
নাকি ওদের কাছে লেখাটাই
পৌঁছয়নি? আদৌ পৌঁছেছে কি?
জানার জন্য সে সব
পত্রিকার দপ্তরে ফোন করত। ডায়েরি দেখে দেখে বলত, অমুক তারিখে এই এই নামের দুটো কবিতা
পাঠিয়েছিলাম, আপনারা কি
পেয়েছেন? মনোনীত হল কি না
বা কী হল, কবে নাগাদ জানা
যাবে একটু বলবেন?
কোথাও থেকে উত্তর
পেতে--- পেয়েছি, এখনও দেখা হয়নি।
প্রচুর লেখা আসে তো, একটু সময় লাগবে।
কেউ বলত--- লেখা পাঠিয়েছেন কত দিন হল? পছন্দ হলে আমরা তিন মাসের মধ্যে ছেপে দিই। যদি তিন মাসের মধ্যে ছাপা না হয়,
তা হলে ধরে নেবেন,
লেখা মনোনীত হয়নি। তখন এই
লেখাটা অন্য কোনও পত্রিকায় দিতে পারেন। অাবার কেউ বলত--- এই নামে কোনও লেখা পেয়েছি
বলে তো মনে পড়ছে না। আপনার কাছে কপি আছে তো? আপনি বরং লেখাটা কপি করে আর একবার পাঠিয়ে দিন।
অথবা শনি-রবি আর সরকারি ছুটির দিন বাদে যে কোনও দিন বেলা দুটো থেকে সন্ধে ছ'টার মধ্যে এসে আমাদের দপ্তরে জমা দিয়ে যেতে
পারেন।
তেমনই একটি
দপ্তরে সন্ধে নাগাদ লেখা পৌঁছে দিতে গিয়ে দেখেছিল, বেশ জমজমাট আড্ডা। সে দিনই প্রথম কবিতা বিভাগের
সম্পাদকের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। সম্পাদক কেমন দেখতে, ও আগে থেকে যেমনটা ভেবে রেখেছিল, সামনাসামনি দেখার পর ও একেবারে থ'। এ তো একেবারে ইয়াং ছেলে।
তিনিই ওর সঙ্গে
পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন আড্ডা মারতে থাকা বাকি লোকগুলোর সঙ্গে। এক একটা নাম
প্রতাপ শুনছিল আর ওর চোখের সামনে ভেসে-ভেসে উঠছিল বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় পড়া
ওঁদের লেখাগুলো।
ওঁদের অনুরোধেই
টেবিলের ওপরে খবরের কাগজে টাল দিয়ে রাখা মুড়ি-বাদাম মাখা আর তেলেভাজায় ভাগ
বসিয়েছিল ও। খেতে খেতেই এ পত্রিকায়, সে পত্রিকায় বেরোনো এঁর-ওঁর কোন লেখাটা ও পড়েছে, সেটা ওর কেমন লেগেছে, কেমন হলে ওর আরও ভাল লাগত, এই রকম দু'-চারটে কথা বলেছিল। ওর কথা শুনে ওঁরা অবাক হয়ে
গিয়েছিলেন, এখনও খুঁটিয়ে
খুঁটিয়ে এমন করে কেউ পড়ে? লেখার লোক প্রচুর
আছে, কিন্তু পড়ার লোকই তো নেই।
চারিদিকে শুধু কবি আর কবি। সে জন্যই বুঝি শক্তি চট্টোপাধ্যায় প্রশ্ন তুলেছিলেন,
এত কবি কেন?
প্রতাপকে ওঁদের
খুব মনে ধরেছিল। ওঁরাই বলেছিলেন, চলে আসুন না...
বুধবার-বুধবার সন্ধেবেলায়। আমরা এখানে বসি। আরও অনেকে আসে। এলে ভাল লাগবে।
ও বলেছিল,
আমাকে আপনি করে বলবেন না।
আমি তো আপনাদের থেকে অনেক ছোট। আমাকে তুই করে বলবেন। আর নাম ধরে ডাকবেন।
ও পাশ থেকে একজন
বলেছিলেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে, তাই হবে।
আর একজন বলেছিলেন,
আরে, তুমি তো আমার ছেলের চেয়েও ছোট। তুমি না বললেও
তোমাকে আমি তুমিই বলতাম।
যে বিভাগীয়
সম্পাদকের কাছে ও কবিতা জমা দিতে গিয়েছিল, তাঁকে কবিতা দিয়ে বেরিয়ে আসার সময়, আবারও যেন কে বলল, পারলে সামনের
বুধবার এসো।
এত ঘরোয়া পরিবেশ,
লোকগুলো এত অমায়িক,এত ভাল যে, না, শুধু কবিতা ছাপার জন্য নয়, শুধুমাত্র এঁদের
সঙ্গে কিছুক্ষণ কাটানোর জন্যও এখানে প্রতিদিন আসা যায়। পুরো ব্যাপারটা খুব ভাল
লেগেছিল প্রতাপের। আরও ভাল লেগেছিল, বাড়ি ফিরে বৃন্দাবনদার চিঠি পেয়ে।
আট
শুধু বৃন্দাবনের
বাড়িতেই নয়, তাদের মেলামেশার
খবরটা কী করে যেন অনন্যাদের বাড়িতেও পৌঁছে গিয়েছিল। শুনেই ওর মা বলেছিলেন,
শেষ পর্যন্ত তুই কি
আমাদের মুখে চুন-কালি মাখাতে চাস, না কি?
যে বাবা মেয়েকে
পাগলের মতো ভালবাসতেন, এই খবর
শোনামাত্র--- না, তিনি কিছু
বলেননি। এমন একটা ব্যাপার নিয়ে মেয়েকে কিছু বলতেও তাঁর যেন রুচিতে বাধছিল। তাই
কিচ্ছু বলেননি, শুধু মেয়ের
সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
এ খবর ছড়িয়ে
পড়লে মেয়ের আর বিয়ে দিতে পারবেন তাঁরা? ছি ছি ছিঃ, শেষ পর্যন্ত কি
না...
বাবা-মা সে রকম
কিছু না বললেও, অনন্যার দুই ভাই
একেবারে নড়েচড়ে বসল। খোঁজখবর নেওয়া শুরু করল, ছেলেটা কে? কোথায় থাকে? কী করে?
ছেলেটা কে?ঠিক আছে। কোথায় থাকে? তাও ঠিক আছে। কিন্তু কী করে?--- যখন জানতে পারল, কিছুই করে না। একই টাইপ স্কুলে বোনের সঙ্গে
টাইপ শেখে। আর ওখান থেকেই ওদের পরিচয়, মেলামেশা আর ঘনিষ্ঠতা। তখন তারা আর ঠিক থাকতে পারল না। বোনকে বলল, তোকে আর টাইপের স্কুলে যেতে হবে না। বন্ধ করে
দে ও সব। ঘর থেকে এক পা-ও আর বেরোবি না। আর তুই যদি বেরোস, তা হলে ওর এমন অবস্থা করব, যাতে ও আর কোনও দিন ওই স্কুলে তো নয়ই, নিজের পায়েও আর
উঠে দাঁড়াতে না পারে। কোনটা চাস বল? তুই যা চাইবি তাই হবে। বল, কী চাস?
অনন্যা বলেছিল,
আমি আর টাইপের স্কুলে যাব
না।
কিন্তু যে জন্য
অনন্যা এ কথা বলেছিল, তার ক'দিন পরেই এক ভরসন্ধেবেলায় সেটাই ঘটে গেল।
বৃন্দাবন যখন
রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আপন-মনে বাড়ি ফিরছিল, ঠিক তখনই পাঁচ-ছ'জন ছেলে আচমকা তার পথ আটকে দাঁড়াল। কিছু বুঝে
ওঠার আগেই এলোপাতাড়ি কিল-ঘুষি-লাথিতে রাস্তায় পড়ে গেল বৃন্দাবন। ও যখন উঠে কোনও
রকমে উঠে ওদের কাছ থেকে ছুটে পালাতে যাবে, ঠিক তখনই, ক'হাত দূরের ঠান্ডা পানীয়র দোকান থেকে এই
ছেলেগুলোর মধ্যে থেকেই কে যেন দৌড়ে গিয়ে একটা সোডার বোতল নিয়ে এসেছিল। পেছন দিক
থেকে সপাটে চালিয়ে দিয়েছিল ওর মাথায়। রাস্তায় লুটিয়ে পড়েছিল বৃন্দাবন। আরও
হয়তো মারত, হয়তো মেরেই
ফেলত। কিন্তু ততক্ষণে আশপাশের লোক হইহই করে ছুটে আসায় এই ছেলেগুলো সঙ্গে সঙ্গে
বাইক নিয়ে চম্পট দিয়েছিল।
আটটা সেলাই
পড়েছিল বৃন্দাবনের মাথায়। কালশিটে পড়ে গিয়েছিল চোখের নীচে। লেগেছিল ঘাড়ে,
পাজরেও।
ওর বাবা বলেছিলেন,
এটা কারা করেছে বুঝতে
পেরেছিস তো? ওই মেয়েটার
বাড়ির লোকেরা। দেখলি তো, তোকে ওই মেয়েটির
সঙ্গে মিশতে কেন বারণ করেছিলাম? আমার কথা
শুনিসনি। এখন তার ফল কী হল দ্যাখ। কোনও বাবা-মা কখনও তার সন্তানের খারাপ চায় না।
কোনও বেকার ছেলের সঙ্গে তার মেয়ে মিশছে, এটা কোনও মেয়ের বাবা-মাই মেনে নেবে না। ছাড়াবার চেষ্টা করবে। সহজে না ছাড়লে
তাকে এমন শিক্ষা দেবে যাতে সে বাপ-বাপ করে ছেড়ে পালায়। তোকে বারবার করে বলছি,
আগে নিজের পায়ে দাঁড়া।
আজ যদি তোর কোনও সরকারি চাকরি থাকত, মাস গেলে যদি একটা মোটা টাকা মাইনে পেতিস, তা হলে কি ওরা তোর সঙ্গে আর যাই করুক, এ রকম ঘটনা ঘটাতে পারত? পারত না। আমি তো বলছি, হয় এটা ওর ভাইয়েরা করেছে, না হলে ওর বাবা লোকজনকে টাকা-পয়সা খাইয়ে
করিয়েছে। না হলে তোর কে এমন শত্রু আছে বল তো, যে তোকে এ রকম নৃশংস ভাবে মারবে? লোকগুলো ছুটে না এলে তো ওরা তোকে মেরেই ফেলত।
বৃন্দাবনের কানে
তখন কোনও কথা ঢুকছিল না। ও শুধু ভাবছিল, অনন্যা কি জানে তার এই অবস্থার কথা? জানে, সে এখন হাসপাতালে
ভর্তি?
মাথায় লেগেছে
ঠিকই, তবে যে ভাবে লেগেছিল,
ডাক্তাররা আশঙ্কা
করেছিলেন ভয়ানক কিছু হয়েছে। কিন্তু না, সিটি স্ক্যান করে দেখা গেছে সে রকম কোনও চোট লাগেনি। ফলে ইন্টারনাল হ্যামারেজও
হয়নি। তাই দু'দিন পর্যবেক্ষণে
রেখেই বৃন্দাবনকে ছেড়ে দিয়েছিলেন ডাক্তারবাবুরা।
বাড়ি আসার পর ওর
বাবা শুধু একটা কথাই বলেছিলেন, অন্য কাউকে
ভালবাসার আগে নিজেকে ভালবাসবো .
siduabp@gmail.com
No comments:
Post a Comment