1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, January 1, 2020

তাল নবমী



                                                                                                ...সিরাজুল ইসলাম
         ভাদ্রের মাঝামাঝি। ভাঁটি অঞ্চলের অনেক নদীই আজ মরে হেঁজে গেছে। ক্ষীণকায়া সেসব স্রোতস্বিনীর পাড়ে সহায় সম্বলহীন মানুষেরা বাঁচার শেষ আশ্রয়টুকু আঁকড়ে ধরে মাটি কামড়ে পড়ে আছে।কাজ নেই কাম নেই, অভাব এখানে নিত্যসঙ্গী! পেটের ধান্ধায় তাই অনেকেই পাড়ি জমিয়েছে উজানের দেশে। নিম্ন আয়ের মানুষগুলো উদয়াস্ত হাঁড়ভাঙা পরিশ্রম শেষে যা আয় করে তা দিয়ে একজনের পেট চালানো দায়। চেষ্টাচরিত্র চলে দু'পয়সা ডেড়ী করে একদিন ঘরে ফিরবে, বৌ-ছেলেমেয়ের মুখে হাসি ফোটাবে। মিথ্যে আশায় আশায় শহরের মোহে পড়ে একদিন যান্ত্রিক সভ্যতায় নিজেকে ভাসিয়ে দেয় তারা। জৈবিক চাহিদার কাছে ম্লান হয়ে আসে ফেলে আসা পিছনের ঘরসংসার!
আস্তে আস্তে একদিন স্মৃতিও ঝাঁপসা হয়ে আসে!
           বাবার স্মৃতিটাও ঝাঁপসা হয়ে গেছে হাসান আর ফাতিমার কাছে। দশ আর চৌদ্দ বছরের দু' ভাইবোন। পিঠোপিঠি না জন্মালেও দু'জনেরই এক আত্মা,একপ্রাণ! জ্ঞান হওয়া অব্দি যা কিছু কাজ, দু' ভাইবোন মিলেই করে। নির্জন অজগাঁয়ে তাদের সাথে মেশার মত নেই কোন সাথী। গরীব বলে সবাই কেমন অবজ্ঞা করে।বাবা রহিম শেখ একদিন কাজের খোঁজে যেয়ে আর ফেরেনি। ফাতিমা তখন চার আর হাসান কোলে! নিজের বাপের আদলটা তাই আর মনে নেই দু'জনেরই!
          হাসানের বয়স তখন দুই, আর ফাতিমার ছয়! ওদের মায়ের আবারও বিয়ে হলো বাবুদের বাড়ীর পেটেভাতে  কিষেন আবুলের সাথে! হ্যাংলা পাতলা আর সারা বছর রোগে ভোগা মানুষটাকে দেখলেই মনে হয় ভিজে বেড়াল! যেন কিছুই বোঝেনা। তবে যেমন খেতে পারে, মেজাজটাও তেমনি তিরিক্ষে! এতদিনে বুঝে গেছে দু'ভাইবোন। তাই সব সময় আড়ালে আবডালে লুকিয়ে থাকে হাসান ফাতিমা। কারণ এ দু'টো আপদকে সহ্য করতে পারে না আবুল। কথায় কথায় খ্যাঁক করে ওঠে তাদের ওপর।
পেটের সন্তানের হেনস্থা দেখেও নিরব অভিমানে দাঁতে দাঁত চেপে সব সহ্য করে আছিরন। এ ছাড়া উপায়ই বা কি? প্রতিবাদ করতে যেয়ে দু'এক ঘা নিজের ঘাড়েও পড়েছে কখনো কখনো। তাছাড়া এই স্বামী নামের সার্টিফিকেট সম্বল করেই তো আরও দু'দুটো ট্যাঁ ফ্যাঁ জন্মেছে।
          সব পুরুষই এক! প্রয়োজন ফুরোলেই ভোঁ-কাট্টা ঘুড়ির মতন পাল্টি খেয়ে দূরে হারিয়ে যায়! ভেবে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে আছিরনের বুক থেকে।সেবারে, ফাতিমার বাবা চলে গেলে, সংসারের হাল ধরতে বাবুদের বাড়ীতে ঝিঁয়ের কাজ জুটিয়ে নেয় আছিরন। কোলের বাচ্চা ফাতিমার দায়ীত্বে দিয়ে কাজ সারতে হয় তাকে। কেঁদে কঁকিয়ে গড়াগড়ি খায় হাসান! শিশু ভাইটাকে সামলাতে যেয়ে হিমসিম খেতে হয় ফাতিমাকে। সেদিকে তাকানোর মতন ফুসরৎ হয়না আছিরনের। বাবুদের বাড়ীতে কাজের ধকলে নাজেহাল বেচারী।
          কারণে অকারণে মাঠ থেকে ফিরে আসে আবুল। হাসানকে কোলে তুলে আদর যত্নে কান্না ভুলিয়ে দেয়! দু' ভাইবোনের প্রতি বিশেষ যত্নআত্বি! মতিগতি দেখে একদিন বাবুবাড়ীর গিন্নিমা প্রস্তাব দেয় আবুল আর আছিরনকে। সুচতুরা গিন্নিমা এক ঢিলে দুই পাখী মারার সুদূর পরিকল্পনা করেই এ প্রস্তাব দিয়েছিলো। বিনিপয়সায় তাহলে আবুল আর আছিরনকে রেখে দেয়া যাবে পাকাপোক্ত ভাবে।
          অকূল দরিয়ায় ভেসে যাওয়া খোলামকূঁচির মত স্বামী পরিত্যক্তা আছিরনের সামনের পৃথিবীটা তখন অন্ধকারাচ্ছন্ন। সন্তান দু'টোর ভবিষ্যৎ চিন্তা করেই সম্মত হয় সে। তাছাড়া বাচ্চা দু'টোর প্রতি আবুলের প্রগাঢ় ভালোবাসা দেখে মনেমনে মুগ্ধ আছিরন। শক্ত আশ্রয়ের সন্ধান পায় আবুলের মধ্যে। স্বলাজে কত কথার ফাঁনুষ ওড়ায় দু'জনে কাজের ফাঁকে ফাঁকে। অথচ বিয়ের পর মানুষটার সম্পূর্ন বিপরীত রুপ। পান থেকে চুন খসবার উপায় নেই। ফাতিমা ার হাসানের কাছে আবুল এক মূর্তিমান আতঙ্ক, যমদূত।
          খড়িওঠা দেহ! অনাহার আর অবহেলায়, অজীর্ন পেটে ক্ষুধার আগুন জ্বলে দাউদাউ। দু'ভাইবোন তাই বাবুদের বাগানে সারাক্ষণ ঘুরে বেড়ায়। কাকপক্ষীও যখন ওঠে না, দু'ভাইবোন সেই ঝঁপসী অন্ধকার থাকতেই চলে আসে কষাঢ় অন্ধকার এই বাগানে। রাতে ঝরে পড়া নারকেল, পেয়ারা, পেঁপে কিছু না কিছু পেয়ে যায় প্রতিদিন। দু'ভাইবোন মহাখুশী। বাড়ীতে নিয়ে যেয়ে মহা উল্লাসে সেসব খায়।
          জোষ্টমাসের দমকা বাতাসকে এরা দু'ভাইবোন খুউব ভালোবাসে। কারণ এসময়ে দমকা বাতাসে টুপটাপ ঝরে পড়ে আম। প্রতিদিন এই এ্যত্তো এ্যত্তো আম কুড়ায় ভাইবোন মিলে। কিশোরের উন্মাদনায় ভরা দিনগুলো মানেনা শাসন, মানেনা বারণ। নিভৃত পল্লীর অনামী এই কিশোর কিশোরীকে শাসন করে মানুষ করার কেইবা আছে!
                     আজ দু'দিন ধরে মুষলধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। থামবার কোন লক্ষন নেই। রাস্তাঘাট সব ডুবে গেছে। মনে হচ্ছে আকাশ বন্যায় এবার ভেসে যাবে পৃথিবীটা।
গতকাল সন্ধ্যায় বাবুদের বাড়ীতে তাল রান্না হয়েছে। মিষ্টি একটা গন্ধ ভেসে এসেছে গোটা এলাকায়। নলেন গুড়ের ম ম গন্ধে।
          হাসান আর ফাতিমা রাতে শুয়ে শুয়ে ছক কষে। আগামীকাল ভোরে মানিকতলা সোনাদহের পাড়ে সেই তাল তলায় গেলে দু'একটা পাঁকা তাল নিঃশ্চয়ই পাওয়া যাবে। আর আজকে কুড়িয়ে পাওয়া ঝুনো নারকেলটা তো আছেই। বেশ মজা হবে, মনে মনে ভাবে দু'ভাইবোন।
           মালোপাড়ার তাল নবমী উৎসবে যে খুশীর বান ডেকেছে, তার ছোঁয়া এসে লেগেছে অনাহারক্লিষ্ট হতদরিদ্র কিশোর বয়সী দু'ভাইবোনের মনে। অশিক্ষিত দু'টি কচি নিঃস্পাপ মনে যে স্বর্নাভ দ্যূতি ছড়িয়ে পড়েছে তার আলো কোন শিক্ষিত সভ্য মানুষের দরবারে পৌছুবে না। বিজাতীয় সংস্কারে নির্মল ছোঁয়ায় সভ্যতায় জড়ানো মানুষেরা এদেরকে কুৎসিত বলে তাড়িয়ে দেবে।সোনাদহ!
এলাকার মানুষের মনে একটা বদ্ধমুল ধারনা,বলা চলে কুসংস্কার। এই সোনাদহ প্রতি বছর "কর " নেয়। এর জলে কেউ নামলে সে আর উঠে আসে না।
কবে কোনকালে কোন জমিদার এটা খুঁড়িয়েছিলো তার হিসেব আজ আর কারো কাছে নেই। তবে সেই আদ্দিকাল থেকে জনশ্রুতি হয়ে আছে "অপয়া দহ " হিসেবে এই সোনাদহ।
এরই একপাড়ে সারিসারি তালগাছ। দহের পশ্চিম পাড় ভেঙে নদীর সাথে মিশে একাকার হয়ে আছে দু'দিনের বন্যায়। সোনাদহ এখন তাই রণরঙ্গীনী। উজান থেকে ধেঁয়ে আসা জলের স্রোত পাক খেয়ে খেয়ে সশব্দে দু'কূল ছাঁপিয়ে ছুটে চলেছে ভাঁটির দিকে। সেই স্রোতে দু'একটা মরা গরু ছাগল যে মিশে আছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পাড়ভাঙা গাছপালা তো আছেই।
ঝুঁপসী কালো অন্ধকারে হাসান আর ফাতিমা যখন সোনাদহে এসে পৌছেচে, ঝিঁরিঝিঁরি বৃষ্টি আর প্রচন্ড বাতাসের দাপট রয়েছে। বড় মানকচু-র পাতা কেটে দু'ভাইবোন মিলে মাথা ঢাকবার আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। সর্বাঙ্গ ভিজে গেছে দু'জনারই। ঠান্ডা আবহাওয়ায় শীতের কনকনানি টের পায় কচিদেহ।
মানিকতলার তাল তলাতে এসে খুঁজে খুঁজে মাত্র দু'টো তাল খুঁজে পেয়েছে। আরও খুঁজে পেতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ওরা। সোনাদহের পাড়ে তাল তলায় মনে হচ্ছে একটা তাল পড়ে আছে! ভাইবোনের মুখে খুশীর হাসি ঝিলিক দিয়ে ওঠে। অনাবিল অপার সৌন্দর্য্যে দু'ভাইবোন পরস্পরে চেয়ে দেখে! কিশোরী ফাতিমার বুকটা হঠাৎ কেন যেন মোচড় দিয়ে ওঠে। কষ্টের লোনাজল হৃদয় নিঙড়ে বেরিয়ে আসে দু'চোখ বেয়ে! ভাগ্য ভালো, বৃষ্টিজলে তা ধুয়ে গেছে। না হলে হাসানের সামনে তাকে  লজ্জায় পড়তে হতো।
কে আগে যেয়ে তালটা কুড়োবে, ভাইবোনের মধ্যে হিসেব হয়। হাসান বলে," আমি আগে দেখেছি। তাই আমিই নিয়ে আসি। " এ নিয়ে দু'জনের মান অভিমান হয়। অবশেষে ভাইকে খুশী করার জন্য ফাতিমা রাজি হয়। হাসানকে তালটা নিয়ে আসার জন্যে।
সোনাদহের শুকনো পাড় এতদিনে খটখটে পাথর হয়ে ছিলো। প্রবল বর্ষায় আজ একেবারে কুমোরপাড়ার ছলকানো কাদা! দুরন্তঃ বন্যার ঘূর্নীতে পাড়ের মাটি ক্ষয়ে ভেঙে আছে ভেতরে ভেতরে। অসীম অতলজলের  গহব্বরে টেনে নিয়ে যাবে যেকোন সময়। ওপরের মাটি দেখে বোঝার উপায় নেই ভেতরের ভাঙনের রুপ। শুধু নিকষকালো অথৈজল পাক খেয়ে চলে যাচ্ছে, ভেসে আসা খড়কুটো, কচুরীপানা,শ্যাওলার দঙ্গল।
ফাতিমার হাতে মান-কচুর পাতাটা ধরিয়ে দিয়ে বেশ তৃপ্তির হাসি হেসে বিজয় গৌরবে এগিয়ে যায় হাসান। তালটা কুড়িয়ে ফিরে আসার পথে মনে হলো যেন শরীরের ভার হাল্কা হয়ে আসছে। পায়ের তলার মাটি যেন তেমন জেরালো নয়। ভয়ে বুকটা ধ্বক্ করে ওঠে! চিৎকার করে ডাক দেয় ফাতিমাকে।
          "যখন বড় হবে, ভাইটাকে নিজের কাছেই রেখে দেবে সে! " সবেমাত্র কল্পনার জাল বুনতে শুরু করেছে ফাতিমা। হাসানের চিৎকারে সম্বিৎ ফিরে তাকিয়ে দেখে, ঝুঁপ করে পাড় ভেঙে সোনাদহের অতলে তলিয়ে গেলো হাসান! বানের জল পাক খেয়ে পাড়ভাঙা ঘোলাজল টেনে নিয়ে গেছে সোনাদহের মাঝ বরাবর!চিৎকার করতে যেয়েও কোন শব্দ বেরোয় না ফাতিমার কন্ঠস্বরে।

আকাশে শুরু হয়েছে প্রবল বর্ষন!


sirajulislamsirajulislam412@gmail.com
বাংলাদেশ 

1 comment: