...সুদীপ ঘোষাল
১
গ্রামের নাম পাঁচুন্দি।আশেপাশে প্রচুর গ্রাম।সবাই
সকলের খবর রাখে।সৌমদীপ এখানকার ছেলে।কতজন যে পাঁচুন্দি বাস স্ট্যান্ডে ওঠানামা করে তার
ইয়ত্তা নেই।ঠিক জীবন মরণের মত।যার সময় হয় সে চলে যায়।
সৌম্যদীপ সকলের কাছে সৌম বলেই পরিচিত।
ছোটো থেকেই সে পড়াশোনায় খুব ভালো। আবার ডানপিটে সাহসীও বটে।কথাগুলো বলছিলেন সোমের দাদু। বিনয় শুনছে। বিনয় সব জানে।তবু শুনছে। দাদু আজ সোমের সাফল্যে
খুব খুশি।সাফল্যের পিছনে দাদুর অবদান অনেক।ছোটো থেকে সোম দেখে আসছে দাদু তাকে মায়ের আদরে মানুষ
করেছেন। বাবা মায়ের মধ্যে
যখন সাংসারিক বিষয়ে তর্কাতর্কি চলতো তখন দাদু সোমকে অট্টহাসের মাঠে,মন্দিরে
ঘুরিয়ে আনতেন। অট্টহাসের মন্দিরে
পঞ্চমুন্ডির আসন দেখে সোম বলেছিলো,আমি অই আসনে বসবো। দাদু বলতেন,ছোটোদের এই আসনে
বসতে নেই। এর জন্য অনেক সাধনা
করতে হয়।
----- সাধনা কি দাদু?
------ এই মনে করো তুমি পড়তে বসার আগে মা সরস্বতীকে প্রণাম
করে বসলে। তারপর ফাঁকি না দিয়ে ভালোভাবে পড়াশোনা করলে। দিনরাত সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করলে।
------ সিদ্ধিলাভ আবার কেমন?
_------- তুমি মন দিয়ে পড়াশোনা করলে আর তার ফলে পরীক্ষায়
ভালো ফল করলে। এই হলো তোমার সিদ্ধিলাভ।
তারপর দাদু সন্ধ্যাবেলা পড়তে বসার আগে একটা মন্ত্র
শিখিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন রোজ পড়তে
বসার আগে এই মন্ত্রটা পাঠ করবে।
সোম বলতো দাদুর সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রটা। " মুকং করোতি বাচালং পঙ্গুং লঙ্ঘয়তে গিরিম্। যৎকৃপা তমহং বন্দে, পরমানন্দ
মাধবম্।। "
দাদুর কাছেই ছোটোবেলায় জীবনের ভিত শক্তপোক্ত হয়ে
গেছিলো সোমের। তাকে আর পিছু ফিরে
তাকাতে হয়নি। এক একটা ইমারত ফাঁকি
দিয়ে তৈরি হয়। তাই সামান্য ভূকম্পে
ভেঙ্গে পরে। সোমের ভিত শক্ত বলেই
মন ভেঙ্গে পরেনি কোনোদিন। দাদু জানতেন সোমের
অন্দরমহলের কথা। তাই কোনোদিন কোনো
কাজে দাদু বাধা দেন নি বড়ো প্রিয় তার নাতিকে। মুক্ত বিহঙ্গের জীবন দর্শন তার পরতে পরতে। সময়ের স্বাভাবিক নিয়মে সে বড়ো হলো সাফল্যের
অনেক সিঁড়ি পার করে।
তারপর দাদুর অজান্তে সোম কোথায় যে চলে গেলো,কেউ
জানতো না।
সোমের দাদু ও বাবা গোমোতে ছিলেন তখন।
সোমের মা কান্নাকাটি করতেন। দাদু তার বাড়ি এসে বলতেন,হীরের
টুকরো তোমার ছেলে। ঈশ্বর ঠিক রক্ষা
করবেন,চিন্তা কোরো না।
সাফল্যের ইতিহাস বেশ জটিল। দাদুকে সোম বলছে নিজের কথা। বিনয় বসে আছে দাদুর পাশে। বাড়ির সবাই বসেছে সোমের সামনে।
সৌম বলে চলেছে তার হারিয়ে যাওয়া বছরগুলোর কথা। সৌম তার জীবনের অজানা অধ্যায় প্রকাশ করছে
সকলের কাছে।
দাদু আর বাবা তখন গোমোতে চাকরী করতেন। বছরে দুবার আসতেন। আমি তখন সেই সুযোগে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াতাম আমতলা,বেলতলা। গোকুল পুকুরের জল শুকিয়ে গেলে পুকুরের মাঝখান
দিয়ে রাস্তা হয়ে যেতো।সেই পুকুরের গা ছে ভূত থাকতো। শুনেছি। একদিন স্বচক্ষে দেখলাম। হাতে কমন্ডুল নিয়ে গোকুল পুকুরের পাশের জঙ্গলে ঢুকে
গেলো। সেই দৃশ্য আজও আমার
চোখে ভাসে। তারপর সময়ের সঙ্গে
তাল মিলিয়ে বড়ো হলাম।
২
গ্রাজুয়েট হওয়ার পরে আমার ঈশ্বর দর্শনের ইচ্ছা হলো। বেড়িয়ে পরলাম বাড়ি ছেড়ে। ঘুরতে ঘুরতে ক্ষিদে পেয়ে গেলো। মনে পরছে বাবা মায়ের আদর করে খেতে দেওয়া। আর একটু ভাত নে খোকা। কত অভুক্ত শিশুর মুখ ভেসে উঠছে আকাশ জুড়ে। বীরভূম জেলার জয়দেবের কেন্দুলি মেলা চলছিলো। সেখানে চলে এলাম। মচ্ছব খেলাম। তারপর এক বটগাছের তলায় ঝুড়ি নামা বটগাছের
মতোই জটাজুট ধারি এক সাধুবাবা বসে আছেন। দেখলাম
ওর থালায় অনেক পয়সা। আমি মজা করে কাড়াকাড়ি
করছি।সাধুবাবা দেবেন না। আমিও ছাড়বো না। হঠাত্
সাধু হু হু করে কান্না শুরু করলেন। আমি
তাড়াতাড়ি সাধুর থালা ছেড়ে দিলাম।সাধু
বললেন,না না আমি থালার জন্য কাদি নাই।এই নে
তোর থালা।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম,তাহলে কি জন্য কাদছেন।
সাধু বললেন,রত্নার জন্য। সে আমাকে ল্যাং মেরে পালিয়েছে।
আমি ভাবলাম,এই বয়সেও সে রত্নার
জন্য অনুরাগ পুষে রেখেছে। কি বিচিত্র মানবজীবন।
পাশ দিয়ে কোপাই নদী বয়ে চলেছে। লাল মাটির উচুনীচু ঢিবি। মন কেড়ে নেওয়া হাওয়া। সব কিছু ছাড়িয়ে সাধুর হায় হায় স্বর হাওয়া বাতাস
ছাড়িয়ে নদীর জলে হারিয়ে যাচ্ছে।
আমার চিন্তার সুতো সরিয়ে সাধুবাবা বলে উঠলেন,কি গো
কিছু বলো।
আমি বললাম,আপনি রত্নাকে ভালোবাসতেন?
তবু ও চলে গেলো কিসের লোভে।
সাধু বললেন, ছি ছি ওকথা বলো না। ও আমার। মেয়ের মতো। হু হু হু...
আমি বললাম, কি কারণ বলুন। আমি শুনতে চাই।
সাধু বললেন,আমি গান লিখেছি অনেক। রত্না সব গান নিয়ে পালিয়ে গেছে। ও দরদি আর একমুঠো আকাশ দে... , বড়ো
মানুষের মন লো,এইসব গান শোনো নি।
----- হ্যাঁ শুনেছি, সবাই শুনেছে। সব বিখ্যাত গান। রত্না লাহার কন্ঠে।
আমি বললাম আপনার নাম কি?
সাধু বললেন,কাউকে বোলো না। আমি
হিয়ানন্দ চট্টরাজ।
আমি তো অবাক। বলে কি লোকটা। হতেও পারে। ছাই সরিয়ে সোনা,একবার দেখলি না কানা।
সঙ্গে সঙ্গে আমি সাধুকে নিয়ে চলে এলাম বোলপুর। দাড়ি,গোঁফ কামানোর পর
সবাই চিনতে পারলেন।
নব বিশ্বভারতীর এক প্রফেসর বললেন,ইনিই
সেই হিয়ানন্দ। সুরকার,গীতিকার। আর তুই সোম শোন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভরতি হয়ে যা। পড়াশোনা শুরু কর।
স্যার আমাকে খুব ভালোবাসতেন। তিনি আমার সকল সমস্যা দূর করলেন।
হিয়ানন্দবাবু আবার লেখা শুরু করলেন। কবি, লেখকের মৃত্যু নেই। পাঠকের হৃদয়ে তারা চির অমর।
তারপর আমার পালে হাওয়া উঠলো। তর তর করে এগিয়ে গেলো পানসি।
৩
আমার মনে পড়ছে,কোপাই নদীর ধারে
আশ্রম করেছিলাম। মহিলা ও পুরুষের
পায়খানা ঘর তৈরি করেছিলাম পাঁচটা গ্রামে চাঁদা তুলে। কি সুন্দর পরিবেশ। সহজ সরল লোকের ভালোবাসা ভুলিয়ে দিয়েছিলো কৃত্রিম
শহুরে জীবন।
একবার রাতে আমার ভালোবাসার লোকেরা খবর দিলো,
বটগাছের
তলায় অপ্সরা নামেন আকাশ থেকে।
---- কাছে গেয়েছিস কোনোদিন?
---- না বাবা ভয় লাগে। অমর বললো।
----- তাহলে চ, আজকে চ, সবাই
দেখে আসি।
পাঁচজন গেলাম। তখন এক মহিলা বললেন,টাকা এনেছিস?
আর একজন বললো, ফেলো কড়ি মাখো তেল....
আর বুঝতে বাকি থাকলো না। ওরা
অপ্সরা নয়, বেশ্যা। রোজগার
করে, কষ্টের সংসারে।
মনে পড়ছে,গ্রামের সহজ সরল
লোকগুলোকে
কিছু ঠগ ঠকিয়ে রোজগার করে। একটা সুড়ঙ্গ। তার ভিতরে
মা মনসা থাকেন। সাপের ফোঁস ফোঁস
শব্দে ওদের ভয় পায়। ঠাকুরের নাম করে
সবাই দু টাকা, পাঁচ টাকা দেয়। আর ওই টাকা মদ আর মাংসে খরচ করে খচ্চর গুলো।
একদিন আমি একা সুড়ঙ্গ দিয়ে নেমে দেখলাম কেউ নেই, কিছু নেই। হাওয়ার শব্দ। মানুষের ভুল ধারণা ভেঙ্গে গেলো। বন্ধ হয়ে গেলো রোজগার। ওদের রাগ হলো। ষড়যন্ত্র শুরু করলো ওরা।
আমার ভক্ত রহিম বললো,বিরাজুলের কাছে শুনলাম
আপনাকে আজ রাতে আক্রমণ করবে খচ্চরের দল। সাবধানে
থাকবেন।
সেদিন একটা লাঠি হাতে ওদের খেলা দেখালাম।
মারতে এসে ওরা বসে পরলো আমার খেলা দেখার জন্য। দশটা টালি পর পর সাজিয়ে ভেঙ্গে দেখালাম।
ওদের একজন বললো,এ ব্যাটা সাধু না
ডাকাত। তারপর আমার মারমুখী
মূর্তি দেখে ওরা ভালো মানুষের মতো বললো,আমরা আপনার এখানে বেড়াতে এসেছিলাম। অন্য কিছু নয়।
তারপর থেকে আর ওরা কোনো অসুবিধা করে নি। ওরাও ভক্তের দলে নাম লিখিয়েছিলো। ঈশ্বর দর্শন আমার হলো সহজ সরল মানুষের মাঝে।
৪
আজ আমি আবার পড়াশোনায় মন দিয়েছি। তবু ভুলতে পারি না বাল্যবন্ধুদের।
কদতলার মাঠে এসে ঢিল মেরে পেরে নিতাম কাঁচা কদবেল। কামড়ে কচ কচ শব্দে সাবাড় করতাম কদ। বুড়ো বলতো, কদ খেয়ছিস। আর খাবি। কই তখন তো গলা জ্বলতো না। এখন শুধু ওষুধ। ভক্ত,ভব,ভম্বল,বাবু
বুলা, রিলীফ সবাই তখন আমরা আমড়া তলায় গিয়ে পাকা আমড়া খেতাম। জাম, তাল,বেল,
কুল,শসা,
কলা,
নারকেল
কিছুই বাদ রাখতাম না। নারকেল গাছে উঠতে
পারতো গজানন। শুধু দুহাতের একটা
দড়ি। তাকে পায়ের সঙ্গে
ফাঁদের মতো পরে নিতো গজানন। তারপর
কিছুক্ষণের মধ্যেই নারকেল গাছের পাতা সরিয়ে ধপাধপ নিচে ফেলতো। আমরা কুড়িয়ে বস্তায় ভরে সোজা মাঠে। বাবা দেখলেই বকবেন। তারপর দাঁত দিয়ে ছাড়িয়ে আছাড় মেরে ভেঙ্গে
মাঠেই খেয়ে নিতাম নারকেল। একদম বাস্তব। মনগড়া গল্প নয়। তারপর গাজনের রাতে স্বাধীন আমরা। সারা রাত বোলান গান শুনতাম। সারা রাত নাচতাম বাজনার তালে তালে।
শীতকালে খেজুর গাছের রস। গাছের কামান হতো হেঁসো দিয়ে। মাথার মেথি বার করে কাঠি পুঁতে দিতো গুড়
ব্যাবসায়ী। আমাদের ভয় দেখাতো,
ধুতরা
ফুলের বীজ দিয়ে রাকবো। রস খেলেই মরবে সে। চুরি করা কাকে বলে জানতাম না। একরাতে বাহাদুর বিশুর পাল্লায় পরে রাতে
রস খেতে গেছিলাম। বিশু বললো,
তোরা
বসে থাক। কেউএলে বলবি। আমি গাছে উঠে রস পেরে আনি। তারপর গাছে উঠে হাত ডুবিয়ে ধুতরো ফুলের
বীজ আছে কিনা দেখতো। পেরে আনতো নিচে। তারপর মাটির হাঁড়ি থেকে রস ঢেলে নিতাম আমাদের
ঘটিতে। গাছেউঠে আবার হাঁড়ি
টাঙিয়ে দিয়ে আসতো বিশু। সকালে হাড়ি রসে ভরে
যেতো। ভোরবেলা ব্যাবসায়ির
কাছে গিয়ে বলতাম, রস দাও, বাড়ির সবাইকে দোবো। বুক ঢিপঢিপ চাঁদের গর্ত। দেবে কি দেবে না, জানিনা। অবশেষে প্রাপ্তিযোগ। যেদিন রস পেতাম না তখন মাথায় কুবুদ্ধির
পোকা নড়তো। তাতে ক্ষতি কারো
হতো না। বিশু ভালো মিষ্টি
রস হলে বলতো, এটা জিরেন কাঠের রস। মানে চারদিন হাড়ি না বাঁধলে রস মিষ্টি হতো। জানি না। আমরা গাছে
নিচে গিয়ে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকতাম। রস পরতো
জিভে টুপ টাপ। কতদিন ঘনটার পর ঘনটা
কেটে গেছে রসাস্বাদনে। মোবাইল ছিলো
না।ফেসবুক ছিলো না। কোনো পাকামি ছিলো না।সহজ সরল হাওয়া ছিলো। ভালোবাসা
ছিলো।
আনন্দ ছিলো জীবনে। ব্লু হোয়েলের বাপ
পর্যন্ত আমাদের সমীহ করে চলতো। কোনোদিন
বাল্যকালে আত্মহত্যার খবর শুনিনি। সময়
কোথায় তখন ছেলেপিলের। যম পর্যন্ত চিন্তায়
পরে যেতো বালকদের আচরণে, কর্ম দক্ষতায়।
সোম বলে যাচ্ছে তার জীবনের অভিজ্ঞতার কথা। পট দেখানো শিল্পীর মুগ্ধতায় সবাই শুনছেন
তার জীবন কাহিনী। যে কাহিনী শুধু সোমের। তার আনন্দের সাক্ষী শুধু তার সফল হৃদয়। হৃদমাঝারে জেগে ওঠে রাখালিয়া বাঁশির সুর। সে বলে চলেছে স্কুল জীবনের কথা।
আমরা চার বন্ধু। রমেন, জীবন,
বিশু
আর আমি।
যেখানেই যেতাম একসাথে থাকতাম। বিশু
ছিলো আমাদের দলের অলিখিত নেতা। নেতা তো এমনি এমনি হয় না। তার কাজ,দল চালানোর
কৌশল তাকে নেতা বানিয়েছিলো। একদিন দুপুর বেলায় সে আমাদের ডাক দিলো তার বাঁশি
বাজিয়ে।
বাঁশির ডাক শুনেই মন চঞ্চল হয়ে উঠতো। ঠিক যেনো রাধার পোড়া বাঁশির ডাক। চুপি চুপি
বাড়ি থেকে বেড়িয়ে বটতলায়।
আমাদের মিলন অফিস ছিলো এই বটতলা। চারজন ছুটে চলে যেতাম মাঠে। সেখানে বিশুবলতো, দাড়া
কয়েকটা তাল কাঁকড়া ধরি । ভেজে খাওয়া যাবে।
বলেই হাত ভরে দিলো সোজা ধানের জমির গর্তে। একটা মাগুর
ধরেছি, বলেই মাথা টিপে হাত বের করতেই দেখা গেলো মাছ নয়একটা বড় কালো কেউটে সাপ। বিশু সাপটাকে
সাঁ সাঁ করে ঘুরিয়ে সহজেই ছুঁড়ে দিলো দূরে। তারপর
তাল কাঁকড়া ধরে ভেজে খাওয়া হলো মাঠে। ভাজার সমস্ত সরঞ্জাম বিশু লুকিয়ে রাখতো একটা পোড়ো
বাড়িতে। সাঁতার কাটতে যেতাম
নতুন পুকুরে। একবার ডুবে যাওয়ার
হাত থেকে রেহাই পেয়েছিলাম তার প্রখর বুদ্ধির জোরে। মাথার চুল ধরে টেনে তুলেছিলো
ডাঙায়।
গ্রীষ্ম অবকাশে বট গাছের ডালে পা ভাঁজ করে বাদুড়ঝোলা
খেলতাম বিশুর নেতৃত্বে।তারপর ঝোল ঝাপটি। উঁচু ডাল থেকে লাফিয়ে পড়তাম
খড়ের গাদায়।
এসব খেলা বিশুর আবিষ্কার। তারপর সন্ধ্যা হলেই গ্রামের বদমাশ লোকটিকে ভয় দেখাত
বিশু।
সুদখোর সুরেশ মহাজন বটগাছের ডাল থেকে শুনলো, কি রে বেটা খুব তো
চলেছিস হনহনিয়ে।
আয় তোকে গাছে ঝোলাই। সুদখোর অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো। তারপর
থেকে ও পথে যেত না মহাজন। সাদা চুলো গান্ধিবুড়িকে
রোজ সন্ধ্যাবেলা নিজের মুড়ি খাইয়ে আসতো অতি আদরে। বিশু বলতো, আমি তো রাতে খাবো। বুড়ির
কেউ নেই, আমি আছি তো। শ্রদ্ধায়
মাথা নত হত নেতার হাসিতে।
একবার বন্যার
সময় স্কুল যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন আমাদের নেতা। কোথাও সাঁতার জল কোথাও বুক অবধি
জল। একটা সাপ বিশুর হাতে
জড়িয়ে ধরেছে।
বিশু এক ঝটকায় ঝেরে ফেলে দিলো সাপটা। স্কুল
আমাদের যেতেই হবে।
সাঁতার কাটতে কাটতে আমাদের সে কি উল্লাস। যে কোনো কঠিন কাজের সামনাসামনি
বুক চিতিয়ে সমাধান করার মতো মানসিকতা বিশুর ছিলো। সে সামনে আর আমরা চলেছি তার
পিছুপিছু।
শেষ অবধি পৌঁছে গেলাম স্কুল। হেড মাষ্টারমশাই খুব বাহবা দিলেন স্কুলে আসার জন্য। তিনি বললেন,
ইচ্ছা
থাকলে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।
টিফিনের সময় ছুটি হয়ে গেলো। আসার সময়
একটা নৌকো পাওয়া গেলো।
মাঝি বললেন, আমার বয়স হয়েছে আমি একা অতদূর নৌকা বাইতে পারবো
নি বাবু। তাছাড়া আমার এখনও
খাওয়া হয় নি।
বিশু সঙ্গে সঙ্গে নিজের টিফিন বের করে দিলো। আমরাও মন্ত্রমুগ্ধের মতো টিফিন বের করে
দিলাম।
মাঝি ভাই বললেন, এসো সবাই এক হয়ে খেয়ে লি। তারপর নৌকার কান্ডারি হলো বিশু। আর আমরা সবাই মুড়ি মাখিয়ে খেতে শুরু করলাম। মাঝি ভাই
ও বিশু খেলো।
ধীরে ধীরে পৌঁছে গেলাম গ্রামে। মাঝি
ভাইকে পারিশ্রমিক দিয়ে বিদায় জানালাম।
পরের দিন রবিবার। রঙিন সকাল। আকাশে মেঘের আনাগোনা। কাশের কারসাজি নদীর তীর জুড়ে। বন্যার
জল নেমে গিয়েছে। পুজো পুজো ভাব। বিশু কাশফুলের ভিড়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। কয়েকদিন হলো তাকে দেখা যাচ্ছে না।
আমি ঘুরতে ঘুরতে পুজো বাড়ির ঠাকুর দেখতে গেলাম। সেখানে দেখি বিশু হাতে কাদা মেখে শিল্পীকে
সাহায্য করছে।
তিন দিন ধরে এখানেই তার ডেরা। এখন তার মনে বাজছে ঢাকের ঢ্যামকুড়াকুড়। মন মন্দিরে তার দুর্গা গ্রামদেশ ছাড়িয়ে
অভাবি বাতাসে বাতাসে।
পুজো বাড়িতে আমাকে দেখেও কোনো কথা না বলে হাঁটতে হাঁটতে বাইরে চলে গেলো।
আমি জানি সে এখন চাল, ডাল নিয়ে সর্দার
বুড়িকে রেঁধে খাওয়াবে।
সে বলে, ওর যে কেউ নেই। ও খাবে কি?
বিশুর বাবা বছরে একবার বাড়ি আসেন। তিনি ভারতীয় সৈন্য বিভাগে কাজ করেন। বাড়িতে এলেই বিশুর হাতে হাতখরচ বাবদ তিনি
বেশ কিছু টাকা দিয়ে যান। সেই টাকা বিশু লোকের
উপকারে কাজে লাগায়।
বড়ো অবাক হয়ে ভাবি, ছোটো বয়সে এতবড় মন
সে পেল কোথা থেকে?
৫
স্কুলের দূরত্ব অনেক বেশি হওয়ায় আমাদের চার বন্ধুর
বাড়ির গার্জেনরা শলা পরামর্শ করে হোষ্টেলে থাকার কথা বললেন। দায়িত্ব নিলো বিশু। কিন্তু
হেড মাষ্টারমশাই বললেন, সেশনের মাঝে হোষ্টেল পাবি না। ঘর ভাড়া
নিয়ে চারজনে থাক।
পরীক্ষা এসে গেছে।
কাছাকাছি থাকিস তিনটি মাস। রেজাল্ট ভালো হবে।
ঘুরে ঘুরে অবশেষে ভাড়া ঘর পেলাম। কিন্তু বাড়িওয়ালার পাশের প্রতিবেশি বললেন,
সাবধান
ওই বাড়িতে ভূত আছে। আমরা ভয় পেয়ে তিনজনে
বলে উঠলাম, তাহলে অন্য ঘর দেখি চল।
বিশু বললো, টাকা দেওয়া হয়ে গেছে। ভূতের
বাড়িতেই থাকবো।
বিশু যখন সঙ্গে আছে, ভয় কি তোদের।
তার অভয় বাণী ভরসা করে আমরা মাল পত্তর নিয়ে ঢুকে
পড়লাম লড়াইয়ের কোর্টে।
ক্যাপটেন বিশু বাড়িটা এক চক্কর পাক দিয়ে হাতে একটা লাঠি নিয়ে বললো, চলে
আয় ভূতের বাচ্চা। আমরা ওর সাহস দেখে
অবাক হতাম। রমেন বলে উঠলো,
ভূতের
শেষ দেখে ছাড়বো।
জীবনের মরণের ভয় একটু বেশি। সে কাঁপা গলায় বলে উঠলো, যদি গলা টিপে ধরে
ভূত। বিশু বললো, ভয় নেই, আমি একাই একশো। তোর কিছু
হবে না। হলে আমার হবে।
এই বাড়ির নিচু তলায় কিছু অসামাজিক লোকের কাজকর্ম
বিশু এক সপ্তাহের মধ্যেই টের পেয়ে গেলো। তারাই এই ভূতের ভয় দেখায়। একদিন জীবন বাথরুম গেছে এমন সময় নাকি সুরে একজন
বলে উঠলো, এঁখান থেকে পাঁলা। ঘাড় মটকে দেবো। আবার একদিন রমেন ভয় পেলো। ঠিক সেই বাথরুমে। বিশু তদন্ত
করে দেখলো বাথরুমের ভেন্টিলেটার ভেঙ্গে একটা সরু দড়ি ঢোকানো হয়েছে। বাইরে
গিয়ে দেখলো দড়িটা নিচের ঘরের বারান্দায় শেষ হয়েছে। বাথরুমে ভাঙ্গা কাঁচে টান পরলে
বিকট আওয়াজ হয়।
আর মুখ বাড়িয়ে মুখোশ পড়ে নাকি সুরের কথায় সকলেই ভয় পাবে। বিশু বললো সবাই তৈরি থাকিস। আজ রাতেই ভূত ধরবো।
আজ আর কেউ স্কুল গেলাম না। একটা উত্তেজনা রাতে জাগিয়ে রেখেছে। এবার সেই
বিকট শব্দ। বিশু বাঘের মতো লাফিয়ে
লাঠি হাতে নিচের তলায় গিয়ে জলজ্যান্ত ভূতের পাছায় লাঠির আঘাতে ভূতকে কাবু করে ফেললো। ভূত বাবাজি
জোড় হাতে বলছে, ছেড়ে দাও বাবা আমি আর ওসব করবো না। ভূতের
সঙ্গিরা সব পালিয়েছে, আমাদের হাতে লাঠি দেখে। বিশু বললো, যাও, যেখানে বিশু আছে সেখানে চালাকি করার চেষ্টা
কোরো না। বিপদে পড়বে।
তারপর থেকে আর কোনোদিন ভূতের উপদ্রব হয়নি সেই বাড়িতে।
বিশুর বাহাদুরি দেখেই আমরা সাহসী হয়ে উঠেছিলাম। বিশুর সঙ্গে আমরা বেরোলে সকলের চোখেমুখে
একটা সাহসের,শান্তির ছাপ ফুটে উঠতো। পাড়ার কোনো মানুষ বিপদে পরলে বিপদের বন্ধু এই টাইগার
বিশুকেই স্মরণ করতো। তার সঙ্গে আমরা তো
থাকতাম অবশ্যই। রমেন, জীবন,বিশু,আমি
একবার বন্যার সময় নৌকা করে মানুষের খাবার জোগাড় করতে চড়খী গ্রামে গিয়েছিলাম। হেলিকপ্টার থেকে চিড়ের বস্তা,গুড়ের
বস্তা ফেলছে চড়খীর ব্রীজে যার আসল নাম কাশীরাম দাস সেতু। সেখান থেকে আমরা চিড়ে, গুড়ের পাটালি নৌকায়
তুললাম। রমেন পেটুক। বললো, একটু টেষ্ট করলে
হয় না। বিশু বললো,
এখন
এটা সকলের সম্পত্তি।
যা হবে সকলের সামনে হবে। কেউ
হাত দিবি না। এখন তাড়াতাড়ি চল। বান বাড়ছে। বিশু দাঁড় টানেআর আমরা সবাই সাহায্য করে নৌ্কা ও
খাবার নিয়ে চলে এলাম নতুন পুকুরের পাড়ে। সেখানে
বাড়ি বাড়ি সকলকে সমানভাবে খাবার ভাগ করে দিলো বিশু। তারপর আমরা বাড়ি এসে জীবনের মায়ের হাতের রান্না, গরম
খিচুড়ি আর পেঁপের তরকারি খেলাম। অমৃতের স্বাদ। বিশু বললো, কাকীমা অনেক পেঁপে
গাছ পড়ে গেছে বন্যার স্রোতে। আমরা
আপনাকে অনেক পেঁপে এনে দেবো। সেবার
বন্যায় পেঁপে, গ্রামের লোকের প্রাণ বাঁচিয়েছিলো। আমাদের গ্রাম অজয় নদীর ধারে। গ্রামগুলিও
খুব নীচুস্থানে অবস্থিত।
নদীর নাব্যতা বা গভীরতা অল্প। ফলে
বন্যা প্রায় প্রতি বছর দেখা দিয়ে যেতো। জল যখন
কমে যেতো তখন তোতনের মা ও পাড়ার মা বোনেরা মাঠে মাছ ধরার জন্য যেতো। নানারকমের শাক, ঢোল কলমি,
শুশুনি
তুলতো।
খুব ভালো লাগতো নানারকমের মাছ ভাজা খেতে। আমি দেখলাম,
তোতনের মা মাঠ থেকে দুই তিন রকমের শাক তুলেছে। ওরা ভিটামিন
বোঝে না, শরীরচর্চ্চাও বোঝে না। ওরা জানে খাটবো, রোজগার করবো আর খাবো
পেট ভরে।
মাঠেই পাওয়া যেতো বেশির ভাগ শাক, সব্জী।
, খলসে, ওআরও নানারকমের মাছ মাঠের জলে সাঁতার কেটে
বেড়াতো।
বেলে, তে চোখো,চ্যাঙ,ছিঙুরি,গচিমাছ
ছাড়াও ছোটো কাঁকড়া তাল কাঁকড়া পাওয়া যেতো। গর্তে হাত ঢুকিয়ে বিশু অনরকবার তআল কাঁকড়া বের করে
আমাদের দেখিয়েছে।
পাঁকাল,গুঁতে,কৈ,মাগুর,ল্যাটা
প্রভৃতি অসংখ্য মাছ।
বিত্তি পেতে দিতো স্রোতের মুখে।
বিশু বলছে, খাল কেটে মাঝখানে
বিত্তি পেতে জল যাওয়ার নালা কেটে দিতো। মাছ
লাফিয়ে ওই গর্তে পড়তো। টানা জাল,পাতা
জাল দিয়ে মাছ ধরতো। এখন তোতনের মায়ের
জায়গায বৌমা মাঠে যায়। কিন্তু কৃষিকাজে
সার, ওষুধ প্রয়োগ করার ফলে সেইসব মাছ ইতিহাসের পাতায় চলে গেছে। শাকপাতাও পায় না মা বোনেরা। এখন সব বাজারমুখী।। তখন শাক আঁচলে করে নিয়ে গিয়ে
বাউরীবউ মুড়ি নিয় আসতো চাষি বাড়ি থেকে। মাঠের
টাটকা শাক সবাই নিতো জলের দরে। আজ আর টাটকা কিছু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশুর কথা একশো শতাংশ সত্য। এখন আমরা বড় হয়ে গেছি। কিন্তু,
স্বর্ণ
যুগের সেইসব স্মৃতি মনের মণিকোঠায়চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
পড়াশোনা
আমার ভালোবাসা। মানুষ আমার দেবতা। মাষ্টার ডিগ্রী কমপ্লিট করে আমি বি,এড করেছি। তারপর স্কুল সার্ভিস পরীক্ষা দিয়েছি। তিন মাস পরে রেজাল্ট। এই অবসরে আমার বন্ধু আশীষের কথা মনে পরছে।
৬
আশীষ নামের সীমাহীন আনন্দমাখা ছেলেটা ভেলোরে গিয়ে
জানতে পারলো,তার হার্ট বড়জোর আর দুবছর চলবে। এত কথা জেনেও কোনোদিন মুষড়ে পরেনি তার মন। ফুটবল খেলতে ভালোবাসতো ছেলেটা। সারা
বিকেল ছুটে ছুটে সে আনন্দ মাখতো সারা গায়ে। আলো নামের আলো মনের মেয়েটা জেনেশুনে তার সমস্তকিছু
দিয়েছিলো দুদিনের আনন্দের দেবদূতকে। পৃথিবীর
রঙ,রূপ, রস সে একশো বছরের পরমায়ুর মতো পেয়ে গিয়েছিলো মনের
প্রসারতায়। কেউ তাকে সান্ত্বনা
দিতে এলেই কথা ঘুরিয়ে তার চোখে এঁকে দিতো স্বপ্ন।
তার সঙ্গে ঘুরতে গেছিলাম মুর্শিদাবাদের রামপাড়া। গঙ্গার ধারে গ্রামটি। ছোটো হলেও আমরা বন্ধুরা প্রত্যেকটি বাড়ি
বাড়ি ঘুরেছি। কারো বাড়ি স্নান
করা, কারও বাড়িতে খাওয়া দাওয়া।কারওবাড়িতে
গান বাজনা করেই দিন চলে যেতো। দুর্গাপুজোর
বিসর্জনের দিনে নৌকা করে ঠাকুর বিসর্জন দেখলাম। গঙ্গার ধারের সব গ্রামের ঠাকুর নৌকো করে মাঝ গঙ্গায়এনে
বিসর্জন করা হচ্ছে ঢাক,ঢোল বাজিয়ে। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নেমেএলো। সন্ধ্যা নেমে এলো আশীষের জীবনে। রাত হওয়ার আগেই পাড়ি দিলো ভবসাগরের ওপাড়ে। তার সংসারে বাবা,মা, তিন
বোন। আশীষের বাবাকে আমি জামাইবাবু বলতাম। তিনি কেলকাতা লালবাজারের কমিশনারের দপ্তরে কাজ করতেন। তার দাপ ছিলো ভীষণ। তার নামে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খেতো। তিনি ছেলের শোকে মারা গেলেন। দিদি কয়েক মাসের মধ্যেই চলে গেলেন। বড্ড প্রাণপ্রিয় ছিলো তার আশীষ। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। রামপাড়ার বাড়িতে আর কেউ নেই। কতকগুলো ঘুঘু মনখারাপের ডাক ডেকে চলে নিশিদিন। ওই নিরীহ পাখি মানুষকে সত্য, সুন্দরের
বাণী শোনায় আজীবন। বড্ড প্রিয় আমার
এই ঘুঘু পাখি। ভিটেতে ঘুঘু চড়ে
না,সে মনে রাখে এই ভিটের মালিক একদিন আমাকে আশ্রয় দিয়েছিলো,আজও
দিয়েছে। তাই কৃতজ্ঞ সুরে
তার শোকপ্রকাশ মালিকের অবর্তমানে। আমার
তাই মনে হয়। সত্য ঘটনা থেকে শিক্ষা
নেওয়ার নাম ধর্ম।
কি করে একটা সাজানো বাগান তছনছ হয়ে যায়। বন্ধু অমিত বললো। তবু মানুষের এত অহংকার। তারা মনে করে মৃত্যু বোধহয় তাদের ভুলে গেছে। সে ভোলে না। হঠাৎ চলে আসে। সময় থাকতে বাড়ির কাছের মানুষের সেবা করাই ভালো। পৃথিবী সুন্দর হয়ে উঠবে,পরস্পরের
সেবা, ভালোবাসার মাধ্যমে।
আমার বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ দুই বছর নেই। কোনোদিন যদি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারি,তখন
বাড়ি যাবো। মা, বাবার
চিন্তা আমি দূর করবোই। আমি যেখানে ভাড়া
আছি, তার পাশের বাড়ির ছেলেটা আমার কাছে পড়ে। ছেলে পড়িয়েই ভালোভাবে আমার চলে যায়। পাশের বাড়ির মর্মান্তিক ঘটনা আজও আমায় ব্যথিত
করে। সেই ঘটনা ছবির মতো
মনে পরছে...
বিয়ের পর থেকেই স্বামী স্ত্রী র মধ্যে বনিবনা ছিলো
না। কথায় কথায় ঝগড়া। এমনি করেই দিনগুলো কেটে গেলো। সন্তান হলো। পুত্র সন্তান। ঝগড়া,অভাবের মধ্যে দিয়েই বেলা বয়ে গেলো। পানসি তরি। চর চর করে এগিয়ে যায় স্রোতের প্রতিকুলেও। থামা জানে না।
রুমা বললো, ছেলে বড়ো হলো। কলেজে পড়ছে। এবার আয় বাড়াও। এতে আর সংসার চলছে না।
বিমল সব বোঝে। কিন্তু উপায় নেই। ছোটো থেকে পরিশ্রমের কাজ করে নি। তাই পঞ্চাশ বছরে ভারি কাজ করতে পারে না। তাঁতি তাঁত বুনেই যায়। তারপর দোকানে দিয়ে আসে। এসব কাপড়ের কদর আগের মতো আর নেই। বিক্রি কমেছে। আয় কমেছে। বয়স, সংসারের খরচ বেড়েছে। তবু আলো খোঁজে বিমল। অবসর সময়ে কবিতা লেখে। ছবি আঁকে। রুমা দেখেছে কবিতা লেখার সময় বিমলের বয়স বোঝা যায়
না। অনেকখানি কমে যায়
বয়সের বল্লিরেখা।
ছেলে সবুজ। কলেজে পড়ে। মোবাইল চাই। বন্ধু বান্ধবীদের হাতে সব দামি দামি মোবাইল। এখনকার ছেলে মেয়েরা কথা কম বলে। কানে তাদের গোঁজা হেড ফোন। হাতে মোবাইল। আনলিমিটেড কল। তাই সব সময় ফোনে কথা। হেড ফোন গোঁজা। কথা শুনতে পায় না। ফোন করলেই পাওয়া যাবে। ভয় হয় বিমলের মানুষ কুড়ি বছর পরে কথা বলবে তো? সমাজ, আত্মীয় স্বজন থাকবে
তো। সম্পর্ক ভালোবাসা
বলতে কিছু থাকবে তো। সম্বিত ফিরে এলো
রুমার রমণীয় গলার ডাকে।
---- কই শুনছো,বাজারে যাচ্ছি। দরজাটা ভেজিয়ে দাও।
আর কিছুদিন পরেই ভাইফোঁটা। রুমা বাবার বাড়ি যাবে। খুড়তুতো,জ্যাঠতুতো সব মিলিয়ে
অনেক ভাই। ওর পাড়াশুদ্ধ ভাই। বাইরেআকর্ণ বিস্তৃত হাসি। স্বামীর কাছে এলেই গম্ভীর। তবু বিমল সম্পর্কটা টিকিয়ে রেখেছে। গড়াই তার ধর্ম, ভাঙ্গা নয়। কিন্তু বাড়ির লোক বোঝে না।
ভাইফোঁটায় নিজের ভাইয়ের কল্যাণ কে না চায়। বিমলের দুই বোন। আজ বোধহয় পাঁচবছর ফোঁটা পাইনি,বিমল
ভাবে। তাতে কি?
ওরা
সুখে থাকুক।আমি বাড়ির প্রহরায় আছি। বিড় বিড় করে বিমল আপন মনে। মনটা ছিলো তাই,কথা বলে সুখ পায়।ছেলেটাও ভাইফোঁটায় খুড়তুতো বোনের কাছে ফোঁটা নিতে
পারে নি পাঁচ বছর।বিমল বলেছে,তুমি একবার যাবে,আবার
আমাদের এখানে ফোঁটা হবে পরের বছর। কিনতু
রুম্পা রাগ করে। বলে, কতগুলো
উপহার পাই বলতো। আর এখানে থাকলেই
তোমার কৃপণতা। ফালতু বোকো না। আমি ভাইফোঁটায় বাবার বাড়ি যাবোই। কিন্তু তোমার ছেলে,আমার
কারো ফোঁটা হবে না। সে বলে, তা আমি
কি করবো। কিছু করার নেই। আমাকে দাদারা কত টাকা দেয় জানো।
---- না, তা জানি না। তবে জানি টাকাটা তুচ্ছ। ভাইবোনের ভালোবাসাই আসল। বোনের শুভ কামনায় যম দূরে থাকে। ভাইয়ের পরমায়ু বাড়ে। আবার ভাইদের আশীর্বাদে বোনের পরমায়ু বাড়ে।
---- থাকো তুমি তোমার শুকনো ভালোবাসা নিয়ে। আমার টাকা চাই। শাড়ি চাই। মাংস,মিষ্টি চাই। বাবাঃ এই সুযোগ কেউ হাতছাড়া করে। শুধু বসে বসে বড়ো বড়ো কথা।
কিছু ক্ষে্ত্র আছে মানুষের কবছু করার থাকে না। তখন সময়ের উপর সব ছেড়ে দিতে হয়। তা না হলে অশান্তি বাড়ে, কমে
না।
এদিকে বিমলের বোনরা চেপে ধরে দাদাকে। বলে, তোমার আস্কারা পেয়ে
বৌটা একদম কোনো কথা শোনে না। কি আর
বলবো। কোনো সময় দেখা হলেই
কথা শোনাতে ছাড়ে না। মোবাইল নেই। তাই বোনরা ঠিকমতো যোগাযোগ রাখতে পারে না। তারা বলে , দাদা একটা মোবাইল কিনতে পারো না। তাহলে যোগাযোগ ভালো হয়। এখন আর পোষ্ট কার্ডে কেউ সংবাদ পাঠায় না। ওসব ব্যাক ডেটেড। বিমলের মোবাইল ভালো লাগে না। কবিতা আর কাজ নিয়েই তার সময় কেটে যায়।
দুদিন ধরে নিম্নচাপ। প্রচন্ড ঝড়, বৃষ্টি। তবু রুমা ছেলেকে নিয়ে চলে গেলো বাপের বাড়ি। যাক। ঠাকুর রক্ষা করো। বড়ো ভয় হয়। প্রিয়জন বাইরে গেলে সকলের হয়। রাস্তঘাট সারাই হচ্ছে। সাবধানে যেও... বিমলের আর্তি।
কিন্তু রুমা, ছেলের কোনো খবর নেই। দুপুরে রুমার মা জানালো, বাবা
সবুজ আর নেই। বিমলের দম বন্ধ। নিশ্বাস নিতে পারছে না। ওরা বলেছে,বাসআ্যক্সিডেন্টে
রুমা বাঁচলেও সবুজ রক্ষা পায় নি। তিনদিন
খায় নি বিমল। আজকে বাইরে গেলো। কয়েন বুথ থেকে ফোন করে রুমার মাকে জানিয়ে
দিলো,রুমাকে আর এখানে পাঠাবেন না। আমি
সব বিক্রি করে আপনার মেয়েকে টাকা পয়সা দিয়ে আসবো।
রুমাও আসতে চায়নি। স্মৃতি দিয়ে ঘেরা সবুজের বাড়িতে এক মূহুর্ত কাটানো
শক্ত।
বিমলের শরীর গাছের মতো শিকড় ছাড়া হলো। শিকড় ছিঁড়ে গাছ বাঁচে না। তবু তাকে নিয়ে কোলকাতা ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গেলাম। তাকে পি জি হাসপাতালে ভরতি করে দিলাম। তিন মাস হাসপাতালে থাকতে হবে। হার্টের অবস্থা ভালো নয়।
আমার পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে। চাকরি হলেই কেল্লাফতে। কিন্তু গিয়ে দেখলাম প্রচন্ড ভিড়। ভিড় ঠেলে এগোতেই দেখি,লিষ্টে
নাম নেই। হতাশ হয়ে বসে পরেছি। ফিরে আসার আগে আর একবার দেখলাম। পেয়েছি,এক নম্বরে নাম। আমি নিচের দিকে দেখেছিলাম। এক নম্বরে আমার নাম থাকবে বুঝতেই পারিনি। আমি শিক্ষক হলাম। এবার বাড়ি যাবো। কিন্তু ওই ছোটো ছেলেগুলোর কি হবে,কোথায়
যাবে।
মনে পরছে তাদের কথা।
একটা আট বছরের বাচ্চা বাজারে ঘুরে বেড়ায়। কে ওর বাবা কে যে ওর মা কেউ জানে না। বাজারে কারও জলএনে, কারও
চা এনে ও কাজ করে আপনমনে। তারপর পাঁচটাকা করে
সবার কাছে নিয়ে ভাত খায় আধপেটা। কারণ
এখন আর হোটেলে কম পয়সায় খাবার পাওয়া যায় না। বেশ
মানিয়ে নিয়েছে বিধাতার দেওয়া বিচারের রায়। হোটেল
মালিক রিন্টু বলে।
ওকে বাধা দিয়ে গগন বলে, বিধাতার দোহাই দিয়ে মানুষের দোষ আমরা লুকিয়ে ফেলি লজ্জা
সরম ভুলে। ভাগ্যিস বিধাতা বলে
ম্যান মেড শব্দটা ছিলো। কোনো নারী ধর্ষিতা
হলেও বিধিলিপি বলে চালাতে বাধা নেই। মাঝে মাঝে সমাজের খাঁচাটা ভেঙ্গে ফেলতে
ইচ্ছে করে।
রিন্টু সব জানে,সব বোঝে। তবু তার হোটেলেও তিনটি নাবালক সকাল থেকে
সন্ধ্যা অবধি শুধু দুমুঠো খবারের আশায় পরে থাকে।
সত্যি কথাগুলো শুনলেই রিন্টুর মুখটা জোঁকের মুখে
নুন পরার মতো হয়ে যায়। ও বলে, সব বড়ো
বড়ো কথা। আরে কাজ না করলে
ওদের বসে বসে খাওয়াবে কে?
কেন মানুষ। প্রতিটি মানুষ যদি একজনের দায়িত্ব নেয় তাহলেই তো
হবে। গগন বললো কথাগুলো।
কিন্তু কথা বলা আর কাজ করে দেখানোর মধ্যে বিস্তর
ফারাক।
আমি বাজার যেতাম আর বাচ্চাগুলোকে দেখতাম। আজ কয়েকদিন হলো বাজারে ভজনকে দেখা যাচ্ছে
না। বেশ কয়েক বছর আগে
ঘুরতে ঘুরতে এখানে এসে পরেছিলো। তখন
ভজন পাঁচ বছরের।
সবার মুখেএকটাই কথা। ছেলেটা গেলো কোথা? হোটেলে যে বাচ্চাটি
কাজ করে সে এসে বললো, গতরাতে একজন রুমাল দিয়ে মুখ বেঁধে ভজনকে নিয়ে যায়। আমরা চিৎকার করেছি কিন্তু রাতে কাউকে পাই
নি।
রিন্টু বললো, তাহলে কেউ কাজের
জন্যেই নিয়ে গেছে। ছেরে দে,
যা কাজ
কর।
তারপর সুখে দুখে কেটে গেছে অনেকটা সময়। সরকার থেকে আইন করা হয়েছে শিশুশ্রম বন্ধের। কিন্তু সে আইন শুধু কাগুজে আইন।
তারপর অনেক দিন পর চা দোকানে দেখলাম একটা দশ বছরের
ছেলে কাজ করছে। মনটা খারাপ হয়ে গেলো। শরতের শেষে মন খারাপের ঘুঘু পাখিটা ডেকে
চলেছে একসুরে।
আমি দোকানে জিজ্ঞাসা করলাম,কি গো
ভাই,একে পেলেন কোথায়?
--- আর বলবেন না। সমুদ্রের ধারে ওদের বাড়ি ছিলো। একদিন সুনামিতে ভেসে গেলো ওর মা বাবা ভাই
বাড়ি ঘর সব। সেই থেকে ও ঘুরে
ঘুরে বেড়ায় আর কাজ করে খায়। ছেলেটা
খুব ভালো। কথা কম কাজ বেশি
করে।
আমি বললাম, ও কথা বলবে কি করে। বিধাতা ওর কথার মেয়াদ শেষ করে দিয়েছে।
--; অত বুঝি না স্যার। খাটে খায়। কাজ পুরোদম,পয়সা হজম। বলুন কে কে লিকার খাবেন।
আমি পাশে সরে এলাম। আজ আর চা পান করলাম না। সুনামি কে দেখলাম, সে আধা বাংলা আধা
হিন্দীতে বলছে,বাবু চা লিজিয়ে গরম চায়...
আমার বনধু পল্লব যাচ্ছিলো বাজারে। আমি তার সঙ্গ নিলাম।
---- চায়ের দোকানে ছেলেটাকে দেখলি?
---- হ্যাঁ, দেখেছি,ওর সব কথাই শুনেছি। কিছু করার নেই। পারবি বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রাখতে।
না। কারণ,
পরের
ছেলেকে রেঁধে বেড়ে কে খাওয়াবে। আপনি
নিজেকে প্রশ্ন করে দেখুন। উত্তরটা একই হবে।
তাহলে কি উপায়। সুনাগরিক হিসাবে আমাদের দায়ীত্ব তো কম নয়। বললো আমার বন্ধু।
আর আমরা যাদের খাওয়া পড়ার চিন্তা থাকে না,
তারা
শৈশবে ছোটাছুটি, নানারকম খেলা, সাইকেল চালানো এইসব
করেই দিন কেটে যায়। মনে আছে মিলু,
বিশ্বরূপকে
সাইকেল চালানো শেখাতে গিয়ে প্যান্ট খুলে গিয়েছিলো। তবু দায়ীত্ববোধে সে সচেতন। বন্ধু যাতে পরে না যায় তার জন্য সাইকেল কিন্তু ছাড়ে
নি। এই নিয়ে পিনু,
নোটোন,
আশীষ,অধীরের
হাসাহাসিতে লোক জড়ো হয়ে গেছিলো।তখন
আমরা বারো কি তেরো য় পা দিয়েছি।
আর সুনামি বলে ছেলেটার মুখে হাসি নেই। শুধু কাজ আর কাজ। তা না হলে খেতে পাবে না তো। তারপর সাতকুলে কেউ নেই ওর। কোথায় রাত কাটায় তার কোনো ঠিক নেই। হয়ত দোকান বন্ধ হওয়ার পরে ঝাপ ফেলে ওখানেই
শুয়ে পরবে।
চা দোকানের মালিক কাজে গাফিলতি করার জন্য সুনামিকে
একদিন খুব বকাবকি করলো। দিন দশেক পরেএসে
দেখলাম দোকানের কাজ ছেড়ে সুনামি অন্য কোথাও চলে গেছে ভালোবাসার খোঁজে।
এখন আমি বাড়ি ফিরেছি। সফল হয়েছি। একটা হাই স্কুলে মাষ্টারি করি। এই বলে সোম চুপ করলো। মনের লাভা বেরিয়ে এসে চোখে আনন্দ অশ্রু
হয়ে ঝরে পরলো। এবার সোমের বাবা,
মা তার
বিয়ের ব্যবস্থা করলেন।
এখন সোম পুরোপুরি সংসারী। তবু তার মন মানুষের জন্য ভাবে। পৃথিবীর কোণে কোণে তার মন অভুক্ত,ব্যথিত,আতুর
লোককে সান্ত্বনা দিয়ে চলে আজও...
৭
সৌমর সঙ্গে পরিচয় হয়েছে গ্রামের আশেপাশের বহু মানুষের
সঙ্গে।সে তাদের খোঁজ খবর রাখে।সকলেই তাকে ভালোবাসেন।অট্টহাস সতীপীঠ কাছেই।সেখানে
যাতায়াতের সূত্র ধরে অনেক মানুষের খোঁজ খবর সে রাখত।পাঁচুন্দির হাট বসে প্রতি বৃহস্পতিবার।গরু,মোষ,ছাগল নিয়ে কেনাবেচার উদ্দেশ্যে নিয়ে পরিচয়
আরও গভীর হত।রমজান,ইজাজুর,মহম্মদ
নূর,বেণুকর,অপু,সুকুমার,রুণু,শঙ্করী,অসীম,বিজয়
ও আরও কতলোক অজান্তেই পরম আত্মীয় হয়ে গিয়েছিলো।হাটের স্ট্যাম্প মারা গরু, ছাগল সারি দিয়ে যায় পাকা রাস্তা দিয়ে।এই হাট এই অঞ্চলের প্রাণের স্পন্দন।এই অঞ্চলকে ঘিরেই সৌমর এখনকার জীবনযাত্রা। হয়ত আবার কোনোদিন মুক্তোর খোঁজে বেড়িয়ে
পড়বে গেরুয়াবেশে।তার মতিগতি দেখে অনেকেই এই কথা বলে থাকেন।সৌম্য বেশ কয়েকটা লোকের কথা এখনও ভুলতে পারে না।
অনিমেষ
বোস বারান্দায় বসে থাকতেন সকালে।তার দুই ছেলে।সবুজ ও বিজয়।সবুজ
সরকারী চাকরি করে আর বিজয় লেখক।সে একটা
প্রাইভেট স্কুলে কাজ করে।
অনিমা সবুজের স্ত্রী। তার
রান্নার লোক আছে।কাজের মাসি আছে।সারাদিন মোবাইলে
দিন কাটে অনিমার।সে খুব প্রাকটিক্যাল।একদম
রোবোটিক।শ্বশুর শ্বাশুড়িকে পাত্তা দেয় না।কেউ কিছু বললেই তর্ক করে না বুঝে।অথচ ছেলেরা মা বাবার সঙ্গে মুখ তুলে কথা বলেনি কোনোদিন।
বিজয় বৌ নিয়ে কাটোয়ায় থাকে।তার সংসার সে নিজে বুঝে নেয়।তার স্ত্রী খুব ভালো।
কিন্তু বড় বৌমা অনিমা খুব মুখরা।কাউকে সম্মান দিতে জানে না।
অনিমেষবাবু রাশভারি মানুষ। তিনি বুঝলেন,এখানে থাকা কষ্টকর।তাঁর কাজে ব্যাঘাত ঘটে।তিনি আর কবিতা দেবী কৃষ্ণ মন্দিরের লাগোয়া ঘরে চলে গেলেন বড় ছেলেকে বল।ছোটো ছেলে দূরে শিক্ষকতা করে।সেখানেই ভাড়া নিয়ে আছেন তিনি।
অয়াদিপাউসের মত অনিমেষবাবু সত্যের অনুসন্ধান করেন।আজীবন করে এসেছেন।রামকৃষ্ণ সেবাশ্রমের সেবক তিনি।চিরকাল
আর সবিতা দেবী রান্না নিয়ে ব্যস্ত থাকেন।সংসারের কাজ করতেই তার ভালো লাগে।পুরোহিত এলে একবার মন্দিরে যান।প্রসাদ আনেন ঘরে।স্বামীকে দিয়ে তারপর নিজে খান। অবসর সময়ে সবিতাদেবীর মনে পড়ে পুরোনো কথা।আগে খুব মজা হত শ্বশুরবাড়িতে।
সব জা , একত্রে মিলিত হতো
ননদ বা দেওরের বিয়েতে। একবার বাসু দেওরের
বিয়েতে পুণ্যলক্ষী বৌদি ছেলে সেজেছিলো। প্যান্ট,
জামা
পরে চার্লি চ্যাপলিনের মতো একটা লাঠি নিয়ে অভিনয় করে চমকে দিয়েছিলে বিয়ে বাড়িতে। সব জা রা প্যান্ট পরা ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে
যখন ভাশুরদের সামনে দাঁড়ালো,মাথা লজ্জায় নিচু করেছিলো পুরুষদল। তখনকার দিনে এটা একটা ভীষণ সাহসের ব্যাপার
ছিলো। অভিনয়ের শেষে যখন
জানতে পারলো প্রকৃত ঘটনা তখন সকলে হাসাহাসি আর চিৎকার শুরু করলো। নতুন বৌ বুঝতে পারতো একান্নবর্তী পরিবারের
আনন্দ। বিয়ের শেষে যে যার
চাকরীর জায়গায় চলে গেলে বাড়ি ফাঁকা লাগতো। নতুন
বৌ এর ভালো লাগতো না। স্বামী চলে যেতো
চাকরীর জায়গায়। বাড়িতে মা,
বাবা
আর বেকার দেওরের দল। তারপর জলের ধর্মে
যে কোনো পাত্রের আকার ধারণ করতো নতুন বৌ। বাবা,মায়ের
সেবা,দেওরের খাওয়া, রান্নাবান্না সব নজরে রাখতে হতো নতুন বৌকে। প্রাণমন ছটফট করতো বাপের বাড়ি যাওয়ার জন্য। শ্বশুর, শ্বাশুড়িকে রাজী
করে শর্ত মেনে যেতে হতো বাবার বাড়ি। তখন
পুরোনো মাটির গন্ধে নতুন বৌ ভুলে যেতো সব না পাওয়ার দুঃখ।
কিন্তু এখন পরিবার গুলো ভেঙ্গে টুকরো হয়ে গেছে।স্বার্থপরের মত নিজেরটা ছাড়া কিছুই বোঝে না।মা, বাবার খোঁজ নেয় না।কিসের এত ব্যস্ততা।মনগুলো যান্ত্রিক হয়ে গেছে যন্ত্রযুগে।ছেলেদের জন্য খুব চিন্তা হয় সবিতাদেবীর।
৮
অনিমেষবাবু
বি ডি ও অফিসে কাজ করতেন।কাজের
সূত্রে তাকে ঘুরে বেড়াতে হতো গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে।সন্তু ঝিনুক ঘাটা স্টেশনে ট্রেন ধরত।কোনো কোনোদিন রাত হয়ে যেত।একদিন
রাতে স্টেশনে বসে আছে। সামনেই একটা ঠান্ডা
সরবতের স্টল। খুব গরম পড়েছে।সন্তু একটা স্প্রাইট কিনে পান করলো। ঠান্ডা সরবত খেয়ে শরীরটা বেশ শীতল হলো। ট্রেনটা লেট করছে।গ্রামে গ্রামে ঘোরার ফলে পরিচিতি একটু বেড়েছে।অনেকে কথাও বলছে। একজন
বললো,কি ক্যাশিয়ার বাবু আজ রাত হলো কেন?
----আর বলবেন না। কাজ সারতে দেরী হয়ে গেলো।
----বেশি রাত করবেন না। আপনার কাছে তো টাকা পয়সা থাকে। এই জায়গাটা হলো ডাকাতের জায়গা। জামাই মারি আর ঝিনুকঘাটা এই দুটো গ্রামের
নাম মনে রাখবেন। বেশ চলি।
অনিমেষ
ভাবছে লোকটা জানে তার কাছে টাকা থাকে অফিসের। অনেক টাকা। ব্যাগটা চেপে ধরলো।তারপর স্টলের দোকানদারের সঙ্গে গল্প করতে লাগলো।
অনিমেষ
বললো, ভাই কখন তুমি বাড়ি যাও?
----এই ট্রেনটা চলে গেলেই যাব। আপনাকে একা ফেলে যাব না।
হঠাৎ একটা লম্বা ষন্ডা গোছের লোক ছুটে এসে ঠান্ডা
সরবতের স্টলে বরফের ভেতর কি একটা ঢুকিয়ে রাখলো।তারপর অনিমেষের দিকে তাকিয়ে বললো,কে আপনি?
অন্ধকারে
বসে কেন?
দোকানদার বললো ও আমাদের ক্যাশিয়ার বাবু গো। তুমি তো চেন?
-----ও আপনি। তা এত রাত কেন??
----ট্রেনটা লেট করছে তাই?
----- বসুন। আমি
জলে হাত ধুয়ে আসি। আমি না আসা অবধি
নড়বেন না।
অনিমেষ
লোকটার মুখে মদের গন্ধ পেলো। নেশা
করেছে বোঝা গেলো। সন্তু ভয় পেলো।
অনিমেষ বললো ভাই দোকানদার তোমার দোকানে বরফের ভেতর কি রাখলো?
দোকানদার বললো,যতটুকু দেখলাম তাতে
মনে হলো কোনো মেয়েছেলের সোনার গহনা ভরতি কাটা হাত। বরফের ভেতরে রাখলো।কাল কোনো সময়ে এসে নিয়ে যাবে।
অনিমেষের হার্টফেল হওয়ার মত অবস্থা হলো। স্টলের লোকটা বললো,আপনাকে
চেনে তো। আপনার ভয় নেই।
অনিমেষ
ভাবলো অনেক টাকা সঙ্গে আছে। কি জানি
কপালে কি আছে?
ট্রেনটা আসছে না। জানতে পারলো অনিমেষ, আজ ট্রেন তিন ঘন্টা
লেটে আসছে।
স্টলের লোকটা বললো,আপনার তো পরের স্টেশনেই
নেমে বাড়ি। আপনি মাঠে মাঠে হেঁটে
চলে যান।ছয় কিলোমিটার রাস্তা। মাঠে মাঠে গেলে চার কিলোমিটার হবে।
অনিমেষ বললো,ঠিক বলেছো ভাই। আমি তবে যাই।
লোকটা বললো,খবরদার, ফন্টেকে
বলে যাবেন। তা না হলে সব কেড়ে
নেবে।
হন হন করে হেঁটে ফন্টে এলো। বললো,বাঃ,আপনি
তো খুব ভালো লোক। এখনও বসে আছেন?
অনিমেষ
বললো,আপনার সঙ্গে দেখা করে যাবো বলে বসে আছি। ট্রেন অনেক লেটে আসছে।মাঠে মাঠে যাবো।যদি আপনি অভয় দেন।
----হুঁ, সঙ্গে ব্যাগ আছে। টর্চ আছে দেখছি। আমার তিন ব্যাটারির টর্চটা নিন। আর আপনারটা আমাকে দিন। আমার টর্চে নিল ফোকাস আছে। সবাই চেনে এই আলো। কেউ আটকালে শুধু টর্চ জ্বালবেন। কথা বলবেন না। যান কোনো ভয় নাই আপনার। আমি এই দোকানে
দুদিন পরে টর্চ নিয়ে নেব।আপনি
আমার টর্চ এই দোকানেই রাখবেন।
অনিমেষ
বললো,আপনাকে নমস্কার জানাই।আমার অনেক উপকার করলেন।তা না
হলে আজ বাড়ি যেতে পারতাম না।
কোনোরকমে কথা বলে, অনিমেষ টর্চ নিয়ে
হন হন করে হেঁটে চলে এলো মাঠ পেরিয়ে পুকুর পাড়ে।এবার নির্ভয়ে সে একটু বিশ্রাম নিতে বসেছে এমন সময় হেঁড়ে গলায় একটা লোক
বললো, কে রে। ব্যাগ রেখে এখানে
বসে পড়লি।
অনিমেষের
মনে আছে। কথাবলা যাবে না। উত্তরে টর্চ জ্বাললো।টর্চের আলো দেখে ওরা ভয়ে পালালো।বললো,পালা পালা। এত ফাটা ফন্টের লোক।
অনিমেষের মনে পড়ে, জল পান করে বীরবিক্রমে
কাঁধে ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে শুরু করলো। একটা
টর্চের কি মাহাত্ম্য।সেটর্চটা জ্বেলে হাঁটতে হাঁটতে আনন্দে গান
করতে শুরু করলো।
৯
বিজয় লেখক।চাকরী করে একটা প্রাইভেট ফার্মে। যখনই তার লেখা কোনো ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয় সে রেলওয়ে
স্টেশনের স্টলে গিয়ে ম্যাগাজিনটি কিনে বাড়ি ফেরে।কিন্তু রেলওয়ে স্টেশনে ঢুৃকতে গেলে প্ল্যাটফরম টিকিট কেটে ঢুকতে হয়।এখন দশ টাকা লাগে একটা প্ল্যাটফরম টিকিটে।খুব গায়ে লাগে বিজয়ের।কিন্তু কিছু করার নেই। টিকিট
না থাকলে আবার টিকিট চেকার ফাইন করতে পারেন। অতএব
টিকিট নিয়ে স্টেশনে ঢোকাই উচিত বলে মনে করলো বিজয়।
আজ থার্ড আই পত্রিকায় বিজয়ের একটা লেখা প্রকাশিত
হয়েছে।
খুব আনন্দিত হয়ে সে তার বন্ধু সুমনকে বললো,তুই
একটু দাঁড়া, আমি প্ল্যাটফরম টিকিট কেটে বইটা নিয়ে আসি।
শুনে সুমন বললো,আরে প্ল্যাটফরম টিকিটের
দাম দশটাকা। তুই দাঁইহাটের টিকিট
নিলে পাঁচ টাকায় পাবি। একটা টিকিট থাকলেই
হলো।
বিজয় বললো,এটা তো জানা ছিলো
না। তাহলে এত দিন ধরে
আমার অনেক টাকা সেভ হতো।
ঠিক আছে তাই হবে।তোকে অনেক ধন্যবাদ।
----বন্ধুকে, শালা ধন্যবাদ জানানোর
কি আছে?যা, তাড়াতাড়ি যা।একসঙ্গে বাড়ি যাবো।
তারপর বিজয় একটা দাঁইহাটের টিকিট কেটে ম্যাগাজিন
কিনে মহানন্দে বাড়ি চলে এলো। বন্ধুও
তার বাড়ি চলে গেলো।
বাড়িতে এসেই বিজয় বৌকে বললো,বেশ
ভালো করে আদা দিয়ে চা করো তো। একটু
রসিয়ে সব গল্পগুলো পড়বো।বিজয় ভালো করে বিছানায় বসলো।
বিজয়ের বৌ মুন চা করে কাপ দুটি টেবিলে রাখলো।তারপর বসলো বিজয়ের পাশে। গল্পে ডুব দিয়েছে বিজয়।
মুনের মন ফিরে গেলো, পাঁচ বছর আগে কলেজ
জীবনে।তখন ওরা দুজনে দুজনকে চিনত না। একদিন কলেজের কমন রুমে বিজয় বসে আছে। এমন সময় মুন গিয়ে বসলো তার পাশে। একবার মুখ তুলে তাকিয়ে বিজয় আবার নিজের
কাজ করতে লাগলো।মুন বললো,আপনি কোন ইয়ার?
------ থার্ড ইয়ার, বাংলা।
------আমারও বাংলা। ফার্ষ্ট ইয়ার।
-----ও তাই। কোথা
থেকে আসেন।
------টিকিয়াপাড়া।
------ও আমি পটুয়া পাড়া থেকে।
-----তাহলে তো একই দিকে। খুব ভালো হলো একসঙ্গে যাওয়া আসা করা যাবে।
-----অবশ্যই।
তারপর থেকে ওরা একসাথে ওঠাবসা করতো।ভালোলাগা ক্রমশ ভালোবাসায় পরিণত হলো। তারপর বিয়ের। বিয়ের পরেই একটা ফার্মে চাকরী।এখন ওরা ঘর ভাড়া নিয়ে সুখে আছে।
মুন একটা গান গাইছিলো। বিজয়ের জামাটা আলনা থেকে টেনে গন্ধ শুঁকে দেখলো কাচতে
হবে কি না। কাচতে হবে,
তাই
পকেট হাতড়ে টাকা পয়সা কাগজ বের করে টেবিলে রাখলো।মুন দেখলো,কাগজের সঙ্গে একটা রেলের টিকিট। মুন ভাবলো,অফিস তো সাইকেলে
যায় তাহলে দাঁইহাটের টিকিট কেন? দাঁইহাটে
আমাদের সাতকুলে কেউ থাকে না। তাহলে
ওখানে কেন? কই বিজয় তো বলে নি,
সে ওখানে
গিয়েছিলো? তাহলে কি বিষয়টা বলার মত নয় বলে এড়িয়ে গেছে। সন্দেহ দানা বাঁধলো মুনের মনে। গান থেমে গেছে। অকারণে থালা, বাটি, গ্লাস
ফেলে আওয়াজ করছে। বিজয় বললো,আস্তে
কাজ করো।গল্প পড়ছি।
----আমি খেটে মরবো আর তুমি বাবুমশাই বসে গল্পের বই পড়বে?
---- কি হলো, অইভাবে কথা বলছো
কেন?
----না বলবে না। আমি একা একা বাড়িতে থাকি আর উনি হিল্লি দিল্লি করে
বেড়াচ্ছেন।
-----কি বলছো,বুঝতে পারছি না। পরিষ্কার করে বলো।
-----দাঁইহাট কেন গেছিলে।কার কাছে। নিশ্চয় প্রেমিকার
কাছে। আমাকে তবে বিয়ে করলে
কেন?
----আরে দাঁইহাটে কেন যাবো?
-----আবার মিথ্যে কথা। আমার কাছে প্রমাণ আছে।
----কি প্রমাণ। কই দেখাও।
মুন দাঁইহাটের টিকিট এনে খাটে ফেলে দিলো।বিজয় হেসে উঠলো জোরে। বললো,আজ বই কিনতে প্ল্যাটফরমে গেছিলাম।প্ল্যাটফর্ম টিকিটের দাম দশ টাকা। আর দাঁইহাটের টিকিট পাঁচ টাকা। টিকিট একটা থাকলেই হলো। তাই পাঁচ টাকা বাঁচাতে দাঁইহাটের টিকিট
কাটলাম।
সুমন আমার সঙ্গে ছিলো। ওকেই জিজ্ঞাসা করো।
তারপর মোবাইলে সুমনকে ধরে ফোনটা দিতে গেলো বিজয়। মুন ফোনটা কেটে দিয়ে হাসিমুখে বললো,আমার
বুঝতে ভুল হয়েছে। তারপর বিজয়ের গলা
পেঁচিয়ে ধরে বললো,তুমি এমনি করেই শুধু আমার হয়ে থেকো চিরকাল।
১০
সবুজ মায়ের কাছে শিক্ষা পেয়েছে সততার। সৌম্যর
সঙ্গে তার খুব ভাব।মনে পরছে তার মায়ের কথা। সে আপন মনেই বলে চলেছে তার মায়ের কথা। মা রক্ষাকালীর পুজো দিতে দিতে গেয়ে উঠতেন
ভক্তিগীত। নিরামিষ মা কালীর
আশীর্বাদ মাথায় রেখে ছেলেদের নিয়ে সংসার চালাতেন
ছন্দে। অভাব থাকলেও কোনোদিন
তার ছাপ পরেনি মায়ের চোখেমুখে। আসল
মূল্যবান রত্নের সন্ধান তিনি পেয়ে গেছিলেন পুজোর আসনে বসে। কোনোদিন তার কথায় প্রকাশ পেতো না সেসব
কথা। তার চলনে,
বলনে
ফুটে উঠতো মাতৃরূপের জলছবি। মাকে
দেখেই মাথা নত হয়ে যেতো সকলের। দাদু
মাকে, মা বলেই ডাকতেন। তিনি
সময়ে অসময়ে মাকে রামপ্রসাদী শোনাতে বলতেন। মায়ের
গান শুনতে শুনতে একদিন চলে গেলেন পরপারে তৃপ্ত মুখে। একবার বৈশাখি ঝড়ে আম গাছের ডাল ভেঙ্গে পড়লো। মা বললেন,তোদের দাদুর আত্মা
মুক্তি পেলো। অই ডালে বাঁধা ছিলো
দাদুর মুক্ত হবার লাল চেলি। অবশ্য
এটা ছিলো এক সাধুবাবার তুকতাক। বুড়ি
ঠাকুমা সেদিন কেঁদে উঠেছিলো জোরে। ঠাকুমা
বলে উঠলেন,চলে গেলো,ও চলে গেলো। কোনো কিছুই আমরা নিশ্চিতভাবে জানি না। তবু কিছু ঘটনা বার বার তার অস্ত্বিত্বের
কথা স্বীকার করে নেয়। একটা দেশি কুকুর
আমাদের বাড়িতে থাকতো ছোটে থেকে। তোমরা
বিশ্বাস করবে কি না জানি না? সে অমাবস্যা,পূর্ণিমায় কিছু খেতো
না। রক্ষাকালী পুজোয়
উপবাস করতো। তার সামনে খাবার
দিয়ে দেখা গেছে সে খাবারের ধারের কাছে যেতো না। শুধু কথা বলতে পারতো না। কিন্তু ভাবে, ভঙ্গিমায় সব বেঝাতে
পারতো মানুষের মতো। মা বলতেন,পূর্বজন্মে
তোর সঙ্গে কোনো আত্মীয়তা নিশ্চয় ছিলো। তাই
তোর আমাদের বাড়িতে আগমণ। যেদিন জিম দেহ রেখেছিলো
সেদিন ওকে মাটি চাপা দিয়ে ধূপ আর ফুলে শেষ বিদায় জানিয়েছিলো সারা পাড়ার বাসীন্দা। তাহলে কি বলবে তুমি এই ঘটনাকে। কোন যুক্তিতে অস্বীকার করবে তার সারা জীবন
ধরে পালন করা ব্রত,উপবাস। বলবে,কাকতালীয়। সেসব তো এক আধবার হয়। সারাজীবন ধরে নিয়মিত হয়।
সবুজের মনে পড়ছে,
বিজয়ার সময় আমার মা জিমকে প্রথম মিষ্টিমুখ করাতেন। ধান রাখার গোলার তলায় একবার গোখরো সাপ দেখে,
ঘেউ
ঘেউ শব্দ করে জিম আমাদের দেখিয়ে দিয়েছিলো সাপটা। তারপর সাপুড়ে ডেকে সাপটি বনে ছেড়ে দেওয়া হয়। বড়দার বিছানার মাথার কাছে সে শুয়ে থাকতো। কোনো বিপদ বুঝলে ঝাঁপিয়ে পরতো নিঃস্বার্থ
ভাবে। প্রত্যেক প্রাণীর
কাছে আমাদের শেখার আছে অনেক কিছু।
সবুজ ভাবে,মা ছোটো ভাইয়ের কাছে
ভালো থাকতো। ভাইরা সবাই ভালো। শুধু আমি হয়তো খারাপ। তাই মা আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন। আর তার দেখা পাই না।। মন্দিরের ঘরে যেতে
ভয় লাগে।
তার মনে
পরছে বাল্য জীবনের স্মৃতি।
তেঁতুলতলার মাঠে এসে ঢিল মেরে পেরে নিতাম কাঁচা
তেঁতুল।একজন বহুরূপী হনুমান সেজেছিলো।আমাদের এক বন্ধু তার লেজে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেলো।
আর হনুমান লাফিয়ে শেষে জলে ঝাঁপ দিলো।
চারদিকে প্রচুর লোকজন ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। তারা মজা দেখছে আর হাততালি দিচ্ছে।আমরা সবাই ওকে চাঁদা তুলে পাঁচশো টাকা দিয়েছিলাম।
তাল গাছের
কামান হতো হেঁসো দিয়ে। মাথার মেথি বার করে
কাঠি পুঁতে দিতো তাড়ি ব্যাবসায়ী। আমাদের
ভয় দেখাতো, ধুতরা ফুলের বীজ দিয়ে রাকবো। সকালের তালের রস খেলেই মরবে সে। চুরি করা কাকে বলে জানতাম না। একরাতে বাহাদুর বিশুর পাল্লায় পরে রাতেসকালের
তালের রস খেতে গেছিলাম। কারণ বেলা বাড়ার
সঙ্গে সঙ্গে তালের রস তাড়িতে পরিণত হয়। মদের
মতো নেশা হয়। বিশু বললো,
তোরা
বসে থাক। কেউএলে বলবি। আমি গাছে উঠে রস পেরে আনি। তারপর গাছে উঠে হাত ডুবিয়ে ধুতরো ফুলের
বীজ আছে কিনা দেখতো। পেরে আনতো নিচে। তারপর মাটির হাঁড়ি থেকে রস ঢেলে নিতাম আমাদের
ঘটিতে। গাছেউঠে আবার হাঁড়ি
টাঙিয়ে দিয়ে আসতো বিশু। সন্ধেবেলায় হাড়ি
রসে ভরে যেতো।
ব্যাবসায়ির কাছে গিয়ে বলতাম, রস দাও। বুক ঢিপঢিপ চাঁদের গর্ত। অবশেষে প্রাপ্তিযোগ। যেদিন রস পেতাম না তখন মাথায় কুবুদ্ধির
পোকা নড়তো। তাতে ক্ষতি কারো
হতো না। কোনো পাকামি ছিলো
না।সহজ সরল হাওয়া ছিলো। ভালোবাসা ছিল ।
sudipghoshal59@gmail.com
No comments:
Post a Comment