1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, February 21, 2021

বিলম্বিত বোধোদয়

 

ছবি  : ইন্টারনেট 

বিলম্বিত বোধোদয়
আনন্দদীপ চৌধুরী

                     1

          বছর দুয়েক আগে পতিদেবের এক পুরানো বন্ধু এসেছিলেন বাড়িতে । ভদ্রলোক হাত দেখতে পারে জেনে অত্যুতসাহী হয়ে ম মেয়ের সাথে সাথে নিজের হাতখানিও দেখিয়েছিলাম তাকে । ভদ্রলোক বলেছিলেন -"পরোপকার তো  করলেন অনেক। এএবার একটু সাবধানে আর কমিয়ে   করুন।"

কিন্তু বললেই কি সবকিছু  কমান যায় ! সঙ্কট বিনা অহংকার কমে কি? কমে না তো। বিনা খরচে কষ্টার্জিত অর্থ কমান দেখি? পারবেন না তো। আর বিনা পরিশ্রমে ওজন? না সেও কমে না। সেখানে  পন্চান্ন বছর বয়সে এসে পরোপকার করা কমাব কি করে? তার উপর এটা যখন  আমার জিনগত অধিকার ।জিনগত নয়?নামকরা হোমিওপ্যাথ ডাক্তার হয়েও রোজ বিনেপয়সায় রুগী দেখতেন বাবা। তার মেয়ে হয়ে টুকরোটাকরা পরোপকার করার অভ্যাস আত্মস্থ  করা তো জিনগত অবিচ্যুতিরই লক্ষণ।নাকি!

এমনিতে মধ্য পন্চাশে পা দিয়েও  বেশ সুখি গৃহিণী আমি। পতিদেব সুমন্ত আর কলেজ পড়ুয়া কন্যা পৃথাকে নিয়ে ছোট্ট সাজানো সংসার আমার। বাজারের বড় রাস্তার মোড়ে কাপড়ের একটা দোকান আছে সুমন্তর। লক্ষীদেবীর আশীর্বাদে উতসব ছাড়াও মানুষের আনাগোনা লেগেই থাকে সে দোকানে।এমন চালু দোকান থেকে অর্জিত আয়ে দিব্যি চলে যায় আমাদের ।কখনও সখনও অতিরিক্ত কিছুও রয়ে যায় হাতে। সেই অবশিষ্ট অর্থের বদান্যতায় টুকটাক পরোপকার সারি আমি।

না কেবল আমি নয়। মেয়ে আর সুমন্তর যোগ্য সঙ্গত না পেলে আমার একার দ্বারা একাজ করা সম্ভব হত না  কখনও।সুমন্ত আর পৃথাই তো সন্ধান দেয় সেইসব দরিদ্র সন্তানদের, যাদের জন্য বছরে দুবার নিজহাতে মহাভোজের আয়োজন করি আমি।পুজোর আগে ওদের হাতে তুলে দিই নতুন পোষাক। আর পৃথার জন্মদিনে? দরিদ্র কোনো মেধাবী স্টুডেন্টের হাতে তুলে দিই উচ্চশিক্ষার প্রয়োজনীয় অর্থ।

এসব ব্যতীত আর একটা পরোপকার করি আমি।কি ? মনদিয়ে প্রতিবেশী লতিকাদির দেখাশোনা করি আমি।

খুব বেশী দূরে নয় লতিকাদির বাড়ি।আমাদের বাড়ি থেকে   বড়জোর দুমিনিটের পথ  ।

হ্যাঁ, সেখানেই থাকেন এককালের দোর্দণ্ডপ্রতাপ বছর পয়ষট্টির লতিকাদি । নিজের সুসজ্জিত ত্রিতল বাড়িতে  বহাল তবিয়তে থাকলেও নিঃসঙ্গ জীবন যাপনে এখন তিনি ভীষনরকম ক্লান্ত, অবসন্ন ।

সত্যি বলতে টাকা-পয়সার অভাব কোনোদিনই সেভাবে ছিল না লতিকাদির। আজও স্বর্গত স্বামীর পেনশনের টাকায় দিব্যি কেটে যায়  তাঁর। কিন্তু কাটে না সময়। ঘরে থাকা বড় দেওয়ালঘড়ির কাঁটা গুলোকে মাঝেমাঝে বড় শ্লথ মনে হয় তাঁর। একাকী এতবড় বাড়িতে প্রাযশই খাঁচায় থাকা বন্যপাখীর মত অসহায় বোধ করেন তিনি।

অথচ এমনটা তো হওয়ার ছিল না লতিকাদির। বছর পাঁচেক আগে বেশ ধুমধাম করেই বিয়ে দিয়েছিলেন পুত্র  অর্চির। কিন্তু বিয়ের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই শ্বাশুড়ি-বৌমার কলহ প্রকট হয়ে ওঠে সংসারে।  তাই জন্মদাত্রী মাকে ছানা কাটা দুধের মত উচ্ছিষ্ট ভেবে ঘর ছাড়ে অর্চি আর তার সহধর্মিণী।

কেবল ঘর ছেড়েই ক্ষান্ত হয়নি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার অর্চি। বন্ধ করে মায়ের সাথে সবধরনের যোগাযোগ। কানাঘুষোয় জানা যায় অফিসের প্রজেক্টের কাজে সস্ত্রীক ব্রাজিল পাড়ি দেয় সে। এদিকে একমাত্র পুত্রকে দেখবার আশায় ঘরের চার দেওয়ালে কেঁদে চলেন লতিকাদি।ধীরে ধীরে শুকিয়ে যায় তাঁর চোখের জল। অনিচ্ছা থাকতেও একটা সময় লতিকাদি আপন করে নিতে শেখেন নিঃসঙ্গ জীবনের তিক্ততাকে ।

ঠিক এমন সময় লতিকাদির নিঃসঙ্গ জীবনে প্রবেশ ঘটে আমার ,অনেকটা কনকনে শীতে মোলায়েম মিঠেরোদের মতনই। সময় পেলেই দুম করে চলে যেতাম তাঁর বাড়ি। দেদার আড্ডা দিতাম ঘন্টাখানেক।ওষুধ খাবার কথা মনে করাতাম কথায়কথায় । কখনও বা টুক করে দিয়ে আসতাম পুজোবার্ষিকীর সদ্য প্রকাশিত বইখানি। আর খাবারের কথা!সে  না হয় বাদই দিলাম ।বাড়িতে তৈরি স্পেশাল খাবারের ভাগ না পেলে  তো কথা বন্ধ করতেও পিছপা হতেন না অভিমানী লতিকাদি।

তবে সে সবই চলছিল মাস ছয় আগে অব্ধি। তালটা কাটে হঠাত করে আসা অর্চির আগমনে। হ্যাঁ বলা নেই কওয়া নেই, ব্রাজিল থেকে প্রজেক্টের কাজ সেরে সস্ত্রীক স্বগৃহে ফেরে অর্চি। সাথে আড়াই বছরের ফুটফুটে কন্যা।

মা বলতেন, সন্তানের শত দোষ-ত্রুটি এক লহমায় মাপ করে দিতে পারেন কেবল জন্মদাত্রী জননীই। লতিকাদিও পেরেছিলেন। ঘরে ফেরা অর্চিকে বুকভরা আশীর্বাদ দিয়ে আপন করে নিয়েছিলেন ফের একবার।                                                                                       

                                                                        2.


অর্চি আসার পর লতিকাদির কাছে ঘনঘন যাতায়াত কমিয়ে দিয়েছিলাম অনেকটাই।তাও সপ্তাহে দুবার ঢুঁ না মারলে কেমন অসম্পুর্ণ মনে হত নিজেকে। কিন্তু গত মাসে  অর্চির থেকে পাওয়া অপ্রত্যাশিত দুর্ব্যবহার যতিচিহ্ন বসায় সে অভ্যাসেও। কি যে নীচমনের ছেলে একটা!

সেদিন ছিল লতিকাদির জন্মদিন। একটা ছোটো কেক নিয়ে সকাল সকাল হাজির হয়েছিলাম তাঁর দ্বারে। গেটের মুখে হঠাতই জর্জরিত হই অর্চির প্রশ্নবাণে-"আন্টি, কেক  এনেছেন কেন ?"

অপ্রস্তুত হলে কথা একটু আটকে যায় আমার। সেদিনও রুদ্ধ স্বরে বলি -"লতিকাদির জন্মদিন... তাইইই..   মানে.... " একথা শুনেই বিজ্ঞের  মত জ্ঞান দিতে থাকে অর্চি -"মায়ের তো হাই সুগার। কেক খাইয়ে মারবেন নাকি! " অর্চির কথায় আগুনে পোড়া লোহার রডের মত তপ্ত হয়ে ওঠে মাথার চাঁদি। ঝাঝিয়ে বলি -"মায়ের প্রতি এত দরদ যদি, এই কবছরে বেপাত্তা হয়েছিলে কেনো শুনি! "

সুমন্ত বলে নীচমনের লোকেদের নাকি চরম অপমানেও হাসি ফুটে ওঠে। সে হাসি কখনও দেখিনি আমি। সেদিন দেখেছিলাম অর্চির মুখে।আর সে ক্রুর হাসি মুখে ঝুলিয়ে অর্চি বলেছিল-"এসব বলে সুগার রোগি কে মিষ্টি খাওয়ানোর অপরাধ কি চাপা দিতে পারবেন আন্টি? "

বলে কি ছেলেটা! লতিকাদিকে জন্মদিনে  সামান্য কেক খাওয়ানোটা অপরাধ! না এরপর বিনা বাক্যব্যয়ে যে স্থান ত্যাগ করেছিলামআমি।

এঘটনার পর সুমন্তও বলেছিল -"এবার অন্তত বন্ধুর কথাটা মেনে চল। "

-"কোনকথা?-"প্রশ্ন ছিল আমার। সুমন্তর সপাট জবাব ছিল -"ওই যে পরোপকার কর। তবে একটু সাবধানে আর কমিয়ে  । "

লতিকাদির বাড়ি যাওয়াটা প্রায় বন্ধই করে দিয়েছিলাম আমি। যদিও মিস করতাম তাঁর সাহচর্য, তাঁর সাথে দেওয়া আড্ডা, আলোচনা ,গল্প সবকিছু। আসলে এ কবছরে লতিকাদি কোথাও যেন প্রতিবেশী থেকে স্নেহময়ী দিদি হয়ে উঠেছিলেন আমার। সেই ছোট্ট বেলায় রোড আক্সিডেন্টে নিজের বড়দিকে হারিয়েছি আমি।তবে কি লতিকাদির মধ্যে  বড়দির প্রতিচ্ছবিই দেখতে পেয়েছিলাম?কে জানে!

অপরদিকে আমার অনুপস্থিতিও হয়ত দারুণভাবে ব্যথিত করেছিল লতিকাদিকে। না হলে পড়িমড়ি দুদিন আগে কেউ আমার বাড়ি হাজির হয়!

বাড়িতে এসে সটান জানতে চান -"আমার বাড়ি আস না কেনো? "

চেপে গিয়েছিলাম অর্চির সে দুর্ব্যবহার,বলেছিলাম-"ওই সুমন্তর শরীরটা ভালো যাচ্ছে না তাই। "

-"সেকথা তো একবার এসে জানিয়ে যেতে পারতে।" কথা ঘোরাই আমি -"আসলে অর্চি-বৌমাও এসে গেছে । প্রতিবেশী হিসেবে রোজ রোজ আপনার বাড়ি যাওয়াটা ভালো নাও লাগতে পারে তাদের।"

গর্জে ওঠেন লতিকাদি -"আমার বাড়ি। তাই কে আসবে না আসবে সে আমি ঠিক করব, অর্চি নয়। আর হ্যাঁ, অনেকদিন ধোঁকার ডালনা খাইনি। একদিন  খাওয়ানোর আবদার করে গেলাম। "

লতিকাদির আবদার কি অমান্য করা যায় ?তাই অর্চির দুর্ব্যবহার ভুলে গতকাল রাতেই লতিকাদিকে দিয়ে এসেছিলাম নিজ হাতে তৈরি রসাকষা ধোঁকার ডালনা ।কি যে খুশি হয়েছিলেন উনি কি বলব! হ্যাঁ, মূল্য দিয়ে এ খুশির দাম বিচার করলে তা হবে আদর্শ অর্বাচীনের কাজ।

                                                                       

                                                                          3. 


আজ সকাল সকাল দুঃসংবাদটা পেয়েই দৌড়ে গিয়েছিলাম নার্সিংহোমে। সঙ্গ দিয়েছিল সুমন্তও। আমাদের দেখেই  অকস্মাত তেড়ে আসে অর্চি -"না করলেও শোনেন না কেনো। মা কে না মারা অব্দি তর সইছে না আপনার। কাল রাতের ওই ঝাল ধোঁকা খেয়েই তো বমি শুরু হয় মায়ের । ঠিক সময়ে নার্সিংহোমে না আনলে  তো মরেই যেত মা। এরপরে ফের এধরনের কাজ করলে আপনার নামে কিন্তু আটেম্ট টু মার্ডার চার্জ আনব। "

অর্চি একটানে কথাগুলো বলে চলে যেতেই অন্তরটা কেমন দুমড়ে মুচড়ে গেল আমার। হঠাত করেই মনে পড়ে গেল সুমন্তর বন্ধুর করা সেই সাবধানবাণী।

সত্যিই আমার খুব উপকার হল আজ ।আসলে বেশ ভালো করে বুঝতে পারলাম, পরোপকার শব্দটায় সংযমের বেড়ি না পড়ালে জীবনে আঘাতের আবির্ভাব অবশ্যম্ভাবী।যাক বাবা! কথায় বলে বেটার লেট দ্যান নেভার। তাই দুবছর বিলম্ব হলেও অঙ্গীকারবদ্ধ হলাম আমি। হ্যাঁ , সুমন্তর বন্ধুর পরামর্শ মেনে পরিমিত পরোপকারের  সাবধানী মন্ত্রেই অঙ্গীকারবদ্ধ হলাম আমি।

dip14337@gmail.com
কলকাতা

No comments:

Post a Comment