1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, February 21, 2021

সামরস

 

ছবি  : ইন্টারনেট 

সামরস
 ডাঃ অরুণ চট্টোপাধ্যায়
--কই বাবা ফিসফ্রাই। এদিকে এসো একটা দুটো করে। ঘাড় নেড়ে নেড়ে ফিসফ্রাইগুলোকে তখন ডাকছেন মিঃ ডাট। বেশ সুরেলা মধুর ভাবগদ গদ ডাকটা। যেন আবেগঘন কন্ঠে কোনও প্রেমবিলাসী স্বামী ডাকছে তার এক উপপত্নীকে।
কপিল তখন হাঁক ছাড়ল, ফিসফ্রাইয়ের ঝুড়িটা দে রে। স্যারকে গোটাকয়েক দে।
মাথা তখনও দোলাচ্ছেন মিঃ ডাট, ভাল করে সস মাখিয়ে আনিস বাবা। ও মানিক, মানিক আমার, বেশী করে স্যালাড দিস।
মিঃ ডাটের আদরে গলে গিয়েও আমতা আমতা করল ছেলেটা, আমার নাম মানিক নয় স্যার, ভোলা।  
ধমক দিলেন ডাট সাহেব, চোপ শালা! আমি বলছি যখন তখন তুই মানিক । ভোলা নয়।
নাম-বিভ্রাট এড়াতে ভোলা ভীড়ে সেঁদিয়ে যাবার তালে ছিল। তার ঘাড়টা খাবলে ধরলেন মিঃ ডাট।
--কোথায় যাও বাছাধন। মানিকই হোস আর ভোলাই হোস আগে ফিসফ্রাইটা এনে দিয়ে যা।
--ইয়ে আমি—
প্রতিবাদটা পুরো করে ওঠার আগেই সঞ্জীব চোখ টিপল। মনে হচ্ছে সঞ্জীবদা বুঝতে পেরেছে ডাট সাহেবের অবস্থাটা। আর তাতেই পুরোপুরি পালটি খেল সে।
--ইয়ে, আপনি যা বলবেন স্যার।
কিন্তু তাকে কোনোরকম অনুগ্রহ না করেই ডাট সাহেব মাথা দোলাতে লাগলেন। একটা চমৎকার গান মনে এসেছে তাঁর। একটা হিন্দি গানের কলি। পুরোন দিনের এক সিনেমায় নিজেকে নায়ক হিসেবে বেশ মানিয়ে নিচ্ছেন। আরে ঐ তো নায়িকাকেও দেখা যাচ্ছে। ঐ যে ঢলঢল চোখ, টলটল করা ফর্সা গোলগাল মুখখানা। জিনস টপে চমৎকার মানিয়েছে। ডাট সাহেবের মনের মধ্যে আবার কে যেন বলে উঠল, মেয়েটা তো চুড়িদার পরেছে। ডাট সাহেবের মাথার মধ্যে কি যেন চলছে। ক্ষণে ক্ষণে মূর্তিগুলো যেন বদলে যাচ্ছে। চোখদুটো রগড়ালেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে উঠলেন, কে বলল রে বেয়াদপ? ও জিনস টপই পরেছে। নিজের অজ্ঞাত দ্বিতীয় এক সত্ত্বার সঙ্গে বাকযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে বিড়বিড় করতে থাকেন ডাট সাহেব, আমি যখন বলছি আলবত ও জিনস টপই পরবে। মনে মনে সেই সুন্দরীর কোমর জড়িয়ে নাচতে থাকেন মহানন্দে।
আর সেই সুযোগে ভোলা হাওয়া।
সেই সুন্দরী কাছে এল। মনে মনে তাকে ডাকছেন, আয় আয় কাছে আয়। মনের সুর মুখে ফুটল। বিড় বিড় করে বলতে থাকেন, আয় আয় কাছে আয়। মেরে গুড়িয়া কাছে আয়।
সুন্দরী আর কেউ নয়। এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার চম্পকের সুন্দরী বৌ ঋতুপর্ণা। বয়েস পঁয়ত্রিশের মধ্যে। মাত্র সাড়ে তিনবছরের ছেলে সোনাইকে তার জ্যাঠাইমার কোলে ঠাঁই করে দিয়ে আজকের এই পিকনিকে স্বামীর সঙ্গে তার যোগদান।
সাত সকালেই বেশ চড়িয়েছেন। তাই চোখে এখন সাংঘাতিক রঙ্গীন এক চশমা ডাট সাহেবের। ঋতুপর্ণার সিঁথির এক চিলতে সিদুর দেখতেই পাচ্ছেন না। কল্পনার দৌড়ে নিজের বয়েস প্রায় বত্রিশে দাঁড় করিয়ে নিজেকে এনে ফেলেছেন ঋতুপর্ণার ঘনিষ্ট সান্নিধ্যে।
একটু ভয়ে ভয়েই এদিকে আসছিল ঋতুপর্ণা। ডাটসাহেবের আজকের দৃষ্টিটা যেন কেমন কেমন। নিজের বর ছাইপাঁশ খায় না। অন্তত তার সামনে। তাই তার চোখে এমন ঘোলাটে দৃষ্টি কোনদিন দেখে নি। এই সেদিন মানে সপ্তা দুয়েক আগের কথা। চম্পক তার বৌকে নিয়ে বেড়াতে এসেছিল ম্যানেজার ডাট সাহেবের ফ্ল্যাটে। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছিল ঋতুপর্ণা। বাবার বয়েসী লোকটাকে বেশ ভাল লেগে গিয়েছিল। কি অমায়িক আর মিষ্টি ব্যবহার।
ডাট সাহেব তার চিবুকে হাত দিয়ে আদর করে সেদিন বলেছিলেন, এস বৌমা। ভাল থেক।
আজ লজ্জায় ঋতুপর্ণা আর তাকাতেই পারছে না স্যারের দিকে। লজ্জা চম্পকেরও কম নয়। ডাট সাহেব পুরোন দিনের মানুষ। তাই এখনও ম্যানেজারই রয়ে গেছেন। আর সে ম্যানেজমেন্ট পাশ করে প্রথমেই এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার হয়ে জয়েন করেছে। আর কিছুদিনের মধ্যেই ম্যানেজার হয়ে যাবে। কিন্তু নিজের বাড়িতে বসের আচরণের সঙ্গে আজকের এই আচরণের তুলনা করতে পারছে না।
বারংবার অর্থপূর্ণ মুচকি হেসে যেমন ভাবে তাকাচ্ছেন বস তাতে ঋতুপর্ণার মনে হতে লাগল ঘোমটা দেওয়া প্র্যাক্টিস করলেই তার খুব ভাল হত। বসের এমন হ্যাংলার মত দৃষ্টি আছে সে কোনওদিন ভাবতেও পারে নি। 
এদিকে অধৈর্য হয়ে উঠেছে সমীর। দূর থেকে চেঁচাচ্ছে, কিরে ফিস ফ্রাই গুলো কি সব ওদিকেই চলে যাবে? একটা দুটো আসুক এদিকে। পেট যে চুঁই চুঁই বাবা।
--বেলা তো দুটো হল। খাবারের নামগন্ধ নেই। বিরক্ত শ্যামল সমর্থন জানালো সমীরকে। ওপাশ থেকে বাদল হেঁকে উঠল, এদিকে বৃষ্টির ঝাঁটে রান্না করা যাচ্ছে না।
কে জানত এমন শীতের দিনে এমন বর্ষা ওত পেতে বসে আছে। বাইরে খোলা জায়গায় রান্নার ব্যবস্থা হয়েছিল। এখানে এসে পরিস্থিতি বিবেচনা করে মাথায় একটা তেরপলের বন্দোবস্ত হলেও এলোমেলো মাতাল হাওয়াকে সামালান দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে। হাওয়ার দাপটে বার্নারের আগুনের শিখা নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে।
সমীর বলল, ভাগ্যি এখন গ্যাসে রান্না হয়। সে যুগের মত কাঠ বা কয়লার উনুনে হলে পিকনিক তো মাথায় উঠত।
শ্যামল সাপোর্ট দিল, হাওয়াটাও যা জোর ছেড়েছে দাঁড়াতেই দিচ্ছে না এক জায়গায়।
ওদিকে মেয়েদের দিকে ফিরে স্ফূর্তিতে আবার মাথা নাড়ছেন মিঃ ডাট। স্ফূর্তির সীমা পরিসীমা নেই। সকাল থেকেই নিম্নচাপের বৃষ্টি। টিপটিপ নয়। বেশ জোরাল। ঝোড়ো বাতাসটা আবার পাগলের মত ক্রমাগত দিক পাল্টাচ্ছে। কনকনে হয়ে শীত জেঁকে বসেছে গায়ের ওপর। ফুলহাতা, সোয়েটার, উইন্ড চিটার, টুপি—কারও কাছেই সে বশ্যতা স্বীকার করবে না বলেই যেন পণ করেছে। হাতদুটো দুই পকেটে ভরে ঘাড় কাত করে সিঁটিয়ে থেকেও থামান যাচ্ছে না দাঁতের সঙ্গে দাঁতের দ্বন্দ্বযুদ্ধটাকে।
এমন আবহাওয়ায় পিকনিক যে জমবে না বা জমতে পারে না সে সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ ছিল না কারও। নেহাতই পূর্বনির্ধারিত তাই বেরিয়ে পড়েছে সকালে। মনে আশা মর্নিং শোজ দি ডে ইংরেজির এই প্রবাদ বাক্য অস্বীকার করে যদি মেঘের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে পড়ার বিপ্লব ঘটাতে পারে সূর্যদেব তবে আসা আর পরিশ্রম দুইই সার্থক হবে একসঙ্গে।  
বলাই বাহুল্য এটা কোনও এক অফিসের পিকনিক। অফিসের বড়, মেজ, সেজ, ছোট সাহেব, বিভিন্ন মাপের বাবুরা তাদের বৌ, ছেলে, মেয়ে, শালা, শালি, বন্ধু, বান্ধবী নিয়ে তা প্রায় জনা পঁয়ত্রিশের হবে দলটা। পিকনিক বা গেট টুগেদার যে যাই বলুক। বছরের এই একটা দিন অফিসের ম্যানেজার থেকে ম্যাসেঞ্জার সব এক ছাতার তলায় পাশাপাশি আর ঘেঁষাঘেষি। এখন সব পরিবার মিলেমিশে একটাই পরিবার। অফিসের কঠোর শৃংখলা বা বিশৃংখলা থেকে সাময়িক মুক্তি। বাচ্চাতে বাচ্চাতে ক্রিকেট বল কিংবা ফ্লাইং ডিস্ক নিয়ে দৌড়োদৌড়ি। গিন্নিতে গিন্নিতে নিজের স্বামীর নিন্দে আর পরের স্বামীর সহাস্য বা নির্লজ্জ গুণকীর্তন। কর্তায় কর্তায় আপন শক্তি আর কুটকাচালির পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন। সুতরাং এই একটা দিনের জন্যে সকলের থাকে সাগ্রহ প্রতীক্ষা। বাধাহীন এক মুক্তির হাওয়া বইবে আজ সারা দিন ধরে। 
তার বদলে বাধাহীন এক মাতাল হাওয়া আর দাঁতাল শীতের আকস্মিক আক্রমণ। সেই বহু কষ্টার্জিত অমৃতভান্ডটা অকালের বেরসিক বর্ষা অসুরের মত ছিনতাই করে নিয়ে যাক তা কেউ চায় না। তাই মুখ বেজার সকলের। গিন্নীর মুখ গোমড়া। বাচ্চাদের মুখ থমথমে কর্তাদের চোখেমুখে বিরক্তির কুঞ্চন। পিকনিক গার্ডেনে লন চেয়ার পেতে হিমেল হাওয়ায় সস আর স্যালাডের সঙ্গে ফিস ফিংগার চিবোতে চিবোতে এ কর্তার সঙ্গে ও গিন্নীর ক্রশ কানেকশন হবে না। চোরাদৃষ্টির ছোরাছুরি খেলায় হতাহত হবে না কেউ।

          সুতরাং এই পিকনিক জমল না। কমবেশি সকলেই আক্ষেপ করছে। ব্যতিক্রম বোধহয় ডাট সাহেব। এই ঝর ঝর বাদর মুখর দিনের সূত্রপাতে একটা গোটা বোতল প্রায় শেষই করে দিতে যাচ্ছিলেন। যদি না অবিনাশ এসে প্রায় থাপ্পড় মেরে বোতলটা ছিনিয়ে নিয়ে নিজের গলায় ঢালত। পিকনিক স্পট থেকে কিছু দূরে ছোট একটা কুঞ্জবনে মাত্র জনা পাঁচ সাতের এই অমৃত অভিসার হয়েছিল। বোতলের প্রায় তিন চতুর্থাংশ গলাধঃকরণের মধ্যে দিয়ে উদ্বোধন করেছিলেন ডাট সাহেব। তারপর টলতে টলতে দিয়েছিলেন ছোটখাট একটা উদ্বোধনী ভাষণও।   
--আও বাচ্চো পি লো। লেকেন জারা সামহালকে। থোড়া সে পি লো জাদা নেহি।
তারপর কাদার মধ্যে দিয়ে থপথপ করে দলে ফিরে আসা। একমাত্র ডাটসাহেবই আনন্দে মাতোয়ারা। স্ফূর্তির বান ডেকেছে যেন মনে। পিকনিক দলের মহিলা সদস্যদের আবার এক নজর দেখেই মনে এদের যেন চেনা চেনা লাগছে। হয় সিনেমার পর্দায় আর নয় স্বর্গের নন্দন কাননে দেখেছেন ঠিক মনে করতে পারছেন না।
বিড়বিড় করে বললেন, অ্যাই হেমা, না না জয়া, না না টিনা মুনি—মা-ধু-রী—
পাশ থেকে অবিনাশ বলে উঠল। ম-নিষা কৈ-রালা—
দেবব্রত অফিসের কালচারাল সেক্রেটারি। কমিটির প্রেসিডেন্ট সুতনুকে বলল, কি সব আগেকার দিনের পচা পচা নায়িকাদের নাম করছে রে।
--লোকটাও তো পচা—সেই আদ্দিকালের। পাশ দিয়ে কি কাজে যাবার সময় কথাটা বলে শ্যামল তো হেসেই ফেলেছিল। ঝট করে মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে দৌড়ে চলে গেল।
মাথা নাড়লেন ডাট সাহেব, ঠিক ঠিক। স-রি সরি। উ-র-ব্বসি মেনকা—
জড়ান গলা আর মুখভঙ্গিতে মুখ লুকিয়ে হাসতে হল তো সকলকেই। ডাট সাহেব কিছু মনে করলেন না। আসলে তিনি ভাবছিলেন সবাই তাঁর খুব প্রশংসা করছে। তিনি নাচের তাল আর লয় দুটোই বাড়িয়ে দিলেন।
অস্বস্তি তো ডাট সাহেবের বৌয়ের। একটু বিরক্তি নিয়ে তাকাতেই নলীন বুঝে গিয়েছিল ব্যাপারটা। সে তাড়াতাড়ি বলল, আপনি স্যার বাইরে এসে বসুন।
চোখ পাকালেন ডাট সাহেব, কেন রে শালা? বাইরে বৃষ্টি পড়ছে না? আমার নেশা কাটাবার প্ল্যান করেছিস বুঝি?
--বৃষ্টি আর নেই স্যার। ওখানে ফিসফ্রাই ভাজা হচ্ছে।
কথাটা বলে মুখ লুকিয়ে হেসে নিল নলীন।
মাথাঝাড়া দিয়ে উঠলেন ডাটসাহেব। ফিসফ্রাইয়ের কি অসীম শক্তি। তারপর তাঁকে মাঠে উনুনের একটু দূরে বসিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। উনি মাথা নেড়ে নেড়ে গুনগুন করতে থাকেন। কখনও চোখ পাকিয়ে হালুইকরকে পরামর্শ দিতে থাকেন আর একের পর এক গরম ফিসফ্রাই সাঁটাতে থাকেন।
মানিক দাঁত কড়মড় করে বলল, শালা একেবারে হাঘরের মত খাচ্ছে।
নীতিশ দোষ দেয় নলীনকে, ওটাকে বাইরে বার করলি কেন বল তো? করলি তো করলি একেবারে ফিসফ্রাইয়ের ঘাঁটিতে?
নলীন সাফাই দিল, কি করি যা মাল টেনেছে তাতে আর মেয়েদের সামনে বেশীক্ষণ বসিয়ে রাখার সাহস হল না। ডাটসাহেবের মুখের অবস্থা যদি দেখতিস। রাগ আর লজ্জ দুটো মিলে একেবারে যাচ্ছেতাই।
অমৃতাভিসারের অন্যতম এক দেবতা সঞ্জয় এসে জুটল। বলল, বোতলটা সবই ঝেড়ে দিয়েছে প্রায়। এখন ওনার পক্ষে হাঁটাই দায়। টাল সামলাতে পারবে না। তা সে চলারই হোক বা বলার। মুখে তো আর ঢাকনা পরান যায় না ঘোড়ার মত। তুই ঠিক করেছিস নলীন। কটা ফিসফ্রাই যায় যাক। কিন্তু মেয়েদের প্রেস্টিজ যেতে দেওয়া যায় না।
বৃষ্টি এখন বেশি পড়ছে না। টিপটিপে বৃষ্টি। তবু সেটাকে বরদাস্ত করতে পারলেন না ডাটসাহেব। তাছাড়া গোটা দশ পনের ফিসফ্রাই আর বড় একটা বোতল সাবড়ে পেটের তাগিদও তেমন ছিল না। টিপটিপে বৃষ্টিতেও নেশা কেটে যেতে পারে। সন্দেহ হল এরা সেই প্ল্যান করে নি তো? অমনি ছেলেমানুষের মত বায়না বৃষ্টি থেকে সরিয়ে নিয়ে যাবার।
এবারে তাঁকে মেয়েদের কাছ থেকে বেশ একটু দূরে একটা চেয়ারে বসতে দেওয়া হল। অবিনাশও টেনেছিল মন্দ নয়। সে প্রায় ঢুলতে ঢুলতে ফিসফ্রাইয়ে বিস্কুটের গুঁড়ো মাখিয়ে সেগুলোকে সাইজ করছিল। ডাটসাহেব একমনে দেখছিলেন। হঠাৎ জড়ানো গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন, মেয়েদের ফিসফ্রাই দেওয়া হয়েছে?
অবিনাশও চেঁচিয়ে উঠল, নীলাবৌদি পেয়েছে দত্তবাবু।
বিরক্তিতে মাথা নাড়েন ডাটসাহেব ওরফে দত্তবাবু, হ্যাং ইয়োর নীলাবৌদি। বলি সব মেয়েরা পেয়েছে?
অবিনাশ হো হো করে হেসে উঠে আবার বলল, নীলাবৌদি পেয়েছে দত্তবাবু।
নীলাবৌদি হল ডাটসাহেবের বৌ। এই একেবারে ক্ষেপে গেলেন সাহেব, চোপ চোপ! আর একটা কথা বলবি তো আমি তোকে ডিসচার্জ করে দেব। ডিসমিস হয়ে যাবি।
বিস্কুটের গুঁড়ো মাখাতে মাখাতে অবিনাশ একই সুরে বলল, চার্জ কি আর আছে দত্তবাবু? যা টেনেছেন তাতে তো চার্জ ফেল করে একেবারে ফিউজ হয়ে রয়েছেন?
সবাই হো হো করে হেসে উঠল দুই মাতালের চাপান উতোরে। নীলাবৌদি তখন মেয়েদের জড়িয়ে একটা প্রসঙ্গ তুলতে গেলেন। কিন্তু শাক দিয়ে মাছ ঢাকা গেল না। আবার তাল ঠুকে ঠুকে গান জুড়ে দিলেন ডাটসাহেব। আর প্রমীলা, লিপি, সহেলিরা তাঁর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসতে লাগল দায়সারা ভাবে।
গানটা শেষ হল। উসখুস করতে লাগলেন। ঠিক যেন জমছে না জমছে না ভাব। চোখ পড়ল দিবাকর ভৌমিকের ওপর। গোবেচারা ক্লার্ক। সেদিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে নেড়ে তাকে ডাকতে থাকেন ডাটসাহেব, দিবু এগিয়ে আয়। এগিয়ে আয়।
বছর বিয়াল্লিশের দিবাকর ভৌমিকের তখন চুলে একটু একটু পাক ধরেছে। হেয়ার ডাই লাগাবেন কি লাগাবেন এই দ্বন্দ্বে থেকে সেটা এখনও করা হয় নি। ডাট সাহেব তাকে অফিসে কখনও আপনি ছাড়া তুই তো দূরের কথা তুমি বলেও ডেকেছেন বলে মনে পড়ে না। বস হিসেবে ডাটসাহেব তো খুবই ভদ্র আর মার্জিত।
অবাক হওয়ার পালাটা শেষ হতেই বুঝলেন তাঁকেই ডাকা হচ্ছে। মাথায় হাত বুলিয়ে নিজের বয়েসটাকে আর একবার বিবেচনা করে বড় সাহেবের ডাক উপেক্ষা করবেন কিনা ভাবছেন। কিন্তু সেটা হল না। ফোক্কড় সাধন বোস মুচকি হেসে বলল, দিবুদা, স্যার আপনাকে ডাকছেন।
কাছে যেতেই হল গোমড়া মারা মুখে অপ্রস্তুতির একটা হালকা হাসি ঢাকা দিয়ে।
হাড়কাঠের দিকে এগিয়ে যাবার মত আড়ষ্ট ভঙ্গিতে কাছে যেতেই খপ করে তাঁর হাত ধরে ফেললেন সাহেব। তারপর পিঠে ঘাড়ে হাত বোলাতে বোলাতে বলতে থাকেন, দিবু আমার। আমার দিবু খুব ভাল ছেলে। ভেরি গুড বয়।
একঘর মানুষের সামনে অস্বস্তির কাঁটাগুলো খচ খচ করে বিঁধছে কিন্তু কিছু করার নেই। শুধু নিজেকে একটু গুটিয়ে নেওয়া ছাড়া আর কি করতেই বা পারে? হলই বা পিকনিক? তারও তো একটা পর আছে নাকি? পিকনিকের পরের দিনই তো অফিস। বস বলে কথা। কাঁচাখেকো দেবতা যাকে বলে। কার রোষ যে কখন কি ভাবে পড়ে তা কি দেবতারাও জানে?
আজকের এই ডাটসাহেবকে কিন্তু মেলানো যাচ্ছে না এই মাত্র কটা মাস আগের ডাটসাহেবের সঙ্গে। মুখ কাঁচুমাচু করে যেদিন দিবাকর ভৌমিক ঢুকে পড়েছিলেন বসের ঘরে।
--আরে ভৌমিক বাবু বসুন বসুন। কিছু বলবেন?
দিবাকর ভৌমিক খুব মিত আর মৃদুভাষী। আমতা আমতা করে অনুরোধ করলেন ফেস্টিভ্যাল অ্যাডভান্সটা কটামাস আগেই দিয়ে দেবার জন্যে। অফিসের নিয়মে আছে তিনমাস আগেও এই অ্যাডভান্স নিয়ে নেওয়া যায় যদি আউটস্ট্যান্ডিং ব্যালান্স মানে বাকি যা পড়ে আছে সেটা এই মুহূর্তেই শোধ করে দেওয়া যায়।
--নো প্রবলেম। কটা বাকি আছে?
--আর তিনটে স্যার।
--তাতে কি হল? ওগুলো জমা দিয়ে ক্লিয়ার করে দিন।
একেবারে চুপ করে আছে দিবাকর। অফিসের সব স্টাফের আর্থিক অবস্থার মোটামুটি খবর রাখেন ডাটসাহেব। দিবাকর ভৌমিকের বৌ খুব কঠিন এক রোগে ভুগছে। হেন জায়গা নেই সেখান থেকে সে লোন নিয়েছে। আউটস্ট্যান্ডিং ব্যাল্যান্স যে বেশ ভাল রকম।
তার মুখটা বেশ ভাল করে পড়ে নিয়ে ডাটসাহেব বললেন, আমি কি করব বলুন? নিয়ম তো আর ভাঙ্গা যায় না।
মুখ চুন করে বেরিয়ে যাচ্ছিল দিবাকর। আবার তাকে ডাকলেন সাহেব।
--আচ্ছা দেখছি কি করা যায়। আপনি এখন যান।
পরের দিন সেই অ্যাডভান্সের সব টাকা জমা পড়ে গিয়েছিল তার অ্যাকাউন্টে। আর সেই সঙ্গেই কিছু টাকা মানে সেই লোনের গত বছরের বাকি টাকা কেটে নেওয়া হয়েছিল বসের অ্যাকাউন্ট থেকে। কৃতজ্ঞতায় কাঁদতে কাঁদতে চেম্বারে ঢুকেছিল সে। আশ্চর্য সেদিনও কিন্তু দাঁড়িয়ে উঠে এমনি ভাবে তার ঘাড়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন ডাটসাহেব, ভাল করে বৌয়ের চিকিৎসা করান। জানবেন টাকা ফেললে বৌয়ের মত অনেক পাওয়া যায় কিন্তু বৌ পাওয়া যায় জীবনে মোটে একটাই।
সেদিন কিন্তু নেশা করেন নি ডাটসাহেব। তাই সেদিনের মানুষটার সঙ্গে আজকেরটাকে মেলাতে বড় অসুবিধে হতে লাগল দিবাকর ভৌমিকের। অস্বস্তির মাত্রা বেড়ে গেছে সেই জন্যেই।
এমন সময় হাতের কাজ ফেলে উঠে পড়ল অবিনাশ।
--চলুন স্যার, খেলার রেজাল্ট জেনে আসি।
অতনুর কানে মোবাইল। এফ-এমে রানিং কমেন্ট্রি শুনছে। হেঁকে হেঁকে স্কোর বলতে লাগল।
উঠে পড়লেন ডাটসাহেব, দূর দূর এতে হবে না। চল টিভিতে দেখে আসি।
তাকে আর আরও জনা তিনেক সাঙ্গপাঙ্গ জুটিয়ে তাদের কাঁধে হাত দিয়ে প্রায় টলতে টলতে হাঁটা দিলেন ডাট সাহেব। সঙ্গে দিবাকরকেও নিয়েছিলেন। নিরীহ সেই মানুষটা ভীষণ অস্বস্তিতে প্রায় সিঁটিয়ে ছিল। কিন্তু একে তো বস বলে কথা তাতে সেই লোন নেওয়ার ঘটনার পর থেকে সে বেশ একটু কৃতজ্ঞ ছিল। তার বৌ আজ একটু সুস্থ। সেও বার বার বলে, ডাট সাহেবের তুল্য নেই গো।
--হ্যাঁ সেদিন অ্যাডভান্সটা না পেলে তোমাকে বাঁচানো খুব মুস্কিল হত। দিবাকরও সে তালে তাল দিত।   
পেছন থেকে বাদল বলল, মাতালগুলো আবার চলল গিলতে। এবার বোধহয় বাংলা। রেস্ত তো সব ফুড়ুৎ ফাঁই।
শ্যামলও ফোড়ন কাটল, রেস্তোতে আর বিলিতি আঁটবে না। বাংলা ছাড়া গতি কী।
সোমরসে বঞ্চিত নয় অবশ্য সে। কিন্তু পিকনিকে তার বৌ এসেছে। বৌয়ের সামনে সে একেবারে ভালমানুষ সেজে থাকতেই ভালবাসে।
সহেলি মেয়েলি নিচু গলায় মুচকি হেসে বলল, আমরা একটু বাঁচি তবে।
ডেসপ্যাচ ক্লার্ক শশধর সেনের কচি বৌ দিব্যাও হিসেব মেলাতে পারছে না। পাঁচদিন শশধর অফিস যেতে পারে নি। দরখাস্ত পাঠিয়েছে শরীর খারাপ বলে। দেখতে এলেন স্বয়ং বস। একগাদা ফল নিয়ে।
সত্যি সত্যি অসুখ। বিছানায় বসে বরকে সুপ খাওয়াচ্ছিল দিব্যা। বুকের আঁচল সামান্য সরে গিয়ে থাকবে অতটা খেয়াল করে নি সে। কিন্তু ঝট করে অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন ডাটসাহেব। মাটির দিকে চোখে রেখে কিছু উপদেশ দিয়ে চলে গিয়েছিলেন। চা খান নি। বলেছিলেন, ভাল করে স্বামীর সেবা কর। তোমরা দুজনেই তো দুজনকে দেখবে মা। আমি নাহয় অন্যদিন আবার আসব।
সেদিনের ডাটসাহেবের সঙ্গে আজকের ডাটসাহেবকে মেলানোই যাচ্ছে না। আজ তো তার দিক থেকে নজর সরেই না সাহেবের। মনে মনে ভাবছিল আচ্ছা হ্যাংলা তো লোকটা।
রাস্তা দিয়ে থপ থপ করে হাটছেন ডাটসাহেব। কাদায় পেছল রাস্তা অতিকষ্টে আদরের দিবু ভৌমিকের গলা জড়িয়ে ধরে হাঁটছেন। দিবাকরের ইচ্ছে নেই নেশা করার তবু উপায় কি হাত ছাড়াবার। শেষে যখন কাদা সামলে কুঞ্জবনে গিয়ে উপস্থিত তখন সেখানে বোতল নিয়ে বসে গেছে আরও দুজন।
ডাটসাহেব এসেই ছোঁ মারলেন বোতলে। ঢাললেন গলায়। চোখ পড়ে গেল দিবুর দিকে। দিলেন ডাক, দিবু আয় একটু খা।
--স্যার আমি তো খাই না। মানে নেশা করি না। দূর থেকেই নাক কোঁচকাল দিবু।
--ওঃ নেশা করি না। গুড বয়। ভেঙ্গিয়ে উঠলেন ডাটসাহেব, বলি চা খাস না? মেয়েছেলের নেশা নেই তোর? তো বিয়ে করেছিলি কেন? বৌয়ের নেশা নেই তোর? তো দে না তোর বৌটাকে দিয়ে দে আমায়? খাসা বৌ তোর দিবি নাকি আমায়?
লজ্জায় লাল হয়ে গেল দিবু। এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। যেন খুঁজতে লাগল সেই চিত্রনাট্যকারকে যে সীতার পাতাল প্রবেশের সীনটা লিখেছিল।
তার দাড়ি ধরে চুমু খেয়ে নিলেন ডাটসাহেব।
সিঁটিয়ে গেল দিবাকর, স্যার আপনি হলেন বস আর আমি—
--হ্যাং ইয়োর বস। চেঁচিয়ে উঠলেন সাহেব, আজ আমার অনারে একটা ড্রপ গলায় ঢাল না বাবা। হয়ে যাই এক গেলাসের—না না এক ড্রপের ইয়ার।
হা হা হা করে অট্টহাসি হাসলেন। এ যেন এক অন্য মানুষ ডাট সাহেব। অন্যদিনের সঙ্গে মেলানো যাচ্ছে না একেবারেই। কিংবা এটাই আসল ডাট সাহেব। অন্যদিন অন্য মুখোস পরে থাকেন।
অবিনাশ তাল দিল, একেবারে সেয়ানে সেয়ানে।
বাধা মানলেন না সাহেব। এক ড্রপ তো দূরের কথা। পুরো বোতলটা ঢেলে দিলেন তাঁর গলায়। ঢক ঢক করে খেয়ে নিল দিবাকর। তারপর তার এক অপূর্ব মুহ্যমান অবস্থা। সেটা কাটতেই সে এগিয়ে এল ডাটসাহেবের দিকে। ম্যানেজারের গলা জড়িয়ে ধরে জড়ান গলায় বলতে লাগল, এই ম্যানেজার। তুই কি বলছিলি রে? আমার বৌটাকে নিবি? হা হা হা—নিবি তো নে না। ও তো একটা কালপেত্নি। তোর তো খাসা বৌ। উর্বশী মে—ন-কা। আয় না পাল্টাপাল্টি করি।
ডাটসাহেব হেঁচকি তুলে বললেন, ভাল বলেছিস। কিন্তু বাবা দিবুচাঁদ এটা জানো তো? আমার বৌ মানে ওই উব্বশি আর মেনকা—আমাকে শুতেই নেয় না বিছানায় কোনওদিন। সেই বিয়ের পরে কিছুদিন শুয়েছিল। তারপর আর আমাকে ভাল লাগে নি। ওর বিছানায় এখন অন্য লোকে শোয়। কেউ জানে না। কেউ জানে না।
দুলে দুলে বলে চলেছেন ডাটসাহেব, জানবে কি করে বল? সে যে আমার গাড়ীর ড্রাইভার। আমি যে বস রে তোদের ডাটসাহেব। আমি কি আর বৌয়ের নিন্দে করতে পারি বল? সামলাতে পারবি তো বৌকে? তা তোকে না হয় দিয়ে দেব আমার গাড়িটাও। হবি আমার ড্রাইভার? তবে বৌটাকে পাবি। আর সঙ্গে---
মুখে কুলুপ এঁটে গেল ডাটসাহেবের। মাথাটা নিচের দিকে ঝুলে গেল।
সবাই ভাবল ঘুমিয়ে পড়েছেন। কিন্তু না। চোখের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন যে সকলের নীলা বৌদি। বসের বৌ মানে সকলের মাননীয় ম্যাডাম।   
chattopadhyayarun@gmail.com
হুগলি 

No comments:

Post a Comment