1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, February 21, 2021

ইতিহাসের সাধক

 

ছবি  : ইন্টারনেট 

ইতিহাসের সাধক
ইন্দ্রানী দলপতি

।। ১ ।।

“যেকোনো মানুষ হয়তো শুধু একজন মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠে না, পাশাপাশি সে যেন সাক্ষী হয়ে থাকে তার সমকালীন সময়ের, ধীরে ধীরে তার আপাদমস্তক পরিণত হয় একটা গল্পের বইতে, না, বই নয় বই নয়, উপন্যাস…” জানলার দিকে তাকিয়ে সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে এক দৃষ্টিতে সামনের শিমূল গাছটার দিকে তাকিয়ে ছিলেন সমরেশ বাবু। এই মুহূর্তে তার কোনো ক্লাস নেই, খানিকটা অবসর মিলেছে। অবসর পেলেই তিনি জানলা দিয়ে শিমূল গাছটার দিকে চেয়ে থাকেন। অনেক কথা হয় তাদের মধ্যে। সমরেশ বাবু নিজের জীবন দিয়ে দেখেছেন, মানুষের বয়স যত বাড়তে থাকে, জীবনে প্রকৃত বন্ধুর সংখ্যা ততই কমে আসতে থাকে। একটা সীমা পার করে আসার পর মনের কথা বলার মত আর কেউ থাকে না। খুব কাছের হয়ে ওঠে সাদা কাগজ আর কলম, আর তার পরেই গাছ। গত পাঁচ বছর ধরে এই শিমূল গাছটা সমরেশ বাবুর প্রকৃত বন্ধু হয়ে উঠেছে। সমরেশ বাবু বিপত্নীক, পেশায় একজন বিদ্যালয়ের শিক্ষক, একটিমাত্র পুত্রসন্তান ও পুত্রবধূ নিয়ে তার সংসার। বই পড়া তার একমাত্র নেশা। সাধারণ জীবনযাপনেই তিনি বরাবর অভ্যস্ত। পরিচিত পরিসরে বেশ ডাক-নাম রয়েছে তার অমায়িক ব্যবহারের জন্য। আর মাত্র মাস চারেক পরেই তার অবসর মিলতে চলেছে কর্মজীবন থেকে। সমরেশ বাবুর মনটা বিষণ্ণ হয়ে আছে বেশ কিছুদিন ধরেই। শিক্ষকতাকে শুধুমাত্র পেশা হিসাবে তিনি দেখতেন না, এটা ছিল তার অস্তিত্ব। সমরেশ বাবুর মনে পড়ে যায়, আজ থেকে বেশ কয়েক মাস আগেও অবসর সময় কাটানোর জন্য তিনি অনেক পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন, কিন্তু আজ আর কিছুই মনে করতে পারেন না, জোর করে মনে করতে গেলে কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যায় মাথার ভেতর। জানলার কাছ থেকে সরে এলেন সমরেশ বাবু। চেয়ারে বসলেন। বোতল থেকে খানিকটা জল খেলেন। বিতেশ বাবুর ক্লাস শেষ হতে আর এক মিনিট মতো বাকি আছে প্রায়। হাতে ইতিহাস বইটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন সমরেশ বাবু, গন্তব্য ৭ নম্বর ক্লাসরুম। 

জীবন মুখোপাধ্যায়ের ইতিহাস বইটার সিন্ধু সভ্যতার অধ্যায়টা খুলে টেবিলের ওপর রাখলেন সমরেশ বাবু। সামনের দিকে তাকিয়ে একবার বেঞ্চের সারিগুলোতে চোখ বুলিয়ে নিলেন তিনি। আজকালকার ছাত্রগুলো কেমন যেন সব ঝিমিয়ে থাকে, পড়াশোনাতে একদম আগ্রহ নেই। কোনও প্রশ্ন করে না, কিছু জানতে চায় না, কেমন নির্বিকার হয়ে তাকিয়ে থাকে শুধু। সমরেশ বাবু তবু হাল ছাড়েন না, তিনি পড়ানো শুরু করেন। 

“আজকে আমরা জানবো সিন্ধু সভ্যতার বিষয়ে, এখানে কেউ কি জানো এর সম্পর্কে?” – বোর্ডে বড় বড় করে “সিন্ধু সভ্যতা” লিখে সামনের দিকে ঘুরে দাঁড়ান। নিস্তেজ হয়ে থাকা ক্লাসে প্রাণ ফেরানোর জন্য আবার তিনি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন – “আচ্ছা, এই নামটা নিশ্চয়ই তোমাদের জানা?”উত্তরের জন্য আর অপেক্ষা না করেই তিনি বিশদে বর্ণনা দেওয়া শুরু করেন। “প্রাচীন কালে ভারতবর্ষের বুকে যে সমস্ত সভ্যতা গুলো গড়ে উঠেছিল, তার মধ্যে অন্যতম একটি সভ্যতা হল সিন্ধু সভ্যতা। এই সিন্ধু সভ্যতাকে তাম্র-প্রস্তর যুগের সভ্যতাও বলা হয়ে থাকে। যেহেতু সেই যুগে মানুষ তামা আর ব্রোঞ্জের পাশাপাশি পাথরের ব্যবহারও করতে শিখেছিল, তাই এই যুগের নাম তাম্র-প্রস্তর যুগ। এই সভ্যতা আবিষ্কারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক প্রখ্যাত বাঙালী প্রত্নতত্ত্ববিদের নাম। তিনি হলেন রাখলাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। আচ্ছা, কেউ কি বলতে পারবে প্রত্নতত্ত্ববিদ কাদের বলে?”

নাহ্, এবারেও সেই একইরকম নির্বাক হয়ে চেয়ে রয়েছে সকলে। তবে সমরেশবাবু এবার আর নিজে থেকে জানালেন না উত্তরটা, তিনি ছাত্রদের একদিন সময় দিলেন উত্তরটা জেনে আসার জন্য। ক্লাস শেষ করে বেরিয়ে আসলেন ক্লাসরুম থেকে। মনটা একটু খারাপ হল বোধহয়। কেন এরা পড়াশোনা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে? আচ্ছা, ওরা তো বিজ্ঞান পড়ে মন দিয়ে, অঙ্ক কষে মন দিয়ে, ইংরাজী ক্লাসেও সকলে কী সুন্দর প্রশ্ন করে ইংরাজীতে, অথচ ইতিহাস, বাংলায় ওদের কেমন পুতুলের মত হাবভাব হয়ে যায়। কীসের এত অনীহা ওদের? বাংলায় কথা বলতে কীসের এত অনীহা? ইতিহাস জানতে কীসের এত অনীহা? মন খারাপটা ক্রমশ বিরক্তিতে পরিণত হল এবার। মাথার পারদ চড়তে লাগলো ক্রমশ…

ঘুমটা ভেঙে গেল শৌভিকের। হুড়মুড় করে কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ হল না! তবে কি বাবা আবার… শৌভিক আর দেরী করল না। গায়ের ওপর থেকে ঝট করে চাদরটা সরিয়ে এক লাফে বিছানা থেকে নেমে বিদ্যুৎ গতিতে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেল। বাবার ঘরে আলোটা জ্বলছে। তার মানে ও শব্দটা ঠিকই শুনেছিল। দরজা খুলে ঘরে ঢুকল শৌভিক। দেওয়ালে বড় বড় করে লেখা “সিন্ধু সভ্যতা”। সামনে কয়েকটা চেয়ার একে-অপরের গায়ে পড়ে রয়েছে। বিছানার ওপারে উঁকি দিতেই শৌভিক দেখতে পেল তার বাবা জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে রয়েছে। জলের গ্লাসটা নিয়ে কাছে গিয়ে চোখে মুখে কিছুটা জল ছিটিয়ে দিল। শৌভিক বাবার মাথাটা তুলে নিয়ে নিজের কোলে রাখল। বাবার মাথায় আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিল। কানের কাছে মুখটা নামিয়ে ডাকল – “বাবা, ও বাবা, শুনতে পাচ্ছ? বাবা…” ধীরে ধীরে সমরেশ বাবু চোখ খুলে তাকালেন। শৌভিকের সাহায্যে উঠে বসলেন বিছানায়। বাবাকে শুইয়ে দিয়ে গায়ের উপর চাদরটা চাপা দিয়ে দিল। তারপর আস্তে আস্তে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। সমরেশ বাবুর চোখ ঘুমে বুজে আসতে লাগলো। ক্ষীণ স্বরে তিনি শৌভিকের দিকে চেয়ে বললেন – “তুমি কী জানো প্রত্নতত্ত্ববিদ কাদের বলে? কাল কিন্তু জেনে আসবে, জে…নে আ…সবে ক…কা…।” শৌভিক তখনও পরম স্নেহে বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। বাবা ঘুমিয়ে পড়লে আলো নিভিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দরজাটা বন্ধ করে দিল। এরপর নিজের ঘরে না ফিরে সোজা ছাদে উঠে গেল। পৌষ মাস পড়ে গেছে হয়তো, বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। একটা সিগারেট ধরিয়ে দিল শৌভিক। মানুষ যখন অনুতপ্ত হয় তখন সে একমাত্র প্রকৃতির কোলেই মুখ লুকিয়ে শান্তি পায়। শৌভিক শান্তি পেল না ঠিকই, তবে খানিকটা হালকা বোধ করল হয়তো ।


।। ২ ।।

- কী সমরেশ বাবু, ক্লাস কেমন হল?

- সেই একইরকম। কেউ কোনো প্রশ্ন করে না, কিছুই জানতে চায়না। ইতিহাসকে আর কেউ ভালবাসে না, বুঝলে সমীর?

- ইতিহাস পড়ে কী হবে মশাই? ওসব সাল-তারিখ থোড়াই কাজে লাগে!

- সমীর, ইতিহাস মানে শুধুই সাল তারিখ নয়। সাল তারিখের বাইরেও ইতিহাসের নিজস্ব একটা অস্তিত্ব রয়েছে।

- তাই বুঝি? কীরকম বলুন তো?

সমরেশ বাবু আগ্রহ নিয়ে নড়েচড়ে বসেন চেয়ারটাতে, তারপর বলতে শুরু করেন,

- ইতিহাস মানে শুধু সাল-তারিখ নয়, তোমার অস্তিত্ব, আমার অস্তিত্ব, আমাদের অস্তিত্ব, আমাদের পূর্বপুরুষের অস্তিত্ব। আর……

- আর কী সমরেশ বাবু? 

- দলিল, সময়ের দলিল।

- ধুর মশাই! আপনি ইতিহাসের মাষ্টার না হয়ে নাটকের স্ক্রিপ্ট লিখতে পারতেন তো!

সমীর উঠে বেরিয়ে যায়, সমরেশ বাবুর সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সমরেশ বাবু আপন মনে বলে চলেন -

“আবিষ্কার কি শুধু বিজ্ঞানে হয়? বিজ্ঞানের আবিষ্কারই কি শুধু সাড়া ফেলার যোগ্য? ইতিহাসের আবিষ্কার বুঝি আবিষ্কার নয়? কোনো গুরুত্ব নেই তার? এই যে চাকা, গড়গড়িয়ে চলছে সেই কোন যুগ থেকে, ইতিহাসের কোনো অবদান নেই তাতে? এই যে আগুন, জ্বালিয়ে দিচ্ছে, পুড়িয়ে দিচ্ছে, এই আগুন আবিষ্কারও তো ইতিহাসের অবদান! ইতিহাস ছাড়া বিজ্ঞান হত? গণিত হত? প্রশাসন হত? ইতিহাস ছাড়া চিকিৎসা হত? ইতিহাস ছাড়া আমদের সমাজ হত? এই মানব সভ্যতা হত? আধুনিক হলাম বলে কী অতীত মিথ্যে হয়ে যাবে!”

একটানা কথাগুলো বলে একটু দম নিলেন। একটু জল খেয়ে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। তাকিয়ে রইলেন শিমুল গাছটার দিকে। মায়ের কথা মনে পড়লো তার। মা যখন স্নান সেরে লাল পেড়ে সাদা শাড়ি পড়ে ঠাকুরঘরে পুজো করতেন, মায়ের দিকে তিনি অভিভূত হয়ে তাকিয়ে থাকতেন। কপালে লাল টিপ, এক মাথা সিঁদুরে মাকে ঠিক যেন দেবী দুর্গার মতো লাগতো। তিনি মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকতেন। মা তাকে পরম যত্নে খাইয়ে দিতেন, গল্প শোনাতেন। দালানে দাঁড়িয়ে দেখতেন তুলসী তলায় মায়ের প্রদীপ দেওয়া। গ্রামের দিকে তখনও সেভাবে বাড়ি বাড়ি বিদ্যুৎ পৌঁছে যায়নি। মায়ের কোলে বসে দুজনে মিলে জোনাকি দেখতেন। তখন তো আঁধার নামলেই সারা বাড়ি জুড়ে জোনাকিদের রাজত্ব। বাড়ির পশ্চিমে একটা শিমূল গাছ ছিল। মায়ের সাথে একসাথে বসিয়েছিলেন গাছটা। গাছটা বেড়ে ওঠার সুযোগ পেলে এই গাছটার মতোই হয়তো দীর্ঘ হতে পারত। একদিন মা-ও চলে গেলেন, সাথে হারিয়ে গেল মায়ের আদর, যত্ন, স্নেহ, তুলসীতলার প্রদীপ আর জোনাকি। 

“সব হারিয়ে গেলে পরে ইতিহাসই শুধু সাক্ষী রয়ে যায়… আর এরা বলে কিনা ইতিহাস মানে শুধুই সাল আর তারিখ!” – বিড়বিড় করতে থাকেন সমরেশ বাবু।

শৌভিক দরজা খুলে খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকল। খাবারটা বিছানার পাশে টেবিলের ওপর রেখে বন্ধ জানলাটার সামনে বাবার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। বাবা তাকে জানলার দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করে বলল – “ঐ শিমূল গাছটাকে দেখছ? ঐ শিমূল গাছটা সব জানে। অনেক ইতিহাস জানে। তুমি কিস্যু জানো না, কিস্যু না!” শৌভিক কোনো কথা বলল না। বরাবর সে কম কথা বলত। এখন প্রয়োজনটুকু ছাড়া আর কোনোও কথা বলে না। মনের মধ্যে যে তীব্র যন্ত্রণা জমে রয়েছে, তাতে তার বহন ক্ষমতা দিনে দিনে যেন কমে আসছে মনে হয়, তাই অযথা শক্তি খরচ করে লাভ কী! বাবাকে খাবার খাইয়ে, ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সে।


।। ৩ ।।

“কথা বলার জন্য সত্যিই কাউকে প্রয়োজন হয়, এই ধ্রুব সত্যটা নিজের জীবন দিয়ে যতক্ষণ না উপলব্ধি করা যায়, ততক্ষণ অন্যের অনুভূতিগুলোকে অনেকটা পাগলের প্রলাপের মতোই লাগতে থাকে। বাবা বরাবর ইতিহাস পাগল। ইতিহাসের প্রতি তার এই ভালোবাসাটা অবশ্য ছোটোবেলা থেকেই যে ছিল, তা ঠিক নয়। বরং বেশ দূরে দুরেই থাকত সে। ঠাকুমা মারা যাবার পরে বাবা যখন প্রথম এই শহরে এসে উঠলো, এখানকার এক স্থানীয় বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। সেখানকারই এক মাষ্টার বাবার ইতিহাসের প্রতি সমস্ত ভীতি দূর করে দেয়। তিনিই নাকি বাবাকে শিখিয়েছিলেন আমদের জীবন আর ইতিহাস একে অপরের সাথে ওতোপ্রোতোভাবে জড়িয়ে রয়েছে। সেই থেকে বাবা ইতিহাসে জীবন খুঁজে পেল, আর তাকে ঘিরে ভালবাসাও তৈরি হল। বাবা চাইতেন সবার যেন ইতিহাসের প্রতি ভীতি দূর হয়, সবাই যেন ইতিহাসে শুধু সাল আর তারিখের তলায় দাগ না দেয়, বরং ইতিহাস যেন তাদের মনে দাগ কেটে যায় এই চেষ্টাই সর্বদা করতেন। এখনকার শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি বাবার অনেক অভিযোগ ছিল। বাবা আসলে আগেকার মানুষ, তিনি মোটেই এই ফাঁকিবাজি করে শুধুমাত্র নম্বরের পিছনে দৌড়ানোতে সন্তুষ্ট থাকতে পারতেন না। তিনি শেখাতে চাইতেন, তিনি আত্মস্থ করাতে চাইতেন। অস্থির থাকতেন, সারাক্ষণ কী সব যেন ভেবে যেতেন। তবে মা ছিল বাবার যথাযোগ্য সহধর্মিনী। বাবার সকল অনুভূতি দাম পেত একমাত্র মায়ের কাছে। হয়তো বাবার সংস্পর্শে এসেই মায়েরও ইতিহাস চর্চায় শান পড়েছিল। মা-বাবার অবসর সময়ের আলাপ-আলোচনাতেও শুধুই ইতিহাস থাকত। আমার বড় বিরক্ত লাগত। আমি কোনোদিন বাবার সান্নিধ্যে যেতে চাইনি। কাছে গিয়েছি অনেকবার, কিন্তু সান্নিধ্যে যাওয়া হয়নি। তাই আমার কাছে ইতিহাস সাল-তারিখের গণ্ডি পেরিয়ে মনে জায়গা করে নিতে পারেনি কোনোদিনই। লোকটাকে পাগল মনে হত, মনে হত অসুস্থ, ডাক্তার দেখানো প্রয়োজন। মা কিন্তু বাবার পাশে শেষ পর্যন্ত ছিল। ওরা দুজনে ঠিক করে রেখেছিল একটা পাঠশালা খুলবে, সেখানে ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েদের ইতিহাস-ভীতি দূর করবে, জীবনের সাথে ইতিহাসকে মিলিয়ে দেবে, ভালবাসতে শেখাবে। বাবা বিশ্বাস করতেন, ইতিহাস না পড়লে, ইতিহাসকে না জানলে মানুষের মত মানুষ হওয়া যায় না। বাবার এই লড়াই আসলে মানুষ তৈরি করারই লড়াই ছিল। আমি বুঝিনি। আরও অনেকে বোঝেনি। অনেকের কাছে তো এখন বাবা শুধুই একজন ‘পাগলা মাষ্টার’। সারাজীবন ধরে একটা মানুষের এতখানি অবদান এইভাবে নিমেষে ধুলোয় মিশিয়ে যায়!” – কান্নায় ভেঙে পরে শৌভিক। ডঃ বাসু খানিকটা সময় দেয় তাকে, তারপর জলের গ্লাসটা তার দিকে এগিয়ে দেয়। মানুষ চাইলেও অনেক সময় নিজে থেকে কাঁদতে পারে না, অনুতাপের পাথর ভাঙতেও একটা আঘাতের প্রয়োজন হয়। সমরেশ বাবুর লেখা ডায়েরি সেই মস্ত আঘাতের ভূমিকা পালন করেছে। মনোবিদ ডঃ বাসু নিজের নেওয়া সিদ্ধান্তে খানিকটা সন্তুষ্ট হয়। আমরা নিজেরাই অনেক সময় নিজেদের চারপাশে এক অদৃশ্য দেওয়াল তুলে দিই, নিজেকে বন্দী করে রাখি সেই ঘেরাটোপের মধ্যে, অনুতাপে পুড়তে থাকি, ভাবতে থাকি নিজেকে শাস্তি দিচ্ছি। অথচ এইসবের মাঝে কখন যে সত্যি সত্যি ক্ষমার অযোগ্য কোনো অপরাধ করে ফেলি তা আমরা অনুধাবনও করতে পারিনা। ডঃ বাসু চেয়েছিলেন শৌভিক এই দেওয়ালটা ভেঙে বেরিয়ে আসুক। তাতে আদতে শৌভিক এবং সমরেশ বাবু, দুজনেরই লাভ। 

শৌভিক খানিকটা স্বাভাবিক হলে আবারও বলতে শুরু করে – “জানেন, বাবার এই ইতিহাস প্রীতি আমার বরাবর অপছন্দের ছিল। বাবার সাথে আমার মতের মিল কোনোদিনই ছিল না। মা, একমাত্র মা আমদের মাধ্যম হিসাবে কাজ করত। বাবা থাকতেন বাবার মতো, আমি থাকতাম আমার মতো, আর আমাদের দুজনের মাঝে পড়েছিলেন আমার মা। অথচ মা সবটা হাসিমুখে মানিয়ে নিয়ে চলতেন। কী করে পারতো কে জানে! হঠাৎ করেই মা একদিন অসুস্থ হয়, ভোররাতে মায়ের হার্ট অ্যাটাক হয়, মায়ের পাশে কেউ ছিল না, বাবা তখন পড়ার টেবিলে ঘুমে অচেতন ছিলেন, আর আমি… আমিও ছিলাম না।“ শৌভিকের গলার কাছটা দলা পাকিয়ে আসে। একটু জল খেয়ে নেয়। তারপর আবার বলতে শুরু করে – “বাবা আমাকে খবরটা জানায়নি। আমাকে তো বাবা নিজের ছেলে বলেই মনে করতেন না। মা মারা যাবার সাতদিনের মাথায় আমি যখন বাড়ি ফিরে সবটা জানতে পারি, নিজেকে আর সামলাতে পারিনি। বাবার ঘরের দিকে যাই, সেদিনও বাবা ঐ পড়ার টেবিলে বসে পড়াশোনা করছিলেন। টেবিলের ওপর ইতিহাস বইটা দেখে মাথায় আগুন চড়ে যায়। বাবার এই ইতিহাস-প্রীতির জন্যই আমি আমার মা-কে হারিয়েছি; এই কথাটাই বারবার মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছিল তখন। আর সামলাতে পারিনি নিজেকে। বাবার বইয়ের আলমারি তছনছ করে ফেলি, পড়ার টেবিল লণ্ডভণ্ড করে দিই, সেই মুহূর্তেই বাবা আমাকে বাঁধা দিতে আসেন, গায়ের জোরে ধাক্কা দিয়ে ফেলি দিই তাকে। হাঁফাতে হাঁফাতে আমি বসে পড়ি মাটিতে। কিছুটা শান্ত হলে তাকিয়ে দেখি রক্তাক্ত অবস্থায় বাবা মাটিতে পড়ে রয়েছে। বুকের ভেতরটা কেমন একটা করে ওঠে জানেন। অদ্ভুত একটা কষ্ট হতে শুরু করে। বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে যাই, এরপর সবটাই তো আপনার জানা।“

“অনেকটা রক্ত বেরিয়েছিল সেদিন। আমার হাতে রক্ত লেগেছিল, জামায় রক্ত লেগেছিল। বাবাকে আমি ঘৃণা করতাম, কিন্তু সেদিনের পর থেকে নিজের দিকে তাকাতেই কেমন ঘৃণা হতে লাগল। জ্ঞান ফেরার পর যখন প্রথম বাবাকে দেখতে গেলাম, ওইভাবে নিস্তেজ হয়ে শুয়ে থাকতে দেখে বাবার প্রতি কেমন মায়া হল জানেন। বাবা আর আমাকে চিনতে পারেনি সেদিনের পর থেকে… আমারও মানুষটাকে চিনতে অনেকটা দেরী হয়ে গেল, অনেকটাই দেরী হয়ে গেল।“ – একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে থেমে যায় শৌভিক।

অনুতাপে জর্জরিত শৌভিককে চুপ করে বসে থাকতে দেখে মিঃ বাসু-ই প্রথম নীরবতা ভাঙেন – “এখন কী একটু হালকা লাগছে আপনার? কষ্ট হচ্ছে না তো আর?”

…শৌভিকের সত্যিই একটু হালকা লাগছে। এতকিছু নিজের মধ্যে চেপে রাখতে বড়ই কষ্ট হচ্ছিল তার। মিঃ বাসুর চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসে সে। অনেকদিন পর শৌভিক ভালো করে চারপাশটা লক্ষ্য করল, অনেককিছু পরিবর্তন হয়ে গেছে। এলাহাবাদে থাকার দরুণ এখানকার পথঘাটের ছবি ধীরে ধীরে মাথা থেকে মুছেই যেতে বসেছিল। পাড়ার চায়ের দোকানে গিয়ে এক কাপ চা নিল। চা খেতে খেতে দোকানীকে জিজ্ঞাসা করল, “আচ্ছা দাদা, সামনে একটা খেলার মাঠ ছিল না?”

- ”হ্যাঁ, একসময় ছিল, এখন সেটা ইতিহাস হয়ে গেছে বুঝলেন দাদা। দেখছেন না সামনে সব বড় বড় ইমারত তৈরি হয়ে গিয়েছে“, হাসতে হাসতে জবাব দিল দোকানী। 

 শৌভিক বিনিময়ে কিছুটা হাসি দিয়ে আবর্জনার পাত্রে চায়ের কাপটা ফেলে দিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। শৌভিকের মনে পড়ে যায়, বাবা বলতেন, “জীবন থেকে ইতিহাসকে আলাদা করা যায় না, সভ্যতা যত এগোবে ইতিহাসের পাতায় ততোই নতুন নতুন সংযোজন হতে থাকবে। এক একটা মানুষ এক একটা যুগের সাক্ষী হয়ে বেঁচে থাকবে, এক একটা মানুষ স্বয়ং ইতিহাসের ধারাকে বয়ে নিয়ে চলবে। ইতিহাস কোনো সাল তারিখে আটকে থাকবে না, ইতিহাস অস্তিত্বে পরিণত হবে, সময়ের দলিল হয়ে থাকবে এই ইতিহাস।“


।। ৪ ।।

“আজ আমরা জানবো ‘সিন্ধু সভ্যতা’ সম্পর্কে। সিন্ধু সভ্যতা হল সেই তাম্র-প্রস্তর যুগের সভ্যতা। যে যুগে মানুষ তামা আর ব্রোঞ্জের পাশাপাশি পাথরের ব্যবহারও করতে শিখেছিল, সেই যুগকে বলা হয় তাম্র-প্রস্তর যুগ। তোমরা কি জানো, এই সভ্যতা আবিষ্কারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক প্রখ্যাত বাঙালী প্রত্নতত্ত্ববিদের নাম……”

…সমরেশ বাবু পড়িয়ে চলেছেন তার মনোজগতের ক্লাসে। সামনে চেয়ারে বসে শৌভিক মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রয়েছে তার দিকে। শৌভিকের যেন মনে হয় তার সামনে যিনি কথা বলে চলেছেন তিনি শুধুই তার বাবা নন, তিনি আসলে একজন ইতিহাসের সাধক। শৌভিক যেন ক্রমাগত সেই সাধকের সাধনায় অভিভূত হয়ে যেতে থাকে…

nayonika3@gmail.com
হাওড়া


1 comment: