1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, February 21, 2021

ভগ্নাংশ

 

ছবি  : ইন্টারনেট 

                       ভগ্নাংশ                         
ঋভু চট্টোপাধ্যায়

আজ বাজারটা এক্কেবারের ভালো নয়।সারাটা দিন বৃষ্টি।লোকজনও খুব কম।সিঁড়ির পাশে বসে বসে কালটির এত বেলাতেও পঞ্চাশ টাকাও হয় নি।বেলা কত হয়েছে স্টেশনের ঘড়িতে দেখে বুঝতে না পারলেও রোজকারের সেই লাল ট্রেনটা পেরিয়ে গেছে।তার মানে দুপুর হতে আর বেশি দেরি নেই। কোলে শুয়ে থাকা চারমাসের ভাইটা ঘুমিয়ে পড়েছে।পাশের ছোট পুঁটুলি থেকে একটা গামছা বের করে শরীরে জড়িয়ে নেয়। ফ্রকের পিছনের দিকটা ছিঁড়ে গেছে।স্টেশনের ছেলেগুলো মাঝে মাঝেই ঘিরে ধরে জামা টানা টানি করে। কালটি পুঁটুলি থেকে টিউবটা বের করে রুমালে ঢালতে যায়। এটাও শেষ, আজ আর কিনতে যায় নি। মুখে ভরতে যাবে এমন সময় নিচ থেকে একটা গলা শোনে,‘এই কালটি, তুকে ইখানে কে বইসতে বলিছে, পোঁদে বেশি রস?’ 

পাঁচটা প্ল্যাটফর্মের এই স্টেশন তাও বসা নিয়ে প্রতিদিন ঝামেলা।এখানে বসলে ওরা চেল্লায়, ওখানে বসলে অন্য কেউ চেল্লাবে। এখানেও ঝামেলা করেই বসছে।

কালটি ঘাড় ঘুরিয়ে নিচের দিকে তাকায়।আবার সেই ছেলেটা এসেছে।স্টেশনের সবাই পদা বলে ডাকে।শুধু রুমালে জেলিই মেশায় না, প্ল্যাটফর্মের ওদিকে গিয়ে চুল্লু মারে, খুব বেদো।অন্য কোন স্টেশন থেকে কয়েকদিন আগে এসে এখানে পোদ্দারি মারছে।কালটিদের মত ছোট নয়।ইয়া দামড়া ছেলে, কথায় কথায় চড় মেরে দেয়।তাও কেউ কিছু বলেনা।ফিরিতে রুমালে ঢেলে দেয়।কালটির ভালো লাগে না।কয়েকদিন আগেই সন্ধের দিকে কালটির বুকের সামনের দিকটা খামচে ধরে ছিল। কালটির চোখ দিয়ে জল বেরোলেও ছেলেটা হেসে লুটোপুটি খাচ্ছিল।কিছু ক্ষণ পরে বলে উঠল,‘বেশ বড় হয়ি গেছে।’ ওর দেখে স্টেশনের বাকি ছেলেগুলোও ওরকম করছে। কাউকে কিছু বলা যাবে না।পুলিশগুলোকে বললে ওরাও গাল দেয়। একবার লক্ষ্মীর পেটে জোর লাথি কষিয়ে দিয়েছিল।

–কিরে কি শুধালম?

কালটি কোন উত্তর না দিয়ে ভাইটাকে কোল থেকে নামিয়ে পাশে নামিয়ে রাখে।মুখে কোন উত্তর না দিয়ে বাটি থেকে পয়সাগুলো গুনছে এমন সময় নিচ থেকে পদা নামের ছেলেটা কয়েকটা সিঁড়ি উপরে উঠে এসে কালটির পিঠে এক লাথি মেরে আবার সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাবার সময় বলে ওঠে, ‘কাল থেকে বসলে এক্কেবারে নিচে ফেলে দিবো।’ 

কালটি হুমড়ি খেয়ে সামনে দিকে পড়ে।রেলিংটা ধরে না নিলে ভাইয়ের উপরেই পড়ত।তাও মাথায় আঘাত লাগে, বেশ জোরেই।আজ সকাল থেকে বৃষ্টির জন্যে একটাও টিউব আনতে পারেনি।স্টেশনের বাকি ছেলে মেয়েগুলো প্ল্যাটফর্মের অন্য দিকে চলে আছে।একটা মাল ট্রেন ঢুকেছে।ওরা সবাই ওখান থেকে মাল নামাচ্ছে ।কালটি দু’ তিন বার গেছে।লোকগুলো খুব বদ।কালটি গেলেই চেপে ধরে, বুকে মোচড় দেয়।

প্ল্যাটফর্মের ছোট মেয়েদের মধ্যে এখন কালটিরই বয়স বেশি।প্ল্যাটফর্মের তার বয়সি ছেলেগুলো ছাড়াও মুড়ির লোকটা, এমনকি সব ভিখারিগুলো পর্যন্ত দেখে। কিন্তু কেউ কিছু বলে না। একদিন ভুনি মাসিকে কথাগুলো বলতে ভুনি মাসি বলে ওঠে, ‘স্টেশনে থাকিস, দেখবে,  তার পরে গায়ে হাত দেবে না তো কি পূজা করবে? চেহারাটাও তো গাবদা হচ্ছে।তুই, তোর মায়ের কোলে কিভাবে জন্মালি সে খবর রেখেছিস? মাকেও তো এমনি করেই সবাই দেখত।’ 

কালটি কোন উত্তর দিতে পারে না।এই তো মোটে চারমাস আগে ভাইটা জন্মাবার পর তার মা এক রাতে কোথায় চলে গেল।পুটকারা বলছিল, ‘কারা যেন তুলে নিয়ে চলে গেছে, মরে  যেতে পারে।’ 

স্টেশনের পিছনের দিকের মাঠে এক পোড়া লাশ পেয়েছিল। কিছুই বোঝা যায় নি। কালটি দেখতে না গেলেও কয়েকজন বুড়ির কথা বলছিল।বুড়ি কালটির মায়ের নাম ছিল। 

স্টেশনে কেউই বাবার নাম জানে না।সবাই মাকে চেনে।পুটকা, ভজা, টুনি, রঘু, ক্যাবলা, সবার মা ছিল, বা আছে অথবা কালটির মায়ের মত কোথাও চলে গেছে।মা থাকতেও প্রায়ই রাতের দিকে কোথায় যেন চলে যেত। কালটি শুত ওভার ব্রিজটার উপরে।কোন দিন মা ফিরত, কোন দিন........। 

একটু বৃষ্টিটা থেমেছে।শালা পটার বাচ্চা পিঠে লাথিটা খুব জোরেই মেরেছে।এখনও ব্যথা আছে।ওভার ব্রিজের মাঝখানটা  থেকে নেমে কালির চায়ের দোকানের দিকে পা বাড়ায়।পয়সাগুলো দিয়ে দশটাকার নোট নিতে হবে। যেতে সময় লাগে। হাঁটলে পিঠে ব্যথা লাগছে। দোকানে যেতেই কালি বলে উঠল, ‘আজ আর টাকা নিয়ে কি করবি, রিক্সা স্ট্যাণ্ডের কাছের মন্দির থেকে খিচুড়ি দিচ্ছে। গিয়ে খেয়ে নে গা।’

-খিচুড়ি দিছে? কই আমাকে তো কেউ বলে নাই, কারা দিছে ঐ সাদা মাগিগুলো?

-তা আমি জানি না। এখান থেকে তো দেখা যায় না।  

-কিন্তু আমি তো কিছু আনি নাই।তুমি একটা কিছু দাও।

একটা মেয়েদের দল আছে।কি সুন্দর সবাইকে দেখতে।প্যান্ট আর শার্ট পরে সবাই আসে। প্ল্যাটফর্মে ঘুরে বুড়ো বুড়িদের ওষুধ দেয়, কালটিদের খাবার,খেলনা খাতা বই, জামা কাপড় কত কিছু দেয়, নেশা করতে বারণ করে।মাঝে মাঝে ওরাই স্টেশনের বাইরে দাঁড়িয়ে খাবার দেয়।অনেক সময় ছয় নম্বর প্ল্যাটফর্মে গিয়ে পড়াশোনা শেখায়। সবাই ফর্সা দিদি বলে ডাকে, বা ফর্সা মাগি। 

চায়ের দোকানের কালি কালটির হাতে একটা বড় থালা দিয়ে বলে, ‘তাড়াতাড়ি ফেরত দিয়ে যাবি।’ 

বৃষ্টিটা একটু থামার জন্যে খিচুড়ির লাইনে বেশ ভিড়। কালটি অনেককেই চিনতে পারে। স্টেশনের বাইরেরও অনেক জন লাইনে দাঁড়িয়ে খিচুড়ি নেয়।কালটিকে দেখে পটলা নামের একটা ভুটকো ছেলেটা বলে ওঠে, ‘তুই আবার আজ ওভার ব্রিজের মাঝে বসেছিস? তোকে সেদিন বারণ করলাম যে।’ কালটি কোন উত্তর না দিয়ে লাইনে বাকি সবার মত দাঁড়িয়ে থাকে।কোন উত্তর না পেয়ে পটা নিজের থেকেই বলে,‘এবার বসতে দেখলে লাথি মেরে নিচে ফেলে দেবো।’ 

–খানকির ব্যাটা, স্টেশনটা তুর বাপের, আমি ওখানেই বসব। 

এই বসা নিয়ে কয়েক দিন ধরেই কালটির সাথে পটাদের ঝামেলা চলছে।আগে যখন ওদের সাথে থাকত, পাশে বসত, এক রুমালে জেলি নিত, তখন কিছু বলত না। ওরাও সময় অসময়ে কালটির বুক খামচে ধরত, জামা বা প্যান্টের ভিতর হাত ঢুকিয়ে দিত।কালটি আগে কিছু বলত না। যেদিন প্যান্টের পিছন দিকটা রক্তে ভিজে গেল লক্ষ্মী মাসি দেখেই নিজের পোঁটলা থেকে একটা পাঁউরুটির মত একটা লম্বা জিনিস বের করে।ভেতরে আবার তুলো আছে।তারপর বাথরুমে নিয়ে যায়। স্টেশনের পাশে স্বাস্থ্যের কোন দিদিমণির ঘর থেকে এই পাউরুটির মত জিনিস গুলো পাওয়া যাবে সেটাও দেখিয়ে দেয়। কয়েকদিন পরে ফর্সা দিদিগুলোও কালটিদের ওগুলো দেয়। লক্ষ্মী মাসিই সেদিন কালটিকে পটাদের থেকে সরে তাদের সঙ্গে থাকতে বলে।কালটি ভাবে তাদের সাথে থাকা মানেই তো সন্ধে নামলেই সেজে গুজে এদিক ওদিক দাঁড়িয়ে থাকা বা ফাঁকা ট্রেনের কামরার ভিতর রেল পুলিশ বা হকারদের সাথে উঠে যাওয়া। 

‘লক্ষ্মীদের সাথে থাকলে তোর অবস্থাটাও তোর মায়ের মতই হবে।’ 

এই কথাগুলো সাদা বুড়ি একদিন দুপুরের দিকে খেতে বসে বলেছিল।সেদিনও স্টেশনের পাঁচ নম্বর প্ল্যাটফর্মের কাছের কালি মন্দিরে খিচুড়ি দিচ্ছিল।তার উপর এই বাচ্চাটা আছে।কালটি তারপর থেকেই একাই থাকবার চেষ্টা করে।তাও কি উপায় আছে, কারণে অকারণে লোকজন অত্যাচার করে।রাতের অন্ধকারে লোকজনের হাত শরীরের এদিক ওদিক চড়ে বেড়ায়।কিছু বলতে গেলেই মুখ চেপে ধরে।তারপর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ঘা, জেলিটা টেনে টেনে নাক দিয়ে সব সময় জল পড়ে।এর মাঝে এই বসার জায়গা নিয়ে রোজ কিচাইন, ভালো লাগে না।

কয়েক দিন আগে কালটি চার নম্বর প্ল্যাটফর্মে বসে ছিল, ঠিক ওভার ব্রিজের নিচটাতে।যে নামছিল বা উঠছিল সবার পা ধরে ভিক্ষা চাইছিল।এমন করে তার মা ভিক্ষা করতে শিখিয়েছিল।কোলে ভাইটা ছিল।প্ল্যাটফর্মে রাতের আলো জ্বলে উঠেছিল।তবু লোকজনের ওঠা নামা ছিল।এই সময় প্ল্যাটফর্মটা ভিড় হয়।অনেকগুলো খুচরোই হয়েছিল।এমন সময় কোলের বাচ্চাটা চেল্লাতে আরম্ভ করে।কালটি অনেক চেষ্টা করে কান্না থামাতে না পেরে উঠে কলের ধারে বসে।ভাইটা তখনও কেঁদেই যায়।কালটি চারদিকটা দেখে নিজের বুকটা ভাইয়ের ঠোঁটে গুজে দেয়।ভাই চুপ করে গেলেও কালটির শরীরে একটা শিহরণ আসে।পায়ের আঙুলগুলোয় সুড়সুড়ি লাগে হাত পায়ে একটা অন্য রকমের অনুভূতি আসে।পাশ থেকে চা বিক্রি করার মছুয়া বলে, ‘তোর এই বয়সেই দুধ হয়ে গেছে নাকি রে?’ তারপরেই হো হো করে হেসে ওঠে।

কিছুক্ষণ পরেই মুড়ি বিক্রির ল্যাংড়াদা কাছে বসে কয়েকটা কথা বলবার পরে বলে ওঠে, ‘শোন একটা কথা বলি, এই বাচ্চাটাকে তুই আমাকে দিয়ে দে, অনেক লোক নিতে আসে,  কিছু টাকা পাবি, আর খাওয়ার কোন চিন্তা থাকবে না।’ 

ভয় পেয়ে যায় কালটি।ভাইটাকে বুকের মধ্যে আরো চেপে ধরে চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম  থেকে সরে যায়।তারপর থেকে রাতে ভালো করে ঘুম হয় না। এমনিতে ওভার ব্রিজের উপর শুলে সারা রাত ট্রেনের আওয়াজ আর দোলানিতে স্টেশন বা প্ল্যাটফর্মে শুয়ে থাকা কারোরই ঘুম হয় না। পটারা আবার এখন রাতে এদিক ওদিক চলে যায়। অনেক মালপত্র চালান করে। ভাইটাকে যদি অন্য কোথাও চালান করে দেয়? 

-তুই এখানে লাইনে দাঁড়িয়ে আছিস, ওদিকে তোর বাচ্চাটা কেঁদেই যাচ্ছে, গিয়ে দ্যাখ।   

ভাইটাকে সবাই এমনি ভাবে ‘তোর বাচ্চা’ বলে। অন্য সময় হলে কালটি রেগেও যায়।

বুধার মুখে কথাগুলো শুনে কালটি থালাটা ফেলেই ওভার ব্রিজের মাঝের সিঁড়িটাতে পৌঁছে যায়। বাচ্চাটা তখন হাত পা এদিক ওদিক ছুঁড়ে কাঁদছে।কালটি তার পাশে বসে তাকে কোলে নিয়ে নিজের শুকনো বুকে আবার বাচ্চাটার ঠোঁট লাগিয়ে কান্না থামায়। কিছু সময় পরেই ওভার ব্রিজের নিচে পদারা এসে হাজির হয়। কালটি তাদের দেখেই ভয়ে আবার শিউড়ে ওঠে।পদা কালটির দিকে তাকিয়ে বলে,‘তুই কিন্তু কাল থেকে এখানে বসবি না, সব  ফেলে দেব।’

এবার কালটি রেগে উঠে চিৎকার করে ওঠে,‘আমি এখানেই বসব। তুরা যা করার করবি।’

–খুব রস না, খুব রস? 

কথাগুলো বলতে বলতেই পদারা ওভার ব্রিজের উপর উঠে এসে কালটির পুঁটুলিটা নিয়ে টানাটানি আরম্ভ করে।কালটিও টান দেয়।টানাটানিতে পেরে না উঠে হাতের পাশে থাকা ভিক্ষা নেওয়ার থালাটা পটার দিকে ছুঁড়ে মারে। পটার মাথায় লেগে থালা ওভার ব্রিজের বিমের ধাক্কা খায়।তারপর ওভারব্রিজের উপর থেকে নিচে পড়ে। নিচে থাকা কোন এক প্যাসেঞ্জারের গায়ে আঘাত লাগে।ওভার ব্রিজের উপরে তখনও পটারা দাঁড়িয়ে থাকে।কিছু সময়ে পরেই হৈ হৈ করে রেল পুলিশ কালটিদের তেড়ে আসে।পটারা আগেই পালিয়ে গেলে কোলে পাঁচ মাসের বাচ্চা ভাইটাকে নিয়ে কালটি ছুটতে পারে না। পুলিশ এসে সটান লাঠি চালিয়ে দেয়।কালটির পিঠে লাগে।পুঁটুলি, থালা বাটিতে লাথি মারে।উপর থেকে সব কিছু ওভার ব্রিজের উপর থেকে ছড়িয়ে যায়। পিঠে লাঠি খেয়েও কালটি ভাইকে কোলে নিয়ে আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে নেমে প্ল্যাটফর্মে ছড়িয়ে থাকা সব জিনিসগুলো একে একে তুলে একটা ছেঁড়া ব্যাগের ভিতর ভরে রাখে।সব জিনিসে কাদা লাগে, জল লাগে। তবে কালটির কান্নার ফোঁটাগুলো কেউই দেখতে পায় না। 

                                                 ২ 

স্টেশনটা কালটিকে ছাড়তে হয়।এখন বাসস্ট্যাণ্ডে বসে।ওখানেই একধারে রাতে ঘুমায়।অবশ্য বাসস্ট্যাণ্ড আর স্টেশন প্রায় কাছাকাছি। পুটেরা প্রায়ই আসে।শুধু তাই নয় মুড়ির লোকগুলোও মাঝে মাঝে চলে আসে।একদিন ল্যাংড়া কালটির কাছে এসে বলে,‘কি রে ছুটকি কিছু ভাবলি? এটা তো সত্যি ভাইতো?’

কালটি কোন উত্তর না দিয়ে বসে থাকে। কিছু সময় পর ল্যাংড়া আবার বলে,‘শোন এটাকে বিচে দে, যা টাকা পাবি আরামে বাঁচতে পারবি।তোর যখন এরকম মাল বেরোবে তাদের কোথায় রাখবি?’

-কালটির মুড়ির লোকটাকে খিস্তি করে তাড়িয়ে দেয়। বাস স্ট্যাণ্ডেও কালটির নির্দিষ্ট কোন ছাদ নেই। এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়। এখানেও অনেকে খিস্তি দেয়।সময় পেলেই গায়ে হাত দেয়, ইশারা করে ডাকে তবে কোলে ভাইটা থাকবার জন্যে দু’ একবার কিছু বলবার পর চুপ করে যায়।

বাসস্যাণ্ডে আরেকটা উল্টো সমস্যা এসে দাঁড়িয়েছে।লোকেরা ভিক্ষা দিলেও কথায় কথায় জিজ্ঞেস করে, ‘কি’রে এই বয়সেই মাল বেরিয়ে গেছে? বাবা কি কোন মানুষ না.... বয়স তো তেরো চোদ্দর বেশি হবে না।’ 

কালটি চুপ করে সব কথা শোনে। কি বলবে, এক্ষুণি এক পয়সাও না দিয়ে চলে যাবে।এখানেও কেউ বাস ধরবার জন্যে দাঁড়িয়ে বা বসে থাকলে কালটি কাছে এসে প্যান্ট বা শাড়ি ধরে টানাটানি করে। কেউ বিরক্ত হয়ে ঐ সব কথা বলে, কেউ কেউ তাড়িয়ে দেয়।তবে বেশির ভাগই কিছু পয়সা অন্তত দেয়।কয়েকটা দিন ছোটখাটো অসুবিধার পরে বাসস্ট্যাণ্ডও এখানে থাকা লোকজনগুলো কালটির পরিচিত হয়ে ওঠে।তাও প্রতিদিন দুপুর ও রাতে একবার করে স্টেশনের দিকে যেতে হয়।কে কোন দিন খাওয়াবে বলা যায় কি? সেদিন আবার বাসস্ট্যাণ্ডে সেই ফর্সা দিদিগুলোকে দেখে। কালটিকে চিনতে না পারলেও স্টেশনের মত খাবার, খাতা বই এমনকি সেই পাউরুটির মত বড় তুলোর কতগুলো প্যাকেট দিয়ে বিভিন্ন রকমের প্রশ্ন করে। মেয়ে হলেও তাদের সামনে ঐ সব উত্তর দিতে কালটির লজ্জা লাগে। কালটির কোলে বাচ্চাটাকে দেখে তাদেরও ধারণা হয়ে যায় এটা হয়তো কালটিরই ছেলে। ওদের মধ্যে একটা মেয়ে কেমন যেন। কালটির কোল থেকে বাচ্চাটাকে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কি সব দেখে।তারপরের দিন একাই এসে বাচ্চাটার জন্যে দুটো নতুন জামা প্যান্ট কিনে দেয়।কালটি জামা প্যান্টটা পরালেও একদিন ঐ মেয়েটাকে ল্যাংড়া মুড়ির লোকটার সাথে কথা বলতে দেখেছে।কালটি তাড়াতাড়ি এসে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে বসে থাকে। তারপর দিন অবশ্য সব কিছু আবার ভুলে যায়। কয়েকটা দিন পরে এক রাতে কালটির শুতে অনেক রাত হয়ে যায়। সেদিনও আবার স্টেশনে কারা সব রাতেও খাবার দিচ্ছিল। তারপর রাতে বাস স্ট্যাণ্ডে এসে দেখে সেই ফর্সা দিদিদের দুজন বাস স্ট্যাণ্ডে ঘুরে বেড়াচ্ছে।কালটি স্ট্যাণ্ডে যেতেই তারা কাছে এসে বিভিন্ন রকমের কথা বলে, কালটির শরীরের খোঁজ নেয়।বাচ্চাটাকে কোলে তুলে আদর করে।কালটিকে একটা বড় বিস্কুট খেতে দেয়। বিস্কুটটা খুব সুন্দর দেখতে। রাতের খাবার খেয়ে এলেও কালটির বিস্কুটটা দেখে খুব লোভ হয়।ঐ ফর্সা দিদিগুলোর সামনেই একটু একটু করে অনেকটাই খেয়ে ফেলে।তারপরেই বাসস্ট্যাণ্ডের চারদিকটা অন্ধকার হয়ে যায়। পাশে শুয়ে থাকা বাচ্চাটাও কেমন যেন ধোঁয়া ধোঁয়া। 

                                              ৩ 

কালটিকে আবার পুটেদের সাথেই দেখা যায়। আবার সেই মুখে রুমাল ভরা, হাঁটু পর্যন্ত একটা ছেঁড়া জামা কোন দিন গায়ে একটা গামছা ঢাকা দেওয়া থাকে। এখন আর ফর্সা দিদিমণিদের থেকে খাতা বই খাবার কিছুই নেয় না। খাবার দিলেও ফেলে দেয় বা স্টেশনের কুকুরগুলোকে দিয়ে দেয়।কখনো বা সব কিছু এমনিই পড়ে থাকে।পুটেরা আর কথায় কথায় জামার ভিতর হাত ভরে দেয় না। কালটি এক পাশে এমনিই শুয়ে থাকে। রাতে মাঝে মাঝেই জ্বর আসে, সকালে কাশে, কোন রকম জলস নেই।অনেকেই তাকে নানা রকম কথার মাঝে জিজ্ঞেস করে, ‘তোর ভাইটার কোন খোঁজ পেলি না?’ কালটি  চিৎকার করে বলতে পারে না, ‘আমি ঐ ফর্সা দিদি দুটোকে চিনি। ঐ রাতে ওরাই আমাকে.....’  তবে চোখ দুটো দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।

wribhuwriter.dgp@gmail.com
পশ্চিম বর্ধমান


No comments:

Post a Comment