1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, February 21, 2021

হানাবাড়িতে হানাদারি

 

ছবি  : ইন্টারনেট 

হানাবাড়িতে হানাদারি
কৌস্তুভ বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রথমে খেয়াল করিনি, হাঠাৎ মানুষের গলার আওয়াজ পেয়ে তাকিয়ে দেখি, এক ভদ্রলোক মাথা থেকে পা পর্যন্ত চাদর মুড়ি দিয়ে বসে। বললেন, ‘গল্পের শেষটা একটু ভুল হল বাবু।’
রতনদার চায়ের দোকানে বসে আছি আমরা। অনুপম, শতানীক, মণীশ আর আমি। শীতকাল। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে ঝমঝম করে। বায়ুমন্ডলে কী একটা গোলমালের জেরে বৃষ্টি পড়ছে সকাল থেকে। বিকেলে একটু থেমেছিল। এখন আবার নামল অঝোরধারে।
মণীশ বলল, ‘আজ আর বোধহয় কেউ আসবে না।’
‘মনে তো হয় না,’ অনুপম বলল। ‘যা বৃষ্টি নেমেছে বাড়ি ফিরতে পারলে হয়।’
রতনদা বলল, ‘কুছ পরোয়া নেই। চালে-ডালে খিচুড়ি বসিয়ে দিচ্ছি।’
বাইরে বৃষ্টির দাপট বাড়ছে। সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়ার ক্রুদ্ধ গর্জন। চায়ের দোকান হলেও রতনদার এই ঘরটি বেশ আরামদায়ক। মজবুত গাঁথনি। ভেঙে পড়ার আশঙ্কা নেই। ঝড়-বৃষ্টির দাপট বাড়লেও আমরা তাই নিশঙ্কভাবে বসে। শতানীক এতক্ষণ একটা খবরের কাগজ পড়ছিল মনযোগ দিয়ে। হঠাৎ লোডশেডিং হতেই বিরক্ত হয়ে ছুড়ে দিল সেটা। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী পড়ছিলি?’
‘আজকের কাগজে হানাবাড়ি নিয়ে বেশ ইন্টারেস্টিং খবর বেরিয়েছে একটা,’ শতানীক উত্তর দিল। ‘সেটাই পড়ছিলাম আর কি।’
‘কী খবর?’ জানতে চাইলাম আমি।
শতানীক বলতে যাবে হঠাৎ হুড়মুড় করে কে একজন ঢুকে এল। আবছা অন্ধকারে প্রথমটায় ঠাহর হয় নি। পরে দেখি, প্রদীপ্তকাকু। ভদ্রলোককে এসময় এখানে আশা করি নি। তবু ভদ্রলোকের অবস্থা দেখে করুণা হল। পরনের খদ্দরের পাঞ্জাবিটা ভিজে সপসপ করছে। বললাম, ‘এ-হেঃ ভিজে তো একেবারে কাক হয়ে গেছেন! আসুন, আসুন। ভিতরে আসুন।’
একটা রুমাল দিয়ে মাথাটা মুছতে মুছতে ভিতরে ঢুকে এলেন ভদ্রলোক। মুখখানাকে কাঁচুমাচু করে বললেন, ‘অমলের বাড়ি গিয়েছিলাম। ফেরার পথে হঠাৎ বৃষ্টি নামল ঝমঝম করে। মাথা বাঁচাতে তাই এই দোকানেই ঢুকে এলাম।’
‘বেশ করেছেন। বসুন, একটু চা খান,’ অনুপম বলল।
ভেজা পাঞ্জাবিটা খুলে প্রথমে সেটাকে ভালোভাবে নিংড়ে দড়িতে টাঙিয়ে দিলেন। তারপর রতনদার কাছে একটা চাদর চেয়ে নিয়ে সেটাকে ভালোভাবে জড়িয়ে প্রদীপ্তকাকু একটা হাতলভাঙা চেয়ারে এসে বসলেন। 
ভদ্রলোক বাবার ছেলেবেলার বন্ধু। এখন অবশ্য কর্মসূত্রে ছত্তিশগড়ের বাসিন্দা। বললেন, কলকাতা এসেছিলেন কি একটা কাজে। কাজ মিটিয়ে আবার ছত্তিশগড় ফিরে যাওয়ার আগে একবার সহজপুর এসেছেন সবার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতে। 
কথার মাঝেই রতনদা চা দিয়ে গেল। চায়ে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে ভদ্রলোক বললেন, ‘তোমাদের আসরটা বোধহয় আমি মাটি করে দিলাম।’ ভদ্রলোকের গলায় অপরাধবোধের সূর।
কাকুকে থামিয়ে দিয়ে শতানীক বলল, ‘না, না। আসর আর কি! খবরের কাগজে হানাবাড়ি নিয়ে একটা খবর বেরিয়েছে, সেই নিয়েই কথা বলছিলাম।’
‘হানাবাড়ি? চমৎকার।’ ভদ্রলোকের চোখ দু’খানা যেন উৎসাহে জ্বলজ্বল করে উঠল। বললেন, ‘এই বৃষ্টি-বাদলের সন্ধ্যেয় গল্পের বিষয় বাছাইটা মন্দ হয় নি। বেশ ইন্টারেস্টিং! তা কী গল্প হচ্ছিল হানাবাড়ি নিয়ে?’
বাবার কাছে প্রদীপ্তকাকুর অনেক গল্প শুনেছি।ভদ্রলোক নাকি গল্পের জাহাজ। একটা সময় কাজের সূত্রে সারা দেশ চষে বেরিয়েছেন। অভিজ্ঞতার ঝুলিটা তাই একেবারে পরিপূর্ণ। আমি বললাম, ‘ওসব বাদ দিন। আপনি বরং একখানা গল্প বলুন।’
এক চুমুকে চায়ের বাকী অংশটুকু শেষ করে প্রদীপ্তকাকু থম্ মেরে বসে রইলেন কিছুক্ষণ, হয়তো মনে মনে গল্পটা একটু গুছিয়ে নিলেন। তারপর শুরু করলেন—
সে অনেকদিন আগের কথা। তখন বোধহয় তোমাদের জন্মই হয় নি। আমাদের এই সহজপুরে ভীষণ সুন্দর বাড়ি ছিল একটা। এখান থেকে চাঁদনির দিকে যেতে রাস্তাটা যেখানে রানিদীঘির দিকে বেঁকে গেছে, ঠিক ওইখানে। অনেকটা জমির ওপর ভীষণ সুন্দর একটা বাড়ি। আমরা বলতাম ‘সাহেব-বাংলো’। বাড়ির সামনে ঢেউ খেলানো লন। তাতে কেয়ারি করা ফুলের ঝাড়। একপাশে নুড়ি বিছানো ড্রাইভওয়ে। লনের ঠিক মাঝখানে একখানা ছোট্ট পুকুর। তাতে আবার একটা পদ্ম ফুল ফুটে আছে। এক সাহেব বাড়িটা বানিয়েছিলেন। শুনেছিলাম, বিদেশ থেকে স্থপতি আনিয়ে বাড়িখানা তিনি বানিয়েছিলেন। 
আমি যখনকার কথা বলছি, তখন অবশ্য সাহেব আর বেঁচে নেই। মেমসাহেবও ছেলের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া চলে গেলেন। বাড়িটা অবশ্য পড়েই রইল। হানাবাড়ি বলে দুর্নামও একটু হয়েছিল, এলাকার লোকজন তাই খুব একটা ধারেকাছে ঘেঁষত না। 
অম্বুজাক্ষ চৌধুরি নামে এক ভদ্রলোক অনেক চেষ্টা চরিত্র করে বাড়িখানা কিনে ফেললেন। তারপর মেরামত-টেরামত করে বসবাস করতে শুরু করে দিলেন। ভদ্রলোক নাকি জাহাজে চাকরি করে অনেক টাকা রোজগার করেছিলেন। তারই কিছুটা সদ্ব্যবহার করতেই বাড়িটা কেনা। ভদ্রলোক বাড়িখানা কিনলেন বটে, তবে তাঁর সুখ বেশিদিন স্থায়ী হল না। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই কি একটা অজানা জ্বরে দেড় দিনের মাথায় তাঁর স্ত্রী মারা গেলেন। লোকে অবশ্য বলল, ‘ওই সাহেবই চৌধুরি-গিন্নীকে খেয়েছে।’ 
স্ত্রী মারা যাওয়ার পর ভদ্রলোক একেবারে একা হয়ে গেলেন। তাঁর দুই মেয়ে। একজন থাকে ইস্তাম্বুলে, আর অন্যজন ইন্দোনেশিয়ায়। তারা অবশ্য বাবাকে নিজেদের কাছে নিয়ে যাবার জন্যে পেড়াপিড়ি করল। কিন্তু অম্বুজবাবু রাজি হলেন না। তার বদলে ভদ্রলোক দুম করে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন। ঠিক করলেন, বাড়িখানা তিনি বিক্রি করে দেবেন। এমনিতেই অতবড় একটা বাড়ি কেনার মতো লোক তখন সহজপুরের বিশেষ একটা ছিল না। তার ওপর ভদ্রলোকের অদ্ভুত শর্ত। অম্বুজবাবু শর্ত দিলেন, বাড়িখানা তিনি বিক্রি করবেন বটে, তবে যতদিন তিনি জীবিত থাকবেন ততদিন তিনিই ও-বাড়ির ভোগদখল করবেন। তিনি মারা যাবার পর ক্রেতা ও বাড়ির দখল পাবে।
যদিবা দু-একজন খদ্দের জোটে, অম্বুজবাবুর শর্ত শুনে পালানোর পথ পায় না। অবশেষে একজনকে পাওয়া গেল, যিনি শর্ত সমেত অম্বুজবাবুর বাড়িখানা কিনতে চান। তিনি মাধবসখা দত্ত। 
শুনেছিলাম, মাধববাবু বেশ জলের দরেই বাড়িটা কিনেছিলেন। বাড়িখানা কেনার পর ভদ্রলোককে অবশ্য বেশীদিন অপেক্ষা করতে হল না। মাস ছয়েক যেতে না যেতেই এক রাতে অম্বুজবাবু ঘুমের মধ্যে হার্টফেল করে মারা গেলেন। এলাকার লোকজন বলল, ‘এ নির্ঘাৎ ওই মার্টিন সাহেবের কান্ড। না হলে অমন সুস্থ-সবল মানুষটা হঠাৎ এমনভাবে মারা যায়!’
যাইহোক, শর্ত অনুযায়ী মাধববাবু বাড়ির দখল নিলেন।
বাড়িটি একটু সাফ-সুতরো করার জন্যে একদিন ভদ্রলোক জন কয়েক মজুর লাগালেন। লনের আগাছা পরিস্কার, ভাঙা কেয়ারি মেরামত, দেওয়ালের কলি ফেরানো। প্রথম দিন ভদ্রলোক নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সবকিছু তদারক করছিলেন। এই দুপুর বেলাটায় একটু বিশ্রাম নেবেন বলে যেই ভিতরে ঢুকেছেন, অমনি মজুরের দল হুড়মুড় করে দৌড়ে এল।
‘কি ব্যাপার?’
ওরা বলল, ‘আমাদের পাওনা-গন্ডা মিটিয়ে দিন, আমরা পালাই।’
মাধববাবু তো থ। ‘কেন? কি এমন হল যে কাজকর্ম ফেলে পালাতে চাইছ?’
প্রথমটায় ওরা বলতে চাইছিল না কিছু। অনেক চাপাচাপিতে একজন মাতব্বর গোছের লোক এগিয়ে এসে বলল, ‘বাড়িতে ভূত আছে বাবু।’
‘ভূত?’ মনে মনে হেসে ফেললেন মাধববাবু। মজুরি বাড়ানোর পুরনো কৌশল এসব।
‘হ্যাঁ, বাবু,’ একজনকে দেখিয়ে সেই মাতব্বরটি বলল, ‘এ ডোবার জঞ্জাল পরিস্কার করছিল। একটা লতা পরিটাকে এমন পেঁচিয়ে ধরেছিল, সেটাকে ছিঁড়তে গিয়ে পরিটার ডানার একটা অংশ ভেঙে গেল। অমনি কোথা থেকে একজন খিটখিটে বুড়ো মানুষ এসে ওকে গালি-গালাজ করতে শুরু করে দিল। আমি এই এলাকারই মানুষ। মার্টিন সাহেবকে চিনতে আমার ভুল হয় নি।’
‘মার্টিন সাহেব? ঠিক দেখেছ?’ মাধববাবু জানতে চাইলেন।
লোকটি বলল, ‘নিজের চোখে দেখা জিনিস ভুল বলি কি করে, বাবু?’
ওরা চলে গেল। মাধববাবু মজুরি বাড়ানোর প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু কোনও কিছুতেই রাজি হল না ওরা। বলল, ‘জীবনটা তো আগে। বেঁচে থাকলে জীবনে এমন অনেক রোজগার হবে।’
এদিকে মাধববাবু পড়লেন ফ্যাসাদে। তাঁর গৃহ-প্রবেশের দিন এগিয়ে আসছে, অথচ বাড়িখানা সাফ-সুতরো করার লোক পাচ্ছেন না। মার্টিন সাহেবের ভূত দেখার কথাটা এমনভাবে চাউর হয়েছে যে কাছে-পিঠের কোনও লোকই আর সাহেব-বাংলোয় কাজ করতে আসতে রাজি নয়। দূর-দুরান্ত থেকে দু-এক জনকে নিয়ে এলেন। কিন্তু সকাল হতে না হতে তারাও কেটে পড়ল। নিরুপায় হয়ে ভদ্রলোক শেষ পর্যন্ত পারিবারিক গুরুদেবের শরণ নিলেন। অনেক বিচার-বিশ্লেষণ করে গুরুদেব জানালেন, ‘এ বাড়ি দোষ পেয়েছে। খন্ডন করতে হবে।’ মাধববাবুর অবশ্য এসবে তেমন বিশ্বাস ছিল না। এখন বাধ্য হয়ে এসব মেনে নিলেন।
গুরুদেবের কথা মতো দিন-ক্ষণ দেখে নির্দিষ্ট দিনে পূজার্চনার কাজ শুরু হল। সারাদিনটা বেশ নির্বিঘ্নেই কাটল। সবাই মোটামুটি নিশ্চিন্ত। হঠাৎ বিকেল বেলাটায় এমন একটা কান্ড ঘটল, যার জন্যে কেউই প্রস্তুত ছিল না। সেদিন বিকেল বেলাটায় মাধববাবুর এক আত্মীয় বাড়ির লনে একটা চেয়ার পেতে বসে কাজের তদারক করছিলেন। হঠাৎ বলা-নেই-কওয়া-নেই, কোথা থেকে একখানা ফুলের টব এসে পড়ল তাঁর মাথায়। একেবারে রক্তারক্তি কান্ড। মাধববাবু সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রলোককে নিয়ে হাসপাতালে দৌড়লেন। ডাক্তারবাবুরা অনেক পরীক্ষার-নিরিক্ষা করে জানালেন, আঘাত তেমন গুরুতর নয়। তবে সে রাতটা ভদ্রলোককে ওখানেই থেকে যেতে হবে। সমস্ত বন্দোবস্ত করে মাধববাবু ফিরে এলেন। গুরুদেবের নির্দেশ মতো সে রাতটা তাঁকে ও-বাড়িতেই কাটাতে হবে। 
একটা ঘর মোটামুটি সাফ-সুতরো করাই ছিল। রাতটুকু ভদ্রলোক সেই ঘরেই আশ্রয় নিলেন। বিছানায় পড়তে না পড়তেই সারাদিনের পরিশ্রম, উৎকন্ঠা আর ধকল তাদের শোধ তুলে নিল। মুহূর্তে তলিয়ে গেলেন ঘুমের অতলে। কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলেন কে জানে, হঠাৎ একটা আওয়াজে তাঁর ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ভাঙার পর কয়েক মুহূর্ত সময় লাগল ধাতস্ত হতে। তারপর মাধববাবু স্পষ্ট শুনতে পেলেন একটা গমগমে আওয়াজে কে যেন তাঁকে উদ্দেশ করেই বলল, ‘বাড়ি না ছাড়লে এরকম অনেক হবে।’
প্রথমটায় ভদ্রলোক একটু ঘাবড়ে গেলেন ঠিকই, তবে তিনিও সাতঘাটের জল খাওয়া মানুষ। খুব দ্রুত সামলে নিলেন নিজেকে। বললেন, ‘কে আপনি? হিম্মত থাকলে সামনে আসুন।’ 
ভুতুড়ে কন্ঠস্বরটি সরাসরি সে কথার উত্তর দিল না। বলল, ‘এ বাড়ি না ছাড়লে ভীষণ পস্তাতে হবে।’
ভদ্রলোকের মুখে এক চিলতে হাসি খেলে গেল। প্রথমদিনেই তিনি আন্দাজ করেছিলেন, কোথাও যে একটা গোলমাল আছে। সেইমতো আটঘাট বেঁধে তৈরি ছিলেন। হরিহর নামের এক বিশ্বস্ত অনুচরকে তিনি খবর সংগ্রহের কাজে লাগিয়ে দিলেন। সেই একদিন খবর এনে দিল।
অম্বুজবাবুর বাড়ির ঠিক পিছনেই একটি ক্লাব। এই ক্লাবের ছেলেদের সঙ্গে ভদ্রলোকের দীর্ঘদিনের বিবাদ। অল্প বয়সী ছেলেছোকরার দল। সামান্য কারণে তারস্বরে গান বাজিয়ে আমোদ-ফূর্তি করাতেই তাদের আনন্দ। আর এই নিয়েই ভদ্রলোকের সঙ্গে বিবাদ। 
এমনিতেই এইসব হই-হুল্লোড় ভদ্রলোকের একেবারে না-পসন্দ। নিজে টার্মিনাল পেশেন্ট। মৃত্যুর দিন গুনছেন। তার ওপর স্ত্রীর মৃত্যু তাঁর এই নিঃসঙ্গপ্রিয়তাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। অথচ এরা এক মূহূর্তও শান্তি দিতে চায় না।
সে রাতেও এমনই হই-হুল্লোড়ে মেতেছিল ওরা। সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন বাইরে। একবার ভাবলেন, থানায় একটা খবর দেবেন। কিন্তু, আজকালকার পুলিশের ওপর বিশেষ শ্রদ্ধাভক্তি তাঁর নেই। নিজের কাজ নিজের নিজে-নিজে করাতেই তাঁর আগ্রহ।। 
বাড়িতে একখানা লাঠি ছিল। মোটা, শক্ত। গিঁটগুলো লোহা দিয়ে বাঁধানো। লাঠিখানা হাতে নিয়ে ভদ্রলোক বেরিয়ে পড়লেন। ক্লাবের ভিতরে ছেলেরা নিজেদের নিয়েই মত্ত। ভদ্রলোক ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন। শব্দের উৎস খুঁজে লাঠিখানা বসিয়ে দিলেন। একবার, দু’বার, তিনবার…
প্রথমটায় ওরা টের পায়নি কিছুই। হঠাৎ শব্দ পেয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। ভদ্রলোক ধরা পড়ে গেলেন। তারপর নানা কটু-কাটব্য, লাঞ্ছনা, অপমান সহ্য করে একসময় বাড়ি ফিরে এলেন। সে রাতেই দেহ রাখলেন তিনি।
অম্বুজবাবু মারা যেতে ওরা ভেবেছিল, যাক্, পথের কাঁটা সরল। বাড়িটা এবার নিশর্ত ভোগ-দখলের অধিকার পাওয়া গেল। কিন্তু রঙ্গমঞ্চে হঠাৎ মাধববাবুর আবির্ভাব হওয়াতে প্রমাদ গুনল ওরা। এই মানুষটাকে সরাতে না পারলে সবকিছুই ভেস্তে যাবে। ওই মানুষটিকে সরানোর জন্যেই মতলব আঁটল ওরা। ভুতের বাড়ি হিসেবে এক সময় বাড়িটার দুর্নাম ছিল। সেটাকেই কাজে লাগাতে চাইল ওরা।
ভূত-বাবাজি ধরা পড়ে গেল। পুলিশের লাঠির ঘায়ে স্বীকার করে নিল সব কথা। তারপর থেকে ও বাড়িতে আর ভূতের উৎপাত হয় নি।
শতানীক বলল, ‘এ তো দেখছি, হানাবাড়িতে হানাদারি। এভাবে ভয় দেখিয়ে বাড়ি দখল করা এখনকার ধুরন্ধর প্রোমোটারদেরও লজ্জা দেবে।’ 
গল্প শেষ। বৃষ্টিও ধরে এসেছে। আর এক রাউন্ড চা খেয়ে উঠব উঠব করছি, এমন সময় ওই অপরিচিত ভদ্রলোক বলে উঠলেন কথাটা, ‘গল্পের শেষটা একটু ভুল হল মশাই।’
এতক্ষণ খেয়াল করি নি। তখন থেকে ভদ্রলোক মাথা থেকে পা পর্যন্ত চাপা দিয়ে বসে আছেন। আবছা আলোয় মনে হচ্ছিল, রতনদা বুঝি বস্তায় ভরে রেখে দিয়েছে কিছু। হঠাৎ মানুষের গলার শব্দে ভুল ভাঙল। ফিরে তাকালাম। দেখি ভদ্রলোক চাদর থেকে মুখখানা বের করেছেন। বললেন, ‘ওভাবে নয়। অম্বুজবাবুর মৃত্যু হয়েছিল অন্যভাবে।’ 
কাকু হাসলেন। বললেন, ‘সে রাতের সব ঘটনাই আমার চোখের সামনে ঘটেছিল। আসলে, অম্বুজবাবুর বাড়ির পিছনে ওই তরুণ সংঘ ক্লাবের সদস্য ছিলাম আমি। তার পরে অবশ্য কিছুদিন গা ঢাকা দিতে হয়েছিল পুলিশের ভয়ে।’
ভদ্রলোকের মাথা নাড়া দেখে প্রদীপ্তকাকুর গা’টা রিরি করে উঠল। কিছুটা বিরক্ত হয়েই বললেন, ‘সঠিক ঘটনাটা তাহলে আপনিই বলুন।’ 
ভদ্রলোক মনে মনে কিছু একটা ভেবে নিলেন। তারপর বললেন, ‘তাহলে বলছি শুনুন।’
‘কন্ঠস্বরটি গমগমে গলায় বলে উঠল, ‘বাড়ি না ছাড়লে এরকমই ঘটবে।’’
‘মাধববাবু সাতঘাটের জল খাওয়া মানুষ। রহস্যময় এক কন্ঠস্বরের ভয়ে গুটিয়ে যাওয়ার মানুষ নন। প্রথমটায় একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু দ্রুত নিজেকে সামলে নিলেন। বললেন, ‘কে আপনি? কী চাই?’
‘বিকট শব্দে হেসে উঠল কন্ঠস্বরটি। সে হাসি শুনলে যে কোনও মানুষের রক্ত জল হয়ে যাবে। মাধববাবুও কেঁপে উঠলেন যেন। হাসি থামতে সে বলল, ‘কী, মাধবসখা দত্ত? পুরনো কথা কি কিছু মনে পড়ছে?’
‘মাধব দত্তর মনে পড়ছিল। সে-রাতের সব কথাই এক এক করে মনে পড়ছিল তাঁর।
‘তিনি ব্যবসায়ী মানুষ। বাড়িটা কেনার আগে নির্দিষ্ট একটা পরিকল্পনা ছিল তাঁর। অম্বুজ চৌধুরি কবে মারা যাবেন, ততদিন হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হবে – মাধবসখা দত্ত সে বান্দা নন। দীর্ঘদিন ধরেই কয়েকজন অনুচরকে অম্বুজবাবুর পিছনে লাগিয়ে রেখেছিলেন। তাদেরই একজন একদিন একটি মোক্ষম খবর আনল। অম্বুজবাবু একা থাকলেও ভীষণ তাঁর ভূতের ভয়। 
‘মাধববাবু ঠিক করলেন, এই ভয়টাকেই কাজে লাগাতে হবে। 
‘সেই মত সেদিন সন্ধ্যে হতেই ভদ্রলোক নিজেই পৌঁছে গেলেন অম্বুজবাবুর বাড়ি। ভদ্রলোকের কুশল সংবাদ নিয়ে কিছুক্ষণ দুজনে গল্প-গুজব করলেন। তারপর একসময় মাধব দত্ত উঠে দাঁড়ালেন। এবার তাঁকে বাড়ি ফিরতে হবে। 
‘অম্বুজবাবুর কাজের লোকটি সেদিন বাড়ি গিয়েছিল। মায়ের নাকি শরীর খারাপ। অগত্যা নিজের হাতে রাতের খাবারটুকু বেড়ে খেয়ে একসময় শুয়ে পড়লেন। তারপর মাঝরাতে বিকট একটা শব্দে ঘুম ভেঙে গেল অম্বুজবাবুর।
‘‘মাধব দত্ত, আমি আজ প্রতিশোধ নিতে এসেছি।’ মধ্য-রাতের ভুতুড়ে কন্ঠস্বর একসময় বলে উঠল।
‘ভদ্রলোক আর নিতে পারলেন না। হার্ট-ফেল হবার আগেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি। তারপর থানার রাস্তা ধরে হাঁটা দিলেন তিনি। 
‘আজ সব কথাই কবুল করতে হবে।’
ভদ্রলোকের গল্প শেষ হল। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিন্তু এত কথা আপনি জানলেন কী করে?’
‘আমিই মাধব দত্ত।’ ভদ্রলোকের কথায় চমকে উঠলাম। ‘কিছুদিন জেলে ছিলাম। ছাড়া পাওয়ার পর সব ছেড়ে পন্ডিচেরি চলে গিয়েছিলাম। সম্প্রতি ফিরে এসেছি।’
আমাদের তখন মুখের কথা হারিয়ে গেছে।
kaustuvaa@gmail.com
পূর্ব বর্ধমান

No comments:

Post a Comment