1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, February 21, 2021

অলীক মানুষ

 

ছবি  : ইন্টারনেট 

অলীক মানুষ
কৌশিক বাঙ্গাল

বাড়ী থেকে বেরিয়েই আবার খটকাটা লাগল প্রশান্তবাবুর । মাঝেমধ্যেই এমনটা হচ্ছে । কাউকে  এখনও কিছু বলেননি তিনি । আর বললেও, ফল কি হবে বিলক্ষণ আন্দাজ করতে পারছেন তিনি । হয় বেমালুম হাত নেড়ে হাওয়ায় উড়িয়ে দেবে কিংবা হয়ত মুচকি হেসে তাকে দিনকতক রেষ্ট নিতে বলবে । নতুবা কেউ মেকী দরদ দেখিয়ে ভালো কোন ডাক্তারের পরামর্শ নিতে বলবে ।
কিন্তু প্রশান্তবাবু নিশ্চিত এটা তার চোখের বা মনের ভুল নয় । সাধারণ মানুষের সাদা চোখে ব্যাপারটা হয়তো নজরেই পড়বে না । কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে দেখে, ঠোঁট উল্টে মাথা নাড়তে নাড়তে চলে যাবে । তবে কিনা, প্রশান্তবাবুর আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে । তার চোখ ধোঁকা খেতে পারে না । আর মগজও বিলকুল সাফ । ধীরে,… খুব ধীরে ধীরে… ওটা হেলছে । মিলিমিটারেরও কম ভগ্নাংশে । যার অভিমুখ দিনদিন স্পষ্টতর হচ্ছে । পাশের প্রশান্তবাবুর সাবেকী বাড়ীর দিকেই ।
রবিবারের সকাল । সপ্তাহান্তে বাজার শেষে ফেরার পথে অলকবাবুর সঙ্গে দেখা । তুখোড় ফন্দীবাজ আর বাচাল টাইপের লোক । প্রশান্তবাবু এড়িয়ে যেতে চাইছিলেন ।
“নমস্কার দাদা । অনেকদিন পর । খবর-টবর সব ভালো তো”?
“ঐ চলছে একরকম”।
“ওদিক থেকে কোনো ঝামলা-টামেলা....”?
মুখের কথা কেড়ে নিলেন প্রশান্তবাবু, “না...না, সে সব এখন চুকেবুকে গেছে”
“হ্যাঁ..হ্যাঁ.., ওসব মিটমাট হয়ে যাওয়াই ভালো । আর দাদা এই বয়সটা কি থানা-পুলিশের সঙ্গে চু-কিত-কিত খেলার বয়স ? নাকি নাতি-নাতনির সঙ্গে আগডুম-বাগডুম খেলার, কি বলেন” ?, রসিকতার ছলে খ্যাক খ্যাক করে হাসলেন অলকবাবু ।
মলিন একটা হাসি ঠোঁটে ঝোলালেন প্রশান্তবাবুও ।
“আচ্ছা ভাই অলক, তোমার চেনাশোনা কোন ভালো চোখের ডাক্তারের খোঁজ আছে, পাওয়ারটা ক’দিন ধরে মনে হচ্ছে গড়বড় করছে । ছানি-টানি পড়ল কিনা কে জানে”?
“সে কি দাদা, এই বয়সেই ছানি বাঁধিয়ে বসলেন ? তবে অসুখ-বিসুখ কি আর বয়সের গাছ-পাথর মানে ? এই তো দেখুন না আমার গিন্নীর পিসতুতো ভাই । বৌ-ছেলেপুলে নিয়ে দিব্যি ছিলেন । রিটায়ারমেন্টের আর বছর তিনেক বাকী । হঠাৎ সেদিন শুনলাম, এখন নাকি গ্লকোমা ধরা পড়েছে । স্টেজ টু । কি অবস্হা ভাবুন তো” ? 
প্রশান্তবাবু অধৈর্য হয়ে কান খোঁটরাতে লাগলেন ।
“....ও হ্যাঁ, তা আপনি মন্দিরতলায় ডাক্তার তন্ময় সরকারের কাছে একবার দেখিয়ে নিন না । আমার বড়দার ফেকো সার্জারি তো উনিই করলেন । শুনেছি, একেবারে সোনা বাঁধানো হাত”  
মনে মনে নিজের পিঠ চাপড়ালেন প্রশান্তবাবু । খুব কায়দা করে প্রসঙ্গটা এড়ানো গেছে ।  দুর্বল জায়গায় কাঠিবাজি করা এইসব লোকের কুৎসিত একটা স্বভাব । 
     .... হ্যাঁ, ঘটনা একটা ঘটেছিল তাদের জীবনে । তাও সেটা প্রায় বছর সাড়ে পাঁচ আগে । এতদিনে সেখানে যথেষ্ট পলি পড়ে ঘটনাপ্রবাহ তার নাব্যতা হারিয়েছে । তবু এই টাইপের কিছু লোকজন ড্রেজিং করে নাব্যতা বাড়াতে ব্যস্ত ।
সেইসব দিনের কথা ভাবলে শিউরে ওঠেন প্রশান্তবাবু । গোটা কান্ডের মূল হোতা তার একমাত্র গুণধর পু্ত্র । কীর্তিমান হঠাৎ একদিন উধাও বাড়ী থেকে । চারদিক খোঁজ খোঁজ ।  পুলিশে মিসিং ডায়েরিও করা হল । কিন্তু, নিট ফল জিরো ।
হপ্তাখানেক পর একদিন রাতে হঠাৎ হাজির মূর্ত্তিমান । সঙ্গে অল্পবয়সী একটা মেয়ে । সিঁথিতে এক ধ্যাবড়া সিঁদুর । কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে । হুড়মুড়িয়ে দুজনে মিলে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম ঠুকল । 
“বাবা, আজ আমরা ভীষণ ক্লান্ত । যা বলার কাল তোমাদের বলব”
সেই কালটা যে এত দ্রুত বিভীষিকাময় হয়ে উঠতে পারে, তখন প্রশান্তবাবু অনুমান করতে পারেননি ।  
পরের দিনই নাবালিকা হরণ এবং ফুঁসলে বিয়ে করার ধারায় মামলা রুজু হল কনিষ্কের নামে । তার ছেলে । প্রশান্তবাবু ইতিহাসের ছাত্র ছিলেন । তাই অনেক শখ করে প্রিয় ঐতিহাসিক চরিত্রের নামে পুত্রের নামকরন করেছিলেন । কিন্তু ইতিহাসের সমনামী ঐ সম্রাটের মূর্ত্তির মতো তার মাথাও যে এইভাবে  কর্তিত হবে কোনদিন কি তিনি ভেবেছিলেন ?
পরের পক্ষকাল কেটেছিল অসম্ভব চাপা টেনশন আর অস্হিরতাকে সঙ্গী করে । একদিকে অসুস্হ,   স্ত্রীকে দেখাশোনা করা, অন্যদিকে পুলিশ-থানা-কোর্ট টানাহ্যাঁচড়া । প্রশান্তবাবু হাঁপিয়ে উঠেছিলেন ।
তবে কনিষ্কের নবপরিণীতা বধূটিকে বেশ করিৎকর্মা মানতে হবে । পালিয়ে বিয়ে করার আগে  যাবতীয় শংসাপত্র বগলদাবা করে নিয়ে আসতে ভোলেনি । ফলতঃ নাবালিকা হরণের তত্ত্ব নিমেষে নস্যাৎ হয়ে গিয়েছিল । বরংবদু’জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের স্ব-ইচ্ছায় বিবাহে অনধিকার পুলিশী হস্তক্ষেপকে তীব্র ভর্ৎসনা করেছিল আদালত ।
       ইতিমধ্যে গঙ্গা-যমুনা দিয়ে কোটি কোটি কিউসেক জল বয়ে গিয়েছে । দুই বাড়ীর সম্পর্কও এখন গনগনে উনুন থেকে নিভুনিভু প্রদীপে পর্যবসিত হয়েছে । তবু এখনও কিছু লোকে নিস্তরঙ্গ পুকুরে অকারনে ঢিল ছুঁড়তে ব্যস্ত ।
    । দুই । দুইদুই দুদুই
       প্রশান্তবাবুর বাড়ী থেকে মাত্র ফুট বারো দুরেই সেই পঞ্চতলীয় আবাসন । মাঝেমধ্যেই জানালা দিয়ে একদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকেন তিনি । এই তো বছর চার-পাঁচ আগের কথা । জায়গাটা ছিল ঝোপঝাড়ে ঘেরা জলা জায়গা । হঠাৎই সেটা রাতারাতি ভরাট করে কনস্ট্রাকশনের কাজ শুরু হয়ে গেল । এখন তো মাঝেমধ্যেইমাঝেমধ্মাঝেনির্মানকার্য প্রায় শেষের মুখে । মাঝে বুকিংও শুরু হয়ে গিয়েছে বোধহয় । অসঙ্গতিটা যখন তার নজরে এসেছিল, প্রথমে অসম্ভব মনে হয়েছিল । পরে ঠান্ডা মাথাতেও মনের সঙ্গে অনেক তর্ক-বিতর্ক করেছেন । শেষে সাহস করে লোকাল মিউনিসিপ্যালিটিতে দিয়েছিলেন একটা কমপ্লেন ঠুকে । 
তাতেও কোথাও হেলদোল না দেখে লোকাল একটা এনজিও’র শরনাপন্ন হলেন । যথারীতি যযপ্রথমে তো ওরা পাত্তাই দিল না । তার মানসিক স্হিরতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করল । কিন্তু প্রশান্তবাবুও নাছোড়বান্দা । হাল না ছেড়ে পুরসভাতে জমা দেওয়া তার অভিযোগপত্রের কপি, বিল্ডিং-এর ছবি-টবি ইত্যাদি দেখিয়ে ওদের নিমরাজি করালেন ।
মৌচাকে ঢিল মারার ফলাফল কি হতে পারে কদিন পরেই অবশ্য প্রশান্তবাবু হাতেনাতে টের পেলেন ।  
সেদিন ব্যাঙ্ক থেকে পেনশন তুলে অটোর লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন । হঠাৎ মাস্তান টাইপের একটা ছেলে গায়ের উপর হুমড়ি খেয়ে বলল, “আগুন বেশী লাফড়া করবেন না জেঠু । লাইফে শান্তি যদি পেতে চান, ফ্যামিলি-বন্ধুবান্ধব নিয়ে এনজয় করুন । বয়স হয়েছে । যে কোনদিন কিন্তু টপকে যাবেন’’
      একটু চোখটা টিপে ছেলেটা জোরসে অটোওয়ালাকে হাঁকড়ানি দিল, “অ্যাই পল্টু, জেঠুর কাছ থেকে ভাড়া নিবি না । একদম বাড়ীর কাছে নামিয়ে দিবি । আমার লোক আছে”।
বাড়ীতে ফিরে থরথর করে কাঁপছিলেন প্রশান্তবাবু । এদের এত বাড় বেড়ে গেয়েছে । সরাসরি একেবারে খুন করার হুমকি! মগের মুলুক পেয়ে গেছে নাকি । মানুষ নিজের বিপদ জেনেও মুখ খুলতে পারবে না । ঘেন্নায় প্রশান্তবাবুর জিভের ভিতরটা তিতকুটে হয়ে গেল ।
গার্লস স্কুলের উল্টোদিকে কনিষ্ককে একটা ফাস্ট ফুডের দোকান করে দিয়েছেন প্রশান্তবাবু । একদম পশ এরিয়ায় দোকানটা । সেলামী বাবদ মোটা টাকা গুনতে হয়েছে । সবই তার রিটায়ারমেন্টের বেনিফিট থেকে । দোকানটা এখন বেশ চালুই বলা চলে । 
      সেদিন রাতে হন্তদন্ত হয়ে বাড়ী ফিরে কনিষ্ক বলল, “এসব কি শুরু করেছ বাবা, কালো ইঞ্জিন দোকান বয়ে এসে রীতিমতো শাসিয়ে গেল, তোর পাগলা বাপটাকে সামলে রাখ, নাহলে ব্যবসায় কি করে লালবাতি জ্বালাতে হয়, সেটা দেখাব”
ওঃ তাহলে সেদিনের বেয়াদপটার নামই কালো ইঞ্জিন । মুখটা প্রশান্তবাবুর একটু যেন চেনাচেনা ঠেকছিল বটে । নামটা পেটে আসছিল কিন্তু কিছুতেই মুখে আসছিল না ।
মুহুর্তে তিনি তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে বললেন, “কি হচ্ছে নিজের চোখে দেখতে পাচ্ছিস না, পাশের বিল্ডিংটা কেমন আস্তে আস্তে আমাদের দিকে হেলছে । কোনদিন না হুড়মুড়িয়ে এ বাড়ীর উপর ভেঙ্গে পড়ে । এভাবেই দেখবি, হয় আমাদেরকে একদিন বাস্তুহারা হতে হবে, নইলে এক্কেবারে ধ্বংসস্তুপের তলায় জ্যান্ত সমাধি হবে” ।
“কি আশ্চর্য ! কোথায় বিল্ডিং হেলছে ? তোমার মাথা-টাথা সব ঠিক আছে তো ? আচ্ছা বেশ, আমাকে না হয় ছাড়ো । আশপাশের লোকজনের থেকে খোঁজ নাও । কারো নজরে পড়ে কিনা । সবাই তো আর চোখে ঠুলী পরে বসে নেই । তুমি বরং প্রেসার-সুগারটা একবার চেক করিয়ে নাও । শোনো বাবা, যথেষ্ট হয়েছে । ব্যাপারটা নিয়ে আর একদম ট্যাঁ ফোঁ করবে না । কালো ইঞ্জিনরা কিন্তু ডেঞ্জারাস । আজ হুমকি দিয়েছে । কাল দোকান ভাঙচুর করবে । পরশু বাড়ীতে এসে হামলা করবে । বাড়ীর মেয়ে-বৌএর ইজ্জত নিয়ে টানাটানি করবে । সেটা খুব ভালো হবে তো ? তোমার জন্য আমরা সকলে কিন্তু বিপদে পড়তে পারব না” ।
অনেকক্ষণ ধরে বমি ওগরালো কনিষ্ক ।
“শোন ওদের ঐসব ফাঁকা আওয়াজে আমি ভয় পাই না । সাড়ে ছত্রিশ বছর চাকরি করেছি  বুক চিতিয়ে । ভয়ে জুজু হয়ে থাকা আমার স্বভাবে নেই । ফাইট করব তো সামনে দাঁড়িয়ে থেকে । তোর মতো এসকেপিস্ট হওয়া আমার নেচারে নেই ।”
“কি বললে আমি এসকেপিস্ট ? বেশ, থাকো তুমি তোমার একগুঁয়েমী নিয়ে । এরপর ওরা যখন আমাদের জীবনটা নরক-গুলজার করে দেবে, তখন যদি তোমার হুঁশ ফেরে” ।
প্রশান্তবাবু অনেকক্ষণ ধরে গুম মেরে রইলেন । পাশেই স্ত্রী বিজয়া খাটের বাজুতে হেলান দিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে । সদ্যোজাত শিশুর মতো ভাবলেশহীন ভঙ্গি । হঠাৎ করেই   সেরিব্রাল অ্যাটাক । বছরখানেক আগে । মস্তিষ্কের ধূসর কোষগুলো কর্মক্ষমতা হারিয়ে একেবারে নির্জীব হয়ে পড়েছে । যৌবনের মারকাটারি সুন্দরী স্ত্রীকে এখনকার চোয়াল ঝুলে পড়া, অজান্তেই লালা গড়িয়ে পড়া অবস্হায় মেলাতে গিয়ে প্রশান্তবাবুর বুকটা হাহাকার করে ওঠে । 
      তাই এই মুহুর্তে স্বামী-পুত্রের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় বিজয়ার কর্ণকুহরে প্রবেশ করলেও মস্তিষ্কে আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারছে না । নির্বাক জীবনকে ভবিতব্য করেই বেঁচে আছেন বিজয়া । বাইরের কাউকেই প্রায় চিনতেই পারেন না । ইঁট-কাঠ-পাথরের দেওয়ালগুলোও বোধহয় এখন বিজয়ার সঙ্গে একাত্ম অনুভব করে । রোগের বিষাক্ত ছোবল ধীরে ধীরে জড়পদার্থে পরিনত করে দিচ্ছে তাকে ।
অথচ এই বিজয়াই প্রশান্তবাবুর একসময়ের কত আনন্দ-যন্ত্রনার সঙ্গী । প্রতিদিনকার ঘটনাগুলো মন উজাড় করে জীবনসঙ্গিনীর কাছে উপুড় না করলে দিনটা বিস্বাদ আলুনির মতো লাগত । রাতে একান্ত অবসরের গল্পচারিতার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকত তার মন । প্রশান্তবাবুর চরম মনখারাপের বেলায় বিজয়ার ছোট ছোট দরদী বাক্যগুলো যেমন প্লাসেবো এফেক্টের কাজ করত । তেমনি তার ছোট্ট খুশীর খবরেও বিজয়ার শিশুর মতো উচ্ছাস প্রকাশ, বুকে কাশফুলের দোলা লাগত প্রশান্তবাবুর ।
মাঝেমধ্যেই পুরানো স্মৃতিগুলো আজও বুকে ঝাপটা মারে প্রশান্তবাবুকে । 
      তাই চরম অস্হিরতার দিনগুলোতে তিনি সহধর্মিনীর কাছে মনের ঝাঁপি খুলে প্রশান্তি খোঁজার চেষ্টা করেন । জানেন, সবকিছুই দর্শকবিহীন থিয়েটারের মঞ্চে একাঙ্ক নাটকে অভিনয়ের মতো । নিক্তিতে মাপা উল্লাস-আবেগ-কান্না-যন্ত্রনা সবই আছে । শুধু দর্শকের কোন প্রতিক্রিয়া নেই । তবুও এক অদৃশ্য তরঙ্গবার্তার অপেক্ষায় থাকেন প্রশান্তবাবু । তার ধনাত্মক বা ঋণাত্মক স্পন্দনই বুঝিয়ে দেয় তাকে অনেককিছু ।
 প্রথম যখন পাশের বিল্ডিং এর ‘হেলে যাওয়া’ নিয়ে তার সন্দেহ জমাট বাঁধল । সংশয় আর দ্বিধার নাগরদোলায় ঘুরপাক খাচ্ছিল মন । তখন বিজয়ার কাছেই তিনি প্রথম প্রকাশ করেছিলেন । উন্মুখ হয়ে তাকিয়েছিলেন স্ত্রীর দিকে । প্রত্যাশামতোই জবাব তিনি পেয়েছিলেন । সদর্থক বার্তাই । সবসময়ের মতো এবারেও তিনি অর্ধাঙ্গিনীকে পাশে পেয়েছিলেন । 
 কনিষ্ক বেরিয়ে যাওয়ার পর প্রশান্তবাবুর বুকটা মুচড়ে উঠল । আহত চোখে তাকালেন স্ত্রীর দিকে । বিজয়া ফ্যালফ্যালে দৃষ্টিতে তাকিয়ে স্বামীর দিকে । যেন এই মুহুর্তে তিনি ভিনগ্রহের আশ্চর্য  বাসিন্দা । হয়ত নিকট সম্পর্কগুলোর সহজ রসায়ন আজ দুর্বোধ্য বিজয়ার কাছে । প্রশান্তবাবু অসহায়ভাবে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন । তবু তিনি আজ অপেক্ষা করবেন । কনিষ্কের সঙ্গে এই চরম সংঘাতে বিজয়ার মতামতটা জানাও যে বিশেষ জরুরী ।
পরম মমতায় বিজয়ার শীর্ণ শীতল করতল নিজের দুই মুঠিভরে নিলেন । যেন কতকাল পরের আবেগমথিত ভালবাসা জড়ানো এই স্পর্শ । তার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল । প্রশান্তবাবু বেশ অনুভব করতে পারছেন মুঠিমধ্যে বিজয়ার করতল তিরতির করে কাঁপছে তার অনুচ্চারিত ডাকে । যেন অধীর আগ্রহভরে অপেক্ষা করে আছে স্বামীর কথা শোনার জন্য । প্রশান্তবাবু উত্তেজনায় অস্হির হয়ে উঠলেন । 
রুদ্ধকন্ঠে বলে চললেন, “জয়া, ছেলের কথাগুলো শুনলে ।  দেখলে বাপকে কিভাবে অপদস্হ করল । এইজন্যেই কি আমরা সন্তান চেয়েছিলাম ? ওকে মানুষের মতো মানুষ করার স্বপ্নের জাল বুনেছিলাম”
প্রশান্তবাবু একটু থামলেন । নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে আবেগজড়ানো স্বরে বললেন, “জয়া,   তোমার প্রতিটা মতই আমার কাছে অমূল্য । আমি যে পথে এগোচ্ছি তাতে তোমার পুরোপুরি সমর্থন আছে তো ? বুকে সাহস এনে বলো । তোমার স্বামী বীরপুরুষ । ওসব ছুটকো হুমকিতে ঘাবড়ায় না । আমি জানি বরাবরের মতো এখনও তুমি আমার পাশে আছো । থাকবেও” ।
ঘড়ির কাঁটা এগোচ্ছে টিকটিক করে । প্রতিটা পল মনে হচ্ছে যেন অনন্তকাল । হয়ত সেই মানসিক তরঙ্গসূত্র তার সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করতে গিয়েও বিচ্ছিন্ন হচ্ছে । প্রশান্তবাবু চোয়াল শক্ত করে সেই মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন । কেটে গেল বেশ কিছুক্ষন । হঠাৎ তার সারা শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল । ইঙ্গিত পেলেন, সেই আকাঙ্খিত মুহুর্ত এখন সমাসন্ন ।
অবশেষে ধীরে ধীরে পরিষ্কার হচ্ছে বিজয়ার তরঙ্গবার্তা । স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে সেটি । বিজয়ার বিপরীতমুখী মনোভাব টের পেলেন প্রশান্তবাবু । এখন তিনি অনুধাবন করতে পারছেন স্বামীর উপর বিজয়ার হাল্কা অসন্তোষ । অসূয়ার বার্তা । তিনি যেন এখন মানসকর্ণে শুনতে পেলেন বিজয়ার চাপা ভর্ৎসনা । 
থমকে গেলেন প্রশান্তবাবু । একি ? এ যে তার প্রত্যাশারও অতীত । এজন্যই কি প্রিয়তম নারীর সঙ্গে বহুবছর পাশাপাশি থেকেও পুরুষের চোখে সে রহস্যাবৃতা । মনের অলিগলি খুঁজতে সেই পুরুষকে হাবুডুবু খেতে হয় । বিফল মনোরথে স্ত্রীর মুঠোবন্দী করতল খসে পড়ল । সন্তানস্নেহের কাছে পৃথিবীর সব মায়েরাই কি শেষমেষ পরাজিত হয় । আর বিজয়ারই বা দোষ কি ? সন্তানস্নেহে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে পর্যন্ত ভ্রাতুষ্পুত্র ভীমকে বুকে পিষে মারার কৌশল নিতে হয়েছিল । সেখানে বিজয়া তো কোন ছার ।
। তিন ।
আজকের আবহাওয়াটা বেশ চমৎকার । এদিন ছাদে উঠে মিঠে রোদ পোহাচ্ছিলেন প্রশান্তবাবু  । একটু দূরেই বুকে আতঙ্কের মতো চেপে বসা সেই হেলে পড়া টাওয়ার । গত মাসখানেক ধরে এই ধরনের ‘লীনিং বিল্ডিং’ নিয়ে অনেক পড়াশোনা করেছেন তিনি । অত্যাধুনিক ‘স্ক্রু জ্যাক’ পদ্ধতিতে নাকি আজকাল এই ধরণের বিল্ডিং সোজা-স্বভাবিক করে দেওয়া হচ্ছে । বিদেশে তো বটেই । বাইরের রাজ্যেও প্রচন্ড ব্যয়বহুল এই পদ্ধতির প্রয়োগ হচ্ছে । কিন্তু তার কথায় কেউ পাত্তা দিলে তো ? কারো চোখেই তো সেই সুউচ্চ বক্ররেখাটি নজরে আসছে না ।
তার মনে হচ্ছে এই সুবিশাল পৃথিবীর তিনি একদম একাকী, কোণঠাসা । আর ঠিক তার পাশেই চিরপরিচিত গোটা দুনিয়া তাকে অচ্ছুৎ করে মুখ ফিরিয়ে উল্টোদিকে হেলে আছে । প্রতি মুহুর্তেই সেই দুনিয়ার বাসিন্দাদের বিষাক্ত কটুক্তি, ঝাঁঝালো বিদ্রূপে বাণে বিদ্ধ হচ্ছেন তিনি ।
“দাদু...দাদু”, কচি গলার মিষ্টি আওয়াজে ঘাড় ঘোরালেন প্রশান্তবাবু ।
বুকুন, কনিষ্কের ছেলে । সবে স্কুল থেকে বোধহয় ফিরেছে । প্রতিদিন বাড়ীতে এসেই আগেই দাদুর খোঁজ । 
ছোট ছোট স্টেপে দুদ্দাড় করে তার দিকে এগিয়ে আসছে ।
প্রশান্তবাবু বুকুনকে কাছে টেনে গাল টিপে একটু আদর করে দিলেন ।
“একি বুকুনবাবু, তুমি এখনও ইউনিফর্ম ছাড়োনি । কিছু খাওনি । তার আগেই দাদুর কাছে চলে এলে । মা কিন্তু শুনলে খুব বকবে”
উত্তরে বুকুনের চোখমুখে দুষ্টুমির হাসি ঝিকমিক করে উঠল ।
“আচ্ছা দাদু ‘ছিটিয়াল’ মানে কি ?....আর...’ভীমরতি’ কি জিনিস ? তোমার কাছে তো ভীম-অর্জুনের গল্প শুনেছি । কিন্তু ভীমরতির কথা তো বলোনি” 
সরল প্রশ্ন প্রশান্তবাবুর নাতির ।
“কেন বলো তো দাদুভাই”?
“দাঁড়াও চুপিচুপি বলি, জানো তো কাল রাত্তিরবেলা মা আর বাপি শুয়ে শুয়ে কি একটা বড় বাড়ী নিয়ে কথা বলছিল । তখন মা বলল তোমার নাকি ভীমরতি হয়েছে । …. বলো না দাদু, তোমার কি হয়েছে ? …..তখন বাপি বলল একটা হাবা-গোবা’কে নিয়ে হিমশিম খাচ্ছি, এখন একটা ছিটিয়াল...আধপাগল ঘাড়ে জুটল”
প্রশান্তবাবুর সুষুন্মাস্নায়ু দিয়ে উত্তপ্ত রক্তস্রোত দাপাদাপি করতে লাগল ।
“জানো তো দাদু, মা-বাপি কিচ্ছু জানে না, একদম না । কোথায় হাবা, পাগল আমাদের বাড়ীতে আছে ? ওরা তো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় । ময়লা জামাকাপড় পরে থাকে । জানো তো দাদু, ঐসব কথা শুনে আমার খুব ভয় করছিল । কষ্টও হচ্ছিল । খু-উ-ব ।  ইচ্ছে করছিল ছুট্টে গিয়ে তোমার গলা জড়িয়ে ধরি” । 
প্রশান্তবাবু শুধু স্তব্ধ হয়ে নাতির মাথায় আলগোছে হাত বোলাতে লাগলেন ।
“আমি জানি, তুমি খুব খুব ভালো । যা বলো স-ও-ব ঠিক । তাই না দাদু” ?
মাথার মধ্যে তোলপাড় করে চলা সাইক্লোনের দাপট কি একটু কমল ? বুকে জমে থাকা বরফের চাঁই একটু কি দ্রবীভূত হল ?
এ জগতে শিশুর মতো পরম বিশ্বাসী আর সরল আর কে আছে ? 
বুকে আগুন আর মনে ঝিরঝিরে বর্ষার মৌতাত নিয়ে বুকুনকে বুকের মাঝে চেপে ধরলেন প্রশান্তবাবু । 

koushikbangal@gmail.com
হুগলী

No comments:

Post a Comment