...হর্ষবর্ধন চৌধুরী
বেলা শেষ। পশ্চিম আকাশে আবীর ছড়িয়ে সূর্যকে বিদায় জানালো। গোচারণ থেকে ঘরে ফেরার পথে গরুরা যেন তাদের গলায় ঝুলানো ঘন্টার টুংটাং
শব্দ বাজাতে বাজাতে সন্ধ্যা দেবীকে আহ্বান করে গ্রামে নিয়ে আসছে। যেন সাথে করে নিয়ে আসছে সন্ধ্যা দেবীর আঁচল। সেই আঁচলে ঢাকা পড়ছে
পৃথিবী। সেই আঁচল ভেদ করে চিৎকার করতে করতে গ্রামের দিকে
আসতে লাগলো -'দুলহা বাবু আ রাহা হ্যাঁয়, দুলহা বাবু আ রাহা হ্যাঁয়।'
মুজাফফরপুর আর মতিহারির মাঝখানে, বড় রাস্তা থেকে
কিছু ভিতরে, একটা ছোট গ্রাম। সবাই আত্মীয় । প্রত্যেকের বাড়ির খবর প্রত্যেকেই জানে। রমজান চাচার মেয়ে রুকসানার বিয়ের কথা মুর্তাজার
সাথে। কিন্তু সে তো আরবে, তার দেশে ফেরার কোনো
খবর আসেনি, তবে কি মূর্তুজা
আসছে? হ্যা,
সেইতো
সাথে বিরাট একটা এটাচি।
মুর্তজা আরব থেকে ফ্লাইটে মুম্বাই এসে নামে। সেখান থেকে ট্রেন ধরে পাটনা। পাটনা থেকে বাস ধরে বেতিয়া
যাবে। চারটের
মধ্যে পৌঁছে গেলে ওখান থেকে গ্রামে যাওয়া সহজ। কিন্তু সবকিছু তো আর হিসাব মাফিক হয়না। মোজফ্ফরপুর থেকে দুজন মেয়ে
উঠলো, একজনের
বয়স কুড়ি র কাছাকাছি আর একজন ৫০ ছাড়িয়েছে বা ছাড়াবে বোধ হয়। দুজনের চোখেই ক্লান্তির ছাপ । বোধ হয় রাত্রে ঘুম
হয়নি । বাস কিছুটা চলার পর একটা মধ্য বয়সি লোক মেয়েটার
কাছে গিয়ে বলল," আরে মুন্নি না, কি রাতে প্রোগ্রাম ছিল?" প্রোগ্রাম মানে কোন
বিয়ে বাড়ির অনুষ্ঠানে বরযাত্রীদের গান শোনানো । মুজাফফরপুরে গান
ওয়ালি আছে। তবে ঘরকা মুরগি ডাল বরাবর। তাই দূরের গানওয়ালীর একটু কদর বেশি। আর শুধু গান গেলেই হবে না তার সাথে নাচতেও হয় আরো অনেক কিছু করতে হয়। এদের বলা হয় বাজারের মেয়ে অর্থাৎ পয়সা দিয়ে এদের ব্যবহার করা যায়। সেই আম্রপালির সময় থেকে এই নিয়ম চলে আসছে। আবার সব সময় এটা
কাউকে দিতে হবে তা নয় গায়ের জোরে এদের ভোগ করা হয়। ফ্রি লোকটা মুন্নির
গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কথা বলা শুরু করলো গালে পিঠে হাত দিয়ে আদর করা শুরু করলো মেয়েটা
ক্ষীণকন্ঠে প্রতিবাদ করল, 'কেন বিরক্ত করছেন?'এটা চিনো একটা হাসির
কথা লোকটা হো হো করে হেসে উঠলো বলল আরে এটা বিরক্ত বলছো কেন আমি তোমার সাথে একটু ভালোবাসা
করছি এই বলে লোকটা মেয়েটাকে বুকের কাছে টেনে নিতে চাই মেয়েটা যথাসম্ভব শক্তি দিয়ে
লোকটাকে ঠেকানোর চেষ্টা চালাতে থাকল। মেয়েটার সাথে বয়স্ক
মহিলা লোকটাকে আটকানোর জন্য বললো," ও দাদা এ কি করছেন ?ছেড়ে দিন না।" লোকটা সেই মহিলাকে একটা
ধমকি দিলো," চুপ কর হারামজাদি ।" বলে তার হাতে
দশটা টাকার একটা নোট গুজে দিল। বাসের অন্যান্য যাত্রীরা
কোনো প্রতিবাদ না করে দৃশ্যটা উপভোগ করতে লাগলো। যাত্রীদের মধ্যে ব্যতিক্রম ছিল এক সেনা বিভাগের কর্মী বোধ হয় ছুটি নিয়ে
বাড়ি যাচ্ছিল। সে আপত্তি করল। লোকটা পাল্টা খেকিয়ে
উঠলো, "একটা বাজারের মেয়ের সাথে কথা বলছি তো তার গায়ে জ্বালা ধরে কেন ?"
সৈনিক
উত্তর করল," বাসটা বাজার নয় ।" লোকটাও কম
যায় না, বলল,"এটা বর্ডার নয়।" এতে সৈনিকের আঁতে ঘা লাগল। সে বলে উঠল,"
আমরা
বিদেশি শত্রুর হাত থেকে দেশকে রক্ষা করি আর দেশের মধ্যেই সবার সামনে তুই মা বোনের ইজ্জত
নিয়ে খেলছিস? আমি তোকে ছাড়বোনা। " দুজনের মধ্যে
গন্ডগোল বাধার জোগাড় , কন্ডাক্টর বাস কাছের থানায় নিয়ে গেল। সব ঝামেলা শেষ হয়ে বাস ছাড়তে বিকেল হয়ে গেল । তখন বেতিয়া পৌঁছাতে অনেক রাত হয়ে যাবে, আর হবু শ্বশুর বাড়ি
কাছেই তাই এখানে নেমে পড়েছে।
'তা ভালই করেছ ',গ্রামের বয়স্ক লোকেরা বললেন।
একটা সময় ছিল, যখন দেশ বিদেশ থেকে লোকে ভাগ্যের সন্ধানে ভারতে
আসত। আজ উল্টো
ধারা বইছে- ইউরোপ-আমেরিকা না হোক, আরবে চাকরি করা গ্রামের লোকের কাছে আকাশের চাঁদ
হাতে পাওয়া। যা সে যে কোনো ধরনের চাকরি হোক না কেন। আর যেখানে উপার্জনই মর্যাদার মাপকাঠি সেখানে দুটো মিথ্যে কথা বললে ক্ষতি
কি ? কে ভেরিফাই
করতে যাচ্ছে ? মর্তুজাও বানিয়ে বানিয়ে বলতে লাগল- সে কি করে অনেক পয়সা আয় করেছে,
বাড়িতে পাঠিয়েছে। তারপর সোনা কিনেছে
এবং সেগুলো জুতোর মধ্যে ঢুকিয়ে কিভাবে ভারতে নিয়ে এসেছে কাস্টমস কে ফাঁকি দিয়ে। এনেছে টেপ রেকর্ডার। সেটায় আবার কথা ধরে রাখা যায়। না , তখনও মোবাইল আসে
নি। সবাই মর্তুজার প্রশংসায় পঞ্চমুখ তার আদর আপ্যায়নের
ত্রুটি হল না । বাইরের ঘরে তার থাকার ব্যবস্থা হল। কিন্তু সুটকেসে যে অনেক দামি জিনিস আছে। যদিও চুরির ঘটনা
এখানে শোনা যায় না , তবু সাবধানে র মার
নেই। তাই সেটা
ভিতরে সুরক্ষিত রাখা হলো। গরমকাল
, শোবার জন্য উঠোনে একটা খাটিয়া পেতে দেওয়া
হলো।
ক্লান্ত শরীর, কিছুক্ষণের মধ্যেই ঠাণ্ডা বাতাসের ছোয়ায় মর্তুজা ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখতে লাগলো রুকসানা বিয়ের পোশাক পরে বাসর ঘরে এসেছে, ঝুঁকে পড়েছে তার
উপর। মুর্তজা তার দুই হাত দিয়ে রুকসানা কে জড়িয়ে ধরতে
যায় এমন সময় তার কানে আসে, "আপনার ভীষণ বিপদ, আপনাকে খুন করবে।আপনি পালান।" হত্যার কথা শুনে কার না
বুক কেঁপে ওঠে! মুর্তজা ধড়মড় করে উঠে বসলো। রুকসানা হাত দিয়ে মুর্তজার
মুখ চেপে ধরে বলল, ওর বাড়ির লোক মুর্তজার সোনা
দানা নেওয়ার জন্য তাকে মেরে কোথাও পুঁতে
ফেলার কথা বলছিল। বাঁচতে হলে এক্ষুনি পালাক। ওরা সবাই খেতে বসেছে,
দেরি
করলে হয়তো আর বাঁচতে পারবে না । মুর্তজা আসন্ন বিপদ
বুঝতে পারল কিন্তু রাস্তা ধরে গেলে কেউ তো তাকে চিনে ফেলবে ধরে ফেলবে । তখন রুকসানা বলল
যে সে তাকে ক্ষেত বাগানের ভেতর দিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু রুকসানার
কি হবে? সে কি তার বাড়ির
লোকের সাথে বেইমানি করবে ? রুকসানা বলল , "একজন লোকের জীবন
বাঁচাতে যদি বেইমানি করতে হয় ,সেও ভালো ।"
দুজনে বাড়ির পিছন দিক দিয়ে ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে হাটা শুরু করল।
chayanteertha@gmail.com
No comments:
Post a Comment