1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, October 21, 2020

কুমারী পুজো

 

ছবি : ইন্টারনেট
                                                                            কথিকা বসু


( এক )

      দূর থেকে পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। অনেকটা আলোর মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। পরনে সেই একই লাল বেনারসিটা, কিন্তু যেন বেশ খানিকটা ছিঁড়ে গেছে আর ধুলোমাখা মনে হচ্ছে। অথচ এরকম তো হবার কথা নয় । একঢাল কোঁকড়ানো চুলটাও বেশ অবিন্যস্ত লাগছে। আর মুকুটটাও মনে হচ্ছে একদিকে ছিঁড়ে ঝুলছে, ঠিক যেমন দশমীতে বির্সজন দেবার পরে হয়। অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠলেন মনিশঙ্করবাবু। তার বাড়ির পুজো এবারে ১৬৩ বছরে পড়ল। তার দাদু, শ্রীমান কালিকিঙ্কর রায় স্বপ্নাদেশ পেয়ে এই পুজো শুরু করেছিলেন। সেই থেকে শুরু, শুরুটা অবশ্য খুব সাদামাটা ভাবেই হয়েছিল,

কিন্তু মার আর্শীবাদে এখন সেই পুজোর খ্যাতি দূর দূরান্তে ছড়িয়ে পড়েছে, আশপাশের সব গ্রাম-গঞ্জের লোক মাকে দর্শন করতে আসে। সবাই বলে মা নাকি খুব জাগ্রত, সবার সব প্রার্থনা শোনেন। মনিশঙ্করবাবু এত কিছু বোঝেন না, তার কাছে মা দেবী পরে, আগে তার মা।

খুব ছোটোবেলায় তিনি তার মাকে হারিয়েছিলেন, তখন থেকে তিনি দেবীকেই মা বলে চেনেন এবং সেইমতোই তার সাথে আচরণ করেন। আজ বড় হবার পর, বাড়ির প্রধান এবং গায়ের মোড়ল হবার পরেও তার কোন পরিবর্তন হয়নি । আজও তিনি মার ছেলে আর দেবীই তার মা। আরেকটা জিনিস এই বংশে বংশপরম্পরায় চলে আসছে, সেটা হলো প্রত্যেক বছর, মহালয়ার আগের দিন মা, এই বাড়ির বর্তমান প্রধান পুরুষ, তথা কুসুমডিহি গ্রামের মোড়লের স্বপ্নে আসেন, যেন এই বার্তা দিতে, যে তিনি মর্ত্যে আসছেন। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হলো না, কিন্তু প্রত্যেক বছর তো তিনি নতুন পরিধানে, নতুন সাজসজ্জায় আসেন, তাহলে এ বছর কি হলো? কিছু কি হল? ভয়ে-আশঙ্কায় দুলতে দুলতে প্রায় দৌড়ে মার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন মোড়লমশাই। একি!!! মার কপাল ফুলে রয়েছে, চোখের তলায় কালশিটে, ঠোঁটের কোন দিয়ে রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে, অলঙ্কার গুলোও প্রায় ভাঙা, গলায়-হাতে অজস্র নখের আঁচড় আর বুকে কাপড় নেই। "তোমার এ অবস্থা কে করল মা," প্রায় চিৎকার করে উঠলেন মনিশঙ্করবাবু, মুখে প্রচন্ড রাগের চিহ্ন। "তুমি শুধু একবার বলো, একবার বলো মা, তোমাকে ন্যায় বিচার পাওয়ানোর দায়িত্ব আমার।", আবার চিৎকার করে উঠলেন তিনি।

"কি গো ওঠ, চারটে বাজে। মার আসার যে সময় হয়ে গেল" - কপালে হাত ঠেকাতে ঠেকাতে কত্তাকে ডাক দিলেন সুপ্রভা দেবী, মণিশঙ্করবাবুর স্ত্রী। তার জীবনে প্রথমবার, মহালয়ার দিনে একরাশ মন খারাপ নিয়ে পালঙ্কের উপর উঠে বসলেন মনিশঙ্করবাবু, সাথে ভাবনা, কি জানি, এই স্বপ্নের মাধ্যমে মা কি বোঝাতে চাইলেন। দূর থেকে ভেসে এল "বাজলো, তোমার আলোর বেনু"।

(দুই)

মহালয়ার গান শুনতে শুনতে পুকুর পাড়ের দিকে হাঁটা দিল বিশু কুমোর। তাড়াতাড়ি চান সেরে মোড়লবাড়িতে ছুটতে হবে, কারন আজ যে মার চক্ষুদান । বংশপরম্পরায় প্রায় একশো বছর ধরে, বিশুর পরিবার মোড়লবাড়ির ঠাকুর গড়ে আসছে। ওর দাদু প্রথম ঠাকুর গড়া শুরু করেছিলেন, তারপর ওর বাবা, আর এখন ও নিজে। আর এতদিন ধরে একসাথে কাজ করার জন্য ওদের আর মোড়লদের সম্পর্কটা ঠিক প্রভু-ভৃত্যের মতো নেই, বরং অনেকটা পরিবারেরই মতো হয়ে গেছে। বিশুর পরিবারে, বিশুর স্ত্রী মালতী ছাড়া আর কেউ নেই। বহু বছর আগে, ওদের মেয়ে উমা পাঁচদিনের জ্বরে মারা গেছে। খুব কষ্ট হয়েছিল ওদের, কিন্তু সবই মার বিধান বলে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। আর মনিশঙ্করবাবুর সাথে ওদের আর একটা বিষয়ে খুব মিল আছে, সেটা হলো, উনি যেমন দেবীকে তার মা ভাবেন, বিশু-মালতীও, উমা যাবার পর থেকেই দেবীকে তাদের মেয়ে ভাবেন। পুকুরপাড়ে পৌঁছেই তাড়াতাড়ি গায়ের গামছা খুলে জলে নেমে গেল বিশু। বেশ কয়েকটা ডুব দিয়ে, ও যখন পুকুরের পাড়ে উঠল, তখন চারদিকে হালকা সূর্যের আলো ফুটে গেছে। হঠাৎই ওর চোখ পড়ল পুকুরপাড়ে জন্মানো কলাবনের দিকে, কে যেন একটা শুয়ে আছে মনে হচ্ছে । কলাবনে কে শুয়ে থাকতে পারে, তাও আবার এই সময়ে, ভেবে খুব অবাক হয়ে গেল বিশু। কৌতূহলবশত কলাবনে গিয়ে দাঁড়ালো মাত্রই, ভূত দেখার মতো চমকে উঠল সে।একটা পনের ষোল বছরের মেয়ে, অর্ধমৃত,বিবস্ত্র অবস্থায় পড়ে আছে। চোখের তলায় কালশিটে, ঠোঁটের কোণ দিয়ে রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে আর সারা গায়ে অজস্র নখের আঁচড়ের দাগ। মেয়েটা এ গ্রামের না,কোথা থেকে এসেছে, আর ওর এই সর্বনাশই বা কে করল, কিছুই বুঝতে পারল না বিশু। কিন্তু মানবিকতার খাতিরে নিজের গা থেকে গামছা খুলে মেয়েটার গায়ে জড়িয়ে দিয়ে, দৌড়ে মালতীকে ডাকতে গেল বিশু। মালতীকে নিয়ে বিশু যখন ফিরল, তখন পুকুরের পাড়ে অনেকে ভিড় করেছে।

সবাইকে ঠেলে সরিয়ে মেয়েটাকে,একটা ভ্যানে তুলে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাবার সময় কেন জানি না, বিশু-মালতী দুজনেরই মনে হল তাদের মেয়েটা বেঁচে থাকলে, মনে হয় এরকমই বড় হত। আর বিশু স্বাস্থ্যকেন্দ্রে থাকার জন্যে, এই প্রথমবার মাহেন্দ্রক্ষণে, মোড়লবাড়ির দেবীপ্রতিমার চক্ষুদান হল না।

(তিন)

পুজো শুরু হয়ে গেছে । চারদিকে উৎসবের পরিবেশ। বাড়িভর্তি আত্মীয়-স্বজন, কিন্তু মণিশঙ্কর বাবুর মনে শান্তি নেই । একে তো এত বছরে এই প্রথমবার, মাহেন্দ্রক্ষণে মার চক্ষুদান হলো না, তার ওপর কোথা থেকে একটা মেয়ে এসে বিশুর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। আর তারপরেই, গাঁয়ের লোক মনিশঙ্করবাবুর কাছে এসে বিহিত চেয়েছে এই বলে যে, এই মেয়ে নষ্টা, ভালো মেয়ে নয়। কোন ভালো মেয়ের সাথে এরকম হয় না। আর এ যদি গ্রামে থাকে, তাহলে সব মেয়ে নষ্ট হয়ে যাবে। আর, ওদিকে বিশু বলছে যে, অনাথ মেয়েটার কোন দোষ নেই । ও যে হোমে থাকত, সেখানকার লোকেরাই ওর এই অবস্থা করে, ওকে এখানে ফেলে দিয়ে গেছে। তো ব্যাপারটা সরেজমিনে দেখার জন্য উনি ঠিক করেছেন, উনি নিজেই মেয়েটিকে বিশুর বাড়িতে গিয়ে দেখে আসবেন এবং সেইমতো বিধান দেবেন। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। সপ্তমীর পুজো শেষে, বিশুর বাড়ির দিকে মনিশঙ্করবাবু রওনা হলেন। বেশীক্ষণ লাগল না বিশুর বাড়ি পৌঁছাতে, তারপর দরজায় কড়া নাড়লেন। ভেতরের থেকে মালতীর গলা ভেসে এল, "উমা, আমার চানঘর থেকে বেরোতে একটু দেরী হবে মা, দরজা খুলে দেখ তো কে এসছেন আর তোর বাবার খোঁজ করলে একটু বসতে বল, উনি কাজ সেরে এখুনি ফিরবেন।"

মণিশঙ্করবাবু ভাববেন, ব্যাপারটা ভালোই হলো, বিশু-মালতী দুজনেই অনুপস্থিত, এই সুযোগে মেয়েটিকে তিনি ভালোভাবে জেরা করে নিতে পারবেন। ওরা থাকলে তিনি হয়তো এতটা খোলাখুলি কথা বলতে পারতেন না, কারন এই কদিনেই মেয়েটা ওদের মরা মেয়ে, উমার জায়গাটা নিয়ে নিয়েছে। এমনকি ওরা ওকে উমা বলেই ডাকছে। অবশ্য ওদের আর দোষ কি, এতদিন পরে মেয়ের বয়সী, একজনকে পেয়েছে, আর স্নেহের বশবর্তী হয়ে মানুষ কি না করে! তিনি অবশ্য এসবের ধার ধারবেন না, কারণ তিনি গ্রামের মোড়ল এবং গ্রামের যেটায় ভাল হবে, সেটাই তিনি করবেন। এসব ভাবতে ভাবতেই দরজা খুলে গেল এবং যিনি তাকে দরজা খুলে দিলেন, প্রশ্ন করবার জন্য তার মুখের দিকে এক ঝলক তাকিয়েই, ওখানেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন মণিশঙ্করবাবু।

(চার)

আজ অষ্টমী । অঞ্জলি শেষ । এবার কুমারী পুজো শুরু হবে।  সারা গ্রামের লোক মোড়ল বাড়িতে উপস্থিত,তাদের মধ্যে বিশু-মালতীও আছে। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে, চিন্ময়ী মাকে দেখবে বলে, এমন সময়, আস্তে আস্তে পালকি করে তাকে নিয়ে এলেন মোড়লদের ছেলেরা। চারদিক জয় মা, জয় মা ধ্বনিত হল। এবার মার পুজোর পালা, পুরোহিত মাকে পালকি থেকে বের করে সিংহাসনে বসাবেন, কিন্তু সকলকে অবাক করে দিয়ে, বিশু আর মালতী সালঙ্কারা, লাল বেনারসী পরা যে মেয়েটিকে পালকি থেকে বার করে আনল, সে আর কেউ নয়, উমা। এই দৃশ্য দেখে গ্রামের লোকজন চিৎকার চেঁচামেচি জুড়ে দিল। একজন ধর্ষিতাকে তারা কখনোই দেবীরূপে মানবে না, এই কথা সগর্বে ঘোষণা করে, তারা উমাকে সিংহাসন থেকে নামাবার জন্য এগোতেই, পেছন থেকে গুলির শব্দ শোনা গেল। সবাইকে চমকে দিয়ে আসরে এসে দাঁড়ালেন মণিশঙ্কর বাবু এবং বললেন, "প্রত্যেক মেয়ের মধ্যেই মা লুকিয়ে আছেন আর ওর মধ্যে তো আমি তাকে চাক্ষুষ দেখেছি। আর ধর্ষণ? ওটা ধর্ষিতার দোষে হয় না,হয় ধর্ষণকারীর দোষে। আর উমা মার অপরাধীদের যাতে শাস্তি হয়, সেটা ও আমি দেখব। আর পুজো ওরই হবে, সে তোমরা থাক না থাক।"

ওনার স্বরে এমন কিছু ছিল যে কেউ ওখান থেকে নড়ল না। পুজো শুরু হয়ে গেল। ধুপ-ধুনোর ধোঁয়ার মধ্যে বিশু-মালতী সহ অনেকেরই মনে হচ্ছে যে ,দেবীমূর্তি আর উমা যেন এক হয়ে গেছে। আর  সবার সামনে বসেছেন, মণিশঙ্করবাবু, চোখে মুখে প্রশান্তির ছাপ, কারণ তিনি জানেন, নিয়ম ভেঙে, আজ রাতে মা, আবার তার স্বপ্নে আসবেন, আর সেটা দশমীর ধেবড়ানো সাজে নয়, অষ্টমীর রাজরাণী বেশে।


basubhutum@gmail.com
কলকাতা



No comments:

Post a Comment