1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, October 21, 2020

মেছো ডাক্তার

 

ছবি : ইন্টারনেট
                                                         দয়াল বন্ধু মজুমদার

          ন্ডগ্রামের ছেলে, ডাক্তারী পড়তে গিয়েই র‍্যাগিং। ওরে বাবা , কী সব প্রশ্ন দাদাদের। সবই যেন  কালীদাশের হেঁয়ালী । কি উত্তর দিলে যে ওরা খুশী হয় , বুঝতে বুঝতেই মাস খানেক কেটে গেল। দু চার দিনেই একটা কথা পরীস্কার; ভালো ছেলে হয়ে থাকা চলবে না। তোমাকে সাবালক করার গুরু দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তোমার কলেজের দাদাদের। আর সে দায়িত্ব পালনে তারাও নিরলস। একটা দুটো বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্নের পরই , অবধারিত ভাবে এসে পড়ে , আদিরসাত্মক আলোচনা।

    কিছু একটা উত্তর না দিলে, দাদাদের অপমান করা হয়ে যায় । চাই কি চড় থাপ্পরও জুটে যেতে পারে। গ্রামের ছেলে দুলাল , খুব তাড়াতাড়িই বুঝে গেল, উত্তর একটা দিতেই হবে, না হলে নিস্তার নেই। একটা বেশ প্রচলিত প্রশ্ন ছিল , “ তোর হবি কি?” হবি কথাটার মানে যে সখ , এটুকু পড়াশুনা করা ছিল। কিন্তু মানুষ মাত্রেই যে একটা হবি থাকা বাধ্যতামূলক, এ বোধটা সে গেঁয়ো ভুতের ছিল না।  সখ নাকি সবারই একটা না একটা থাকেই। এই ব্রম্ভজ্ঞানটা আসতে কয়েকটা রাতজাগা র‍্যাগিংই যথেষ্ট ছিল।

  কতোটা গন্ডগ্রাম থেকে, কতোটা দারিদ্রের সাথে লড়াই করে একটা ছেলেকে ডাক্তারী পড়তে আসতে হয়েছে, এ ধারনা অধিকাংশেরই ছিলনা। তবে  এটাও ঠিক, মুলে তো ওসব ডাক্তারী পড়ুয়ারা বুদ্ধিমান ছাত্রই। দলের পাঁচ জনের ভেতর তিন-চার জনই বুঝে যেত , এ বেচারার সে অর্থে কোন হবি নেই। কিন্তু তাই বা হয় কি করে; আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত , শুধুই পড়াশুনা করে গেছে একটা ছেলে? তার বাইরে কিছুই কি করেনি?

   ঐ তিন জনের কেউ একটা খুঁটিয়ে প্রশ্ন করে বোঝার চেষ্টা করতো, পড়াশুনার বাইরে , এ ব্যটা আর কি করতো। নিজের বাড়ীর চাষের কাজে, বাবা দাদাকে সাহায্য করার জন্য, কাস্তে কোদাল নিয়ে মাঠে নেমে পড়তে হত, এতটা ভাবার মত মনের জোর বোধ হয় সবার ছিলও না। বাবা কি করতেন রে? একেবারে চাষির ছেলে নয়, এই সংবাদটা বোধহয় ওদের একটু স্বস্তিও দিত।

   দু একজন শহরের ছেলে, ষ্টাম্প কালেকশন, গল্পের বই পড়া, গান শোনা ,এসব হবির কথা বলত বটে; কিন্তু ওসব অন্য জগতের ব্যাপার মনে হত দুলালের।

        দু চার দিন চিন্তা ভাবনা করে , একদিন দুলাল বলেই ফেলল , আমার হবি মাছ ধরা। সত্যি বলতে কি , গ্রামে দু একবার বড়দের হুইল ছিপে মাছ ধরতে দেখলেও ওটা যে একটা বড়লোকি সখের ব্যাপার , এটা ও জেনেছে অনেক পরে। আর ও জীবনে কোনদিন ওরকম হুইল ছিপ ধরেও দেখেনি।

       দাদারা বেশ একটা জম্পেশ হবির কথা শুনে একটু খুশিই হল । তবে কিনা কি মাছ, কত বড় মাছ এসব ভেতরের খবর বলতে গিয়ে ও বেশ বুঝে গেল , ওর ঐ পুঁটি ধরা ছিপ , বা বাচাড়ী জালের কথা এরা কেঊ ভাবেনি। অজ পাড়াগাঁয়ে ছেলেপুলেরা কতো কম বয়স থেকে, কতো বিচিত্র ভাবে মাছ ধরে, এখন ভাবলে অবাক লাগে। ছিপ, জাল, ঘুনি - মুগরী, হাঁড়ি গাড়া, পুকুর গোলানো, মাছ কাটা, কৈ মাছ কুড়িয়ে পাওয়া , নানান বিচিত্র পন্থা। সামান্য কটা মাছের জন্য কী সব দুঃসাহসিক কাজ করছে, এখন ভাবলে ভয় হয়।

    সেই বন্যার সময়, রাতের বেলা , দাদার সাথে মাছ কাটতে বেরনো; আজও পুর্ব জন্মের স্বপ্ন মনে হয়। বন্যার জলে মাঠ ঘাট সব ডুবে যেত। জেগে থাকত বাড়ী সহ বাস্তু ভিটাটা। একশ গজ  মত জল পেরিয়ে বড় রাস্তায় ওঠার জন্য থাকত একটা কলা গাছের ভেলা। দিনের বেলা ভেলায় চড়ে বড় রাস্তায় পৌছে , বাজার দোকানে যেতে হত। রাত্রে মাছ কাটার নেশায় , সাঁতরে জল পেরিয়ে বড় রাস্তায় ওঠা। এর পর রাস্তার পাশে পাশে টর্চের আলো ফেলে দেখলেই , মাছ দেখা যেত। এক হাতে টর্চ ধরে অন্য হাতে একটা দা জাতীয় অস্ত্র দিয়ে ঐ সব  মাছেদের মাথায় আঘাত করলেই হল। দুলালের কাজ ছিল, ঐ মাথা থেতলানো মাছ ব্যগে ভরে দাদার পিছু পিছু চলা। এক দেড় ঘন্টা এভাবে মাছ কেটে ওরা আবার সাঁতরেই ফিরে আসত।

   শরৎবাবুর শ্রীকান্ত যেমন ইন্দ্রনাথের সাথে সাথে রাতের বেলা দুঃসাহসিক কাজ করে বেড়াতো, এও অনেকটা সেরকম।তবে শ্রীকান্ত তো আর হঠাৎ একদিন ডাক্তারী পড়তে হোস্টেলে গিয়ে ওঠেনি।

      তবে হ্যাঁ, ইন্দ্রনাথ যদি বলতেই হয় তো বলতে হবে , নির্মলদাদাকে। দুলালের এই খুড়তুতো দাদা বছর পাঁচেক ছিল ওদের গ্রামের বাড়িতে। জাম গাছের মগডাল থেকে মৌচাক ভেঙ্গে আমার দৃশ্য আজও দুলালের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আর ঐ মাছ কাটতে গিয়ে, কালাচ সাপ মেরে আসা; আজও ভাবলে দুলালের গায়ে কাঁটা দিয় ওঠে। অবশ্য ওটা যে এতো ভয়ংকর বিষধর সাপ, সেটা ওরা তখন জানতোই না। একটা লিকলিকে , ফনাহীন কালো রঙের সাপ যে এমন মারাত্মক ওরা জানতোই না। ওটাকে ওরা কালচিতি সাপ বলতো।

          ঐরকম এক রাতে টর্চ আর দা নিয়ে ওরা মাছ মারতে বেরিয়েছিল। জলের ঠিক উপরে , ভেজা মাটিতে শুয়ে ছিল সাপটা। নির্মলদাদাই দেখতে পায়। নির্বিকার ভাবে বলল, এই দেখ একটা কালচিতি সাপ। দুলাল পেছন থেকে উঁকি দিয়ে দেখলো, কি অনায়াসে সাপটার মাথায় আঘাত করা হল। নির্মলদা বাম হাতে টর্চ লাইট আর ডান হাতে দা ধরে, দায়ের পিছন দিক দিয়ে মোক্ষম আঘাতটা লাগাল।

         তারপর যেন সে রাত্রের বাইশ নম্বর মাছটা মেরে তেইশ নম্বরটা খুঁজতে চললো। নির্মলদা হয়তো চার পাঁচ দিন পরেই বেমালুম ভুলে গেছলো ব্যপারটা। কিন্তু, বিশেষ করে কালাচের মারাত্মক বিষ আর রহস্যের কথা জানার পর, সে ঘটনা দুলাল আর ভুলতে পারে নি।

           আর মাছ কুড়ানো ব্যাপারটা কি? সেই যে হেড স্যারের দশ বারোটা কৈ মাছ কুড়িয়ে বোর্ডিং এ ফেরার গল্প। সে গল্প দুলাল অনেকবারই করেছে। একেবারে গ্রামের লোক না হলে, বুঝবেই না ও জিনিস। গ্রামের লোকেরা সবাই জানে। বর্ষায় এক পশলা বৃষ্টি হলেই , ওপরের মাঠ রাস্তা বা যেখান থেকেই হোক, জল গড়িয়ে পুকুর ডোবায় নামলেই, বিশেষ করে কৈ মাছের দল, পুকুর ছেড়ে ঐ জলের ধারা ধরে, ওপরের দিকে চলতে থাকে। এক সময় ওপর থেকে জল নামা বন্ধ হলেও, ও বেচারারা আর ফেরার কথা ভাবে না। এভাবেই একদিন বিকেলে এক পশলা বৃষ্টির পর , হেড স্যার স্কুল থেকে ফেরার পথে দেখেন, বড় রাস্তা পেরিয়ে একটা কৈ মাছের মিছিল চলেছে। ব্যাস, স্যার ও নিউ কাট জুতোর এক এক আঘাতে ওদের এক একটাকে মেরে , ধুতির কোচরে ভরে , বোর্ডিং এ নিয়ে গেলেন।

       দুলাল এরকম দশ বারোটা মাছের মিছিল কখনো দেখেনি, তবে এক দুটো কৈ বা শোল মাছ কুড়িয়ে পেয়েছে বেশ কয়েক বার।

      হাসপাতালের মাঠের পাশেই বড় পুকুর। পুকুরে সিমেন্টের বাঁধানো সুন্দর ঘাট। একে ওরা বলতো পাকাঘাট। খুব ছোটরা ঐ পাকা ঘাটের সিঁড়ি আর বসার জায়গায় ছোটাছুটি , কুমীর ডাঙ্গা খেলতো। অনেকে ঘাটের সিঁড়িতে বসে , ছোট ছিপ দিয়ে পুঁটি , চ্যালা, ট্যাঙ্গরা মাছ ধরতো।

      সাঁতার শেখার পর , গ্রীষ্ম কালে ঐ পুকুরে , গ্রামের দশ বারোটা ছেলে দাপিয়ে বেড়াতো। ঐরকম একদিন, দুলালের পায়ের তলায় পড়েছিল একটা বড় গলদা চিংড়ি মাছ। সাঁতারের কথায় মনে পড়ে , পুকুরে ফুটবল পড়ে যাওয়ার কথা। পাশের হাসপাতালের মাঠে খেলতে খেলতে পুকুরে প্রায়ই বল পড়ত। তখন সবাই মিলে ঢিল মেরে মেরে বলকে পাড়ের দিকে আনার চেষ্টা। গরমের দিন হলে কেউ একটা ঝাঁপিয়ে পড়তো জলে।

          ফুটবল ! ঐ হদ্দ গ্রামের ছেলেরা ফুটবল পেল কোথায়? দুলালরা যখন ক্লাশ ফাইভে বা সিক্সে পড়ে, হাসপাতালে ছিলেন ডাক্তার দাস। সেই বোধহয় প্রথম ডাক্তারবাবু যার সাথে দুলাল কথা বলেছিল। একটা তিন নম্বর ফুটবল কিনে দেওয়ার আব্দার করে, পেয়েও গেছল , ডাক্তারবাবুর থেকে। ডাক্তার আর দেবদূত ওদের কাছে একই ছিল তখন। খেলার মাঠের পাশ দিয়ে ডাক্তারবাবু হেঁটে গেলে, ওরা খেলা থামিয়ে অপেক্ষা করত। নিজেদের মধ্যে কথা বলতো চাপা গলায়।

      সত্যি বলতে কি , সে সময় কেন, মাধ্যমিক পাশ করে বারো ক্লাসে পড়ার সময়ও দুলাল, ঐ রকম দেবদূত হওয়ার স্বপ্নও দেখেনি কোনদিন। তার আগে ওদের ঐ গ্রামের হাসপাতালে আরও জন দুই তিন ডাক্তার বাবু এলেও, তাদের ভিন গ্রহের প্রাণীই ভাবতো ওরা। পাশের গ্রামে ছিলেন গোষ্ঠ ডাক্তারবাবু। এমন কি গোষ্ঠবাবুর বড় ছেলে যখন স্কুলে পড়ে, তখন তাকেও ওরা খোকনডাক্তার বলতো। অনেক পরে, খোকনডাক্তার , ইস্কুলে শিক্ষক হলেও, তাকে দুলালরা খোকনডাক্তারই বলতো।

        সম্ভবত নিজে ডাক্তারী পড়তে যাওয়ার পর, দুলাল বুঝতে শেখে যে, গোষ্ঠ ডাক্তারবাবু বাস্তবে একজন হাতুড়ে ডাক্তার ছিলেন। কিন্তু উনিই বহুদিন পর্যন্ত ছিলেন, গ্রামের প্রায় সব বাড়ীর ফ্যামিলি ফিজিসিয়ান। দুলালের বাবা মাও গোষ্ঠ বাবুকে খুব শ্রদ্ধা করতেন।

        নিজের বোধ বুদ্ধি হওয়ার পর, দুলাল বুঝতে পারে, ওদের বাড়ির অবস্থা এতোই খারাপ ছিল যে, গোষ্ঠবাবুকে কোনদিনই ভিজিট দেওয়া হতো না।

      কতো কম বয়েসের কথা, পরে আর মনে করতে পারেনি দুলাল। একদিন দুপুরে ও দাদার পিছন পিছন পুকুর পাড়ে গেছল। পুকুরের উত্তর পার থেকে দাদা , পুকুরে বাচাড়ী জালটা ছুড়ে দিল। জাল টেনে তুলতেই  একটা বড় রুই মাছ দেখা গেল। মাছটা ডাঙায় তুলেই দাদা বলল, মাছটা ডাক্তারবাবুকে দিয়ে আসি। দুলাল আজ পঞ্চান্ন বছর পর ও যেন দেখতে পাচ্ছে, দাদা ভেজা জালটা পুকুর পাড়ে রেখেই , মাছটা নিয়ে বাড়ীর দিকে ছুটল। তারপর একটা চটের ব্যাগে মাছটা ভরে, সাইকেলের হ্যান্ডেলে ঝুলিয়ে চলে গেল গোষ্ঠ ডাক্তারবাবুর বাড়ী।

       দুলাল নিজে ডাক্তার হওয়ার পর , একবার ওর অপারেশন করা রোগীর বাড়ী থেকে , একটা মোরগ আর কিছু সুগন্ধী চাল দিয়ে গেছল। তখনও দুলাল ওর স্ত্রীকে , গোষ্ঠ বাবুকে রুই মাছ দেওয়ার কথাটা বলেছিল।

  আজ আর সেই রামও নেই, সেই গ্রামও নেই । সেই রকম রুগির বাড়িও নেই, তেমন ডাক্তারজেঠুরাও নেই। মাত্র পঞ্চাশ পঞ্চান্ন বছরে একটা সমাজ, একটা সম্পর্ক কেমন ইতিহাস হয়ে গেল। দুলালরা কি অকারনেই ভাবে, আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম!

dayalbm@gmail.com
কলকাতা




1 comment: