1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, October 21, 2020

দেওয়াল

ছবি : ইন্টারনেট      
                                                               শর্মিষ্ঠা মুখোপাধ্যায়  


     মার ছোটবেলাটা কেটেছে  উত্তর কলকাতার এক সাবেকি পাড়ায় |  পুরোনো পাড়ার  বাড়িগুলো  ছিল  একটু অন্যরকম | নতুন আমলের  মতো বাড়ির চারপাশে কোনো জায়গা ছাড়া হতো না | পরপর পাঁচ- ছয়টি বাড়ি, প্রত্যেক দুটি  পাশাপাশি বাড়ির একটি সাধারণ দেওয়াল থাকতো | এপাশের বাড়িতে দেওয়ালে পেরেক পুঁতলে মাঝে মাঝে ওপাশের বাড়ির দেওয়ালের চুন সুরকি খসে পড়তো | ওপাশের বাড়ির কাঠের দরজার উইপোকা এপাশের বাড়ির দেওয়াল আলমারির ভিতর অবাধে প্রবেশ করে সর্বনাশ সাধন করতো |এবাড়ির মেয়ের হারমোনিয়াম বাজিয়ে সরগম সাধা ওবাড়ির গিন্নি রান্না করতে করতে শুনতেন | আবার ওবাড়ির দাম্পত্য কলহ এবাড়ির লোক বেশ উপভোগ করতো | মাঝে মাঝে কারোর বাড়িতে কোনো বিয়ে-পৈতে-শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হলে ছাদের দেওয়াল গুলো ভেঙে দেওয়া হতো | ভেঙে দেওয়ার অর্থ জুড়ে দেওয়া | অর্থাৎ ছাদের অলিন্দ দিয়ে এক ছুটে সোজা সিঁড়ি দিয়ে নেমে পাশের বাড়ির একতলার বৈঠকখানায় |

    আমাদের বাড়িটা ছিল অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থানে | সব শেষের বাড়িটা ছিল আমাদের -চার তলা, দক্ষিণ খোলা, সেদিকে ছিল উন্মুক্তমাঠ; পশ্চিমে গঙ্গা আর উত্তর দিকে ছিল একের পার এক চার পাঁচটি বাড়ি | তাই আমরা বসন্ত কালের দখিনা বাতাস যেমন উপভোগ করতাম, তেমনই সে বাড়িতে শীতের রুক্ষ্ম উত্তরের হাওয়ার প্রবেশাধিকার ছিল না | আমাদের বাড়ির পশ্চিম দিকে একটা বাড়ি ছিল যেটা সব বাড়িগুলোর থেকে আলাদা | শুনেছিলাম, অন্য বাড়িগুলি তৈরি করার সময় এটিকে গুদাম-ঘর হিসাবে ব্যবহার করা হতো | পরে মালিক ঘরটি বিক্রি করে দেয় | উঁচু উঁচু অভিজাত বাড়িগুলোর পাশে বেমানান অত্যন্ত সাদামাটা একটি বাড়ি | বাড়িটার ওপর ছিল আসবেস্টসের ছাদ | ঢুকেই সরু গলির মতো একটা উঠোন, বাঁ দিকে ঘুরে একটা লম্বাটে ঘর, যার মাঝামাঝি জায়গায় পাশাপাশি ও  মাথায় মাথায় অনেকগুলো ট্রাঙ্ক দিয়ে দুটো মাঝারি মাপের ঘর বানানো হয়েছে | এই অভিনব ট্রাঙ্ক নির্মিত অস্থায়ী দেওয়াল আমার শিশুমনকে  সর্বদা আকৃষ্ট করতো | ভাবতাম, আমাদেরও যদি এমনি দেওয়াল থাকতো, যখন খুশি ঘর ছোট-বড় করা যেত | অপরিসর স্থানেই এক কোনায় একটি পরিপাটি ঠাকুরঘর ছিল যার মধ্যমণি ছিল একটি রাধাকৃষ্ণের মূর্তি | রাসপূর্ণিমা ও ঝুলন পূর্ণিমায় পুজো হতো | 

     সে বাড়ির বাসিন্দারাও ছিল অন্য বাড়িগুলোর বাসিন্দাদের থেকে অন্যরকম |  ওপার বাংলাকে বিদায় জানিয়ে এপার বাংলায় এসে ঘাঁটি গেড়ে বসা একটি রেফিউজি পরিবার | শিরদাঁড়া ঝুঁকে যাওয়া এক অশীতিপর বৃদ্ধা, যাঁর সঙ্গে পথের পাঁচালীর ইন্দির ঠাকরুনের ভীষণ রকমের মিল ছিল | বড় ছেলেটি পালিত পুত্র, মধ্যবয়সী; প্রথমা স্ত্রী গত হবার পর দ্বিতীয়বার বিবাহ করেছেন | দুই পক্ষ মিলিয়ে মোট নয়টি সন্তান- ছয় ছেলে, তিন মেয়ে | ছোট ছেলেটি বৃদ্ধার নিজের, মধ্য-ত্রিশের একজন সৎ শান্ত প্রকৃতির ভদ্রলোক | তাঁর পরিবার বলতে একটি মুখরা  স্ত্রী, একটি শিশুপুত্র ও একটি শিশুকন্যা | ঐটুকু জায়গায় ষোলো জনের সহাবস্থান কিকরে সম্ভব হতো, তা ছিল সত্যি ভাববার বিষয় |পুরুষ সদস্যদের অনেকেই বাধ্য হয়ে পারিবারিক কাঠের দোকানে রাত্রিবাস করতেন |

    সহাবস্থান হলেও তাকে ঠিক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বলা যেত না | উত্তর কলকাতার লোকেদের বৈশিষ্ট্য হলো তাদের কথোপকথন বেশ চড়া সুরে বাঁধা | তার ওপর পূর্ববঙ্গীয় টানে যখন পরস্পরের সঙ্গে উচ্চৈস্বরে উত্তেজিত বাক্যালাপ হতো, তখন পাড়ার লোকেদের সবসময় সুখকর অনুভূতি হতো না | বড় ভাইয়ের পরিবারের সঙ্গে ছোট ভাইয়ের স্ত্রীর প্রায়শই ঝগড়া ঝাটি লেগে থাকতো | অগণিত অপত্য সহ পালিত পুত্রের বাড়ি ও দোকানের দখলদারি নেওয়া যে তাঁর অপছন্দ তা তিনি মুহূর্তে মুহূর্তে নানাভাবে বুঝিয়ে দিতেন |নেহাত ভালোমানুষ স্বামীর দাদা-বৌদির প্রতি অটল ভক্তি ও বিশ্বাসের জন্য একতরফা বাকযুদ্ধে ক্লান্ত হয়ে তিনি অবশেষে ইস্তফা দিতেন | 

       আমার ছিল ওবাড়িতে অবাধ গতি | ঠাকুমা, জেঠাবাবু-জেঠিমা, কাকাবাবু- কাকিমা -এই নামেই ডাকতাম ওবাড়ির কর্ত্রী ও তাঁর ছেলে-বৌমাদের | আর পরবর্তী প্রজন্মের সঙ্গে আমার ছিল দাদা-দিদি, ভাই-বোনের সম্পর্ক | বিশেষ করে মিনিদি, রিনিদি আর বিনিদি - জেঠিমার তিন মেয়ে ছিল এক কথায় আমার রক্ষাকর্ত্রী | আমি স্কুলের ওয়ার্ক এডুকেশনের জন্য  উল-কাঁটা দিয়ে সোজা-উল্টো বুনতে গিয়ে গলদঘর্ম হচ্ছি, আর পিঠে মায়ের গুম-গুম কিল পড়ছে; রিনিদি ছুটে এলো উদ্ধারকর্ত্রী হয়ে | "ছাড়ো তো মাইমা, আমার কাছে আয় কাজল,আমি শিখিয়ে দিচ্ছি |" কিংবা ক্লাস নাইন-এ প্রথম স্কুলের শাড়ি পরা | বার বার কুঁচি আর আঁচলের প্লিট করা শেখাতে গিয়ে আমার অধৈর্য মা যখন বিনুনিতে টান দিতেন, কোথা থেকে ঠিক মিনিদি ছুটে আসতো আমায় বাঁচাতে | যে কাকিমা সবসময় কলরব-মুখর, তিনিও জন্মাষ্টমীর তালের বড়া বা বিজয়া দশমীর নারকেল নাড়ু আমাকে না খাইয়ে খেতেন না |  ডাক্তার হবার সুবাদে আমার বাবা ওই পরিবারের ছোট-বড় রোগের চিকিৎসা তো করতেনই, তার সঙ্গে তিনি ছিলেন তাদের অলিখিত অভিভাবক | কাকিমা- ভাসুরপো, স্বামী-স্ত্রী, এদের কারো মতান্তর বা ঝক্কি-ঝামেলা হলে বাবা গিয়ে একবার দাঁড়ালেই অনেক সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসতো | 

     এহেন দুই পরিবারের সখ্যের মাঝে এক প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতো দুই বাড়ির উঠোনের মাঝের দেওয়াল | দলিল অনুযায়ী দেওয়াল ছিল পাশের বাড়ির, অথচ তার একপিঠ পড়তো আমাদের বাড়ির দিকে | প্রতি দুই বছর অন্তর আমাদের বাড়ি রং করা হতো |  আর তখনই শুরু হতো গণ্ডগোল | পাশের বাড়ির ছোট থেকে বড় সব সদস্যরা তেড়ে আসতো আর দাবি করতো তাদের দেওয়ালে আমরা রং করতে পারি না | কাকিমা থাকতেন পুরোভাগে, মার সঙ্গে হৈচৈ জুড়ে দিতেন | মাও উত্তেজিত হতেন আর বলতেন, " আশ্চর্য ব্যাপার, আমাদের বাড়ির দিকটা আমরা রং করতে পারবো না? বাড়িতে ঢুকেই লোকে ওই শেওলা ধরা নোনা দেওয়ালটা দেখবে, আমার ক্ষমতা থাকলেও আমি রং করতে পারবো না ? এ কেমন নিয়ম ? " কিছুক্ষন বাদে বাবা আসতেন হাসপাতাল থেকে আর কাকাবাবু ফিরতেন দোকান থেকে | কাকিমা আর মা দুজনেই যে যার কর্তাকে উৎসাহিত করতেন সম্মুখ সমরে নামতে | কাকাবাবু কাঁচুমাচু হয়ে বলতেন, "দাদা, আপনি তো জানেন, এটা আমাদের দেওয়াল, এতে হাত না লাগালেই ভালো |" আমার বড়মামা ছিলেন উকিল | এসব ক্ষেত্রে সাধারণত তাঁর ডাক পড়তো | দলিল দেখে তিনি রায় দিতেন, " আইনত তো ওদের দেওয়াল, ওদের বাধা দেওয়াটা যুক্তিযুক্ত |" আমার শান্তিপ্রিয় বাবা সঙ্গে সঙ্গে রনে ভঙ্গ দিতেন | মা খানিকক্ষণ গজগজ করে অবশেষে চুপ করতেন |

      প্রতি বছর একই নাটকের পুনরাবৃত্তি হতো, কিন্তু একবার নাটকটা একটু অন্যরকম হলো | আমাদের বাড়ির নিরাপত্তার জন্য বাড়িতে কোলাপ্সিবল গেট বসাবার কথা হলো | মিস্ত্রি কাজ করা শুরু করতেই ওপাশ থেকে বাধা এলো | হুক, পেরেক, কল-কব্জা কিছুই ওদিকের দেওয়ালে লাগানো যাবে না | আমার মা উত্তেজিত, " তবে কি আমার বাড়ির গেট টা হাওয়ায় ভাসবে ?" দুই পরিবারের তর্কাতর্কি বাক্য বিনিময়ের পরে অবশেষে গেট বসলো, কিন্তু ওদের দেওয়ালে একটা পেরেকও পোঁতা গেলো না | উপর, নীচ আর পুবদিকের দেওয়ালে কব্জা লাগানো হলো, পশ্চিমের দেওয়াল বাদ দিয়ে | এতে আমাদের লোহার গেটটা খুব একটা মজবুত হলো না ঠিকই, কিন্তু দুই পরিবারের মজবুত বাঁধনটা কিছুটা হলেও রক্ষা পেলো | অনেক পরে বড় হয়ে বুঝতে পেরেছিলাম, এটা ছিল অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই, বিবাদ- বিদ্বেষ নয় |  

   এবার কিন্তু অন্যবারের মতো ব্যাপারটা এখানেই থেমে গেলো না | রাত্রে যখন সবে চোখে ঘুম এসেছে, শুনতে পেলাম মা বাবাকে বলছেন, " সারাজীবন এই অশান্তি আর ভালো লাগে না, তুমি একটা কিছু ব্যবস্থা করো | চলো আমরা ওদের বাড়িটা কিনে নি, আমাদের তো ক্ষমতা আছে | ভালো দাম পেলে নিশ্চয় ওরা টোপটা গিলবে | তখন আমরা দুই বাড়ির মাঝের দেওয়ালটা ভেঙে দেব | দুটো বাড়ির দরজা মিলিয়ে একটা বড় লোহার গেট হবে | আর দুটো উঠোন জুড়ে যে চৌকোনা জায়গাটা হবে, সেখানে হবে আমাদের গ্যারাজ স্পেস | গাড়িটাকে তাহলে আর বাড়ির বাইরে অন্যলোকের গ্যারাজে রাখতে হবে না |"

  সেদিন রাত্রে আমি একটা সুন্দর স্বপ্ন দেখলাম | দেখলাম, আমাদের বাড়িটা কেমন রাজবাড়ীর মতো ঝলমল করছে | বাড়ির সামনে বিরাট বড় লোহার গেট, তার দুপাশে বোগেনভিলিয়ার ঝাড় | গেটের সামনে একজন ইয়া বড় মুচওয়ালা দারোয়ান | আমি ব্যাগ পিঠে নিয়ে স্কুল থেকে ফিরতেই সে সেলাম মেমসাব বলে গেট খুলে দাঁড়ালো | ঘুম ভাঙলো কেমন একটা সুখের অনুভূতি নিয়ে | কিন্তু পরক্ষনেই মনে পড়ে গেলো এই বড় বাড়িটার বাসিন্দা হতে হলে ওবাড়ির সদস্যদের হারাতে হবে | এক নিমেষে আমার সব আনন্দ উবে গিয়ে চোখ ছলছল করে উঠলো | মা প্রস্তাবটা পেড়েছিলেন ওবাড়ির মালিকদের কাছে, কিন্তু তাঁরা সে প্রস্তাবে সম্মত হন নি | আমার তাই আর প্রহরী-রক্ষিত সিংহদুয়ার-সমন্বিত রাজবাড়িতে থাকা হয় নি |

    তারপর অনেক বছর কেটে গেছে | ওবাড়ির বাসিন্দার সংখ্যা ধীরে ধীরে কমতে থাকে | প্রথমে ঠাকুমা, তার কয়েক বছর পর জেঠাবাবু মারা গেলেন | মিনিদি-রিনিদি-বিনিদির একে একে বিয়ে হয়ে গেলো | কাকাবাবুর অকালমৃত্যু ছিল সবথেকে দুঃখজনক | মাঝরাতে হঠাৎ বুকে ব্যাথা ও মৃত্যু, হাসপাতাল অবধি নিয়ে যাবারও সময় হয় নি | জেঠিমাকে নিয়ে ছেলেরা অন্যত্র ঘর ভাড়া করে চলে গেলো | বাড়িতে পড়ে রইলো শুধু কাকিমা আর তাঁর দুই ছেলে মেয়ে অমল আর প্রিয়া | পারিবারিক কাঠের ব্যবসাটাও ধীরে ধীরে ঝিমিয়ে পড়লো |

    আমাদের বাড়ির দৃশ্যপটও ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে থাকে | আমি ডাক্তারি পাশ করি | তারপর চাকরি সূত্রে ও বৈবাহিক সূত্রে আমাকে কলকাতার বাইরে চলে যেতে হয় | বাবার ক্যান্সার ধরা পড়াটা আমাদের সুখী পরিবারে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো | বাবাকে নিয়ে প্রবল উদ্বেগের মধ্যে দিন কাটাতে কাটাতে পাশের বাড়ির লোকগুলোকে নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করার আর অবকাশ পাই নি | এর মধ্যে প্রিয়ার বিয়ে হয়ে গেছে | মায়ের মুখে শুনেছিলাম অমল নাকি ভাগ্যান্বেষণে দিল্লী চলে গেছে | অবশেষে বাবা মারা যাবার পর মাকে নিয়ে চলে এলাম আমার চাকরিস্থলে | বসত-বাড়িটা  বেচে দিতে বাধ্য হলাম | বহু স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটা ছেড়ে চলে আসতে মায়ের যে কতটা কষ্ট হয়েছিল তা বুঝতে পারি | পরিত্যক্ত বাড়িতে হৃদপিন্ডটাকে গচ্ছিত রেখে যেন প্রাণহীন কায়া নিয়ে মা চোখের জল মুছে আমার সঙ্গে রওনা দিলেন | পিছনে পড়ে রইলো বহু স্মৃতি | সেই দক্ষিণের খোলা মাঠ, পশ্চিমে গঙ্গার ওপারে সূর্যাস্তের আভা, বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে এক দৌড়ে বাড়ি ফেরা, সেই নারকেল নাড়ু আর তালের বড়া, ঝালমুড়ি-কাঠি আইসক্রিম, প্রতিবেশীদের সঙ্গে উত্তপ্ত বালুকার মতো তপ্ত বাক্য বিনিময় এবং তার অন্তরালে অন্তঃসলিলা ফল্গুধারার মতো চিরবহমান স্নেহ-ভালোবাসা সবকিছুকে বিদায় জানিয়ে শুরু হলো নতুন পথে চলা | 

   কালের গর্ভে চলে গেলো আরো পনেরোটা বছর | গুরগাঁওয়ের একটি দোতলা বাড়িতে স্বামী, দুই পুত্র-কন্যা আর মাকে নিয়ে আমার সুখের সংসার | দিল্লীর একটি সরকারি হাসপাতালে আমি আজ একজন প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার |একদিন ওয়ার্ডে রাউন্ড দিচ্ছি , হঠাৎ একজন বৃদ্ধা ভদ্রমহিলাকে অজ্ঞান অবস্থায় সবাই ধরে নিয়ে এলো | শীর্ণকায়া মহিলা, অপুষ্টির চিহ্ন সারা শরীরে; শুনলাম রাস্তার ধারে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন, রাস্তার লোক তুলে এনেছে | কিছুক্ষনের মধ্যে সমস্ত রক্ত পরীক্ষা ও মাথার সি.টি স্ক্যান হয়ে গেলো | রক্তে লবনের পরিমান কমে যাওয়ায় এই বিপত্তি | জুনিয়র ডাক্তারদের তৎপরতায় আর নার্সদের সেবা-শুশ্রূষায় মহিলা দ্রুত সেরে উঠতে লাগলেন |

   দিন তিনেক বাদে আবার ওয়ার্ডে রাউন্ড দিচ্ছি | পিছন থেকে কে যেন ডাকলো " কাzল না?" আমাকে কাজল বলে ডাকার লোক এখন প্রায় নেই বললেই চলে | ছোটবেলায় পাড়ার লোক আমাকে ওই নামে ডাকতো ঠিকই, কিন্তু  কাz? পূর্ববঙ্গীয় টানে ছোটবেলার ডাক নামে কে ডাকতে পারে আমায় আজ এই প্রবাসে ? ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম তিন দিন আগে ভর্তি হওয়া বৃদ্ধা আজ উঠে বসেছেন | শীর্ণ চেহারা, এক মাথা পাকা চুল, পরনে ধূলি ধূসরিত শাড়ি, কিন্তু চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে | সে চোখের দৃষ্টিতে অসহায়তার মধ্যেও আনন্দের আভাস, যেন কি এক মানিকরতন খুঁজে পেয়েছে | ফিরে তাকিয়ে ভালো করে দেখলাম | সেই চোখ-নাক-মুখ, অভাব-অনটন আর বার্ধক্য চেহারায় পরিবর্তন এনেছে, সেই গলার জোরও আর নেই, তাবু চিনতে অসুবিধা হয় না যে ইনি ছোটবেলার পাশের বাড়ির কাকিমা | রোগীর ভিড়ে, কাজের চাপে আর অন্যমনস্কতার জন্য কাকিমাকে চিনতে পারি নি ভেবে লজ্জা পেলাম |

  কাকিমার মুখে যে কাহিনী শুনলাম তা বিশেষ সুখকর নয় | ছেলে অমল চাকরি খুঁজতে দিল্লী এসেছিলো | কিছুদিন ফোনে যোগাযোগও রেখেছিলো, কিন্তু পরে অজ্ঞাত কারণে সে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে | বেশ কয়েক বছর অপেক্ষা করার পর কাকিমা ছেলের ফেরার আশা ত্যাগ করেন |এদিকে শরীরও ভেঙে পড়ছিলো, আর হাতে পয়সাও শেষ হয়ে আসছিলো; অগত্যা উপায়ান্তর না দেখে ট্রেনে চেপে বসলেন মেয়ের শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্যে | মুর্শিদাবাদে মেয়ের বাড়ি ছিলেনও বেশ কিছুদিন | মেয়ে-জামাই জলের দরে কলকাতার বাড়িটা বেচে দিলো, বাধ্য হয়ে সম্মতি দিলেন | কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে মেয়ের সংসারে থাকা অসম্ভব হয়ে উঠলো | তাই ছেলের পুরোনো ঠিকানা আর ফোন নম্বর সম্বল করে ছেলেকে খুঁজতে দিল্লী এসে হাজির হলেন | কিন্তু এতো বড় শহরে কোথায় খুঁজে পাবেন নিরুদ্দিষ্ট অমলকে? খাদ্যাভাবে শরীর ক্ষীণ ও দুর্বল হয়ে গেলো , মাথা ঘুরতে লাগলো, চোখের সামনে কালো একটা পর্দা নেমে এলো, তারপরে আর কিছু মনে নেই  | একেবারে জ্ঞান ফিরলো হাসপাতালে এসে |

   সেদিন বাড়ি ফিরে মাকে সব কাহিনীর আদ্যোপান্ত বিবরণ দিলাম | অবাক হয়ে দেখলাম, মায়ের চোখের কোণে জল | খুব উতলা হয়ে উঠলেন কাকিমাকে তখনই দেখতে যাওয়ার জন্য, আমি কোনোক্রমে আটকালাম | আমার মাথায় একটা নতুন চিন্তা বাসা বাঁধলো | হাজারবার প্রশ্ন করতেও কাকিমা কিছুতেই মেয়ের ঠিকানা দিলেন না | ছুটি করার পর কাকিমাকে কোথায় পাঠাবো? কাকিমা বললেন, "এখানে কোনো মন্দির বা আশ্রম নেই যার এককোণে একটু জায়গা পাওয়া যায়?" নিরুপায় হয়ে আশ্রমের খোঁজ করতে লাগলাম, কিন্তু সে কি এতই সহজ? রাত্রে মা এসে আমার বিছানায় বসলেন | বললেন, "একটা কথা ভাবছিলাম | আমাদের বাড়িতে তো অনেক ফাঁকা ঘর পড়ে আছে | বিমলাকে এখানে এনে রাখলে হয় না? অন্তত যতোদিন না মেয়ে-জামাইয়ের ওপর রাগ-অভিমান কমছে | আর যদি বরাবরের জন্য থেকে যেতে যায় থাকুক না, আমার কাছে আমার বোনের মতোই না হয় থাকলো |" আমি অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকালাম | " কি বলছো মা? আর্থিক সামর্থ্য না থাকলেও কাকিমার আত্মসম্মান বোধ প্রবল | আমাদের বাড়ি থাকবেন কেন? " মা মৃদু হেসে বললেন, সে দায়িত্ব আমার |" পরদিন সত্যি মাকে নিয়ে হাসপাতালে গেলাম | দুই দশক পরে দুজনে দুজনকে পেতে খুশির বন্যা বয়ে গেলো, দুজনের চোখেই আনন্দাশ্রু | আমাদের বাড়ি যাবার প্রস্তাবে কাকিমা যথারীতি প্রবল আপত্তি করলেন |  কিন্তু মায়ের কথায় কি যাদু ছিল কে জানে, কাকিমা স্নেহের জালে ধরা দিতে বাধ্য হলেন |

   এর পরের পর্ব খুব দ্রুত ঘটে গেলো | আমাদের দোতলার কোণের ঘরটা ঝেড়ে মুছে নতুন পর্দা লাগিয়ে বাসের উপযুক্ত করে তোলা হলো | মা নিজে হাসপাতালে গিয়ে কাকিমাকে সঙ্গে করে বাড়িতে নিয়ে এলেন | এক বৃদ্ধা আর এক বৃদ্ধাকে জড়িয়ে ধরে নিয়ে চলেছেন পুনর্বাসনের উদ্দেশ্যে | সময়ের স্রোতে ভেসে গেছে সব মান-অভিমান, চুরমার হয়ে গেছে ক্ষণভঙ্গুর অহমিকা, মিটে গেছে সব চাওয়া-পাওয়ার হিসাব | অতীত স্মৃতির পটভূমিতে নতুন করে গড়ে  উঠেছে  সখ্যতা ও পারস্পরিক নির্ভরতার এক সৌধ |

   বহুদিন বাদে সেদিন রাত্রে আবার আমি আমাদের ছেলেবেলার বাড়িটা স্বপ্নে দেখলাম | দেখলাম প্রচণ্ড ঝড়ের তাণ্ডবে আমাদের দুই বাড়ির উঠোনের মাঝের দেওয়ালটা ভেঙে পড়ে গেছে | কোথা থেকে যেন চলে এসেছে মিনিদি- রিনিদি-বিনিদি-অমল-প্রিয়া | আমরা সবাই মিলে ছুটে ছুটে ভাঙা দেওয়ালের টুকরোগুলো সরাচ্ছি | আমাদের উঠোনটা কি চওড়া হয়ে গেছে, আর বাড়িটা বিশাল বড় | ঘুম ভাঙতে স্বপ্নটা মিলিয়ে গেলো | চোখের কোণে জল এলো সেই ছোট্টবেলার মতো | কিন্তু এই চোখের জলে ছিল এক অজানা সুখের অনুভূতি | আজ আমি সত্যি বুঝি দেওয়াল না ভাঙলে বাড়ির পরিধি বাড়ে না |   

drsarmishtha67@gmail.com
কলকাতা



1 comment: