![]() |
ছবি : ইন্টারনেট |
‘ভাড়া কত ?’
টুকটুকি থেকে নেমে জানতে চাইল ফাজিলা। কোমর সোজা করে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই হাতের লাঠি পড়ে গেল দুবার । কাউকে উদ্দেশ্য না করেই গাল দিল বুড়ি । ওদিকে টুকটুকি চালক বেশ বিরক্ত । তার দেরি হয়ে যাচ্ছে । নতুন ভাড়া ধরতে হবে । এই বুড়ির জন্য মেলা সময় নষ্ট করলে তার চলবে কেন ? কমপিটিশনের বাজার । এখন পাড়ার অলি গলিতে টুকটুকি দাঁড়িয়ে থাকে। ভাড়া বলেই তুলেছিল। এখন গাড়ি থেকে নেমে আবার ‛ ভাড়া কত ‘ জিজ্ঞাসা করার মানে কী ! তবু ঠান্ডা গলায় বলল, ‛ কুড়ি টাকা ।’
ফাজিলা কঁকিয়ে উঠল, ‛এইটুকুন রাস্তা কুড়ি ট্যাকা ! বলি আমার ট্যাকার গাছ আছে নাকি ?’
‛ রাস্তা কোথায় দেখলে নানি ? ওই টুকুন তো ঢালাই, বড় রাস্তাকে হাত বাড়ায়ে ধরেছে কেবল । বাকি পথ তোমার কোমর দোলুনিতে টের পাওনি ? এখনো তো সোজা হতে পারলে নি । তাড়াতাড়ি ছাড়তো, তোমার সাথে বকলে হবে না ।’
ফাজিলা তবু ঘ্যান ঘ্যান করে । কাপড়ের খুঁট খুলতে খুলতে বলে, ‛আজ তিনদিন হল ব্যাংকে এলুম । ট্যাকা না পেলি আজ একটা হেস্তনেস্ত করব।’ লাঠি ঠুক ঠুক করে ব্যাংকের দরজার দিকে এগোতে থাকে । চোখ তার ব্যাংক থেকে বেরিয়ে আসা গ্রাহকের দিকে । বয়স্ক কাউকে দেখলেই তার সামনে কোমর বেঁকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে, জানতে চায় ,‛ট্যাকা এইয়েছে ?’
‛কীসের ট্যাকা ?’
‛ভাতার ট্যাকা, বিধবা ভাতা ।’
‛তা কী করে বুলব ! আমি তো জমান ট্যাকা নিতে এইয়েছি। যাও, উপরে যেয়ে সুধাও গে !’
দোতলায় ব্যাংক । ফাজিলা সিঁড়ির মুখে এসে দাঁড়ায় । উপরে তাকাতেই ঘন ঘন বুক ওঠানামা করে । বয়সের হিসাবপত্তর ফাজিলা না জানলেও, তার শরীর বিলক্ষণ জানে । বয়স কত, জানতে চাইলে বেমালুম হেসে বলবে, ‛সে হিসেব জানিনে । তা সত্তর আশি হবে !’ তখন তার হাসির দৌলতে গোটা তিন চারেক প্রাগৈতিহাসিক দাঁতের দেখা মেলে ।
সিঁড়ির মাঝামাঝি এসে আবার বসে পড়ে ফাজিলা । পা যেন উপরে উঠতে চাইছে না । বিশেষ করে বাঁ পায়ের হাঁটুতে কোন রস-কষ নেই। উপরের হাড়ের সাথে নীচের হাড়ের সারাক্ষণ ঠোকাঠুকি । ছোট নাতিটা তাকে খুব ভালোবাসে বলে, ময়ার হাট থেকে ধনেশ পাখির তেল এনে দিয়েছিল । দিন কয়েক উঠোনে মাদুর পেতে বসে মালিশ করছিল । একটু যেন যুতও পাচ্ছিল হাঁটুতে। কিন্তু ফাজিলার কপাল ! গত পরশু ছাগলের বাচ্চা তিড়িং করে লাফিয়ে এসে পড়ল সেই তেলের বাটিতে। পড়ে গেল সব তেল। ফাজিলা সিঁড়ির ধাপে পা ছড়িয়ে বসে হাঁটুতে হাত বোলায় । আহারে ! কত ক্ষ্যামতা ছিল এককালে । ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে সারা সংসারের ধান ভাঙ্গত । এই এক হাতেই ধান সেদ্দ , রোদে দেওয়া, গোয়াল পরিষ্কার করা, সারাদিন কাজ আর কাজ । রাতে বাতি নিভিয়ে না শোয়া পর্যন্ত হাঁটুর বিশ্রাম ছিল না । এখন কি তারই শোধ নিচ্ছে, মরা ?
হাঁকপাঁক করে আরো কয়েক ধাপ উঠে আবার বসে পড়ে। পাশ দিয়ে যারা নেমে যাচ্ছে , পারলে সবাইকে সুধায়,‛দিল ভাতা ?’ সবাই যেন তার মতোই ভাতা তুলতে আসে ব্যাংকে । গেরামে সরকার ব্যাংক খুলেছে, তাদেরকে ভাতা দেবে, ঘরের ট্যাকা দেবে, একশো দিনের কাজের ট্যাকা দেবে, টিভিতে বলছে আরো কত কী দেবে । তা দেবে নাইবা কেনে? বছর বছর হাত উপুর করে ভোট দিচ্ছে না ? এই তো ক’মাস আগেই ভোট হল । আগের দিন রাতে দলবল নিয়ে মেম্বার হাতে একশোটা ট্যাকা গুঁজে দিয়ে বললে, ‛নানি, মাসে মাসে ভাতা পাচ্ছ তো ?’ বলতে যাচ্ছিল, ‛প্রেত্যেক মাসে পাচ্ছি কুথায় ?’ হাতের কড়কড়া নোটটার দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলে নিল ।
মেম্বার আরো বললে, ‛ভাতা আরো বাড়বে নানি । কাল সকাল সকাল চলে যাবা । চিহ্ন মনে আছে তো ?’ ফাজিলা ফোকলা দাঁতের হাসি ছড়িয়ে বললে, ‛আমি ঠিকঠাক নজর পাইনে । ওপাড়ার দীনুই আমার হাত ধরে টিপে দেয় । ভুল হবে কেনে ?’
হঠাৎ পাশের গ্রামের গৌরীকে নেমে আসতে দেখে খুশিতে ডগমগ ফাজিলা । কোমর বেঁকিয়ে হাসে, ‛ও গৌরী, গেলবার তোকে দেখলুম না যে ?’
গৌরী পরম সোহাগে ফাজিলার কাঁধে হাত রাখে । একসময় একই গ্রামে বাস ছিল তাদের । বিয়েও হল পাশাপাশি গ্রামে । তারপর পরবে, উৎসবে, কখনো বা কোন মেলায় দেখা হত । এখন জীবন সায়াহ্নে বিধবা ভাতা নিতে এসে তাদের দেখা হয় এই ব্যাংকে । আর দেখা হলেই ফিরে ফিরে আসে সেই কবেকার কিশোরী বয়সের ফেলে আসা গ্রাম, পরিচিত কত মানুষের স্মৃতি, কোলাহল, আনন্দ, বিষাদ। নানান গল্পকথায় মেতে উঠে তারা ।
গৌরী বলল,‛একটু তীর্থ করে এলুম রে ! বেন্দাবন গিয়েছিনু । আমাদের গেরাম থিকে হালদাররা বাস ছেড়েছিল । ছোট ছেলের কী মতিগতি হল, বুলল, চল মা, তোমায় একবারটি বেন্দাবন ঘুরিয়ে নে আসি!’
ফাজিলার চোখ চকচক করে, ‛বলিস কী রে গৌরী ! আহা, কী পুন্নিমান তুই ! গভ্ভেও ধরেছিলিস অমন ছেলে!’
‛কেনে, সেবার তুই বুলেছিলি যে ,আজমির শরিফ যাবার সব যোগারযন্তর করেছে তোর ছেলে । তখন তুই তো কোমর নড়াতে পারছিলিস নে ! পায়ে ব্যথা, কত কী !’
‛কী আর বুলব, সবই কপাল আমার! তা ভাতা দিল ?’
‛হ্যাঁ, আজ দিল । কাল ফিরে গিয়েছিলুম । আধার নে আসিনি ।’
ফাজিলা বলে,‛আমি তো দুদিন ফিরে গেলুম । একদিন বুলল, আধার লাগবে । আর একদিন আধার নে এলুম, বুলল, লিন নাই, আজ ট্যাকা হবে না । চিৎকার করে সুধালাম, আর কতদিন ঘুরাবা বুড়িটারে ? টুকটুকি ভাড়া দে’ এতটা পথ এইসে, সিঁড়ি ভেঙ্গে তারপর ফিরে যেতি হচ্ছে ! মানুষ মনে কচ্ছ না ? ফরসাপানা মেয়েটা আমার কথা শুনে হাসতে হাসতে কী বুলল জানিস? বুলল, তোমার তো মুবাইল নাই, তুমি বুঝবা কী ! মুবাইলে ট্যায়ার না থাকলে কথা বুলা যায়? যায় না । ইটাও তেমনি, লিন না থাকলে সব অচল । যতই গাল পার, কুন লাভ নাই !’
গৌরী হাসতে হাসতে বলে,‛মেয়েটা ঠিকই বুলেছেরে । আজ লিন আছে । চল, তুকে উপড়ে নে যাই ।’
গৌরীর হাত ধরে উঠে আসে ফাজিলা। ব্যাংকে খুব ভীড় আজ । ভাগ্যিস গৌরীকে পেয়েছে, তা না হলে ট্যাকা তোলার কাগজ নিয়ে এর কাছে, ওর কাছে কাকুতি মিনতি করতে হত । গৌরীর হাতে পাশবই দিয়ে নিশ্চিন্ত হল। আজ আর কোন হেঁপা পোয়াতে হবে না তাকে । গৌরীই সব ব্যবস্থা করে দেবে । শুধু টিপছাপ দিতে হবে তাকে ।
পাখার ঠান্ডা বাতাস পেয়ে চোখ বুজে আসে ফাজিলার । গৌরী বইপত্তর বগলদাবা করে ইস্কুল থেকে ফেরার সময় হাঁক দিয়ে যেত,‛ ফাজিলা, কাল তুদের মাজারের মেলায় একসাথে যাব । তুকে টুকটুক নজেন খায়াব । ’ কতদিন বুলেছিল, ‛তোর আব্বাকে বল না, তুকে ইস্কুলে ভর্তি করে দিতে । ইস্কুলে কত মজা !’
ফাজিলা ঘুমের ঘোরে বাঁ হাত তোলে । বুড়ো আঙ্গুলখানা কপালে ঘষে । খসখসে , লাগছে বড় । টিপ দিতে দিতে আঙ্গুলখানা ক্ষয়েই গেল বুঝি ! ওদিকে গৌরী তারই বয়সি, সেই ছোট্ট কালের সই, চার কেলাস পড়েই তার থেকে যেন কত বড়!
‛ফাজিলা, ও ফাজিলা ! ঘুমিয়ে পড়লি নাকি ? ’গৌরীর ডাকে তন্দ্রা কাটে ফাজিলার । অবাক চোখে গৌরীকে দেখে, বলে, ‛ভাবছিলুম,
তোর কথা, ছোটবেলার কথা, তুই বই বগলদাবা করে বাড়ির সামনে দে’ যেতিস---। মাজারের মেলায় দুজনায় হাত ধরাধরি করে---।’
গৌরী দীর্ঘশ্বাস ফেলে,‘সে সব দিনের কথা বুলে আর কী হবে ! এখন দুজনাই তো বিধবা ভাতার হকদার । নে, কাগজখানায় টিপ দে!’
ফাজিলা টাকা তোলার কাগজখানা কপালে ঠেকায় । মনে মনে বলে, এই ভাতা সংসারে তাকে শুধু মানই দেয় না, মাঝে মাঝে ছোট বেলার সই গৌরীর দেখাও পাইয়ে দেয়। জীবনের শেষ বেলায় এর বেশি আর চাই কী!
সুখপাঠ্য
ReplyDelete