![]() |
ছবি : ইন্টারনেট ডা. প্রাণেশ মণ্ডল |
"সাপে কেটেছে!" ডাক্তার বাবুর মুখে কথাটা
শুনে রতন সত্যিই আকাশ থেকে পড়লো। সাপে যেখানে কামড়ায় খুব জ্বালা যন্ত্রণা করে, রোগী অন্তত বুঝতে
পারে কিছু একটা কামড়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে তো সেসব কোনো লক্ষণই ছিল না!
পাশ থেকে ওর
স্ত্রী বলে উঠলো, "সে কি করে হবে? কেউ তো সাপ দেখতে পায়নি! দাঁত বসার চিহ্নও তো
নেই…"
ডাক্তার বাবু
বললেন, "সে নেই…তবে কালাচ…আপনারা যাকে ডোমনাচিতি বলেন, ওই সাপে কামড়ালে এরকম হতে পারে। রোগী দুই চোখই
খুলতে পারছে না…টোসিস শুরু হয়ে গেছে। এক্ষুনি এ.ভি.এস চালাতে হবে।"
--"সেটা কি?"
--"বিষাক্ত সাপে কামড়ালে যে অ্যান্টি ভেনম
ইনজেকশন দিতে হয় সেটা।"
--"সে কি বলছেন? সাপে কেটেছে নাকি সেটাই তো ঠিক করে বোঝা গেল
না!"
--"তাহলে আপনারাই তো চিকিৎসা করতে পারতেন! এখানে
আনার দরকার কি ছিল?", একটু ঝাঁঝিয়েই বলে উঠলেন ডাক্তার বাবু।
ধমক শুনে রতন
কাঁচুমাচু করে বলে উঠলো, "আমি মুখ্যু-সুখ্যু লোক,
অত কিছু কি জানি!আপনি যা
ভালো মন্দ বোঝেন করেন স্যার।"
কিন্তু সাপে কাটলে পেটে ব্যথা হয়... এরকম কথা তো রতন কখনও শোনেনি! ছেলেটা বাঁচবে তো? সে আর চাপ নিতে পারছিল না, তার ছোট মাথায় কিছুই যেন ঢুকছিল না। তাই হাসপাতালের বাইরে একটা গাছের নিচে গিয়ে বসল সে।
রতন দিনমজুরি করে ছোট সংসারটা কোনরকমে চালায়। বছর সাতেকের রোহন তার একমাত্র সন্তান। গরমের জন্য মাটির ঘরের খোলা বারান্দায় মাদুর পেতে ঘুমিয়েছিল সে। সারাদিন হাড় ভাঙা খাটুনির পর তাদের সন্ধ্যের দিকেই শুয়ে পড়ার অভ্যেস। অত্যধিক গরম থাকলে খোলা জায়গায় মশারি ছাড়াই ঘুমিয়ে পড়ে অনেক সময়। সেদিনও রতন ক্লান্ত শরীরটাকে এলিয়ে দিয়েছিল বিছানায়, চোখে ঘুম আসতে বেশি সময় নেয় নি। তখন বোধহয় রাত দুটো, তার হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। দেখে রোহন অসহ্য পেটের ব্যথায় কাতরাচ্ছে। ওর স্ত্রী ব্যথার ওষুধ খাওয়ায়, তাতেও কোনো লাভ হয় না। শেষে পাড়ার এক হাতুড়ের বাড়ি নিয়ে যায়। তিনি তিনটে ইনজেকশন দেন। কিন্তু ব্যথা যেন ক্রমশ বাড়তেই থাকে। এদিকে রোগীও ক্রমশ যেন নেতিয়ে পড়ছে। একসময় চোখের পাতা দুটি খোলাও কষ্টকর হয়ে পড়ে রোহনের পক্ষে। খারাপ লক্ষণ দেখে একটা গাড়ি জোগাড় করে যখন হাসপাতালে এসে পৌঁছাল তারা, তখন ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে কেবল।
এমনিতেই অনেক
দেরি করে এনেছিল। তারপর এইসব কথাবার্তা...তাঁর মাথাটা একটু গরম হয়ে গিয়েছিল।
বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান, দুশ্চিন্তায় ওরা হয়তো উল্টোপাল্টা বলে
ফেলেছে...এভাবে না বললেই হয়তো ভালো করতেন বলে মনে করলেন ডাক্তার বাবু। যদিও তিনি
অসীম ধৈর্য্যের অধিকারী, তাও তো তিনি রক্তমাংসের মানুষ। সারারাত ধরে
প্রসূতি মা থেকে শুরু করে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, শ্বাসকষ্ট...সব ধরনের রোগীই দেখতে হয়েছে। তারপর
রোগীকে এরকম খারাপ অবস্থায় নিয়ে এসেছে দেখে মাথাটা আর ঠিক রাখতে পারেন নি।
এ.ভি.এস ও
যাবতীয় ইনজেকশন দিয়ে যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে গেলেন ডাক্তার বাবু। কিন্তু
এ.ভি.এস পুরোটা শরীরে যাওয়ার আগেই শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গেল। এইরকম গ্রামীণ
হাসপাতালে ভেন্টিলেশন থাকে না। আবার এই অবস্থায় পঞ্চাশ কিমি দূরের সদর হাসপাতালে
রেফার করাও মুশকিল...পৌঁছানোর আগে রাস্তাতেই রোগী মারা যেতে পারে।
অ্যাম্বুব্যাগ দিয়ে ম্যানুয়াল ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা করেও কিছু করা গেল না। সব চেষ্টা ব্যর্থ করে রোগী ঘন্টা খানেকের মধ্যেই মারা গেল। রোগীর সাথে থাকা রতনের স্ত্রী বুক ফাটা কান্নায় ভেঙে পড়লো। বহু মৃত্যুকে তিনি কাছ থেকে দেখলেও রোহনের জন্য ডাক্তার বাবুর মন সত্যিই ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো। কিন্তু চিকিৎসায় সাড়া না দিলে তাঁরও তো কিছু করার নেই। তিনিও একজন সাধারণ মানুষ, তাঁর ক্ষমতাও তো সীমিত।
খবর পেয়ে রতনও
সেখানে চলে এসেছে। সাথে আরও চার পাঁচজন লোক। সাত বছরের একমাত্র ছেলের হঠাৎ
মৃত্যুতে সবাই গভীর শোকে নিমগ্ন। এমন সময় রোগীর চারপাশের ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন
চেঁচামেচি শুরু করলেন, "এখানে কোনো চিকিৎসা হয় না। এই ডাক্তারের দোষেই
মায়ের কোল খালি হল।"
অনতি দূরেই অন্য
রোগী দেখতে তখন ডাক্তার বাবু ব্যস্ত। হাসপাতালের গ্রুপ ডি স্টাফ সমর বাবু ডাক্তার
বাবুর কাছে গিয়ে বললেন, "স্যার, আপনি রেস্ট রুমে চলে যান। অবস্থা বেগতিক
লাগছে।"
--"কে লোকটা?"
--"প্রদীপ মাস্টার বলেই সবাই চেনে। একসময়
মাস্টারি করতো, এখন এখানে ওখানে বক্তৃতা দিয়ে বেড়ায়।"
--"রোগী ফেলে রেখে আমি কোথাও যেতে পারব না। আমি তো কিছু ভুল করিনি।"
প্রদীপ মাস্টারের
কথা শুনে তাঁর সাথে আসা লোকজন গুলোও এবার হৈচৈ শুরু করে দিল। কেউ পাশে রাখা
স্যালাইনের স্ট্যান্ড তুলে মাটিতে আছাড় মারলো।
যেটা অন্য একটা রোগীর বাড়ির লোকের পায়ে গিয়ে লাগলো। অন্য একজন সাজিয়ে
রাখা স্যালাইনের বোতল গুলো ছুঁড়ে ফেলতে লাগলো। বাকিরা সিস্টারের টেবিলে রাখা
আপৎকালীন ইনজেকশনের ট্রে থেকে অ্যাম্পুল, ভায়াল গুলো ভেঙে
নষ্ট করতে থাকল। টেবিলে রাখা মোটা মোটা খাতা, যেগুলোতে রোগীর চিকিৎসা সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য
নথিভুক্ত করা হত, সেগুলোও রেহাই পেল না। টেবিলের ওপরে রাখা কাঁচ ভেঙে টেবিল উল্টে হাসপাতালের
স্টাফদের দিকে তেড়ে গেল ওরা। এর মধ্যে প্রদীপ মাস্টার ডাক্তার বাবুর কাছে পৌঁছে
গেছেন। ডাক্তার বাবু তখন একমনে ওষুধ প্রেসক্রিপশন করে যাচ্ছেন। হঠাৎ ডাক্তার বাবুর
জামার কলার ধরে সপাটে একটা চড় কষিয়ে দিলেন প্রদীপ বাবু। রোগীর বাড়ির লোক থেকে
শুরু করে হাসপাতালের স্টাফ...সবার সামনে এত তাড়াতাড়ি ঘটনাটা ঘটে গেল যে সবাই
হতচকিত হয়ে গেল। এতেই থেমে থাকলেন না প্রদীপ বাবু...আরও একটা চড় কষাতে উদ্যত
হলেন। কিন্তু তার আগেই সমর বাবু হাতটা চেপে ধরলেন। প্রদীপ মাস্টার চিৎকার করে বলতে
লাগলেন, "আপনি ডাক্তার না পিশাচ? একটা দুধের বাচ্চা কে এভাবে মারতে আপনার একটুও
হাত কাঁপলো না?"
--"আমি মারলাম কোথায়? রোগীর অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। যা যা করার দরকার
ছিল সবই করেছি আমি।"
--"পেট ব্যথার রোগীকে আপনি সাপের বিষের ইনজেকশন
দিলেন! আপনি কি গাঁজা খেয়ে ডাক্তারি করতে এসেছেন? ওই ইনজেকশনের জন্যই একটা নিষ্পাপ শিশুর প্রাণ
গেল!"
কিন্তু প্রত্যুত্তর দেওয়ার আগেই সমর বাবু ও অন্যান্য স্টাফরা ডাক্তার বাবুকে ধরে রেস্ট রুমে নিয়ে চলে গেলেন। প্রদীপ বাবুর সাগরেদরা দরজার পাল্লা, জানালার কাঁচ, অক্সিজেনের নল, টিউব লাইট কিছুই আস্ত রাখলো না।
ওয়ার্ডের সিস্টার এর মধ্যে পাশের পুলিশ ফাঁড়িতে ফোন করে দিয়েছিলেন। খবর পেয়ে পুলিশ ফাঁড়ির হেড কনস্টেবল কোনো রকমে ইউনিফর্ম পড়ে হাসপাতালের দিকে হাঁটা দিয়েছেন। দূর থেকে ওনাকে আসতে দেখে প্রদীপ মাস্টার সবাইকে শান্ত হতে বললেন। তারপর নিজে পুলিশের কাছে গিয়ে বলেন, "ডাক্তারের গাফিলতিতে এক মায়ের কোল খালি হল। আবেগের বশে বাড়ির লোক মাথা ঠিক রাখতে পারেনি। আমরা দোষীর কঠোর শাস্তি দাবি করছি।"
আজ জীবনের সবথেকে অপমানজনক দিন তাঁর কাছে। প্রায় কুড়ি বছর ধরে এই হাসপাতালে চাকরি করছেন ডাক্তার বাবু। দিন রাত জেগে নিরলস পরিশ্রম হাসি মুখে মেনে নিয়েছেন। কত ডাক্তার বাবুই তো এলেন, আবার চলেও গেলেন...একমাত্র তিনিই থেকে গেলেন এতগুলো বছর ধরে। এই প্রত্যন্ত গ্রামীণ হাসপাতালের না আছে থাকার জন্য একটা ভদ্রস্থ কোয়ার্টার, না আছে ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা, না আছে দোকানপাট বা বিনোদনের জায়গা। এখানকার বেশির ভাগ মানুষই খুব দরিদ্র, শিক্ষিতের হারও খুব কম। রেফার করলে অন্যত্র যাবার সামর্থ্যও নেই এদের। শুধু ওদের মুখ চেয়েই তিনি এতগুলো দিন কাটিয়ে দিয়েছেন। ভালো করেই জানেন তিনি না থাকলে এই মানুষ গুলোকে হাতুড়ের ভরসাতেই থাকতে হবে। কিন্তু আজ যা হল সেটাকে তিনি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না। নতুন আরেকজন চিকিৎসক সম্প্রতি এখানে কাজে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর শরীর অসুস্থ থাকায় আসতে পারেননি। তাই উনিই ওভার ডিউটি করছিলেন। শুধু রোগীর প্রতি ভালোবাসা আর গরীব মানুষগুলোর কথা ভেবে তিনি এই বয়সেও এত পরিশ্রম করতে রাজি হয়েছেন। এতদিনের পরিশ্রম, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার বিনিময়ে যে সম্মানজনক জায়গাটা তিনি অর্জন করেছিলেন, আজ এক লহমায় সেখান থেকেই মাটিতে নামিয়ে অপরাধীর আসনে বসানো হল তাঁকে। ওই থাপ্পড়টা তাঁর গালে মেরেছে, কিন্তু আঘাতটা লেগেছে মনে। বিনা অপরাধে এত বড় অপবাদ মাথায় নিয়ে তাঁকে মাথা নিচু করে রেস্ট রুমে বসে থাকতে হচ্ছে!
হাসপাতাল চত্বরে সেদিন বিশাল হৈ হট্টোগোল...মাইকে প্রচার চলছে। "ডাক্তারের গাফিলতিতে মৃত্যুর শাস্তি চাই"। একপক্ষ প্রচার করে বাড়ি গেল তো অন্যপক্ষ নেমে পড়ল। কোন পার্টি রোগীর কত আপন...তার প্রতিযোগিতা চলতে থাকল সারাদিন ধরে। এর মধ্যে ওপরমহল থেকেও ডাক্তার বাবুর কাছে বেশ কয়েক বার ফোন এলো পুরো ঘটনার বিবরণ চেয়ে। সবাই আশ্বাস বাণী শুনিয়ে কাজ চালিয়ে যেতে অনুরোধ করলো। কিন্তু প্রদীপ মাস্টারের দলবল কর্মরত ডাক্তারের গায়ে হাত তুলে, সরকারী জিনিসপত্র নষ্ট করেও সদর্পে ঘুরে বেড়াতে লাগল। এর মধ্যে একজন চুপিচুপি ডাক্তার বাবুর কাছে টাকার বিনিময়ে রফার প্রস্তাবও নিয়ে এলো। কিন্তু ডাক্তার বাবু একগুয়ে। যেখানে তাঁর কোনো দোষই নেই, সেখানে অন্যায় আবদার তিনি মেনে নেবেন না।
এই মানসিক আঘাত ও অপবাদ তাঁর ওপর এমন প্রভাব ফেলল যে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললেন তিনি এখান থেকে চলে যাবেন। কাজের দায়িত্বভার কাউকে না বুঝিয়ে তিনি যেতে পারবেন না, তাই নতুন ডাক্তার বাবুর আসা অব্দি অপেক্ষা করতেই হলো। ঝামেলার খবর পেয়ে তিনি রাতের মধ্যেই চলে আসবেন জানালেন। সেদিন সারাদিনের রোগীর চাপও কম ছিল না। লন্ডভন্ড করা ওয়ার্ড ও নির্বিচারে ভাঙচুর করা সরঞ্জাম গুলো আবার কোনরকমে সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়ে তিনি সব রোগীর চিকিৎসা করলেন। কিন্তু নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থাকলেন। ঠিক করলেন পরদিন খুব সকালেই তিনি জিনিসপত্র নিয়ে চিরদিনের জন্য এই হাসপাতালকে বিদায় জানাবেন।
সব মালপত্র
গুছিয়ে নিয়ে শেষবারের মত বিগত কুড়ি বছরের সুখ দুঃখের সাথী এই হাসপাতালটাকে
একবার শেষবারের মত চোখের দেখা দেখে গাড়িতে উঠবেন ঠিক করলেন। এমন সময় একটা বাচ্চা
মেয়ে ছুটে এলো ওনার কাছে। রিনিকে দেখেই ডাক্তার বাবু চিনতে পারলেন...তাঁর কাছে
প্রায়ই ওষুধ নিতে আসে মেয়েটা। রিনি কাঁদতে কাঁদতে বললো,
"ডাক্তার বাবু আমার মা কে
দেখুন না! মা ছাড়া যে আমাকে দেখার আর কেউ নেই!"
ডাক্তার বাবু দেখলেন একজন মধ্য বয়স্ক মহিলাকে দুজন কোনরকমে রিক্সাভ্যানে চাপিয়ে নিয়ে এসেছে। কাছে গিয়ে জানতে পারলেন ওনার স্বামী সারাদিনই নেশা করে পড়ে থাকে। রিনির মা সারাদিন পরিশ্রম করে সংসারের খরচ জোগান। কিন্তু গত রাতে নেশা করে ওনার স্বামী খুব মারধোর করে ওনাকে। এত অত্যাচার ও কষ্ট সহ্য করতে না পেরে উনি শেষে কীটনাশক খান। ডাক্তার বাবু মোবাইলের টর্চ দিয়ে দেখলেন চোখের তারারন্ধ্র একটা বিন্দুর মত ছোট হয়ে গেছে, মুখ দিয়ে প্রচুর লালা বেরোচ্ছে, কথা বলার শক্তিও নেই। এক মুহূর্ত দেরি করলে এই রোগী বাঁচানো খুব মুশকিল। তিনি রোগী কে ভিতরে নিয়ে যেতে বলে তড়িঘড়ি অ্যাট্রোপিন চালানোর নির্দেশ দিলেন সিস্টার কে।
এতকিছু ঘটনার পরও
আরও একটা মরণাপন্ন রোগীকে নিয়ে ডাক্তার বাবু যেভাবে তৎপরতার সাথে চিকিৎসা করে
চলেছেন, তা দেখে সবাই
অবাক হয়ে গেল। রিনির মা ক্রমশ চিকিৎসায় সাড়া দিতে লাগলেন। আশঙ্কা কেটে যেতেই
নতুন ডাক্তার বাবুকে সব বুঝিয়ে তিনি গেটের দিকে পা বাড়ালেন।
গেটের কাছে রতন
কে দেখে বেশ অবাক হলেন। কিছু বলার আগেই রতন ওনার পায়ে এসে পড়লো। বললো, "আমাকে ক্ষমা করে
দেন ডাক্তার বাবু। আপনি অনেক করেছেন আমার ছেলের জন্য...ওর মা আমাকে সব বলেছে। আপনি
সাপে কেটেছে বলছিলেন, ঠিকই বলেছিলেন। আজ একটা বড় ডোমনাচিতি সাপ ধরা
পড়েছে।"
--"হ্যাঁ, আমি তো বলেছিলাম...ওই সাপে কামড়ালে জ্বালা
যন্ত্রণা থাকে না, রোগী বুঝতেও পারে না বেশিরভাগ সময়। অনেক সময়
ঘুমের মধ্যেই রোগী মারা যায়। আর এই সাপের কামড়ে পেট ব্যথা, গলা ব্যথার মত
অদ্ভুত উপসর্গ থাকে। তোমাদের আসতে অনেক দেরি হয়ে গেছিল। তাই কিছু করা গেল
না।"
কথা গুলো বলেই
ডাক্তার বাবু গাড়িতে উঠতে গেলেন। রতন বললো "ডাক্তার বাবু বাড়ি যাচ্ছেন?"
--"হ্যাঁ, আর আসবো না। নতুন ডাক্তার বাবু কে সব বলা আছে, উনিই এখন থেকে
দেখবেন তোমাদের।"
--"কিন্তু আপনি কেনো চলে যাচ্ছেন? আপনি চলে গেলে আমাদের কে দেখবে? ওই প্রদীপ মাস্টারের জন্যই এই কান্ড হল! বিশ্বাস করুন... আমি ওনাকে ডাকি নি। উনি সকালে হাঁটতে বেড়িয়ে আমাকে দেখে নিজে থেকেই হাসপাতালে এসে ঝামেলা শুরু করে দিলেন। শুনলাম উনি নতুন পার্টিতে নাম লিখিয়েছেন, সামনের ভোটে টিকিট পাবেন। তাই হাসপাতালে এসে ক্ষমতা জাহির করে গেলেন। এদের জন্য আপনি চলে যাবেন? আপনি চলে গেলে আমরা কোথায় যাবো?"
কথাগুলো শুনে
মনটা যেন একটু হালকা হল ডাক্তারবাবুর। যাক কেউ তো বুঝেছে! কিন্তু ওই অপমান এত সহজে
তিনি কিভাবে ভুলবেন? নামিয়ে রাখা ভারি ব্যাগটা গাড়িতে তুলতে
গেলেন। কিন্তু কিসে যেন বাধা পেলেন। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখলেন রিনি ব্যগটাকে খামচে
ধরে আছে। তার দুই গাল বেয়ে নেমে আসছে
অশ্রুধারা! সর্বশক্তি দিয়ে সে ব্যাগ টাকে আটকে রেখেছে। ডাক্তার বাবু অবাক হয়ে
জিজ্ঞেস করলেন, "তোর কি হল রে?"
সে ফুঁপিয়ে
কাঁদতে কাঁদতে বললো, "আপনি চলে যাবেন না..."
রিনির সাথে আশে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রোগীর বাড়ির লোকেরাও কাতর আবেদন জানাতে থাকলো।
ততক্ষনে খবর
পেয়ে গ্রামবাসীরাও এসে ভিড় করতে লেগেছে। ভিড়ের মধ্যে প্রায় সব মুখই ডাক্তার
বাবুর চেনা। একজন বৃদ্ধা লাঠি হাতে এগিয়ে এসে বললেন,
"আমার ছেলে আমাকে দেখে না, তুমি আমাকে দেখে
সুস্থ করেছো... তুমিই তো আমার ছেলে! আমাদের লুকিয়ে তুমি চলে যাচ্ছ কেন বাবা? রিনি না ডাকতে
গেলে তো আমরা জানতেও পারতাম না!"
একজন মধ্য বয়স্ক
ভদ্রলোক এসে বললেন, "আমাদের যখন যা হয়েছে, আপনার কাছে এসেছি... আপনার জন্যই আমার পরিবারের
সবাই মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসেছে। আমরা কি দোষ করলাম যে এত বড় শাস্তি পেতে হবে
আমাদের?"
সত্যিই এদের তো কোনো দোষ নেই! এরা সবাই তাঁর পরিবারের লোকের মত। সবার চোখই অশ্রুসিক্ত...সবার মুখেই ফুটে উঠেছে অসহায় আকুতি। কেউই তাঁকে বিদায় দিতে চায় না। এত বুকভরা ভালোবাসা, এত গরীবের চোখের জল, এত মানুষের ভরসা ...এসব কি এতই ঠুনকো, যে প্রদীপ মাস্টারের একটা থাপ্পড়ে সব শেষ হয়ে যাবে!
আবেগ প্রবণ
ডাক্তার বাবু বুঝতে পারলেন নিজের অজান্তেই কখন তার দুই চোখের অবাধ্য জল দৃষ্টিকে
ঝাপসা করেছে। সেই ঝাপসা দৃষ্টি পথেই দেখলেন একটা গাড়ি এসে থামলো। একজন লোক গাড়ি
থেকে নেমে ভিড় ঠেলে তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে। কাছে এসেই লোক টা হাত জোড় করে বললো, "বড় ভুল হয়ে
গেছে, ক্ষমা করে দিন
ডাক্তার বাবু।"
চমকে উঠলেন
ডাক্তার বাবু, এ তো প্রদীপ মাস্টার! ততক্ষনে প্রদীপ বাবু তাঁর পায়ে এসে পড়েছেন। গলা তুলে
বলতে শুরু করলেন, "কাল যা ঘটেছে, তার পুরো দায় আমি মাথা পেতে নিচ্ছি। প্লীজ
যাবেন না আপনি!"
বিস্ময়ে হতবাক
হয়ে গেলেন ডাক্তার বাবু…গিরগিটিও তো এত তাড়াতাড়ি রং বদলায় না! প্রদীপ
মাস্টার এবার নিচু গলায় ধীরে ধীরে বললেন, "আপনার জনপ্রিয়তার কাছে আমি হেরে গেছি। কিন্তু
সামনে ভোট, সেখানে হারলে তো আর চলবে না!"
একটা লোকও যদি এর থেকে কালাচ সাপের ব্যাপারটা বোঝে সেটাই লাভ।
ReplyDelete