![]() |
ছবি : ইন্টারনেট রাজর্ষি বর্ধন |
উঠোনের লাউমাচায় দুটো শালিক নাচছে বেশ থিরিক-থিরিক
করে। বেশ
মেজাজে আছে ব্যাটারা ! মাচাটার ওপর
লাফিয়ে-ঝাপিয়ে বেড়াচ্ছে। জোড়া শালিককে তো
শুভ বলে থাকে লোকে, কিন্তু সত্যিই কি সুদিন আসে ?
বেলা ক’টা হয়েছে তা বোঝার উপায় নেই,
শীতের সকাল মেঘলা থাকলে যা হয়। নতুন বউয়ের মতো ঘোমটার আড়ালে সূর্যটা,
আকাশ
মেঘের চাদরে জড়ানো!
এই আকাশ দেখেই শোভারাণীর সারা দিনটা
কাঁটে।
বারান্দার ওপাশ থেকে আবার “খুক-খুক” করে
কাশির শব্দ ভেসে আসে। ঘন-ঘন কাশিটা হয়। খুব কাশেন তার স্বামী সুধাময়, একেক সময় খুব
গুরুতর হয়ে ওঠে ! তখন মনে হয়, আবার রক্তবমি হবে নাকি ?
শোভারাণী মনে মনে উত্তেজিত হলেও শরীরে
কোন আন্দোলন টের পান না। সব কিছুই সয়ে গেছে শরীরে !
তিনি আবার আকাশ দেখেন। আকাশ মানেই তো
শূণ্যতা, যে শূণ্যতা শোভারাণীর বুক ভরে আছে। খুব মাপজোক করেই মানুষের জীবনে
সুখ-দুঃখের অনুপাতটা ঠিক করেছেন ওপরওয়ালা, তাতে কোন ভুলচুক নেই ! কিন্তু শোভারাণীর
জীবনে দুঃখের পাল্লাটাই একটু বেশি ঝুঁকে
নয় কি ?
আকাশের সূর্যটার তখনও মেঘেদের সঙ্গে
লুকোচুরি খেলাটা শেষ হয়নি, এদিকে বেলা বয়ে যাচ্ছে ! নিজের ভাগ্যের ওপর থাপ্পড় কষাতে
ইচ্ছে হচ্ছে শোভারাণীর, তার মানে আজকেও রোদের দেখা মিলবে না ! শোভারাণী চিন্তায়
বুক কেঁপে ওঠে !
মাঝে-মাঝে মনের
মধ্যে কথা ভেসে ওঠে, টিবি আজকাল এমন কিছু মারণ রোগ নয়, কতো
রকম ওষুধপ্ত্র এসেছে বাজারে ! নানা রকম পরীক্ষা- নিরিক্ষা রয়েছে, হরেক রকম চিকিৎসা
পদ্ধতি রয়েছে- মরে যাওয়া কি এতই সোজা !
তবু মনটা কু ডাকে শোভারাণীর !
তিনি সুধাময়ের পিঠে হাত বুলিয়ে দেন। ভাবেন, কাশিটা হয়
হোক, রক্তবমি তো আর হচ্ছে না ! আগের চাইতে অনেকটাই ভালো আছেন সুধাময়, আগের মতো
ঘনঘন কাশিও হচ্ছে না, রক্তবমিও বন্ধ হয়ে গেছে ! ডাক্তারের কথামতো তাঁকে এই শীতের
বেলায় রোজ রোদে এনে বসান, তাতে শরীরের ভেতরের বীজানুগুলো
মরে। স্বামীকে সুস্রশা করার সব রকম চেষ্টাই করেন, তবু কেন যে মন কু গেয়ে ওঠে
!
এই যেমন আজ সারাদিন রোদের দেখা মেলেনি,
শীতের মধ্যে জুবুথুবু হয়ে বারান্দার এক কোনে বসে আছে বুড়ো মানুষটা, আর ঘন ঘন কেশে চলেছে, এতে মনে
চিন্তা বাড়ে না ?
মাঝে-মাঝেই মনে হয়- এসবই কি পাপের ফল ?
সুধাময় তো বরাবরই একজন পাপী মানুষ !
কেমন রোগা জীর্ণ হয়ে গেছে সুধাময় রোগে
ভুগে-ভুগে, কাশতে গেলে চোখ দুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে কোটর
থেকে । যেন সুধাময়ের কংকালটুকু পড়ে রয়েছে, আর প্রাণবায়ুটা চলছে এই যা !
পাপ, পাপ- একটা জীবন শুধু পাপ করেই
কাঁটালেন সুধাময় ! কংসের মতো তারও বুঝি
পাপের ঘড়া পূর্ণ হয়ে গেছে! শোভারাণী মনে
করলেন, তিনিও তো সুধাময়ের অনেক পাপের সাক্ষী, তবে স্ত্রী হয়ে তিনি কি সুধাময়কে
শোধরাতে পেরেছেন, ফেরাতে পেরেছেন কি সৎপথে ? এটা কি তাঁর ব্যর্থতা নয়? স্ত্রীর
দায়িত্ব তিনি কি সঠিক পালন করেছেন?
শীতের একটা দমকা হাওয়া আসে হু-হু করে।
আবার কাশেন সুধাময়। শোভারাণী চাদরটাকে আশটেপৃষ্ঠে জড়িয়ে দেন স্বামীর
শরীরের সঙ্গে, আর নিজে সর্বাঙ্গে শীতের হুল টের পান !
তাঁর
মনটা তখন অনেককাল পেছনে হাঁটা দেয়। তখন সবে বিয়ে হয়েছে শোভারাণীর।
পাত্র হিসেবে খারাপ ছিল না সুধাময়, ব্যাঙ্কের কেরানি, ভালো মাইনে, শোভারানীর জন্য উপযুক্ত- এর
চাইতে আর বেশি কিই বা চাইতে পারতেন শোভারাণী,
তিনি নিজেও তো ছিলেন গরীব স্কুল মাস্টারের মেয়ে !
যখন বিয়েটা হয় তখন রানাঘাটে বদলী ছিলেন
সুধাময়, ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। বিয়ের প্রথম বছরটা বেশ ভালোই কেটেছিল শোভারাণীর,
সাধারন ছা-পোষা কেরানীর বউয়ের যেমনটা কাঁটে। তিনি অল্পতেই সুখি থাকতে জানতেন !
বিয়ের দুবছর পর সুধাময় বদলি হন
বাঁকুড়ায়। স্বামীর চাকরিতে যে ঘন ঘন বদলির নোটিশ আসে, এটা তিনি জানতেন।
তবে সে অবাক হয়েছিল যখন সুধাময় তাঁকে
সঙ্গে নিতে চাইলেন না ! বলেছিলেন, “কি হবে বার-বার সঙ্গে গিয়ে, বাঁকুড়া এমনিতেই
খুব গরম যায়গা, ভীষণ জলের কষ্ট সেখানে ! আর আমার বদলির কি কোন ঠিক আছে, দু’ দিন পর
আবার হয়ত এখানেই পাঠাবে ! এমনটা তো হয়েছেও
আগে ! তাই বলে দুজনকেই বাড়ি ছাড়ার কোন প্রয়োজন নেই। আর প্রত্যেকবার বাড়ি বদল করলে
সমস্যা অনেক, নতুন যায়গায় গিয়ে মানাতে-গোছাতেও তো সময় লাগবে ! রানাঘাটের এই বাড়িটা
খারাপ কি? পাড়া-প্রতিবেশী সব চেনা, বিপদে-আপদে
সাহায্য করতে পারবে। তাছাড়া আমি তো
হপ্তায় একবার করে আসবই, দেখবে- কোন অসুবিধাই হবে না, সব সয়ে যাবে!”
দোনোমনো করে শোভারাণী শেষে রাজিই হয়ে
গেছিল স্বামীর প্রস্তাবে। সুধাময় একাই বাঁকুড়া গেলেন, শোভারাণীকে একলা রানাঘাটে
ফেলে রেখে। সপ্তায় একবার করে আসতেন কথামতো, মানভঞ্জনের নানা রকম সামগ্রী নিয়ে হাজির
হতেন, তাছাড়া মাস গেলে টাকা পাঠাতেন, সবই ঠিকঠাক ছিল- কিন্তু এইসব ছাড়াও তো
মেয়েমানুষের বাড়তি চাহিদা থাকে, ক্ষিদে থাকে, সেটা কি সুধাময় বুঝতেন না ?
ভীষণ অভিমান হত শোভারাণীর !
কিন্তু হঠাৎই একটা আশ্চর্যজনক খবর
পেলেন- সুধাময়ের নাকি আবার বদলি হয়েছে !
বাঁকুড়া গেছে তো ছ’মাসও হয়নি, এরই মধ্যে
আবার বদলির নোটিশ ?
এবার
আর একটু দূরে, উত্তর বাংলায়। জলপাইগুড়িতে। তাই প্রতি হপ্তায় আসতে হয়ত পারবেন না, কিন্তু মাসে দু’বার আসার চেষ্টা
করবেন, চিঠিতে এমনটাই লিখেছিলেন সুধাময় !
যা পড়ে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠেছিল
শোভারাণীর। এতো কথা লিখলেন, তবু একবারের জন্যও শোভারাণীকে সাথে নিয়ে যাওয়ার কথা
মনে হল না সুধাময়ের ! শোভারাণী কি সুধাময়ের কাছে বড় বোঝা? এতোই যখন তাঁকে অবহেলা
করেন তাহলে বিয়ে করেছিলেন কেন? অভিমান চরমে উঠল !
কিন্তু আশ্চর্যের ব্যপার জলপাইগুড়িতেও
বেশিদিন টিকতে পারলেন না সুধাময়। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আবার বদলি হলেন। এবার
দক্ষিনে, লক্ষীকান্তপুরে।
এতো ঘনঘন বদলি হওয়াটা শোভারাণীর মনে
খটকা তৈরি করল। তিনি একটা আঁশটে গন্ধ পেলেন। আরো তো লোকে সরকারি চাকরি করে, কার
এতো ঘনঘন বদলি হয় ! সুধাময় যেন এক যায়গায় থিতুই হতে পারছেন
না!
শোভারাণীর অবাক হওয়া অবশ্য তখনই শেষ নয়,
বোধ হয় জীবনের চরম সর্বনাশ অপেক্ষা করছিল শোভারাণীর জন্য !
রানাঘাটে তাঁদের পাশেই থাকত শম্ভু বলে
একটি ছেলে, সেও লক্ষীকান্তপুরে চাকরি করত,
সে এসে একদিন খবর দিলো, যে সুধাময়কে পুলিশে ধরেছে !
ব্যাঙ্কে
চাকরি করার সময় নাকি সুধাময় নানান ছলে-বলে-কৌশলে ব্যাংক থেকে টাকা সরাচ্ছিল, এবং
কেউ তা জানতে পারেনি এতদিনে ! তাঁর এই ঘনঘন বদলির পেছনে নাকি এটাই মতলব ছিল, কেউ
কিছু বোঝার আগে সেখান থেকে কেটে পড়া !
সুধাময়ের
সঙ্গে ওপরওয়ালার সাট ছিল, তাই বদলি হয়াতেও
আটকাতও না, বরং সে নিজেই বলে-কয়ে বদলির বন্দোবস্ত করতেন !
এমনটাই চলছিল পাঁচ বছর ধরে, সুধাময় হয়ত
ধরাও পড়তেন না, যদি না সেই ওপরওয়ালার সঙ্গে বখেরা নিয়ে মনোমালিন্য হত !
এই খবরটা শুনে সবাই খুব অবাক হয়ে গেছিল
! সুধাময়, যাকে কিনা সবাই এতদিন বেশ নিরীহ, শান্ত, সাতে-পাঁচে না থাকা মানুষ ভেবে
এসছিল সে কিনা এমন কাজও করতে পারে ?
সুধাময়ের
ছ’বছরের জেল হয়েছিল। অনেক টাকাই সে আত্মসাৎ
করেছিলেন, সব মিলিয়ে ধরলে লাখখানেক তো হবেই, তখনকার দিনে সেটা অনেক টাকা !
কিন্তু কি কারনে এতো টাকা সরিয়েছিলেন সেটা
জানা যায়নি !
এমনকি
শোভারাণীও
বারবার জিজ্ঞেস করেও উত্তর পাননি ! যে কিনা পুলিশের থার্ড ডিগ্রির সামনেও মুখ খোলেনি,
সে শোভারাণীর কান্নার সামনে সব উজার করবে, এমনটা আশা করা ভুল !
পুরো
ছবছর অবশ্য জেল খাটতে হয়নি সুধাময়কে। গুড কন্ডাক্টের জন্য চার বছর আড়াই মাসের
মাথাতেই তিনি খালাস পেয়েছিলেন। তবে কানাঘুষো শোনা যায় যে জেলে থাকতে
সে একটা বড় নেতা পাকড়েছিলেন, তাঁরই বশংবদ হয়ে উঠেছিলেন! সুধাময়ের খালাসের পেছনে
তাঁরই নাকি হাত রয়েছে !
জেল
থেকে বেরিয়ে সেই নেতাকে ধরিয়েই একটা কারখানায় চাকরি জুটিয়ে নিয়েছিলেন সুধাময়।
সাধারন একাউন্টেন্ট হয়ে ঢুকেছিলেন,
কিন্তু অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই সে লেবার ইউনিয়ানের নেতা হয়ে উঠেছিলেন প্রতিপত্তি
খাঁটিয়ে ! সারাদিন কারখানাতেই পড়ে রইতেন, মিটিং-মিছিল নিয়েই থাকতেন। একা ঘরে শোভারাণী কি
করতেন তার খোঁজও নিতেন না !
তাঁদের দাম্পত্য জীবন পুরো যন্ত্রের মতো হয়ে গেছিল। ঘরে ঢুকেই সুধাময় যেন যন্ত্রের মানুষ হয়ে যেতেন, কোন আদান-প্রদান নেই তাঁদের মধ্যে, সময়মতো ঘুম, খাওয়া, মিলন- সব সময় ধরে, যেন দুটো কলের মানুষের সংসার ! তাঁদের কোন সন্তানও ছিল না যে তাঁদেরকে বেঁধে রাখবে, শোভারাণী সন্তান ধারণে অক্ষম ছিলেন!
লেবার
ইউনিয়ানের নেতা হয়ে সুধাময় কারখানার মধ্যে নানা রকম উপদ্রব আরম্ভ করত, শ্রমিকদের
সারাক্ষনই ক্ষেপিয়ে রাখতেন ! তাছাড়া ধর্মঘট, হরতাল- এসব ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যপার
!
সুধাময়
যে কিসে সন্তুষ্ট হতেন তা ঠাওর করতে পারতেন না শোভারাণী।
তাঁর পাপের তালিকা দিন-দিন বেড়েই যেতে লাগল। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী একে-একে
তাঁদের ত্যাগ করতে লাগল। সুধাময়ের
মতো শঠ মানুষের সংস্পর্শ তারা বাঁচিয়ে চলতে লাগল। এতে সুধাময়ের কোন ভ্রূক্ষেপ না
থাকলেও কষ্ট পেতেন শোভারাণী, বেঁচে
থাকাটাই তাই প্রায় নরক যন্ত্রণার সামিল হয়ে গেলো শোভারাণীর !
এইভাবেই চল্লিশটা বছর কাঁটিয়ে দিলেন
তিনি, পাপের সংসারে এক পাপীর সঙ্গে ঘর করে !
যখন
সুধাময়ের এই জটিল রোগটা ধরা পড়ল, তখন দিন-রাত এক করে সেবা করেছিলেন স্বামীর, নিজের
হাড়-মাস এক করে দিয়ে ! কেন করেছিলেন এসব, সুধাময় পাপী জেনেও ? এ উত্তর তাঁর নিজেরও
জানা নেই !
কোনটা
পাপ, কোনটা পুণ্য সে বোধটাও স্পষ্ট ছিল না শোভারাণীর !
কাশিটা হয়েই যাচ্ছে সুধাময়ের, শোভারাণী
তাঁর পিঠে হাত বুলিয়ে দেন, তবে যন্ত্রের মতো নয়, বেশ মায়া-মমতা মাখানো থাকত সে
ছোঁয়ায়।
বাইরের লাউমাচায় শালিক পাখির নাচ তখনও
থামেনি।
আকাশে তখনও চলছে সূর্য আর মেঘের খেলা,
অনন্তকাল ধরে যেমনটা চলে আসছে !
কেশেই চলেছেন সুধাময়, শোভারাণীও তাঁর পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন, অন্তকাল যেমনটা করে আসছেন !

ভালো লাগল লেখাটা।
ReplyDelete