1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, October 21, 2020

প্রাণপ্রতিষ্ঠা

 

ছবি : ইন্টারনেট
                                                          ইন্দ্রানী দলপতি

।। ১ ।।

“কুমোল পালাল গলুল গালি, বোঝাই কলা কলশি হাঁলি।”-থেকে থেকে এই লাইনদুটোই আওড়ে যায় অপা। আর এই শুনে হাসিতে ফেটে পড়ে নরোত্তম  বাবু। কতবার বুঝিয়েছেন যে ওটা “কুমোল” নয়, “কুমোর”। অনেকবার “ল”-কে “র” বলানোর চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সব চেষ্টাই বৃথা হয়েছে। নরোত্তম  বাবু একজন মৃৎশিল্পী, প্রতিমা গড়েন। প্রতিবেশী নীলাম্বর বর্মণ-এর মেয়ে অপরাজিতা, ডাকনাম অপা, ভারী মিষ্টি মেয়ে। সারাদিন নরোত্তম  বাবুর কাছে পড়ে থাকে, বড্ড ভালবাসে তাকে। নরোত্তম  বাবু অপার গল্পদাদু, অপাকে তিনি দুর্গাঠাকুরের গল্প বলেন, অসুরবধের গল্প বলেন, দুষ্টু অসুরের স্বর্গ দখলের গল্প বলেন। আর অপাও তার গল্পদাদুর নিষ্ঠাবান শ্রোতা।

নীলাম্বর একটি কারখানায় কাজ করত, কোনোরকমে চলে যেত তার। বড় ইচ্ছে ছিল মেয়েটাকে এই বছর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করবে, কিন্তু কোথা থেকে যে কি হয়ে গেল, কারখানা বন্ধ হল, মালিক জানালো লকডাউন কাটলে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া হবে, ততদিন পর্যন্ত কারখানার দরজা বন্ধ। নীলাম্বর অতশত বোঝে না, সে শুধু খিদে বোঝে, খিদের জ্বালা বোঝে, অভাবের যন্ত্রণা বোঝে। তবুও এতকিছুর মাঝেও সে স্বপ্ন দেখে একদিন তার মেয়ে অনেক বড় মানুষ হবে, অনেক অনেক লেখাপড়া করবে, সমস্ত অভাব-যন্ত্রণা সেদিন দূর হয়ে যাবে। ঘরে এসে জানতে পারলো এবার থেকে অঙ্গনওয়াড়ি স্কুলটাও  বন্ধ থাকবে। অপা অন্তত একবেলা ভালো করে পেট ভরে খেতে পেত রোজ, আর তাই স্বামী-স্ত্রী-তে মিলে যেমন করে হোক দিন কাটিয়ে দিত নীলাম্বর, কিন্তু এইবার সে সত্যি সত্যিই মনে মনে প্রমাদ গুনল।

রাতে দু-চোখের পাতা এক করতে পারলেন না নরোত্তম  বাবু। তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে, এইরকম অজানা রোগের সাথে কিভাবে লড়াই করবেন তা ভেবে ভেবেও ঠাহর করতে পারলেন না। তার মধ্যে খবরের চ্যানেলগুলোতে দেখাচ্ছে সবাইকে ঘরে থাকতে হবে, কেউ আর বাড়ির বাইরে বেরোতে পারবে না, নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে প্রশাসন। কিভাবে কাটবে তবে আগামী দিনগুলো, ভাবতে ভাবতে তার ঘুম উড়ে যাবার জোগাড় হল। দারিদ্র্যতা তার এত বছরে সয়ে গেছে মৃৎশিল্পী হওয়ার সুবাদে, তবুও গভীর রাতে তার দুচোখ জুড়ে ঘুম আসার বদলে অনিশ্চয়তা ছেয়ে এলো।

।। ২ ।।

এই মুহূর্তে সারা দেশ জুড়ে এক টালমাটাল অবস্থা! দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। ডাক্তার-নার্সরা মিলে এক মহা সংগ্রামে নেমে পড়েছে, প্রাণ বাঁচাতে তৎপর প্রত্যেকে। গবেষণায় ব্যস্ত সকল বিজ্ঞানীরা। পুলিশ থেকে শুরু করে সমস্ত প্রশাসনিক কর্মীরা পর্যন্ত পরিবার-পরিজন ভুলে এক হয়ে লড়াই করছে। সকলের মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাচ্ছে – “আমরা করবো জয়, নিশ্চয়।” “সবকিছুরই ভালো খারাপ আছে। এই যেমন একটা অজানা আশঙ্কা, ভয় গোটা পাড়াটাকে এক করে দিয়েছে। আনন্দেও সব মানুষ এক হয় না, আমার-তোমার করে ভাগাভাগি করতে শুরু করে, কোন ফাঁক গলে সেই আনন্দের মাঝে তথাকথিত “আমাদের নিয়ম-তোমদের রীতি” প্রবেশ করে একটা বিশাল দূরত্ব তৈরি করে, সেটাই তো আদতে দূরত্ব!” – জানলার ধারে বসে মনে মনে নিজের সাথে কথোপকথন সারছিলেন নরোত্তম  বাবু। অপাকে খুব মনে পড়ছে তার। সে কেমন আছে তার গল্পদাদুকে ছেড়ে? ভাবতেই বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠলো নরোত্তম  বাবুর।

নীলাম্বর আপাতত একটু নিশ্চিন্ত, কয়েকজন সজ্জন ব্যক্তি চাল-ডাল-আলুর ব্যবস্থা করে দেওয়ার ফলে আপাতত খিদের জ্বালা প্রকট হবার সুযোগ পায়নি এখনও পর্যন্ত। বরং তার নতুন কাজ হয়েছে, অপার কাছে গল্প শোনা, অসুরবধের গল্প, দুগ্গাঠাকুরের গল্প, দুষ্টু অসুরের স্বর্গ দখলের গল্প। নীলাম্বর যদি একটু অমনোযোগী হয়েছে তবে তার রেহাই নেই, আবার প্রথম থেকে শুরু হবে অপার গল্প। নীলাম্বর বিরক্ত হয় না তাতে। সে বুকে আরও বড় স্বপ্ন বাঁধছে, তার মেয়ে বড় হয়ে দিদিমণি হবে, গরীব বাচ্চাগুলোকে পড়িয়ে মানুষের মতো মানুষ করবে সে। “এই শহরে প্রকৃত মানুষের বড় অভাব, মানুষ গড়ার কারিগর চাই, মানুষ গড়ার কারিগর!” – ভাবতে ভাবতে অমনোযোগী হয়ে পড়লো নীলাম্বর।

“চারিদিকে রোজই কিছু না কিছু অমানবিক ঘটনা ঘটে চলেছে। আগেও তো রোজ এমন কত কী ঘটে যেত, আমরা দেখেও দেখতাম না। ফুরসত মেলায় এখন দেখছি, দেখাই সার! কাল যদি আমি এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে যাই, তবে আমিও কি অমন অমানবিক হয়ে উঠবো? না…না, এসব কি ভাবছি! আমি এমনটা হবো না। আচ্ছা…. আচ্ছা যদি আশেপাশের প্রতিবেশীর চাপে পড়ে আমি যদি বাধ্য হই অমানবিক হতে, তখন…… কী আবোল তাবোল ভাবছি তখন থেকে!” – নরোত্তম  বাবু খানিকটা ধমক দিয়ে নিজেকে থামিয়ে দিলেন।

পাশের পাড়ার টোটোচালক ঘোতনের সাথে ফোনে কথা হয়েছে নীলাম্বরের, আগামীকাল থেকে দুজনে মিলে সবজি বিক্রি করতে বেরোবে, যা আয় হবে দুজনে মিলে ভাগ করে নেবে। নীলাম্বরের ভেতর ভেতর হালকা উত্তেজনা হল। এমনটা করে আগে সে কখনো কিছু করার কথা ভাবেনি, সারাজীবন অন্যের পদানত হয়েই কেটে যাবে ভেবেছিল। “এই আইডিয়াটা যদি কাজে লেগে যায়, তবে আর ঐ কারখানামুখো হবো না!”-বড় স্বস্তি অনুভব করলো মনে মনে নীলাম্বর।

।। ৩ ।।

এই কদিনের দুর্যোগকে পিছনে ফেলে আবার চলতি জীবনযাপনে ফিরতে চলেছে সবাই। তবে মজার বিষয় হল বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। এই যেমন ধরুন, পাড়ার মোড়ে কিছুদিন আগে ছোটো করে রক্ষাকালী পুজো হয়ে গেল, অবশ্যই সব সতর্কতা, দুরত্ব বিধি মানা হয়েছিল। তবে এই প্রথম একটা গোটা পাড়ার নামে সংকল্প করা হল। ঠিক যেন পুজোর মণ্ডপ তৈরির আগে খুঁটিপুজো হয়ে গেল। বাজার এলাকা, দোকান এলাকায় ক্লাবের সব ছেলেরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সাদা রঙ দিয়ে গোল দাগ কেটে দিতে লাগল, যাতে নিরাপদ দূরত্ব বজায় থাকে সকলের মধ্যে। এও যেন মণ্ডপ তৈরীর প্রস্তুতি! পাড়ার ঘরে ঘরে চিত্রগুলোও অনেক পাল্টেছে আজ, এইতো সেদিন দেখা গেল, অপার মা সারাদিন অপার পাশে বসে গল্প শুনেছে, রান্নাঘরে নীলাম্বর রাঁধছে, যদিও ভাতটা সামান্য গলে গেছিল, কিন্তু তাতে কী! প্রতিমার কাঠামো প্রস্তুত করার সময়েও তো মাপজোকে একটু-আধটু ভুল হয়েই থাকে। পাড়ার বিশুকেও বউকে আর বলতে শোনা যায়নি – “সারাদিন বাড়িতে বসে কি করো তুমি?” বিশু আর আগের মতো কথায় কথায় চিৎকার করে ওঠেনা, শান্ত হয়েছে। কাঠামোতে মাটির প্রলেপ লাগানোর সময় যেমন মন থেকে শান্ত হতে হয়! কথায় আছে, স্বভাব যায় না মলে, তবে একবার যদি বদভ্যাসে চিড় লাগানো যায়, স্বভাব হয়তো পাল্টায়। ঘোতন আর নেশায় বুঁদ হয়ে যায় না, চিড় ধরেছে যে তাতে, বরং সংসারে মন বসেছে তার। সেদিন কথায় কথায় নীলাম্বর-কে জানালো – “বউটা আমার লক্ষীমন্ত রে, অনেক কষ্ট দিয়েছি, আর দেব না, এই মা কালীর দিব্যি কেটে বলছি, বিশ্বাস কর।” প্রতিমা সাজসজ্জার পর চক্ষুদানের পালা মিটলো তবে!

মহালয়া কেটে গেছে। পাড়ার মণ্ডপে প্রতিমা এসে পড়বে আর কিছুদিনের মধ্যে। তারপর পাড়ার সবাই এক হয়ে মায়ের প্রাণপ্রতিষ্ঠা করবে, উৎসবে মাতবে সবাই, আনন্দের উৎসবে, এক হওয়ার উৎসবে, সর্বোপরি মানবিকতার উৎসবে। প্রাণ ফিরে পাবে আবার গোটা সমাজ!

নরোত্তম  বাবু প্রতিমা নির্মাণের একেবারে শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছেন, জোরকদমে প্রস্তুতি চলছে, সাথে পাশে চলছে রেডিও, উনিও গুনগুন করে চলেছেন – “আমার চেতনা চৈতন্য করে দে মা চৈতন্যময়ী……”

nayonika3@gmail.com
হাওড়া



No comments:

Post a Comment