1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Tuesday, January 26, 2021

মিনুর শেষকথা

ছবি  : ইন্টারনেট 

 মিনুর শেষকথা
মৌমিতা ব্যানার্জ্জী

       সুবল আজ আবার এসেছে।রান্নাঘরের মেঝেতেই পিঁড়ি পেতে জাঁকিয়ে বসেছে।আগে সেভাবে আসতো না কিন্তু আজকাল ও প্রায়ই আসছে।কেন আসছে তাও মিনুর অজানা নয়।ও এলে মিনুর ভিতরটা এখন কেমন এক অস্বস্তিতে ভরে ওঠে।মিনু চায়না আবার বারণ ও করতে পারে না।সুবল এটা, ওটা বলে আবার সেই কথাই তোলে।মিনু নীরবে ঘরের কাজ করে যায়, উত্তর দেয়না।সুবল চলে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ স্থির ভাবে বসে থাকে মিনু।অবাক হয়ে ভাবে ওই, ওই যে আমার আত্মজ।অথচ ওতে আর আমাতে কত প্রভেদ।কত মাইলের দূরত্ব।যেনো দুই ভিন গ্রহের বাসিন্দা।এককালে যে আমার সবথেকে কাছের ছিল সে আজ বহুদূরের।মাঝখানে অপরিচয়ের পাহাড়।কবে এই পাহাড় তৈরি হলো?কীভাবেই বা হলো?মিনু জানে না।মিনু চোখ বন্ধ করলে সুবলের শৈশবকাল দেখতে পায়।
রোদ চলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।উঠানে এখন ছায়া পড়েছে।মিনু কতক্ষণ ধরে বসে আছে ও নিজেও জানেনা।এবার উঠতে হবে।এইসময় শিবু আসে।শিবু এমনি সময় বাড়িতে থাকে কম।কিন্তু আজকাল এই সময়টায় ও প্রায়ই আসে।ঘরের মধ্যে খুটুর খুটুর করে।ওদের কী সব দল আছে।শিবুর ঘরটায় পোস্টার, রঙ সব ছড়ানো থাকে।ছড়ানো থাকে পার্টির ঝান্ডা।শিবুরা সারাদিন পার্টির হয়ে খাটে।এইসব দেখলে মিনুর একধরনের বিতৃষ্ণা জাগে।পার্টি শিবুদের থেকে কেড়ে নেয় অনেক কিছু।তাদের সময়,শিক্ষা, পরিশ্রম, পরিবার, রক্ত এমনকি প্রাণ ও।কিন্তু পার্টির বড়ো বড়ো ঘটনাগুলো ঘটে যায় প্রায়শই তাদের অজ্ঞাতসারে।উপরতলায় সব রদবদল হয়ে যায় আর শিবুদের সব পরিশ্রম অতল জলে তলিয়ে যায়।ওই সব রাজার নীতি রাজাদেরই ভালো।মিনু দীর্ঘশ্বাস ফেলে।এখন শিবুও চাইতে শিখেছে।মুখচোরা ছেলে বলে ছোটবেলায় কতো হাসতো মিনু।ওদের দুই ভাইয়ের লক্ষ্য একটাই জিনিসের ওপর।সবার সব সমস্যার সমাধান ওই একটাই।
‘খেয়ে যাবি তো বাবা।দুটো মুড়ি দেবো?’
‘না।তোমায় ভাবতে হবেনা।‘
‘আমি ভাববো না?তো কে ভাববে শুনি?খেয়ে নে না।তবে দুটো ভাত বসিয়ে দি।আবার সেই কতো রাতে ফিরবি।‘
‘বললাম তো না। এঃ’ একটা তাচ্ছিল্যের শব্দ করে শিবু।ওর কথাবার্তা এখন এমনই।
‘অতো ভালোবাসা দেখাতে হবেনা।এসেছিল তো প্রাণের বড়ো ছেলে।খুব তো হলো সোহাগ।‘
শিবু এখন আর দাদা বলেনা।বলে তোমার বড়ো ছেলে।
‘সোহাগ আবার কী?কী যে বলিস তার ঠিক নেই।‘
‘থাক ন্যাকামি করোনা অসহ্য লাগে।তোমার বড়ো ছেলে আর তার বৌটা কী চিজ জানিনা ভেবেছো?মাখন লাগাতে এসেছে।চাই তো শুধু ওই একটা জিনিস।‘  ‘ছি,ও কি কথার ছিড়ি হয়েছে তোর?‘ শিবু খানিকক্ষণ তেরচা চোখে তাকিয়ে থাকে তারপর  রাগে দুমদুম করে পা ফেলে চলে যায়।
হ্যাঁ তা মিনুও জানে বৈকি।আগে তবু রাখঢাক করে বলতো এখন সরাসরিই বলে।শিবুও বলে।মিনু অধিকাংশ সময়েই চুপ করে থাকে।
‘বৌঠান বাড়ি আছো নাকি গো?’
‘আসুন মাষ্টারমশাই।এবার অনেকদিন পরে এলেন।শরীর ভালো?’
‘আর ভালো।ওই আছি আর কী।শিবু এসেছিল মনে হলো। ‘
‘চলে গেছে?’
‘ওহ। ছেলেটাকে একটু সামলে রেখো।যে পথে যাচ্ছে।‘ মাষ্টারমশাই হতাশ ভাবে দুপাশে মাথা নাড়লেন।মিনু শূণ্য চোখে তাকিয়েই থাকে সামনের দিকে।
‘সেই রায়েদের জমিটার কথা মনে আছে বৌঠান?সেই জমিটা সুবল কিনছে।‘
মিনুর শরীরটা এবার একটু আন্দোলিত হলো।সুবল জমি কিনছে!
‘তুমি জানতে?’
‘না।তবে কিনতেই পারে।এখন ও অনেক কিছুই করছে।আজও এসেছিল।‘
মাষ্টারমশাই হাসলেন।‘ওই প্রেসঘরটার জন্য তো?’মিনু সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ে।‘কিন্তু মাষ্টারমশাই ও যে আমি দিতে পারবো না।আপনি তো জানেন।‘মাষ্টারমশাই কোনো জবাব দিলেন না।আর দু একটা কথার পর উঠে পড়লেন।রাত হয়ে গেছে।তাঁকে এখন অনেকটা পথ যেতে হবে।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে অনেকক্ষণ।মিনু এখন একা।সুবল জমি কিনছে? একবারও বলেনি তো।অবশ্য ওকে বলবেই বা কেন?ওকে এখন আর কেউ কিছু বলেনা।শিবু মাঝেমধ্যে মারামারি করে বাড়ি আসে।মিনু কিছু বলতে গেলে তেরচা চোখে তাকায়।মিনু তাই চুপ করেই থাকে‌।সুবল আজকাল খুব ঘনঘন আসছে।সুবলের বিয়ে করে শ্বশুরবাড়িতেই থাকা নিয়ে ঠারেঠোরে অনেকে অনেক কথাই বলেছিল।মিনু অবশ্য খারাপ ভাবে নেয়নি।আহা থাকই না।ক্ষতি কিছু নেই।মেয়ে এখানে এসে থাকতো না হয় ছেলে ওখানে গিয়ে থাকবে।আর একটা ভিন্ন  ভাবনাও ছিল।শিবু আর সুবলের সম্পর্ক মোটেই ভালো যাচ্ছে না।ওদের আলাদা আলাদা থাকাই ভালো।
‘মা’। মিনু চমকে ওঠে।শিবু তো এতো তাড়াতাড়ি ফেরেনা কোনোদিন।আজ হঠাৎ?শিবু এসে মিনুর পাশে  বসলো।কতদিন মিনুর পাশে কেউ বসেনি।মিনু শিবুর গায়ের গন্ধ পাচ্ছে।
‘ওই প্রেসঘরটা আমায় দিয়ে দাও না মা।‘শিবু ভণিতা না করেই বলে।‘ওটা পার্টির ঘর হবে।আমার  কতো নাম হবে ওদের কাছে।দেখো তুমি যদি ওটা না দাও আমার মাথা নিচু হয়ে যাবে ।‘ মিনু নির্বাক,নিস্তেজ চোখে তাকিয়ে থাকে।‘আমি পার্টিতে আরো ওপরে উঠতে পারবো।বোঝার চেষ্টা করো।‘শিবুর গলায় ছেলেমানুষি জেদ ঝরে পড়ে।মিনু কোনো কথা বলেনা।‘তুমি দেবেনা তাই না?কিন্তু ওটা তো আমারি প্রাপ্য।বাবার জিনিস ওটা।ওই সুবল,ও তো তোমার নিজের ছেলে নয়।আমি কিছু জানিনা ভেবেছো?দিয়ে দাও ওটা।এখনো এতো আগলে রাখা কীসের?’মিনুর কানে আর কোনো শব্দই যাচ্ছিল না।ও কাঠ হয়ে গিয়েছিল।শিবু কী করে জানলো?ও তো কখনো কাউকে বলেনি।এই খবর শিবু পেল কোথা থেকে?’
রাত এখন অনেক।শিবু সেই যে ঝগড়া করে বেরিয়ে গেল আর ফিরলো না।মিনুর চোখে ঘুম নেই।সেই কতকাল আগের সব কথা আজ না চাইতেও মনে পড়ছে।
‘বেরিয়ে যা বলছি,বেরিয়ে যা।এই বাড়িতে তোদের আর থাকা হবেনা।‘
‘ওরম বলবেন না কাকা।কোথায় যাবো?’
‘তার আমি কী জানি?’
মিনু আর ওর বর অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছিল কীভাবে একটার পর একটা জিনিস বাড়ির উঠোনময় ছড়িয়ে পড়ছিল।বাপ,মা মরা মিনুর বরটার কাকার বাড়িই ছিল একমাত্র আশ্রয়। নিরাশ্রয় হওয়ার থেকেও কাকার এই ব্যবহার তাদের নির্বাক করে দিয়েছিল। তারপর কতো কষ্ট করে কতো লড়াই শেষে এই ছোট্ট আশ্রয় আর প্রেসঘর।গ্রামের মধ্যে প্রেস শুনে লোকে খুব হেসেছিল।কিন্তু তারপর এই প্রেস ও বেশ চললো তো।ছেলেরা এলো সরস্বতী পুজোর চাঁদার কাগজ ছাপাতে।স্কুলের পত্রিকা বের করা হলো,বারোয়ারি দুর্গাপুজোর কাগজ ছাপানো হল।পার্টির কাজ ও হলো।মিনুর বর মিথ্যে স্বপ্ন দেখেনি।কিন্তু তাও শেষদিকে আর চলতো না।খরচ চালানোই মুস্কিল হয়ে গিয়েছিল।মানুষটা বেঁচে থাকতে থাকতেই প্রেস বন্ধ হয়ে গেল।এখন আর সেই মানুষটা নেই।কিন্তু তাঁর শেষ ইচ্ছা রয়েই গেছে।
‘মিনু আবার প্রেসঘরটা তো খালিই পড়ে আছে।মেশিনগুলোও একটা একটা করে চলে গেল।ঘরটা তুমি গ্রামের মেয়েদের দেবে?ওরা স্বনির্ভর হবে।হাতের কাজ করবে।ওদের একটা জায়গা হলে ভালো হয়।দেবে?কথা দাও দেবে।‘
মিনু চোখ বোজে।শেষকথাগুলো এখনো কানে বাজে রাবণের চিতার মতো।
পরেরদিন বেলা দশটা নাগাদ সুবল এলো।
‘তুই এতো সকালে?’
‘কেন আসতে নেই?’
‘তাই কি বললাম?হ্যাঁ রে আজ এখানে খাবি?ভাত বসাবো?’ মিনু হঠাৎ উৎসাহিত হয়ে বলতে শুরু করলো।
‘বসাও।’ সুবল একটু ইতস্তত করে।শ্বশুরবাড়ি থেকে রীতিমতো পাখি পড়া করেই শিখিয়ে পাঠিয়েছে।সুবল তবু একটু সময় নেয়। অনেকদিন পর মিনু  খুশি হয়।রোজ রোজ একার জন্য রাঁধতে ভালো লাগে না। ‘কী খাবি বল।বড়ির ঝাল করে দেবো?আমড়ার টক খাবি?আমড়া আছে।তুই তো খেতে ভালোবাসিস।‘
‘সে তোমার যা ইচ্ছা।‘সুবল সংক্ষেপে উত্তর দেয়।আর একটু চুপ করে থেকে সুবল বলে ‘শিবুটা কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে তাই না?পার্টি পার্টি করেই গেল।তুমি বোঝাতে পারোনা?’ 
‘তুই ও তো বোঝাতে পারিস।‘ ‘আমি!’ ‘কেন নয় কেন?তুই ওর বড়ো ভাই।‘ ‘আমি ওসব বোঝাতে টোঝাতে পারবো না।বড়ো দাদা বলে মানে নাকি?তুমি প্রেসঘরটা ওকে দেবেনা ব্যাস।‘
আবার সেই এক কথা।মিনু থম মেরে যায়।এই কথা বলতেই এসেছিল তবে ।মায়ের সাথে ওর আর কোনো কথা নেই?মিনুর রান্না করা হাত থমকে গেছে সুবল সেটা টের পায়।
‘ওই বললেই তোমার ওই অবস্থা।কাঠ হয়ে যাবেন একেবারে।আমাকে তো দেবেনা জানি।আমি তো তোমার ছেলে নই।আমাকে দেবে কেন?দাও সব শিবুকেই দাও।‘সুবল হনহন করে উঠে চলে গেল।
সুবল ও জানে?ওরা সবাই জানে?মিনুর দুই চোখে উপচে পড়া নদী।জলের টসটস ফোঁটাগুলো মিনু হাত তুলে মোছে না।
‘মিনু ও মিনু এই দেখো কাকে আনলাম।‘
‘ওমা এটা কে গো।আহা দুধের বাছা তো।‘
‘আমার বন্ধু কাজলকে মনে আছে?এ তার ছেলে।কদিন আগে কাজল আর ওর বৌটা তো মরে গেল।তোমায় বলেছিলাম তো।‘গলাটা ধরা ধরা হয়ে যায় মিনুর বরের।‘কাকার কাছেই ছিল ছেলেটা।কাকাটা ভালো নয়।আবার আমার মতোই ভাগ্য হবে?তাই নিয়ে এলাম সঙ্গে করে।ওরাও এক কথায় দিয়ে দিল।যেন বিদায় হলেই বাঁচে।ভালো করিনি?’ 
মানুষটার মুখে অদ্ভূত সারল্য।এই মুখের ওপর বিরোধিতা করা কঠিন।তাও মিনু বলেছিল ‘নিয়ে এলে কিন্তু মানুষ করবে কেমন করে?আমাদের তো নিজেদেরই জোটে না।‘ 
‘ও আবার কেমন কথা।দায়িত্ব নিতে গেলে ‘বোধ’ টাই তো জরুরি।টাকা আসল নয়।আমরা দুটো শাকভাত,ডালভাত খেলে এই বিল্লি বাচ্চাটাও খাবে।তুমি নিজের খোকা হলে একে ভুলে যেওনা শুধু।‘ 
এই তার সুবল। আর তারপর কোলে এলো শিবু।

‘ও সুবলের মা শিগগির এসো।সুবলকে কারা খুব মেরেছে গো।রক্তে ভেসে যাচ্ছে একেবারে’
‘সে কি কেন?’মিনুর বুকটা খালি হয়ে যায়।
‘তা জানিনা।দেখে তোমায় তাই বলতে এলাম।বোধহয় রাতের অন্ধকারে মেরেছে।‘
মিনু বুকে হাত দিয়ে বসে পড়ে।
‘না না ওতো ভেঙে পড়োনা।এখন সুবল ঠিক আছে।আমি ও পাড়া থেকেই তো এলাম।তুমি যাবে তো চলো নিয়ে যাই।জানো,সবাই বলছে ওরা নাকি শিবুর দলবল।শিবুও নাকি ছিল।‘
মিনুর মুখের দিকে তাকিয়ে পড়শি মহিলা থমকে চুপ করে যান।

মিনু চলে যাচ্ছে।অনেক দূরে।যেখানে ওকে কেউ চিনবে না।ও কাউকে চিনবে না।পিছনে ফেলে রেখে যাচ্ছে ওর পরিচিত জগৎ।ওর সংসার।যাকে ও তিলে তিলে গড়েছিল।মিনু তার শেষকথা জানিয়ে এসেছে।মাষ্টারমশাইকে আইনি ভাবেই দিয়ে এসেছে প্রেসঘরটা।মেয়েদের স্বনির্ভর করার দায়িত্ব উনি নিয়েছেন।এরপর কী হবে মিনু জানেনা।জানতেও চায়না।মনে মনে জানবে কারুর শেষ ইচ্ছা ও রেখেছিল।মিনুর ঘরে গেলে এখন দেখা যাবে দরজার পাশেই ইঁট চাপা দেওয়া মিনুর শেষ চিঠি।কোনো বাহুল্য ছাড়াই লেখা কয়েকটা কথা।

স্নেহের সুবল ও শিবু
                     তোমরা হয়তো ভাবছো তোমাদের মা বড়ো কঠিন।না তা নয়।তোমরা দুজনেই আমার কাছের।আমার সামান্য যা কিছু ছিল তা তোমাদের দুজনকেই দিয়ে গেলাম।জানি প্রেসঘরটা তোমাদের প্রয়োজন ছিল।সুবলের দোকানের জন্য।শিবুর পার্টির জন্য।কিন্তু ওটা তোমাদের বাবার স্মৃতি।ওটা তাঁর জন্যই থাক।তোমরা ভালো থেকো।
                                                  ইতি-তোমাদের মা মৃন্ময়ী
moumitabanerjee005@gmail.com
হাওড়া


1 comment: