1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Tuesday, January 26, 2021

মধ্যবিত্ত

ছবি  : ইন্টারনেট 

 মধ্যবিত্ত 
ঋতব্রত গুহ

১। 

“ বাবা কখন ফিরবে মা ! "

সোমনাথের আজকাল ফিরতে অনেকটাই দেরি হয় । প্রাউভেট সেক্টরে জব করে সোমনাথ । একপ্রকার মারসিলেস জব । পরিশ্রম অনেক করতে হয় । সেই অনুপাতে টাকা পায় না । বস যতক্ষণ বলবে ততক্ষণ থাকতে হয় অফিসে । তিয়াসা যেমন করে নিজেকে বোঝাতে পারে আদি তো তেমনটা পারে না । আদি শুধু বাবাকে আরেকটু বেশী সময় কাছে পেতে চায় । ইদানীং সোমনাথের মাইনেটা আরেকটু বেড়েছে অতএব কাজের চাপও সমানুপাতিক ভাবে বেড়েছে ।

“ ফিরে যাবে বাবা ! তুমি কালকের হোম ওয়ার্ক গুলো কমপ্লিট করেছ তো ! "

“ হ্যাঁ মা ! পুরো কমপ্লিট ! "
তিয়াসা আর সোমনাথের স্বপ্ন অনেক । দুজনেই নিজেদের জীবনে ঠিক তেমন কিছু করে উঠতে পারে নি । তাই দুজনেই চায় আদি যেন পড়াশোনা করে খুব ভালো জায়গায় পৌঁছায় । সীমিত উপার্জন হওয়া সত্ত্বেও আদির কোন কিছুতেই কোন ত্রুটি রাখে না ওরা । যদিও আজকাল সব বিষয়ে যেভাবে খরচ বেড়েছে বিশেষ করে এডুকেশনে যে খরচ বেড়েছে মাঝে মাঝে পেরে ওঠে না ওরা । আদি একটা ভালো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে । তার একটা মোটা খরচ রয়েছে । হাজার রকমের অ্যাকটিভিটিস ! হাজার রকমের কোর্স ! আর স্থায়ী খরচ তো রয়েইছে । নিজেদের সখ আহ্লাদের ক্ষেত্রগুলোকে সঙ্কুচিত করে কোনমতে এত বিশাল খরচ সামাল দেয় ওরা । তবু কিছুটা পারে - কিছুটা পারে না । 

“ মা বাবাকে একবার দেখা করতে বলেছিল স্কুলে ! "

“ বাবা যাবে স্কুলে । পরের সপ্তাহে । ফোনে কথা বলে নেবে ! "

 কলিং বেলের আওয়াজ শুনে ছুটে গেল আদি । সে জানে বাবা এসেছে । সকাল থেকেই এই মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করে আদি । 

“ বাবা ! আজও এত দেরী করলে ! "

সোমনাথ হাসল । সারাদিন ক্লান্তির পরও হাসিটা যেন লেগেই রয়েছে সোমনাথের মুখে । 

“ কি করব বাবা ! তুমিও যখন অফিস যাবে তখন দেখবে এমনই দেরী হবে ! "

আদি কিছু একটা বলতে চাইছিল । 

“ এখন তুমি বাবাকে বিরক্ত করো না আদি ! বাবা সারাদিন পরিশ্রম করে এসেছে । বাবা কে ফ্রেশ হতে দাও আগে ! "


২। 

“ বলছি স্কুল থেকে বোধ হয় আবার টাকার জন্য বলছে ! এর মধ্যে কি কিছু হতে পারে ! "

সোমনাথ করুণ মুখে তাকাল তিয়াসার দিকে । 

“ এই মাসটায় হাতে কিছু নেই জানো । কিছুই নেই । কিছু টাকা লোন করেছি । পরের মাসে কাটিয়ে নেব । তাই দিয়ে সংসার চালাচ্ছি ! "

তিয়াসা হাত রাখল সোমনাথের হাতে । 

“ তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না । আসলে মনে হয় আমরা একটু বেশী খরচ করে ফেলছি । ফ্ল্যাট টা না নিলেই বোধ হয় ভালো হত । "

“ ভাড়া বাড়িতে আর ভালো লাগত না জানো । এত কথা শুনতে হত । "

তিয়াসা দীর্ঘশ্বাস ফেলল । 

“ তবে কি আদি কে স্কুল টা চেঞ্জ করিয়ে দেব ! মানে এই স্কুলে তো এত খরচ । "

“ না না । আমার তো কিছুই হল না । এখন ওর কিছু হলে অন্তত আমার আক্ষেপ টা মিটবে জানো । আসলে ভাগ্য একটা বিশাল বড় ফ্যাক্টর । পড়াশোনায় আমি তো খারাপ ছিলাম না । কিন্তু দেখ,  চাকরি বাকরি কিছুই হল না । ব্যবসাটাও হল না । কেমন যেন ঘেঁটে গেল সবটা ! " 

তিয়াসা জানে সোমনাথ জীবনে হয়ত অনেক কিছু করতে পারত । কিন্তু ভাগ্য ওকে কিছুতেই সাহায্য করে না বরং পদে পদে ওকে নানা রকম বাধার সম্মুখীন হতে হয় ! 

“ তিয়াসা। আমার থেকে বেটার কাউকে ডিসারভ করতে তুমি ! "

তিয়াসা হাসল । 

“ ধৈর্য ধর ! আমাদেরও সুদিন আসবে ! "

দুজনেই জানে সামনে কঠিন সময় । তবে দুজনেই দুজনকে আশ্বস্ত করতে চায় । ভালো রাখতে চায় । এভাবেই সারাদিন কর্তব্য পালনের পর ঘুমিয়ে পড়ে দাম্পত্য । 


৩। 

তিয়াসা ভেবেছিল বিয়ের পর মাস্টার্স টা কমপ্লিট করে নেবে  । তারপর সমস্যা এমন ভাবে চারদিক থেকে ঘিরে ধরল যে তিয়াসার এখন সেই স্বপ্ন দেখতেও ভয় লাগে । সোমনাথ যদি একটু ভালো চাকরি করত তবে হয়ত স্বপ্নপূরণ হত । সোমনাথকেও দোষ দিয়ে লাভ নেই । গত দশ বছরে ও অনেক চেষ্টা করেছে । কিছুতেই কিছু হয় নি ।তিয়াসা চেয়েছিল কিছু রোজগার করে সোমনাথের পাশে দাঁড়াতে । কিন্তু পারেনি । আদির হার্টে একটা সিভিয়ার অসুবিধে আছে । ওকে সর্বক্ষণ নজরে রাখতে হয় । আয়া রেখে যে সামাল দেবে সেই সামর্থ্য ওদের নেই । এখন তিয়াসার ক্লান্ত লাগে । মনে হয় যেমন জীবন আছে তাকে সেভাবেই সহজ করে মেনে নেওয়া ভালো । 

দুপুরে বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পরেছিল তিয়াসা। ঘুম ভাঙল কলিং বেলের আওয়াজে ।  আদি বোধহয় এসে গিয়েছে । 

“ কেমন হল আজকে পড়াশোনা ! সব হোম ওয়ার্ক ঠিক ছিল তো ! "

অন্যদিন আদি এসেই তিয়াসাকে জড়িয়ে ধরে । নিজে থেকেই কত গল্প করে । আজ যেন আদির মনটা ভীষণ খারাপ । 

“ কি হয়েছে সোনা ? কারোর সাথে ঝগড়া হয়েছে ! "

আদি মাথা নাড়ল । 

“ মাম্মাম কে মিথ্যে বলতে হয় না । গুড বয় রা মিথ্যে বলে না কখনো । বল তো কি হয়েছে ! "

“ মা বাবা কি করে ? "

তিয়াসা ভুরু কোঁচকাল । 

“ কেন তুমি জানো না । বাবা তো অফিসে কাজ করে । তুমি জানো না ! তুমি তো গিয়েছ বাবাদের অফিসে ! "

“ না মা তুমি জানো না । বাবা খাবার ডেলিভারি দেয় । আজকে আমাদের ক্লাসে ঋষি বলে একটা ছেলে সবার সামনে আমাকে বলল যে তোর বাবা কালকে আমাদের বাড়ি খাবার ডেলিভারি দিতে এসেছিল ! সবাই যেন আমার দিকে কেমন করে তাকাল। আচ্ছা খাবার ডেলিভারি দেওয়া কি খারাপ ! "

তিয়াসা যেন আকাশ থেকে পড়ল । কিন্তু আদিকে কিছুই বুঝতে দিল না । 

“ খারাপ কেন হবে ! কোন কাজ খারাপ নয় । সব কাজকে মূল্য দিতে হয় । তোমাকে বাবা শিখিয়েছে না । "

“ কিন্তু ওরা যে বলল ……। "

“ ওরা জানে না বাবা । ওরা কিছুই জানে না ! তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও ! সব কাজকে সম্মান করতে হয় । কোন কাজ ছোট নয় ।  "

তিয়াসা মনস্থির করল যে আদিকে ওই স্কুল থেকে সরিয়ে নেবে সে । অনেক সরকারি স্কুলেই  তো ভালো পড়াশোনা হয় । সেরকম একটা স্কুলে ভর্তি করে দেবে আদিকে । সোমনাথের আর্থিক অবস্থা যেহেতু খুব ভালো নয় সেহেতু স্কুলে মাঝে মাঝেই নানা অপমানের সম্মুখীন হতে হয় । একবার তো ম্যানেজমেন্টের একজন সোমনাথকে আদির সামনেই বলেছিল “ হাতে যখন টাকা নেই তখন ছেলেকে অন্য স্কুলে নিয়ে যান না কেন ! " আদির ছোটমনে এসবের প্রভাব পড়ে । ক্রমশ স্কুলে নিজেকে কেমন গুটিয়ে নিয়েছে আদি । আজকের ঘটনার পর এই প্রবণতা আরও বাড়বে । 

৪। 

তিয়াসার আর তর সইছে না । কখন যে সোমনাথ আসবে ! তিয়াসা বিশ্বাস করতে চাইছে না । তবে কি সোমনাথের চাকরিটা আর নেই ! তিয়াসার মনে হাজারো সংশয় । যদি কিছু ঘটে থাকে তবে তো তিয়াসাকে জানানো উচিত ছিল সোমনাথের ।  ঠিক রাত দশটায় কলিং বেল বাজল । তিয়াসা দৌড়ে গিয়ে দরজাটা খুলল। 

 অন্য দিনের মতই সোমনাথ শুকনো হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে গেটের সামনে । এই হাসি দেখলেই তিয়াসার সব রাগ গলে জল হয়ে যায় । একটা মানুষ সারাদিন এত কষ্ট , এত পরিশ্রম করার পরও শুধু নিজের স্ত্রী আর ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে এমন হাসতে পারে ! 

“ এস ! জল খেয়ে নাও ! "

তিয়াসা সোমনাথের পাশে এসে বসল । 

" কাজের চাপ আছে খুব ! তাই না ! "

“ আর কি ! কাজের চাপ তো থাকবেই । "

সোমনাথ পকেট থেকে কিছু টাকা বের করে তিয়াসাকে দিল । 

“ আদির স্কুলের মাইনেটা । কাল পারলে দিয়ে এস ! "

তিয়াসা  হাসল । 

“ জোগাড় হল কি করে টাকাটা সোমনাথ  ! "

“ ওই কোন মতে করলাম ! তুমি রাখ । আমি পরে শোধ দিয়ে দেব ! “

তিয়াসা তাকিয়ে রইল সোমনাথের দিকে । তিয়াসার চোখে জল । 

“ তুমি আমার থেকে লুকোলে কথাটা ! "

সোমনাথের চোখমুখের ভাষা হঠাৎ কেমন বদলে গেল ! 

“ লুকোচ্ছি  মানে ! কি লুকোচ্ছি ! " তিয়াসাকে মিথ্যে কথা বলতে অভ্যস্ত নয় সোমনাথ । 

 কিছু মুহূর্তের নিস্তব্ধতা । 

“ তোমার কি চাকরিটা চলে গিয়েছে সোমনাথ ! "

“ না যায় নি । "

সোমনাথ একটু সময় নিল । সোমনাথ বুঝল কোথাও একটা কিছু গণ্ডগোল হয়েছে । তিয়াসা সব কিছু জেনে গিয়েছে । 

“ আমি আর পারছিলাম না জানো ! এত খরচ চারদিকে ! আদির ট্রিটমেন্ট , স্কুল , ফ্ল্যাটের ই এম আই ,সংসার ওই কটা টাকায় চলছিল না  । তুমি তো সবই জানো । বুঝলাম আমাকে আরেকটা কিছু করতে হবে । এখন সব ফুড ডেলিভারি কোম্পানিগুলো খুব ভালো ব্যবসা করছে । ওরা প্রায়ই ডেলিভারি পার্টনার হায়ার করে । ভাবলাম এই কাজটি আমি করতেই পারি । প্রথমে একটু আড়ষ্ট লাগছিল । যদি ধরা পড়ে যাই । মানে এমনি কিছুই না । বুঝতেই পারছ আমাদের সমাজ তো ! কিন্তু তাও শেষরক্ষা করতে পারলাম কোথায় ! এক মাস থেকে অফিসের পর আমি এই কাজটা করছি । আয় একটু বেড়েছে । এই যা ! সাধারণত কোন পরিচিতের বাড়ি ডেলিভারি দিতে যাই না । তোমাকে কথাটা কে জানাল তিয়াসা ! "

তিয়াসার অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করছে সোমনাথ কে । না বলা শব্দ গুলো ঝড়ে পড়ছে তিয়াসার গাল বেয়ে । 

“ কাঁদছ যে ! "

“ তুমি এত কষ্ট করছ সবাইকে ভালো রাখবার জন্য । এটা কজন পারে বল তো ! কোন রাগ নেই , কোন অশান্তি নেই । হয়ত সময়টা প্রতিকূল । ভালো সময় খুব তাড়াতাড়ি আসবে । আজকে মন ভোলানোর জন্য বলছি না সোমনাথ । আজকে আমি কেন জানি না বিশ্বাস করতে পারছি আমাদের দুজনের জীবনে ভালো সময় আসবেই । "

সোমনাথ হাসল । 

“ আদিকে কিছু বলেছ ! "

‘ আদি সব বুঝতে পারে ! ও নিশ্চয় বুঝতে পারে ওর বাবা ওর জন্য কত কষ্ট করছে । "

তিয়াসা জড়িয়ে ধরল সোমনাথকে । 

আদি ঘর থেকে বেরিয়ে এল । 

 আদি একটা আর্ট পেপার সোমনাথ কে দিল । অপটু হাতে আঁকা একটা ছবি ।  বাবা , ছেলে আর মা হাত ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে । নিচে লেখা “ আমার বাবা , আমার সুপারহিরো ! হ্যাপি ফাদারস ডে বাবা ! "
writabrataguha2020@gmail.com
শিলিগুড়ি


No comments:

Post a Comment