1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Tuesday, January 26, 2021

মুখোশের মন

 

ছবি  : ইন্টারনেট 

মুখোশের মন
দেবাশিস দত্ত 
এ কি তুমি? কি করে এলে?
কেন? উবের ডেকে নিলাম। 
কি প্রয়োজন ছিল? আমি তো বললাম এখানে পেয়ে যাব। তাছাড়া সার্জিক্যাল মাস্ক তো আছেই। 
কিন্তু তুমিই যে বল এই 'লিভিংগার্ড' আমাকে এতদিন ধরে রক্ষা করছে। 
সে একটা দিন চলে যেত।
বিপদ তো কয়েক মুহূর্তের মধ্যে হতে পারে, তাই না? যাক তুমি পরো এটা, আমি চলি। আবার উবের বুক করতে হবে। 
চলো আমি তোমায় পৌঁছে দিয়ে আসি।
না না, একদম না। আমি যেমন এসেছি তেমনই যাব। তোমার এখন ডিউটির মধ্যে বেরনোর কথা নয়।
কিছু হবে না, যাব আর আসব। সবাই আছে। 
না মৈনাক না। যাওয়া আসা মিলে অন্তত এক ঘন্টা। ততক্ষণ আই টি ইউ ফাঁকা থাকতে পারে না। আমি এগোই। তুমি লাঞ্চ ঠিক সময়ে খেয়ে নিও। বাই-ই.....

     ওদের বিয়ে হয়েছে প্রায় দু'মাস হল।মৈনাক তার স্ত্রীকে ঠিক বুঝে উঠতে পারে নি এখনও। বোঝার চেষ্টাও করেছে কি মাঝে মাঝে ভাবে সে। ম্যাট্রিমোনিয়াল সাইটে যোগাযোগ করেছিল মা-বাবা। মৈনাক তখন মানসিকভাবে চূড়ান্ত বিপর্যস্ত। এই নিয়ে পরপর তিনবার পি জি এনট্রান্সে অসফল হল ও।করবীও চলে গেল হঠাৎই। আসলে মাস্ক, ডিউটি, এনট্রান্সের প্রস্তুতি সব মিলে বেশ কিছুদিন ধরেই ঠিকমতো যোগাযোগ রাখতে পারছিল না মৈনাক। তাই বলে চলে যাবে.....সাত বছরের সম্পর্ক। ইদানীং ওর ফোন কমে গেছিল। করলেও ধরত না অনেক সময়। উত্তর দিত না হোয়্যাটসঅ্যাপ মেসেজের। না পড়া থাকতো লাস্ট সীন এর অনেক আগে পাঠানো মেসেজও। রাগলে ওর নাকের ডগা লাল হয়ে উঠত। মৈনাক ডাকত 'রক্তকরবী'। তখন ফোর্থ ইয়ার। কলেজ থেকে দল বেঁধে একাডেমীতে 'রক্তকরবী' দেখতে গেছিল ওরা। একটু দেরিতে হলে ঢুকে প্যাসেজের ধারে করবীর পাশের ফাঁকা সীটেই বসেছিল ও। শো ভাঙল রাত সাড়ে নটায়। বাকি সবাই কলেজ ক্যাম্পাসের পথ ধরল। শীতের রাত।  রবীন্দ্রসদনের সামনে কোনও বাসই পাওয়া গেল না। শেষমেশ পিজির এমার্জেন্সীর সামনে থেকে ট্যাক্সি ধরে করবীকে গল্ফগ্রীনের বাড়িতে পৌঁছে দেয় মৈনাক। সেই শুরু একসাথে পথচলা। তারপর কলেজ স্ট্রীটে কত মাইল হাঁটা। চিনার পার্ক, নলবন, মাল্টিপ্লেক্স.....কলেজ সোশ্যালে একসাথে গান গাওয়া.....মন্দারমণি। 

   স্যার ছয়কে একবার দেখবেন? স্যাচুরেশন কমছে। 
আই টি ইউর বাস্তবে ফেরে মৈনাক। 
NRBM সিস্টার। অভিষেক একবার বি পি টা দেখো তো। হাইড্রোকর্ট হান্ড্রেড এম জি সিস্টার। একবার নেবুলাইজ করুন কুইক।
আধঘণ্টা আগেই পেয়েছে স্যার। 
ওহ।  Why do you argue sister? Please nebulize.
না না স্যার আমি আর্গু করিনি, জাস্ট বলছিলাম। 
ও হো Sister please act fast.

  স্যার আপকা ফোন হ্যায়। 
ওপাশের ব্যারিটোন গলাটা হাসপাতালের ভাইস চেয়ারম্যানের। How is ITU-6, Dr Bose? 
না মানে ঠিকই ছিলেন। একটু আগে ওনার স্যাচুরেশনটা একটু ড্রপ করছিল। আমরা ম্যানেজ করছি স্যার। 
জানেন তো উনি আমাদের MLA সাহেবের পি এ র পিসেমশাই। উনি ফোন করেছিলেন। ঠিক আছে, আপনাদের কাজ আপনারা করুন। ভিজিটিং এর সাথে একবার ডিসকাস করে নিন। আর আমাকেও খানিক বাদে একটা আপডেট দেবেন।

  রক্তকরবী এখনও ওর চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তাই স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্কটাও কিছুতেই স্বাভাবিক হচ্ছে না। কোথায় যেন পিছিয়ে পড়ছিল মৈনাক। প্রথম চান্সেই পিজি লাগিয়েছিল করবী। স্টুডিয়াস মেয়ে। DAMS গুলে খেয়েছে। শেষ দিকে দিনে অন্তত ষোল ঘন্টা পড়ত। মৈনাকও পড়ত কিন্তু পড়াটা মানে এনট্রান্সের পড়াটা ওর প্রায়োরিটি ছিল না। স্টুডেন্টস ইউনিয়ন, মিটিং, মিছিল, রবীন্দ্রসন্ধ্যা, কলেজ সোশ্যাল, ফ্রেশারস ওয়েলকাম এইসব সেরে ক্লান্ত চোখের সামনে অক্ষরগুলো ঝাপসা হয়ে যেত। পিজির সেকেণ্ড ইয়ার থেকেই SR  দাদার সঙ্গে করবীর ঘনিষ্ঠতার কথা বলত মৈনাকের বন্ধুরা। পাত্তা দেয় নি। কিন্তু ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করল ছবিটা। পি জি ডিগ্রীলাভের পরীক্ষার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত যখন করবী, তখন আর একবার এনট্রান্সের জন্য তৈরী হচ্ছে মৈনাক। 

  স্যার ডাঃ ঘোষ রাউণ্ডে এসেছেন।
Hi, today you look little absent minded.....my young friend.....though thouh I find nothing unusual in it for a newly wed like you.....ha.....ha.
না স্যার ওই BHTতে নোটগুলো দিচ্ছিলাম। 
পাশ থেকে রিনরিনে গলা ডিউটি নার্সের। না স্যার ডক্টর মৈনাক আজ খুব অন্যমনস্ক সকাল থেকেই। বাড়িতে লিভিংগার্ড ফেলে চলে এসেছিলেন। একটু আগে ম্যাডাম এসে দিয়ে গেলেন।
Oh, is it? ওটা আসলে তোমাদের থেকে গার্ড করার জন্য। কি তাই না মৈনাক?
না স্যার, আমি আনতে বারণ করেছিলাম। 
Young man, I understand....সে তোমাকে চোখের আড়াল করতে চায় না। 
না না স্যার আমি মানে সেরকম কিছু না।
হাঃ হাঃ মৈনাক please don't try to befool an old fool like me. Anyway, how is 6? সকালে ABG করেছ? pH কত?

  pH.....অ্যাসিড- বেস.....আচ্ছা মানুষে মানুষে সম্পর্কের pH মাপা যায় না? দুজনের মধ্যে বোঝাপড়া কতটা অ্যাসিডিক হয়ে যাচ্ছে? উচ্ছ্বল করবীকে গত শীতেই একদিন দেখেছিল 'ওহ ক্যালকাটা' থেকে বেরোতে, সঙ্গে সেই দাদা। ওটাই তো ছিল লিটমাস টেষ্ট। পরের দিন মৈনাকের ঘুম ভেঙেছিল বাবার বন্ধু গাঙ্গুলীকাকার নার্সিং হোমে। না কেউ কিছু জানতে পারেনি। শুধু মৈনাক জানে জড়ানো চোখে কেবিনের জানলা দিয়ে দেখেছিল সকালের ম্লান আলোয় একগোছা পল্লবিত রক্তকরবী। 

  মৈনাকদা একটু ECG টা দেখবে? আমাদের ম্যাডাম পাঠালেন। আজ দুপুরে OT আছে। অ্যানেশথেটিক ক্লিয়ারেন্স ছিল।খানিক আগে পেশেন্ট বুকে একটু চাপ চাপ বলছিল। প্রেশার 160/90। ECG তে কি আছে গো? OT করা যাবে?

  একসাথে ওরা ECG পড়েছিল  Goldberger এর বই থেকে। বুকের চাপ কি ECG তে ধরা পড়ে? কিংবা গলার কাছে দলা পাকানো অস্বস্তি? পৃথিবীর অসংখ্য সুখী মানুষের উদ্বেগজনক ECG হয় কেন? Can't happiness in life ensure a normal ECG?
মৈনাকদা ECG টা?
এই DNB মেয়েটার গালেও টোল পড়ে......রক্তকরবীর মতোই।

  স্যার কফি দিয়েছি।
হ্যাঁ এবার একটু কফিতে চুমুক দিতে হবে লিভিংগার্ড টা খুলতে খুলতে মনে হয় মৈনাকের। এখানে একটা অর্ডিনারী N 95 অবশ্যই পেয়ে যেত।আসলে গত ক'মাসে এটা প্রায় মুখেরই অংশ হয়ে গেছে। ও আবার কষ্ট করে দিতে এল। কদিন আগে ওর হাত একটা পেরেকে সামান্য ছড়ে গেছিল। মৈনাক ভুলে গেছিল Toxoid নিয়ে যেতে। বাড়িতে ফিরে ওর চোখে যেটা দেখেছিল সেটা ব্যথা নয়, অবিশ্বাস। খুব দায়িত্বজ্ঞানহীন মনে হয়েছিল নিজেকে। ছুটে বেরিয়ে গেছিল পাড়ার দোকান থেকে Toxoid আনার জন্য। না ওর টিটেনাস হয় নি,হবেও না কোনও দিন। কিন্তু ওর মনটা যে দুমড়ে গেল। মনের বক্রতা ঠেকাতে পারে কোন Toxoid?

  ওকে তো এখন বাড়ি থেকে বেরোতে হয় না। ঘরে বসেই 'অনলাইন' ক্লাস নেয়। বেশ ঝামেলার ব্যাপারগুলো। পড়ানো, বোঝানো, পরীক্ষা নেওয়া, মূল্যায়ন সবই তো এখন ভার্চুয়াল। জীবনের ছন্দটাই বদলে গেল।কতদিন এমন চলবে কে জানে?আচ্ছা এবার থেকে কি এটাই স্থায়ী নিয়ম হয়ে যাবে? মানুষ তো অনেকদিন ধরেই দুনিয়াটাকে মুঠোফোনে ভরে ফেলছিল। এই ভাইরাস তাকে আরও গতি দিল। স্কুল মানে তো শুধুমাত্র ক্লাসরুম নয়। বন্ধু,আড্ডা, খেলার মাঠ, রফি ভার্সাস কিশোর, টুর্নামেন্ট, এক্জিবিশন, ফিল্ম ক্লাব, লাইব্রেরি.....পাঁচিলের আড়ালে সুজনের থেকে নিয়ে ফিল্টার উইলস এ টান.....এত্তসব কি করে ভার্চুয়াল হবে? এই ভাইরাস কি ন্যাচারাল নাকি ল্যাব এ বানানো? ওইটুকু জীবাণুর এত ক্ষমতা? মানুষের এতদিনের জীবনযাপনের ইতিহাসকে বিপর্যস্ত করে তুলল। ইতিহাস ভালোই লাগত মৈনাকের। কিন্তু বাড়ির সবাই চেয়েছিল ও ডাক্তার হোক। আচ্ছা ওর তো নিশ্চয়ই বেশ অসুবিধা হয় এইভাবে ইতিহাস পড়াতে। মাঝে একদিন মৈনাক দেখেছিল কি আন্তরিকভাবে ক্লাস টুয়েলভকে ও বোঝাচ্ছিল ভারত মহাসাগরে ব্রিটিশ বাণিজ্য, ডাচ বাণিজ্য। পলাশীর ষড়যন্ত্র। ব্রিটিশ ক্ষমতার ভরকেন্দ্র সরিয়ে আনল মাদ্রাজের ফোর্ট সেন্ট জর্জ থেকে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম এ। সভ্যতার ইতিহাস তো শুধুমাত্র যুদ্ধের দিনলিপি। অসীম জলরাশির বুকে নোঙর তোলা আর ফেলার কথকতা এক বন্দর ছেড়ে আর এক বন্দরে।

  কিরে মৈনাক কি ভাবছিস? তোর কফিতো ঠাণ্ডা হয়ে গেল। বউয়ের কথা ভাবছিলি না কি করবীর? কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি।তুই গভীর চিন্তায় মগ্ন, এদিকে কফি জুড়োচ্ছে। 
না ভাবছিলাম ব্রিটিশরা ফোর্ট সেন্ট জর্জ থেকে আস্তে আস্তে  শিফ্ট করল ফোর্ট উইলিয়ামে। ডানা বিস্তার হল সুবে বাংলায়। বণিকের মানদণ্ড হতে রাজদণ্ড। 
বাঃ বাঃ বেশ। এই তো ইতিহাসের টিউশন বেশ ভালোই চলছে। এবার টুক করে ডাক্তারিটা ছেড়ে দে। ডাক্তারিতে ইতি…..ইতিহাসের শুরু…..তোর নাম ইতিহাস এ থেকে যাবে। 
কি যে বলিস, কথায় কথায় pun তোর। সেই কলেজ থেকে চালিয়ে যাচ্ছিস। ডাক্তারি ছেড়ে খাব কি?
কেন ইতিহাস…..ইতিহাসে ডুবে যা, মানে ডুবেই তো আছিস। এবার খানিক ভেসে ওঠ। হাঃ হাঃ চলি বস। আমাকে আবার লাঞ্চের পর বসের সাথে নামতে হবে। 

  তাই তো। মৈনাক কি সত্যিই ডুবতে পারছে ইতিহাসের দিদিমণিতে? কেন পারছে না? সেখানে অন্তরায় বিগত সাত বছরের ইতিহাস। এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করবে পুরনোকে বিস্মৃত হয়ে? রক্তকরবীর প্রত্যাখ্যান…..গাঙ্গুলীকাকার নার্সিংহোমে সলাজ সকালে জেগে ওঠা গলায় তীব্র ব্যথা নিয়ে। জীবন তো প্রায় অর্থহীন হয়ে গেছিল মৈনাকের। গভীর ঘুমের মধ্যে দিয়ে এক নতুন জীবনে পা রেখেছিল সেদিন। আর সেই অমূল্য জীবনকে ক্ষণিকের অসাবধানতার হাত থেকে বাঁচাতে ও ছুটে এল পৌঁছে দিতে ওর রক্ষাকবচ। আচ্ছা ওর ক্লাসের কি হল? জানা হল না তো?

   9377824664 এ কল অতঃপর। তুমি ঠিকমতো পৌঁছেছ?
হ্যাঁ হ্যাঁ, না পৌঁছানোর কি আছে?
তোমার ক্লাস?
ও ম্যানেজ হয়ে গেছে। 
কোঅর্ডিনেটরের বকুনি শুনতে হয়েছে নিশ্চয়।
ও কিছু নয়, বললামতো ম্যানেজ হয়ে গেছে। 
জানো আজ আমি ভেবেছি তোমাকে একটা নতুন নামে ডাকব।
ওমা তাই না কি?
জানিনা নামটা তোমার পছন্দ হবে কি না?
তা শুনিতো সেটা একবার। 
'লিভিংগার্ড'.....আজ হতে তুমি আমার লিভিংগার্ড।।
duttaduds@gmail.com
কলকাতা


1 comment: