![]() |
ছবি : ইন্টারনেট |
স্নেহের পরশশান্তা শিকদার
-মা আজ যেতে পারব না গো...
-কেন রে মানু? শরীরটা কি খারাপ লাগছে?
-না, না, শরীর ঠিক আছে। আসলে পুপুর কাল বাংলা পরীক্ষা। হঠাৎ করে আজ স্কুল জানালো, কি করি বলো তো? চিন্তিত গলায় জানালো মানসী।
-তবে আর কি করবি, থাক পরীক্ষাটা হয়ে গেলেই না-হয় আসিস।
-আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি ঠিক আছ তো?
-খারাপ থাকব কেন রে? একা একা খাচ্ছি, পড়ছি, আরাম করছি আর কি চাই বল? হেসে কথাক'টি বললেন রত্নাদেবী। কিন্তু মানসীর বুকে যেন বাজলো।
সে চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। গলার কাছে আটকে থাকা ডেলাটাকে গিলে নিয়ে কোনওরকমে বলল, "একটা সবসময়ের মেয়ের খবর পেলে মা?"
রত্নাদেবী আবার হেসে উঠলেন, "তুই এমন করলে আমার থাকাই যে দায় হবে এখানে। সেটা কি ভাল হবে বল? আমি ভাল আছি। আমার কোনও সমস্যা হয় না। তুই নিশ্চিন্তে থাক মানু।"
ফোনটা রেখে কিছুক্ষণ মানসী উদাস হয়ে বসে থাকে। সবকিছু বেশ চলছিল। মাঝখান থেকে বাবা কেমন এক সমস্যায় ফেলে গেল তাকে। বয়স হয়েছিল। মৃত্যু যে একদিন আসবেই, তা সে জানত। কিন্তু সেই মৃত্যু যে তাকে এমন এক খাদের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে যাবে, তা সে ভাবেনি কোনওদিন।
ঢাকুরিয়া থেকে ঘণ্টা দুয়েকের রাস্তা। শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে করে হালিশহর। বিয়ের পর বারোটা বছর কেটে গেলেও এখনও ওই বাড়িটাকে ওদের বাড়ি বলেই মনে করে সে। বাবা-মা আর ও তিনজনের সুখী এক ছোট্ট সংসার ছিল। বাবা-মা দু'জনেই ছিলেন শিক্ষক। একটু বেশি বয়সের সন্তান বলে তার প্রতি বাবা-মায়ের আদর আর ভালবাসাও ছিল মাত্রাতিরিক্ত। বিশেষ করে বাবার কাছে। স্কুলে যাওয়া-আসা সবটাই ছিল বাবার সঙ্গে। বাবার বাইকে চেপে। ওকে স্কুলে ছেড়ে তবে তিনি স্কুল যেতেন। আবার ফেরার পথে ওকে নিয়েই ফিরতেন। এ নিয়ে স্কুলের বন্ধুদের কাছে কম কথা শুনতে হয়নি তাকে। বাবাকে বলেওছে সে কথা, কিন্তু বাবা হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন। বরং মা ওর হয়ে বাবাকে বলেছেন, "সত্যি তো মেয়ে এখন বড় হয়েছে, এবার ওকে ছাড়ো।" কিন্তু কে শোনে কার কথা! এভাবে চলতে চলতে বাবার সেই আদরের মেয়েটি স্কুলপর্ব শেষ করে কলকাতা চলে এল কলেজে পড়তে। কলেজ থেকে ইউনিভার্সিটির পথ চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে শেষও করে ফেলল। আর সেই পথেই একদিন দেখা মিলল কলেজের এক বন্ধুর আত্মীয় সায়কের সঙ্গে। দেখা থেকে পরিচয়। তারপর প্রেম। পরিণতিও হল সুখের। সায়ক বেসরকারি এক সংস্থার উচ্চপদে চাকরি করে। ছেলেও খুব ভাল। তাই বাবা-মা কেউই আপত্তি তোলেননি। দুই পরিবার খুশি হয়ে একদিন চার হাত এক করে দিল। সায়কের বউ হয়ে সে এই শহরেরই বাসিন্দা হয়ে গেল। আর আগের ছন্দে ফেরা সম্ভব হল না সেই তিনজনের পৃথিবীর একজন হয়ে। শ্বশুর-শাশুড়ি, ননদ নিয়ে ছিল তার সংসার। সেই সংসারের গৃহিণী হয়ে উঠল একদিন ধীরে ধীরে। ননদের বিয়ে হল। ছোট্ট পুপুন এল কোলে। বউমা থেকে মা হল। আর নিজের মেয়ে পেয়ে তাকে মানুষ করতে গিয়ে সে যে আর দু'টি মানুষের হৃদয়ের টুকরো, তাঁদের আদরের মানু সেই পরিচয়টাই ভুলতে শুরু করল। মনে পড়ল অনেক দেরিতে। যখন মেয়ে স্কুলে গেল। সায়ক ওকে ছেড়ে কাজকেই অনেক বেশি করে আগলে ধরল। শ্বশুর-শাশুড়ির আগের সেই আবেগও অনেক কমতে শুরু করেছে, ঠিক তখন। কারণ ততদিনে এরা সবাই আবিষ্কার করে ফেলেছে সে এখন মানসী বসু। মানসী চক্রবর্তী নয়। তার গার্জিয়ান এখন আর শ্রী পার্থ চক্রবর্তী নয়, শ্রী সায়ক বসু।
আর এই কথা মনে পড়াতে কাজ কি হল তা সে জানে না, তবে কষ্ট বাড়ল অনেক। মনের কষ্ট। এসবের মাঝে বাবা একদিন না-বলেকয়ে চলে গেলেন। সেইদিনটা ছিল মানসীর জীবনের এক ভয়ংকর দিন। ত্রিশ বছরের জীবনে সেটাই ছিল ওর প্রথম ধাক্কা। তার সঙ্গে মিশল এক অপরাধবোধ। বাবা কী তার ওপর অভিমান করে চলে গেলেন! বাবা কী এমন মনে করেছিলেন যে, তাঁর মানুমা নিজের সংসার পেয়ে তাঁকে ভুলে গেছে! তাই কি তাকে এমন শাস্তি দিয়ে গেলেন বাবা! যেন বলে গেলেন, একটু সময় বার করতে পারলি না মানু বাবার জন্য। এবার আমি দেখব এই বুড়িটাকে নিয়ে তুই কী করিস!
মেয়ের পরীক্ষা মিটতে না মিটতে সায়ক অফিসের কাজে দিন পনেরো জন্য বাইরে গেল। আবার এক মাস চলে গেল। মানসী মায়ের কাছে গিয়ে উঠতে পারল না। যদিও মা এর মাঝে দু'দিন ওর কাছে এসে থেকে গেছেন। সায়ক ফিরতেই ও ধরে বসল এবার কয়েকদিনের জন্য মায়ের কাছে গিয়ে থাকবে। "নিশ্চয়ই," সকলে একবাক্যে রাজি। কিন্তু যখন সবাই শুনল সে সপ্তাহ দুয়েকের জন্য গিয়ে মায়ের কাছে থাকতে চায়, অমনি সকলের মুখের ভাব কেমন যেন বদলে গেল! সুর কাটল। শাশুড়ি-মা সুযোগ বুঝে বললেন, "সায়কের অফিস তো আর বন্ধ নেই মানসী, এতদিন থাকলে ওর তো অসুবিধা হবে।" চুপ করে রইল মানসী।
রাতে সায়ক বলল, "এটা বাড়াবাড়ি। ওখানে গিয়ে তুমি কি করবে শুনি? বরং মাকে আনিয়ে নাও। আর এতদিন তুমি না-থাকলে আমার মায়ের পক্ষেও খুব চাপ হবে। বুঝতেই পারছ তো, এই বয়সে এতটা চাপ নেওয়া মায়ের পক্ষে সম্ভব নয়।
-আর আমার মা বুঝি কচি খুকি! ঝাঁঝের সঙ্গে বলে মানসী।
-তোমার মাকে তো একা থাকতে বলিনি আমি, এটা ওঁর বাড়াবাড়ি, একটু গম্ভীর হয়েই বলে সায়ক,
বাড়াবাড়ি!
-মায়ের একা থাকাটা তোমার কাছে বাড়াবাড়ি! কোথায় থাকবেন শুনি। রেগেই কথাগুলো বলে মানসী।
-কেন যেটা স্বাভাবিক সেটাই করবেন উনি, মেয়ের কাছে থাকবেন।
-এই কথাটা অনেকবার হয়ে গেছে সায়ক, অনেকবার।
একটা গাছকে তার মাটি থেকে শিকড় শুধু উপড়ে আনলে অনেকসময় গাছটা বাঁচে না। আমার মাকেও যদি ওখান থেকে নিয়ে আসি তাহলে তাঁকেও বাঁচাতে পারব না। বলতে বলতে গলাটা ধরে আসে মানসীর। সে থামে না, আর তার চেয়েও বড় কথা মা এখানে এসে থাকলে তোমার সমস্যা অনেকবেশি বাড়ত সায়ক, সেটা তুমিও জানো, আমিও জানি।
-মানে! তোমার মা এখানে এসে থাকলে আমার কি সমস্যা হত?"
-সে তুমি ভালই জানো। আমি বলেই তোমার মায়ের সঙ্গে একছাদের তলায় এখনও একসঙ্গে রয়েছি। অন্য মেয়ে হলে কবেই চলে যেত।
সায়ক রেগে উঠল, "উফ তোমরা মেয়েরা যে কি, শাশুড়ি মানেই ভিলেন, তোমার সঙ্গে কথা বলার কোনও মানেই হয় না।" বলে রাগ করে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। সেদিকে তাকিয়ে মানসী বলে, "সত্যি কথা বললে গায়ে ফোস্কা পড়ে। তারপর সে-ও কোন কথা না-বলে মুখ ঘুরিয়ে নিল।
সায়ক জানে মানসী যা বলল সেটা প্রচণ্ড সত্যি। ওর মায়ের সঙ্গে মানসীর মা কখনও থাকতে পারবেন না। একজন যেমন সুন্দরী, মেজাজি, আধুনিকা অন্যজন তেমনই শান্ত, অন্তর্মুখী কিন্তু সাংঘাতিক ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মহিলা। না-হওয়ার কোনও কারণে নেই। দীর্ঘদিন ছাত্র-ছাত্রী মানুষ করতে করতে মুখের চেহারা অজান্তেই একটু গম্ভীর হয়ে গেছে। মানসীর বাবার মৃত্যুর পরে সপ্তাহখানেক ছিলেন উনি এখানে৷ মেয়ের আবদারে কিছুটা বাধ্য হয়েই। সেইসময়ে মা প্রায় হাঁফিয়ে পড়েছিলেন। তাকে আড়ালে ডেকে বলতেন, "বাবু মানসীকে বল মাকে রেখে আসতে। ওঁর এখানে বোধহয় ভাললাগছে না।
সায়ক হেসে ফেলেছে, "ওঁর ভাললাগছে না, না তোমার ভাললাগছে না মা?"
ধরা পড়ে গিয়ে নিজেই অপ্রস্তুত হয়ে হেসে বললেন, "ভীষণ গম্ভীর মানুষ। কথা বলতে ভয় করে।" ফলে, সায়ক জানে তার মা এবং শাশুড়িকে নিয়ে একসঙ্গে সংসার করা বোধ হয় অসম্ভব। যদিও সেই ভাবনা এখনও পর্যন্ত তার শাশুড়ি তাকে ভাবতে দেয়নি। নিজেই নিজেরমতো করে বাঁচতে তিনি পছন্দ করেন। আছেনও ঠিক তেমন। কিছুক্ষণ পর সায়ক পাশ ফিরে দেখে মানসী চুপ করে চোখের ওপর হাত রেখে শুয়ে আছে। বউ রাগ করেছে বুঝে সায়ক এবার অন্য পথ নিল। আদর করে তাকে নিজের দিকে টেনে নিতে নিতে বলল, -আরে বাবা, রাগের কি আছে! আচ্ছা এতদিন তোমাকে আর পুপুকে ছাড়া আমি থেকেছি বলো?
-এই তো বেঙ্গালুরু থেকে পনেরো দিন ঘুরে এলে।
-ওটা তো অফিসটুর। আমি তো বাধ্য। কিন্তু অফিস থেকে বাড়ি এসে তুমি থাকবে না, সেটা যেন কেমন আলুনি আলুনি লাগবে, প্লিজ। ব্যস, আর বিশেষ চেষ্টা করতে হয় না সায়ককে। তার এই ওষুধেই কাজ হয়। এবার মানসী পাঁচদিনের জন্য তার মায়ের কাছে যায়।
ট্রেন থেকে নামতেই এক চেনাগন্ধ প্রতিবারের মতো এবারেও ওকে আপন করে নেয়। ও ভুলে যায় ওর বর্তমান। চোখের সামনে ভেসে ওঠে কলেজ যাওয়ার দিনগুলো। ছুটতে ছুটতে ট্রেন ধরতে আসা। কতদিন ট্রেন মিস করে ওই গাছের নীচে বাঁধানো বসার জায়গাটায় আড্ডা হত বন্ধুরা মিলে। এক অদ্ভুত আবেগে ভাসে মানসী। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে, "পুপু এটা কি গাছ জানিস? বকুল। দেখিসনি কোনওদিন। দেখবিই-বা কী করে! কি মিষ্টি গন্ধ জানিস!"
স্টেশন থেকে বেরিয়ে রিকশায় উঠে ছোট্ট পুপুকে সে বলতে বলতে চলে, "এটা আমার স্কুল। এটা তোর দাদুর স্কুল। ওই আমাদের ক্লাব। আর দেখ পুপু, এখানে আমরা নাটক করতাম। ইস সেই মঞ্চটা ভেঙে গেছে রে!"
"ভাঙবে কেন দিদি? ভেঙে ফেলেছে। পাকা তিনতলা ক্লাব ঘর হবে। নীচে আর ওপরে বিয়েবাড়ি ভাড়া দেওয়া হবে। আর ওপরে শুধু ক্লাব থাকবে।" রিকশাওয়ালা বলে।
-ও মা তাই নাকি!
মনটা খারাপ হয়ে যায় মানসীর। কত স্মৃতি জড়িয়ে এসব জায়গায়। বাবার মতো এরাও হারিয়ে যাচ্ছে জীবন থেকে।
বাড়ির দরজায় রিকশা থামতেই দেখে মা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। পাশে বছর পনেরোর একটি মেয়ে। এই মেয়েটিকেই মা নিজের কাছে রাখছে বোধহয়। তেমন কথাই তো ফোনে জানিয়েছে। শুনে থেকে কিছুটা হলেও স্বস্তি পেয়েছে মানসী। পুপুকে রিকশা থেকে নামিয়ে দিতেই সে ছুটে চলে গেল দিদার কাছে। দিদাও ওকে জড়িয়ে ধরল, আদর করল। সেই মেয়েটি খুশি খুশি মুখে পুপুকে নিজের কাছে টেনে নেয়। তারপর সবাই ভিতরে ঢোকে। মানসী নাক টেনে টেনে গন্ধ নেয়। মেয়েকে দেখে রত্নাদেবী হেসে ফেলেন, "কি রে শুরু হয়ে গেল পিটপিটানি?"
-না মা, এবার অনেকদিন পরে এলাম তো। তাই বাড়ির গন্ধ নেওয়ার চেষ্টা করছি।
-পেলি সেই গন্ধ!
মানসী সোজা নিজের ঘরে ঢুকে বিছানায় শুয়ে পড়ে। দুই হাত ছড়িয়ে দিয়ে বলে, "পেলাম। মা এই মেয়েটিকে কোথা থেকে জোটালে? দেখতে ভারী মিষ্টি।"
-ওই দেখ, ওর সঙ্গে তো তোর পরিচয় করিয়ে দিলাম না। কোথায় গেল সে?
-পুপুর সঙ্গে ভাব জমাতে ব্যস্ত বোধ হয়, বলে হাসল মানসী।
-ও মারুফা, বোনকে নিয়ে পড়লি যে, মাসিকে এককাপ চা দিবি না? একটু গলা তুলে মেয়েটিকে ডাকলেন রত্নাদেবী।
মানসী বিদ্যুৎ গতিতে উঠে বসে বিছানার ওপর, "কি বললে? মারুফা? এ কেমন নাম? মেয়েটি কি মা?"
-কি মানে?
-কি মানে বুঝতেই পারছ। মানসী একটু রূঢ়স্বরেই মাকে জিজ্ঞাসা করে,"ও কি মুসলমান?"
ঠিক তখনই মারুফা ঢোকে ঘরে। পুপু তার হাত ধরে আছে। সে চেঁচিয়ে বলে, "দিম্মা, মারুফাদিদি আমাকে কি দিল দেখ?"
"কি দিদিভাই? এই যে পুতুল, এটা মারুফা দিদি নিজে বানিয়েছে। দেখো মা," বলে পুপু মায়ের কাছে ছুটে যায়।
মানসীর মুখ থমথমে। সে বলে, "পুপু এখন এখান থেকে যাও। আমি দিম্মার সঙ্গে কথা বলব।" মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে পুপু অভিমানে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। রত্নাদেবী বলেন, "মারুফা মাসির জন্য এককাপ চা করে দে মা।"
-না আমি চা খাব না।"
অবাক চোখে মারুফা দেখে মানসীকে। রত্নাদেবী একটু চুপ করে থেকে বলেন, "তুই যা। হাতের কাজগুলো সেরে নে। আমি গিয়ে মাছটা রাঁধছি।" মারুফা বোঝে কোথাও যেন সুর কেটেছে। ও ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
-মা, তুমি কি ঠিক করলে?
-ভুলই-বা কি করেছি শুনি। গম্ভীর স্বরে বলেন রত্নাদেবী।
-প্রথম কথা মেয়েটি একেবারে বাচ্ছা। দ্বিতীয় কথা
ও মুসলমান।
-আমি যদি খুব ভুল না-করে থাকি তো দ্বিতীয়টাই তোমার খারাপ লাগার আসল কারণ, তাই না মানু?
-ঠিক তাই, ফুঁসে উঠল মানসী। আমাদের সঙ্গে কথা না-বলে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া তোমার একদম উচিত হয়নি মা, গম্ভীর গলায় বলে মানসী।
এবার যেন বাঁধ ভাঙল। উত্তেজিত হয়ে উঠলেন রত্নাদেবী, "কী বললে তুমি!আমার উচিত হয়নি! কেন কেন কি দোষ করতে দেখলে আমাকে? এক অসহায়, বাপ-মা মরা মেয়েকে আশ্রয় দিয়েছি, সেটা কি আমার দোষ? নাকি একাকিত্বের জীবনে একটা অবলম্বন নিজে জোগাড় করে নিয়েছি সেটা আমার দোষ?"
মায়ের এমন মূর্তি দেখে ঘাবড়ে যায় মানসী, "কি হল, তুমি এত রেগে গেলে কেন?" -দেখো, এই বিষয়টা ভীষণই সেনসিটিভ। জানি না পাড়ার লোক জানে কিনা, জানলে সমস্যা হতে পারে।
পাড়ার লোকের কথা জানি না তবে আমার একমাত্র সন্তান যে সমস্যায় পড়েছে, সেটা আমি বুঝতে পারছি।
এরপরে দু'জনেই কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকেন। এক সময় নীরবতা ভাঙলেন রত্না দেবী। আস্তে আস্তে বলেন, "মাস দুয়েক হল আমার কাজের মেয়ে দীপ্তি চলে গেছে বলে পাশের বাড়ির রমা আমার কাছে একটি বউকে পাঠায়। বলে, 'খুব ভাল মেয়ে দিদি। অভাবে পড়ে আজ কাজ করতে এসেছে। তোমার দেওর ওর বরকে চেনে। তুমি নিশ্চিন্ত মনে রাখতে পারো। পাশের পাড়াতে থাকে।'
রমার কথামতো মেয়েটিকে কাজে রাখলাম। শুধু আমি কেন তোমাদের এই পাড়ার আরও চার বাড়িতে কাজ শুরু করে ওর মা।
পরে বউটিই জানাল, অভাবে পড়েই বাড়ি বাড়ি বাসনমাজার কাজ শুরু করেছে ও। বর একটা লেদার কারখানায় কাজ করত। কিন্তু মিথ্যে চুরির অপরাধে ছাঁটাই করে মালিক। সেইথেকে ওর বর ঘরের বাইরেও বেরোয় না লজ্জায়। তাই বউ এখন হাল ধরেছে। একটা মেয়ে। ক্লাস এইটে পড়ে। ও যদি কাজ না করে তবে ওর সংসার ভেসে যাবে। কিছুদিন পর আমি বললাম, "ছুটিছাটার দিনে মেয়েটাকে আমার কাছে রেখে ও কাজে যেতে পারে। আমি ওকে পড়িয়ে দেব সাধ্যমতো। বউটি রাজি হল। এই দু'মাসে মেয়েটার ওপর আমার বড় মায়া পড়ে গেছে। খুবই ভাল পড়াশোনায়। আবার মাঝে মাঝে নিজে থেকেই বলত, 'মা দিদার কাছে আজ রাতটা থাকি। তোমার ভয় করবে না তো?' ওর মা হেসে বলত, 'দিদা কি তোকে রাখবে? সেটা তো আগে জান?'
আমি বলতাম, "থাকলে তো আমার ভালই হয়। কিন্তু তোর বাবাকে ছেড়ে থাকা কি ঠিক হবে? ছেলেটা এমনি নিজেকে সবার থেকে আলাদা করে রেখেছে তার ওপর তুই না থাকলে,... আমার মুখের কথা কেড়ে ওর মা বলত, 'সে কি আর নিজেতে আছে। সে আমাদের ছেড়ে অনেক দূরেই চলে গেছে মা। এ কি হল মা? বেশ ত ছিলাম।' আমি সান্ত্বনা দিতাম। এভাবেই চলছিল। হঠাৎ সপ্তাহ দুই আগে দিন তিনেক ওরা এল না। রমা আমাকে ফোন করে। আমি বলি, রমা ভাল মনে হচ্ছে না, চল দেখে আসি। বিকেলে গেলাম ওদের বাড়ি।" এবার থামলেন রত্না দেবী,
তারপর, মানসী উদগ্রীব।
"বোধ-হয় না-গেলেই ভাল করতাম মানু, বল মা,
দুদিন আগে ঘুমের মাঝে মারুফা জেগে গিয়ে দেখে ওর ঘরের দরজা বন্ধ। ও মা, বাবাকে ডাকে। কেউ সাড়া দেয় না। ও তখন পাশের বাড়ির লোকজন ডাকে। সবাই এসে দেখে দু'জন গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছে।
সব কাজকর্ম মিটতে আমরা হলাম হাজির। মারুফার মামারা তৈরি ওকে নিয়ে যাবে বলে। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সমস্যা বাঁধাল মেয়েটি, আমাকে দেখে, ছুটে এসে পা দুটো জড়িয়ে বসে পড়ল, 'দিদা আমি তোমার কাছে থাকব। মা বলেছে, আমার কিছু হলে দিদার কাছে যাস, সে তোকে ফেলবে না। মামা গো, আমায় এই দিদার কাছে রেখে যাও', বলে অঝোর ধারায় জল আমার পা দুটোকে ভিজিয়ে দিল। আমি স্তম্ভিত। জানিনা কিসের জোরে ও আমার কাছে ছুটে এল, কেন এল! আমি শুধু ওকে তুলে ধরে ওর মামাকে বললাম, থাকুক আমার কাছে কয়েকটা দিন।
স্তব্ধ দুটি নারী। স্তব্ধ ঘর। নীরবে আবার মুখ খুললেন রত্না দেবী, জানি না ও আমার মাঝে কি দিশা খুজে পেল। তুমি বলতে পারো?"
বুকের কাছে চিনচিন করে উঠল মানসীর।
-তুমি বলো, এমন বিশ্বাস নিয়ে যে বাচ্ছাটা ছুটে এল আমার কাছে তাকে কি ফেলতে পারি?"
-মা!
-আমি যেমন একজন মা, তেমন একজন রক্ত মাংসের মানুষ তো! ,
মানসী মায়ের কোলে মুখ লুকায়। ফুলে ফুলে ওঠে ওর শরীর। রত্না দেবী পরম মমতায় ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেন, "আর জাতের কথা বলছ? যেদিন স্কুলের চাকরি জীবন শুরু করলাম, সেদিন থেকে পরিচয় আমার ওই একটাই- দিদিমণি। যার কাছে জাত-ধর্ম, গরিব-ধনী ভেদ হারিয়ে গেছে। আমি মানুষ গড়ার কারিগর মা, ভাগ করার নয়; মা'
দরজার সামনে তখন মারুফা। হাতে চায়ের কাপ। আর পাশে ছোট্ট পুপি। অবাক চোখে দেখছে তার মা কেমন আদর খাচ্ছে দিম্মার।
No comments:
Post a Comment