1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, February 21, 2021

বালুকাবেলায়

 

ছবি  : ইন্টারনেট 

বালুকাবেলায়
শ্রীজা গুপ্ত

এদিকটায় সমুদ্র উত্তাল নয়, মোহনার দিক বলে অনেক শান্ত৷ এখন ভাটা চলছে তাই আরও দূরের, আরও শান্ত লাগছে যেন সমুদ্রকে৷

বীচের ওপর চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে অলসভাবে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বসে আছে তিতাস৷ এখন দুপুর তিনটে হয়ত হবে, চারপাশ সম্পূর্ণ ফাঁকা, ঘুম আসছিলনা বলে টেন্ট থেকে বেরিয়ে এসছে ও৷ তাঁবুর মধ্যে অনিমেষ ঘুমোচ্ছে অঘোরে৷ জুতোটা ইচ্ছে করেই পরেনি আর, খালি পায়ে নরম বালির ওপর হাঁটতে খুব ভালোলাগে ওর৷ আজ আকাশটাও মেঘলা, রোদও তেমন জোরালো নয় তাই বালিও আরামদায়ক৷

তিতাস ও অনিমেষ৷ বছর তিরিশের দুজন, বিবাহিত দম্পতি৷ ওরা এসেছে তিনদিনের ছুটিতে ঘুরতে কলকাতা থেকে একটু দূরে প্রায় নির্জন এক দ্বীপ মৌসুনি আইল্যান্ডে৷ দীঘা, বকখালির মত ভিড়ভাট্টা নেই কিন্তু আছে অনন্ত সমুদ্র আর ক্যাম্পে থাকার অ্যাডভেঞ্চার৷ ওদের এই জায়গাটার সন্ধান দেয় ওদেরই উকিল..

হ্যাঁ উকিল! কারণ দুজনেই মিউচুয়াল ডিভোর্সের জন্য আবেদন করেছিল কোর্টের কাছে আর কোর্ট সব শুনে আপাতত তিনমাস ওদেরকে একসাথে থাকতে বলেছে, বাইরে কোথাও ঘুরে আসতে বলেছে তারপর দুজনকে ফাইনাল সিদ্ধান্তটা জানাতে বলেছে৷ সেইজন্যই ওদের উকিল, যিনি আবার দুজনেরই ছোটবেলার বন্ধু এবং ওদের প্রেম থেকে "শুভ পরিণয়" লেখা গাড়িতে উঠতে দেখারও সাক্ষী, তিনি নিজে সব বুক করে দুজনকে অনুরোধ করে বলেছিলেন, "প্লিজ একটা কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড কর দুজনে একসাথে, আর একবার ভাব তোরা প্লিজ.."

'কোয়ালিটি টাইম'! ভাবতেই একটা কান্নার ছিটে লেগে থাকা হাসি খেলে গেল তিতাসের মুখে৷ গাড়িতে সারাটা রাস্তা শেয়ার মার্কেটের গ্রাফ দেখে কাটিয়েছে অনিমেষ তারপর এখানে এসে হাত-মুখ ধুয়ে, পেটভরে মাছ-ভাত খেয়েই ঘুম৷ তিতাস একবার বলেছিল সমুদ্রস্নানের কথা তা শুনে বলল, "আমাকে আজ আর বলোনা তিতু, এখন তো দুদিন আছি আমরা! তেমন হলে তুমি যাও বরং.."

প্রায় দেড়বছর পর ঘুরতে এসে একা একা সমুদ্রস্নান করে ও নাকি 'কোয়ালিটি টাইম' কাটাবে! তাই তিতাসেরও চলে গেছিল ইচ্ছেটা..

অথচ দু-তিন বছর আগেও কিন্তু অনিমেষ এমনটা ছিলনা বরং ওদের প্রেমটা এখনও গল্পকথা হয়ে রয়ে গেছে দুজনের বন্ধুমহলে! এত বড় কোম্পানির মার্কেটিং হেড হয়েও কেরিয়ার আর প্রেমের ব্যালেন্সশীটটাই ঠিকমত সাজাতে পারলোনা অনিমেষ! হয়ত বা তিতাস নিজেও! সম্পূর্ণ ক্লিনচিট দেয়না ও নিজেকে৷

হঠাৎই গরুর ডাক শুনে চমকে গেল তিতাস! আর তখনই খেয়াল করল আকাশটা নীলচে কালো হয়ে গেছে, সমুদ্রও এগিয়ে এসেছে অনেকটাই৷ উঠে দাঁড়াল ও তাড়াতাড়ি, সাথে সাথেই পিছন থেকে গলা পেল, "ও কিছু করবেনি গো দিদি, খুব শান্ত গরু৷"

চায়ের দোকানের সামনে লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে এক মহিলা৷ এই দোকানটা ওই মহিলারই সকালে দেখেছে তিতাস, একটু হেসে বলল, "না না ওকে দেখে নয়, আমি আকাশটাকে দেখে উঠলাম গো৷ খেয়াল করিনি এত মেঘ করে গেছে! তাঁবুতে যাই, বরকে ওঠাই৷"

মহিলাটি একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে একটু অন্যমনস্ক ভাবে বলল, " এ আর কি! ঘর ভাঙা ম্যাঘ তো আর নয়!"

"ঘর ভাঙা মেঘ মানে?" জানতে চাইল তিতাস৷

"ওই আপনারা যে কত নাম দ্যান ঝড়গুলার, ওর ম্যাঘ যখন করে তখনই আমরা বুঝে যাই আবার ঘর ভাঙ্গবে৷ আবার যেতে হবে ইস্কুলে থাকতে৷ মাছ ধরা বন্ধ হবে, দোকান ভাসবে, খিচুড়ি খেতে হবে দু'বেলা.." বলে চুপ করে যায় সে হঠাৎ, তিতাসও চুপ৷

কিছুক্ষণ পর আবার মহিলাটিই একগাল হেসে বলে ওঠে, "তবে আবার ফিরেও আসি৷ টালি, মাটি, খড় জড়ো করে করে ভাঙ্গা ঘরদোর জুড়ি দুজনে৷ আবার নৌকা বাঁধে ও, মাছ ধরতে যায়, রোদে শুঁটকি বানায়৷ 

বলছি শুঁটকির ঝাল খাবেন কি আজ রাতে? ক্যাম্পে দিয়ে আসব, হাত চেটে খাবেন দুজনে৷"

তিতাস অবাক হয়ে ভাবে এরকম হাসিমুখে কিভাবে বলছে এত যন্ত্রণার কথা মানুষটা! থাকতে না পেরে করেই ফেলল প্রশ্নটা, "দিদি ঘর ভেঙ্গে গেলে কষ্ট হয় না গো তোমাদের? এত খাটনির সংসার৷"

গরুটার গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে মহিলা বলেন, "ওমা তো কষ্ট হবেনা? খুব কাঁদি, গাল পাড়ি ঠাকুরকে তারপর শান্ত হই৷ আর দ্যাকোনা আবার তৈরিও ত হয়ে যায় ঘর৷ দু'জন সোয়ামি-ইস্তিরি আছি যখন আবার কি চাই গো?

জুড়ব-ভাঙ্গবে, ভাঙ্গবে-জুড়ব৷ ব্যস, এই তো.."

কথাটার মধ্যে কি ছিল জানেনা তিতাস হঠাৎ তার মনে হল ভেতরে যেন ধাক্কা লাগল জোরে, মনে হল একটা বন্ধ দরজা হঠাৎ দমকা ঝড়ে খুলে গেল৷ সে হঠাৎ মহিলাটির হাতদুটো ধরে বললো, "আজ রাতে তোমার হাতের শুঁটকির ঝাল খাব আমরা দিদি৷ এখন আসছি৷" তারপরই ছুট লাগাল তাঁবুর দিকে৷ সব ভুলে আজ আবার পুরনো অনিমেষকে জাগিয়ে তুলবে ও৷

ঘর ভাঙ্গা মেঘ কেটে গেছে ওদের আকাশ থেকে, এখন ঘর জোড়ার পালা৷

সমুদ্রের মাতাল হাওয়ায় সারা মৌসুনি জুড়ে তখন ভেসে বেড়াচ্ছে একটাই কথা-

"জুড়ব-ভাঙ্গবে, ভাঙ্গবে-জুড়ব৷ ব্যস, এই তো…"

iamsrija1993@yandex.com
হুগলি

No comments:

Post a Comment