1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, February 21, 2021

দ্বৈত

 

ছবি  : ইন্টারনেট 

দ্বৈত
শাশ্বতী মুন্সী

      দিনের আলো নিভু নিভু হয়ে এসেছে | পশ্চিম আকাশে সন্ধ্যার আবছা অন্ধকার ক্রমশ ঘনিয়ে আসছে | ছাদের ঠাকুরঘরে প্রদীপ জ্বেলে,ধুপ দেখিয়ে গঙ্গাজলের ঘটি নিয়ে একতলায় নামার সিঁড়ির শেষ ধাপে দাঁড়িয়ে থমকে গেলেন যুথিকাদেবী | শোওয়ার ঘর থেকে ভেসে আসা পরিচিত কণ্ঠস্বর হতে নির্গত গানের কলি একটুক্ষণের জন্য তাঁকে বিভোরিত করে দিল | জ্বলন্ত ধূপের কাঠি ও গঙ্গাজলের ঘটি হাতে কখন যেন শোওয়ার ঘরের দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন নিজেরই অজান্তে | হঠাৎ ছোটছেলে টুবলুর ডাকে সম্বিৎ ফিরলো তার | আর সাথে সাথেই গানের মূর্ছনার ঘোর কেটে গেল তাঁর | দু'পা এগিয়ে ঘরে প্রবেশ করলে টুবলু বললো,
  --- দেখ মা, দাদা কি সুন্দর গান গাইলো!
যুথিকাদেবী দেখলেন,মেঝেতে শতরঞ্চি পেতে সামনে হারমোনিয়াম রেখে বসে আছে বড়ছেলে বাবলু,আর চোখেমুখে হাসির প্রলেপ মাখিয়ে দাদার পাশে বসে রয়েছে টুবলু |
মা ঘরে ঢুকলে বাবলু বললো,
  --- দেখো না মা, ভাই বলছে আবার অমন স্বরে গান গাইতে... আমি যত বলছি ঐভাবে গান গাইতে মা বারণ করেছে, তবুও কিছুতেই শুনছে না...
বড়ছেলের কথায় শংকিত হয়ে গেলেন যুথিকাদেবী!পরক্ষনেই নিজের মনের ভাব সুকৌশলে ছেলেদের কাছে লুকিয়ে নিলেন | তারপর ছোটছেলেকে ধমকে বলে উঠলেন,
  --- না না না, ওসব মেয়েদের গান,ছেলেদের তেমন  গান গাইতে নেই,লোকেরা হাসবে ছেলেদের অমন গান গাইতে শুনলে...
মায়ের কথায় খানিক বিস্মিত কণ্ঠে টুবলু বললো,
  --- সেকি মা!দাদা তো ছেলেদের ও মেয়েদের --  দু'রকম গলাতেই কেমন সুন্দর গান গাইতে পারে... যা এই অঞ্চলের কেউ পারে না,তা আমার দাদা পারলে লোকেরা হাসবে কেন!বরং লোকেদের তো প্রশংসা করা উচিত...
দশ বছর বয়সী ছোটছেলের যুক্তিযুক্ত কথার প্রত্যুত্তরে তৎক্ষণাৎ কোনো যুৎসই জবাব খুঁজে না পেয়ে তিনি বললেন,
  --- সমাজে পাঁচজন লোককে নিয়ে বাস করতে হয় আমাদের,তাই সবদিক বুঝে শুনে চলাই মঙ্গল... তাছাড়া তোরা দুই ভাই এখন অনেক ছোট,ছেলেদের মেয়েদের গানের ব্যাপারে অতসব বুঝবি না..
তারপর সহসা ব্যস্ত হয়ে বাবলুকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
  --- নে নে,এবার হারমোনিয়াম তুলে নির্দিষ্ট জায়গায় ঢাকা দিয়ে রাখ,তোদের বাবা যেন বুঝতে না পারে আবার হারমোনিয়াম নামিয়েছিলি...
  --- আমি যাই সারাবাড়িতে ধুপ দেখিয়ে,দোরে গঙ্গাজল ছিটিয়ে সন্ধ্যের জলখাবার তৈরির আয়োজন করি,তোদের বাবার ফেরার সময় হয়ে এলো, বলে ত্রস্ত পায়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেলেন যুথিকাদেবী |
মায়ের গমন পথের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা বাবলু মনের আনাচে কানাচে তখন একটি কথাই প্রশ্নবোধক চিহ্ন নিয়ে ঘুরপাক খেতে লাগলো " তার গান গাওয়া বাবা এক্কেবারে পছন্দ করে না কেন আর কেনই বা গান গাইবার ইচ্ছা হলে বাবার অনুপস্থিতিতে গাইতে হয় "...
           
       দুই ছেলে রোহন আর রোহিত এবং স্বামী বিমলেশকে নিয়ে যুথিকাদেবীর ছোট্ট সংসার | তেরো বছর বয়সী বড়ছেলে বাবলু(রোহনের ডাকনাম) আর সাড়ে দশ বছর বয়সী ছোটছেলে টুবলু(রোহিতের ডাকনাম) দুজনেই শৈশব থেকে শান্ত স্বভাবের এবং লেখাপড়ায় মনোযোগী | স্বভাবে দুই ভাইয়ের বেশ মিল | তবে একটা সময়ের পর থেকে বাবলুর আচরণে কিছু পরিবর্তন আসতে থাকে যা যুথিকাদেবীর নজর এড়ায় নি | পাড়ার ছেলেদের সাথে মাঠে গিয়ে খেলার চেয়ে বাড়িতে থাকতে বেশি পছন্দ করে | তবে ভাইয়ের সাথে ইনডোর গেমস খেলা তার বেশ পছন্দের | এছাড়া যুথিকাদেবী খেয়াল করেছেন যে গানের প্রতি বাবলুর মনে আগ্রহের সঞ্চার হয়েছে!রেডিও বা টিভিতে বাংলা গান হচ্ছে শুনতে পেলে তার সম্পূর্ণ মনোযোগ সেই গানের দিকে ধাবিত হয়ে যায় | এমনকি একটা গানের কথা ও সুর মাত্র দু'তিনবার শুনেই মনে রাখতে পারে | বালক বয়সে বড়ছেলের এই অভাবনীয় ক্ষমতা যুথিকাদেবীকে বিস্মিত করে তুলেছিল!আপন মনে যখন সে গুনগুন করে গানের কলি গাইত,আড়ালে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে তিনি ভাবতেন,
  "এতো কম বয়সে ছেলের গলায় এমন সুর এলো কিভাবে! তাছাড়া গানের কথাগুলো মনে রেখে ঠিকঠাক সুরে গাইতে পারা কোনো সাধারণ ছেলের পক্ষে সম্ভব নয়,তাহলে কি বাবলুর এই গুণ ঈশ্বর প্রদত্ত... "
    যুথিকাদেবী নিজেও গান গাইতে ভালোই জানেন | কৈশোরে কিছুটা সময় তিনি সংগীত শিক্ষায় ব্যাপৃত ছিলেন,তবে বাবলুর মতো সুর তাঁর গলায় ছিল না | বিয়ের পরে গানের চর্চা করতে পারেন নি,ছেলেদের খাওয়াতে বা ঘুম পারাবার সময় কখনো সখনো গুনগুন করে থাকতেন | 
   শৈশবে মাকে গুনগুনিয়ে গান করতে দেখে বাবলুর মনে গান শেখার প্রতি আগ্রহ জন্মায় | নিজে হাতে ধরে ছেলেকে সঙ্গীতের সাত সুরের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন | বাবলু একনিষ্ঠ ও উৎসাহী ছাত্রের মতো অতি অল্পদিনেই সঙ্গীতের প্রাথমিক শিক্ষা রপ্ত করে নিয়েছিল | যুথিকাদেবীর বাপেরবাড়ি থেকে আনা হারমোনিয়ামে সঙ্গীত শিক্ষার অভ্যাস করে যেত লেখাপড়ার পাশাপাশি | এমনকি মায়ের মুখে শুনে খালি গলাতে   অনায়াসেই রবীন্দ্রসঙ্গীত তুলে নিতে পারত,যা ওই বয়সে সহজসাধ্য ছিল না!তবে গান শেখার পুরো ব্যাপারটাই চলতো ওদের বাবা বিমলেশবাবুর অগোচরে | কারণ ছেলেদের গান শেখার ঘোরতর বিরোধী তিনি | ছেলেদের গান গাওয়া তাঁর কাছে একপ্রকার মেয়েলি আচরণ | তাই গানের স্কুলে ভর্তি করে বাবলুকে গান শেখানোর ইচ্ছার পথে প্রধান অন্তরায় ছিল স্বামীর অযৌক্তিক মানসিকতা এবং অনড় জেদ | অগত্যা যুথিকাদেবী ছিলেন বড়ছেলের একমাত্র সঙ্গীত শিক্ষিকা | তবে মায়ের শিক্ষণকে অচিরেই ছাপিয়ে যেতে পেরেছিল বাবলু নিজের সুপ্ত গুণের স্ফুরণ ঘটিয়ে!
            একদিন রান্নাঘরের দৈনন্দিন কাজে ব্যস্ত ছিলেন যুথিকাদেবী | হঠাৎ তাঁর কর্ণকুহরে প্রবেশ করলো মেয়েলি কন্ঠস্বর থেকে উৎসারিত হওয়া একটি বহুশ্রুত গানের কলি | সেই গানের স্বরের উৎস কোনদিক থেকে আসছে তা খুঁজতে হাতের কাজ থামিয়ে ত্বরিৎ পায়ে এগিয়ে চললেন বাড়ির অন্যান্য ঘরের দিকে | কিন্তু পরক্ষনেই বুঝতে পারলেন ছেলেদের ঘর হতে ভেসে আসছে সেই গানের তরঙ্গ | তারপর সেখানে গিয়ে অতিশয় চমকিত হয়ে যুথিকাদেবী দেখলেন,
  "খাটে বসে চোখ বন্ধ করে নিবিষ্ট মনে খালি গলায় অবিকল মেয়েলি কণ্ঠস্বরে সেই গান গেয়ে চলেছে বাবলু... সেদিকে বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে রয়েছে টুবলু!যার মুখের প্রতিটি রেখা থেকে চুঁইয়ে পড়ছে আনন্দের কনা.."
দরজার পর্দা একটু ফাঁক করে ঘরের দৃশ্য চর্মচক্ষে দেখে ও শুনে যেন বিশ্বাস করতে অসুবিধা হচ্ছে যুথিকাদেবীর!ইতিমধ্যেই বড়ছেলের গলায় সুর এবং বয়সের অনুপাতে সঙ্গীতে অস্বাভাবিক পারদর্শিতা অভিভূত হয়ে গেলেন তিনি! কিন্তু এখন, এই মুহূর্তে বাবলুর কণ্ঠ হতে নিঃসৃত যে সুমধুর স্বরক্ষেপনের সাক্ষী হচ্ছেন... তা নিঃসন্দেহে অত্যাশ্চর্য ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ...ছেলের এমন গুণ দেখে ওনার চোখ আনন্দাশ্রুতে ভরে গেল | কিন্তু একটা ভাবনা মাথায় আসতেই সজল চোখে ঘনিয়ে এলো ভয়ের ছায়া | যে মানুষ ছেলেদের গান শেখা বা গাওয়াকে দু'চক্ষে সহ্য করতে পারেন না, তাঁর অর্থ্যাৎ বিমলেশবাবুর কানে বাবলুর কণ্ঠচ্চারিত মেয়েলি স্বর পৌঁছলে তো আর রক্ষে থাকবে না!অন্ধ আক্রোশে,নিজের মনোভাবকে সঠিক প্রতিপন্ন করতে না জানি কোন অনর্থ তিনি ঘটিয়ে ফেলবেন | তাই মা হয়ে ছেলের এই বিস্ময়কর প্রতিভার কুঁড়িকে স্বামীর সর্বনাশা ক্রোধের আগুনে পুড়ে যেতে কিছুতেই দেবেন না | সেই ক্ষনে দাঁড়িয়ে নিজ মনে সংকল্প করলেন যেনতেন প্রকারেন বাবলুর এই বিরল গুণকে যোগ্যস্তরে পৌঁছে দেবেন |
        সেদিন ছেলেদের কিচ্ছুটি বুঝতে না দিয়ে নিঃশব্দ পদচারণে পুনরায় রান্নাঘরের কাজে ফিরে এসেছিলেন যুথিকাদেবী | ভেবে রেখেছিলেন সময় সুযোগ করে বড়ছেলের সাথে এই ব্যাপারে একান্তে কথা বলবেন যা ওর ভবিষ্যতের পক্ষে খুব জরুরি |
দিনদুয়েক পরে বাবলু-টুবলুর পিসির অসুস্থতার খবর আসাতে ছোটছেলেকে নিয়ে বোনের বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন বিমলেশবাবু | এই সুযোগে যুথিকাদেবী বড়ছেলেকে নিজেদের ঘরে ডেকে নিয়ে এলেন | তারপর বললেন,
  --- শিশু বয়স থেকে গানের প্রতি তোর প্রবল আগ্রহ দেখে আমার খুব ভালো লেগেছিল,তাই নিজের অর্জিত শিক্ষার সবটুকু দিয়ে সঙ্গীতের  প্রাথমিক পাঠ দেওয়ার যথাসাধ্য চেষ্টা করে গেছি | সঙ্গীত শিক্ষনে তোর একাগ্রতা প্রতি নিয়ত আমায় সাহস জুগিয়েছে তোদের বাবাকে লুকিয়ে গান শেখানো কর্মধারা অব্যাহত রাখতে | কিন্তু তুই যে প্রতিভা নিয়ে জন্মেছিস,তা সাধারণত্বের সীমা ছাড়িয়ে গেছে বাবলু...
এতোক্ষণ মায়ের বলে যাওয়া কথাগুলো চুপটি করে শুনছিল বাবলু | কিন্তু শেষ বাক্যে চমকিত হয়ে মিনিট কয়েক যুথিকাদেবীর মুখপানে স্থির চাহনি রাখলো সে! তারপর বিস্মিত নয়নে জিজ্ঞাসা করলো,
  --- কোন প্রতিভার কথা তুমি বলছো মা ?
ছেলের জিজ্ঞাসু নয়নের সাথে নিজের আনন্দোজ্জ্বল দৃষ্টি মিলিয়ে স্মিত হেসে তিনি প্রত্যুত্তর দিলেন,
  --- আমি জানি তুই মেয়েদের কণ্ঠস্বরে গান গাইতে পারিস | দূর থেকে শুনলে কোনো মেয়ে গাইছে বলেই ভ্ৰম হবে যে কারোর!এটা তোর যেমন তেমন প্রতিভা নয় বাবলু ঈশ্বর প্রদত্ত অসাধারণ প্রতিভা |
মায়ের কথায় খানিক লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে নিল সে | কিয়ৎক্ষণ পরে থেমে থেমে বললো,
   --- ওই... ব্যাপারটা... তুমি... জেনে... গেছো, মা..
তারপর যেন কোনো গর্হিত অপরাধ করে ফেলে ধরা পড়ে গেছে এমন ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে উঠলো,
  --- বিশ্বাস করো মা,আমি নিজেও কখনো ভাবি নি  যে মেয়েদের গলার স্বরের অনুরূপ স্বরে গান গাইতে পারবো!তবে জানো, এটা হঠাৎ করেই হয়েছে | রেডিওতে শোনা একজন মহিলা শিল্পীর গান গাইতে গিয়ে বুঝলাম আমি মেয়েলি স্বরেই গানটা গাইতে পারছি! তখন থেকে খুব সচেতন ছিলাম যাতে আর কোনোদিন ভুলেও মেয়েদের স্বর গলায় না আসে | কিন্তু ভাই যে কখন আমার গলায় মেয়েলি স্বরের গান শুনে ফেলেছিল,তা সেইসময় বুঝতে না পারলেও পরে বুঝতে পেরেছিলাম...  যখন সেদিন আমায় অবাক করে দিয়ে মেয়েলি স্বরে গান শোনাবার আবদার করলো!আর তাই ওর আবদার রাখতে আবার অমন করে গান গেয়েছিলাম | তবে এবারে বুঝলাম স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই মেয়েদের স্বরে গানটা গাইতে পেরেছি |
       আপন আত্মজর মুখের সরল স্বীকারোক্তি শুনতে শুনতে মোহিত হয়ে গেছিলেন যুথিকাদেবী | কিন্তু এবার যে প্রশ্নবোধক কথাটি মায়ের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দিল বাবলু,তাতে ক্ষনিকে মোহিতভাব ছিন্ন হলো তাঁর |
  --- এটাকে তুমি প্রতিভা বলছো মা,কিন্তু আমার যে মনে হচ্ছে ছেলেদের গলায় মেয়েদের স্বরে গান গাওয়া ভয়ানক দোষের,অপরাধীর ন্যায় শঙ্কাজড়িত কণ্ঠে বললো সে |
ছেলের সারল্যে তাঁর মুখমন্ডলে হাসির ছটায় ভরে উঠলো | তারপর বাবলুর মাথায় স্নেহের পরশ বুলিয়ে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বললেন,
  --- ওরে,তোর কণ্ঠে মেয়েলি স্বর সাবলীল ভাবে উৎক্ষেপিত হওয়া দোষের হতে যাবে কেন!. একই দেহস্থিত কণ্ঠনালী থেকে পুরুষ ও মহিলা -- উভয় স্বরবাহিত এমন হৃদয় জুড়ানো সুর নির্গত হওয়া যে মা সরস্বতীর আশীর্বাদ যা তুই জন্মগত ভাবে পেয়েছিস...দেবী বীণাপাণির এই আশীর্বাদই তোকে বিরল প্রতিভার অধিকারী করেছে...
যুথিকাদেবী কথাগুলি শেষ করে দেখলেন বড় বড় চোখে বিস্ময়াবিষ্ট দৃষ্টিতে তাঁর মুখপানে তাকিয়ে রয়েছে বাবলু! কিয়ৎক্ষণ পরে মায়ের মুখ নিঃসৃত বাক্যগুলো পুরোপুরি বোধগম্য হতে অনাস্বাদিত আনন্দের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো তার সারা মুখখানি | আনন্দের আতিশয্যে মাকে জড়িয়ে ধরলো সে | গর্ভজাত সন্তানের সুপ্ত প্রতিভার সন্ধান পেয়ে তিনিও ভীষণ আনন্দিত হলেন | এবং ছেলের বাহুডোরে আলিঙ্গনাবদ্ধ থাকাকালীন স্নেহরসে সিঞ্চিত সুখানুভবে আবিষ্ট রইলেন |
       নিস্তব্ধ দুপুরের আলস্য মাখা মুহূর্তেরা সাক্ষী হয়ে থাকলো আনন্দ বীনার তারে বাঁধা মা-ছেলের আত্মিক বন্ধনের | খানিক পরে কি যেন ভেবে যুথিকাদেবী বললেন,
  --- শোন বাবলু,তোর এই প্রতিভার কথা আশেপাশের কেউ যাতে জানতে না পারে,সেদিকে সচেতন থাকবি.. তাই আর কখনো টুবলুর আবদারে মেয়েলি স্বরে গান গাইবি না, বেশি জোরাজুরি করলে বলবি'খন 'মা বারণ করেছে'...
তারপর কিছুটা স্বগতোক্তির মতো বললেন,
  --- ঈশ্বর যে অনন্য গুণের অধিকারী হওয়ার সৌভাগ্য তোকে দিয়েছেন,তাকে সর্বসমক্ষে প্রকাশিত করার জন্য উপযুক্ত সঙ্গীতগুরুর প্রয়োজন | যিনি তোর গুণের প্রকৃত কদর করে গানের তালিম দিয়ে সঙ্গীত জগতের উচ্চস্তরে পৌঁছে দিতে সহায়ক হবে | তোর ভবিষ্যৎকে উজ্জ্বল করতে সেই ব্যবস্থা করবো |
 মায়ের নিষেধাজ্ঞাকে শিরোধার্য করে অজানা ভবিষ্যতের স্বপ্নে বিভোর হয়ে গেল কৈশোরের লালিত্যমাখা বাবলুর মন |

      মাঝে কেটে গেছে কয়েকটি দিন | এর মধ্যে যুথিকাদেবী মনস্থির করে নিয়েছেন বাবলুকে অন্যত্র পাঠিয়ে দেবেন যাতে ওর সঙ্গীত শিক্ষা মসৃন পথে অগ্রসর হতে পারে | সেই মতো দুই ছেলের অনুপস্থিতিতে বিমলেশবাবুর সাথে এই বিষয়ে আলোচনা সেরে নিয়েছেন | স্বামীকে বলেছেন, এখানকার মফস্বল অঞ্চলে তেমন ভালো স্কুল নেই বলে কলকাতায় নিজের পরিচিত একজনের বাড়িতে রেখে ভালো স্কুলে বাবলুকে ভর্তি করবেন | তাতে ওর অ্যাকাডেমিক কোরিয়ার গড়ার ভীত ভালো মতন তৈরী হয় | অতি সন্তর্পনে লেখাপড়ার সাথে গান শেখার ব্যাপারটা স্বামীর কাছ থেকে গোপন রেখেছেন তিনি |
    নিজের সিদ্ধান্তে স্বামীর পূর্ণ সম্মতি পেয়ে নিশ্চিন্ত হলেন যুথিকাদেবী | মনে মনে বললেন,বড়ছেলের প্রতিভার বিকাশের জন্য এটুকু মিথ্যার আশ্রয় মা হয়ে আমাকে নিতেই হলো,কারণ কলকাতায় আমার পরিচিতের বাড়িতে থেকে বাবলু শুধু ভালো স্কুলে লেখাপড়া করবে না সেই সাথে এমন একজন শিক্ষয়িত্রী পাবে যিনি ওকে সঙ্গীতের খুঁটিনাটি বিষয়ে নিপুন ভাবে যত্ন সহকারে তালিম দিয়ে পারদর্শী করে তুলবেন |

     কৈশোরের চৌকাঠে সদ্য পা রাখা বাবলু প্রথমে রাজি হচ্ছিলো না নিজের পরিবার ছেড়ে অজানা পরিবেশে অচেনা কারো বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করতে | কিন্তু যখন যুথিকাদেবী বোঝালেন যে ওখানে থাকলে সে ভালো স্কুলে পড়ার পাশাপাশি সঙ্গীত শিক্ষার জন্য একজন উপযুক্ত গুরু পাবে,তখন তার সঙ্গীতের প্রতি ভালোবাসার শক্তি  বিশেষ করে মা-ভাইকে ছেড়ে দূরে থাকার বিরহকে কিছুটা প্রশমিত করলো! অতঃপর নিজের সুপ্ত প্রতিভার পূর্ণ বিকাশের একবুক আশা নিয়ে মায়ের সাথে কলকাতায় অপলাদেবীর বাড়ির পথে রওনা দিল বাবলু |
    যুথিকাদেবীর স্কুল জীবনের বান্ধবীর মাসি হন অপলা সিংহরায় | অবিবাহিতা এই মহিলার জীবনের একমাত্র ধ্যান জ্ঞান হলো সঙ্গীত | প্রখ্যাত শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাসের ছাত্রী ছিলেন তিনি | কিছুকাল রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছিলেন এবং আকাশবাণীর সঙ্গীতানুষ্ঠানেও  অংশগ্রহণ করেছেন | শিল্পের অন্যতম চর্চিত দিক -- সঙ্গীত সাধনায় আজীবন ব্রতী ঠকেছেন উনি | তাই বহুদিনের পরিচিত উদার মনস্ক এই মানুষটি পারবেন বাবলুর গুণের যথাযোগ্য কদর করে গানের পুঙ্খানুপুঙ্খ তালিম দিয়ে সঙ্গীত জগতে স্থায়ী জায়গা করে নেওয়ার উপযোগী করে গড়ে তুলতে |যুথিকাদেবী বিশ্বাস করেন, ওনার ছত্রছায়াতে তাঁর ছেলের প্রতিভার উদ্গিরণ সর্বসমক্ষে ঘটতে পারবে |
---

   সময় তরণীর সওয়ারি হয়ে বাবলু পার করে এসেছে জীবনের মূল্যবান ছয়'টি বছর | একজন গুণী শিল্পীর সাহচর্যে তার কণ্ঠস্থিত গুণের সার্বিক বিকাশ ঘটেছে | পাশাপাশি মাধ্যমিক- উচ্চ মাধ্যমিকে পেয়েছিল আশাপ্রদ সাফল্য | এখন সে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক স্তরে সঙ্গীত বিষয়ে অধ্যয়নে নিযুক্ত রয়েছে | প্রতিদিন শিক্ষাগুরুর পদতলে বসে নিয়মিত গানের তালিম নেওয়া এবং রেওয়াজ করা বাবলুর জীবনের অন্যতম অঙ্গ | এছাড়া সঙ্গীত মহলে অপলাদেবীর চেনা জানার সুবাদে একই স্বরনালী থেকে নির্গত নারী-পুরুষ উভয় কণ্ঠস্বরে একক ও দ্বৈত গান জনসমক্ষে গাওয়ার সুযোগ পেয়েছে সে | কণ্ঠের সুমিষ্টত্ব শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছে.. এমন বিরল প্রতিভাধরের প্রকাশ্যে আসার খবর অল্পদিনেই চারদিকে সাড়া ফেলে দেয়..,আর সেই বার্তা সুরের পথেই এসে পৌঁছয় দাশগুপ্ত পরিবারে |

          রবিবারের এক সকালে বৈঠকখানা ঘরের সোফায় বসে খবরের কাগজ পড়ায় মনোনিবেশ করেছেন বিমলেশবাবু | ঘরের মধ্যে একখানি তেপায়া টেবিলে রাখা রেডিওর কোনো একটি এফ.এম স্টেশনে গানের অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচারিত হচ্ছে | সেদিকে বিশেষ মনোযোগ নেই ওনার | কিন্তু রেডিওর ওপ্রান্তে অবস্থানকারী অদৃশ্য সঞ্চালকের মুখচ্চারিত একটি নাম শুনে চমকে উঠলেন তিনি!শুনলেন সেই সঞ্চালক বলছে,
   --- আজ আপনাদের সামনে এমন এক সঙ্গীত শিল্পীকে আনতে চলেছি যার কণ্ঠের জাদুতে  শ্রোতাবন্ধুরা যে সীমাহীন অবাক হবেন,তা গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি... তাহলে চলুন পরিচয় করা যাক সেই বিশেষ ব্যক্তির সাথে...তবে নামে নয় গানেই সে নিজের পরিচয় দেবে...
এরপর বেতার তরঙ্গ বাহিত হয়ে ভেসে এলো পুরুষ মহিলার দ্বৈতকণ্ঠের শ্রুতিমধুর একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত-
     "তুমি রবে নীরবে,হৃদয়ে মম.. তুমি রবে নীরবে
      নিবিড়-নিভৃত পূর্ণিমা নিশীথিনী সম...
      তুমি রবে নীরবে,হৃদয়ে মম... "
সম্পূর্ণ গানটি চলাকালীন বাকরুদ্ধ হয়ে অপলক দৃষ্টিতে রেডিওর দিকে তাকিয়ে ছিলেন বিমলেশবাবু | গানের জাদুতে এতটাই মগ্ন হয়েছিলেন যে ঘরে যুথিকাদেবীর উপস্থিতি বুঝতে পারেন নি!এবার গান শেষ হতে শুনলেন,
  --- নমস্কার বন্ধুরা,আমি রোহন দাশগুপ্ত | এইমাত্র আপনাদের সামনে পরিবেশিত করা দ্বৈতসঙ্গীতটি আমার স্বকণ্ঠেই উৎসারিত হলো..হ্যাঁ, ঠিক শুনেছেন ঈশ্বরের কৃপায় নারী ও পুরুষ -- দু'রকম স্বরে গান গাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে...ছোটবেলাতে এই ক্ষমতার প্রথম বুঝতে পারেন আমার মা... ওনার অনুপ্রেরণা এবং উৎসাহে সঙ্গীত সাধনায় সুযোগ পেয়েছি.. মায়ের কাছেই আমার গান শেখার হাতেখড়ি..
এবার শোনা গেল সঞ্চালক বলছেন,
  --- আপনার মায়ের নামটি যদি উৎসুক শ্রোতাদের জানান..
  --- অবশ্যই জানাবো... যে নাম আমার শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে মিশে রয়েছে সে নামের অধিকারী মানুষটি হলেন শ্রীমতি যুথিকা দাশগুপ্ত |
   নামটি শোনামাত্র মগ্নতা ভঙ্গ হলো বিমলেশবাবুর | খসে পড়লো হাতে ধরা খবরের কাগজখানা | মাথার মধ্যে ভিড় করে আসলো অজস্র প্রশ্ন | আর তক্ষুনি বিদ্যুৎপৃষ্টের ন্যায় সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে যেই না পশ্চাতে ঘুরেছেন,অমনি ঘরের ভেতর দরজার কাছে উৎফুল্ল চিত্তে দন্ডায়মান যুথিকাদেবীকে দেখতে পেলেন |
    স্বামীর মুখ নিঃসৃত প্রশ্নবাণ তাঁর পানে ছুটে আসার আগে যুথিকাদেবী শান্ত,নিরুত্তেজ কণ্ঠে তোমার সব প্রশ্নের উত্তর এখুনি দিচ্ছি -- বলে নব ঘুরিয়ে রেডিও অফ করে দিলেন | তারপর শৈশব থেকে এখনো অবধি ওনার অজ্ঞাতে ঘটে চলা বাবলুর জীবনের উত্তরণের কাহিনীর বিস্তারিত ভাবে জানালেন | সবটা শুনে স্তম্ভিত হয়ে যাওয়া বিমলেশবাবুর চোখে চোখ রেখে দৃঢ়,শঙ্কাহীন কণ্ঠে তিনি বললেন,
  --- আমাদের বড়ছেলের প্রতিভার কুঁড়িকে সঙ্গীতের আঙিনায় সুবাসিত পুষ্পের ন্যায় প্রস্ফুটিত করার জন্য তোমার অজ্ঞাতসারে এই পদক্ষেপ আমি নিয়েছিলাম..
যুথিকাদেবী আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু দেখলেন তাঁর হাত দুটো ধরে একরাশ অনুতাপে ভরা কণ্ঠে বিমলেশবাবু বলছেন,
  --- ভুল,সব আমার ভুল যুথিকা | অদম্য জেদের কালো পর্দায় ঢাকা ছিল আমার দৃষ্টি,নাহলে বাবা হয়ে কিনা সুরেলা কন্ঠস্বরের অধিকারী এবং এমন অবিশ্বাস্য গুণসম্পন্ন ছেলের গান শেখার ইচ্ছাকে অবদমন করেছিলাম যুক্তিহীন বিশ্বাস ও অজ্ঞতার বশে... ধিক.. ধিক আমার পিতৃত্বকে...
    স্বামীর মনে অবস্থা বিলক্ষণ অনুভব করলেন যুথিকাদেবী | তারপর নরম গলায় বললেন,
  --- গতকাল রাতে বাবলু ফোন করে রেডিওর অনুষ্ঠানের কথা জানিয়েছিল | তাই মনস্থ করলাম আজকেই তোমায় সবকিছু জানবার ব্যবস্থা করবো,সেই মতো বৈঠকখানা ঘরে রেডিওটা রেখে পূর্বনির্দিষ্ট স্টেশন চালিয়ে গেছিলাম... তবে শুধু তোমাকে নয়, অপলাদেবীর কাছে গান শেখার ব্যাপারে টুবলুকেও কিছুটি জানাই নি | তবে এবারে ওকে জানিয়ে দেবো কারণ দাদার গলায় গান শুনতে সে যে খুব ভালোবাসে...
      একটি গ্লানিময় দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বিমলেশবাবুর অনুশোচনা মথিত হৃদয়ের গহীন থেকে | কিয়ৎক্ষণ পরে সমর্থন জানানোর ভাষায় বলে উঠলেন,
   --- আমাকে অগোচরে রেখে ছেলের ইচ্ছা পূরণের পথপ্রদর্শক হয়ে মায়ের উচিত কর্তব্যই করে এসেছো যুথিকা...আর তাতে আমার অপরাধের বোঝা কিছুটা হালকা হবার অবকাশ পেল!

   ---
      সপ্তাহ খানেক পরের এক সন্ধ্যেবেলা মা-বাবার ঘরের খাটে বসে নিখুঁত নারী কণ্ঠস্বরে "আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রাণে " গানটি শুধু হারমোনিয়াম বাজিয়ে সম্পূর্ণ গাইল বাবলু | গান শেষ হতে সমগ্র ঘরখানিতে ছড়িয়ে পড়লো কণ্ঠমাধুর্যের অদৃশ্যমান কনা | গানের আবেশে ঘরময় ছেয়ে গেছে নিস্তব্ধতার বাতাবরণ | বাবলুর স্বরযন্ত্রের জাদু ঘরে উপস্থিত তার বাবা, মা ও ভাইয়ের হৃৎস্পন্দন কয়েক মুহূর্তের জন্য থামিয়ে তাদের যেন  নিশ্চল প্রস্তরমূর্তিতে পরিণত করে দিয়েছিলো!
      সহসা পিনপতনের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ হলো তিনজনের সমস্বরে উচ্চারিত একটি শব্দে 'অপূর্ব'!তারপর বাবলুর কাছে এসে গভীর মমতায় ছেলেকে বক্ষে জড়িয়ে ধরে বিমলেশবাবু গর্বান্বিত ভাবে বললেন,
     "তোর কণ্ঠস্বরের দ্বৈতসত্তাবিশিষ্ট প্রতিভার বিচ্ছুরণে সমৃদ্ধ হোক সঙ্গীত জগৎ...
সঙ্গীতের নিষ্ঠাবান সাধকের ন্যায় বাকদেবীর চরণতলে সাধনালবদ্ধ জ্ঞানের অর্ঘ্য আজীবন নিবেদন করে যাস... "!
saswati. munshi1987@gmail.com
হুগলী

No comments:

Post a Comment