![]() |
ছবি : ইন্টারনেট |
ঘর বাড়িমিনু চক্রবর্ত্তী
দুপুরে খেয়ে দেয়ে
চিলেকোঠার ঘরটাতে গেছিল প্রতাপ অর্থাৎ বুকুন। ওদের ছেলেবেলাটা তো এই চিলেকোঠার
ঘরেই সীমাবদ্ধ ছিল। ওদের মানে ও আর ওর দাদা টুকুনের। স্টেটসএ যাওয়ার পর ছাদে আসাই
হয়নি বুকুনের।বছরে একবার আসত ঠিকই দিন দশেকের জন্য। কিন্তু সে সময়ের ব্যস্ত
সিডিউলে ছাদের বা এই চিলেকোঠার জন্য কোনো সময় বরাদ্দ থাকত না। প্রায় বছর পাঁচেক
পরই বোধহয় এই চিলেকোঠায় পা দিল বুকুন।
দাদার এই
মৃত্যুটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না ও।খবরটা পাওয়া মাত্রই চলে এসেছে । টিকিট তো আগের থেকে কাটা ছিল না।
ওর কলিগ কাম বন্ধু রীতম টিকিট কেটে দিয়েছে । এর জন্য কম ঝক্কি পোহাতে হয়েছে নাকি
ওর!!
ছাদে উঠে
চারিদিকটা দেখতে লাগল বুকুন।আশেপাশের সব
বাড়িগুলোই প্রায় ফ্ল্যাটে রূপান্তরিত হয়েছে। বুকুনদের এই বাড়িটার জন্যও ওঁত পেতে
ছিল প্রোমোটার।কিন্তু মা কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। মাকেও দোষ দেওয়া যায় না। এই বাড়ির সাথে মায়ের অনেক সেন্টিমেন্ট জড়িয়ে
আছে। তাই যখন দুটো ফ্ল্যাট আর বেশ কিছু টাকার অফার নিয়ে টেকো হারু বুকুনদের বাড়ি এসেছিল
তখন মা পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিল --"আমি যতদিন বেঁচে আছি এই বাড়ি
বিক্রি হবে না।"
অথচ আজ...
বুকুনের অজান্তেই একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস পড়ল।
বুকুনের যখন
স্টেটসের চাকরীর অফারটা এলো দাদা তখন
ব্যাঙ্গালোরে একটা কোম্পানিতে চাকরী করে। দুবছর আগেই বাবা মারা গেছেন। মাকে একলা
রেখে বুকুন কি ভাবে জয়েন করবে ভাবছিল।ছাড়তেও পারছিল না। বিশাল স্যালারির লোভনীয়
চাকরী। একবার ভেবেছিল ডোমজুড়ে মাসতুতো দিদির বাড়িতে মাকে রাখবে। কিন্তু মা রাজি
হয়নি। বুদ্ধিটা মায়েরই ছিল।
--"একটা কাজ কর। টুকুনের চাকরীটাতো তেমন ভালো নয়, আর তাছাড়া নাকি
ইদানিং ওর চাকরীর স্থলে কি সব ঝামেলা চলছে। ওকেই বরং চাকরী ছেড়ে চলে আসতে বল।
"
বেশ মনপুত হয়েছিল
মায়ের কথাটা। দাদাও চাকরী ছেড়ে বাড়ির
সামনের বারান্দায় একটা স্টেশনারি দোকান দিয়েছিল।পাড়ার মধ্যে দোকান বেশ ভালোই
চলছিল। এই তো গতমাসেই দাদা ফোন করে বলেছিল --"বুকুন,
একটা ফ্রিজ কিনতে হবে রে
দোকানের জন্য। এখানে আইসক্রিম কোল্ড ড্রিংকের বেশ ডিমান্ড।"
বুকুন টাকা
পাঠিয়ে দিয়েছিল। সেই ফ্রিজ আনতে যাওয়ার সময়ই বড় রাস্তায় একটা দশ চাকার লড়ি থেঁতলে
দিয়েছিল সাইকেল সমেত দাদাকে।
এখন তো মাকে এখানে একা রেখে ফিরতে পারবে না বুকুন। তাই ঠিক করল এই বাড়ি প্রমোটার হারুর হাতেই তুলে দেবে। যে বাড়ি ছেড়ে মা কোথাও কোনোদিন দুদিনের বেশি কাটাননি সেই বাড়ি ছেড়ে মাকে চলে যেতে হবে সেই সাগর পারের দেশে। কিন্তু কিছু করারও নেই। ওদের এমন কোনো আত্মীয় নেই যে বলবে মায়ের সাথে এসে থাকতে। কিন্তু ফ্লোরা! ফ্লোরার কথা তো বুকুন মাকে বলেওনি।আর ফ্লোরাই কি মাকে মেনে নেবে? জীবনে এমন দোটানায় পড়তে হবে বুকুন তা কল্পনাও করতে পারেনি। কিন্তু কিছু করারও তো নেই। এই বয়সে মাকে একলা ফেলে ও যায়ই বা কি করে। ওর এই সমস্যার কথা ফ্লোরাকে বলে নি। ফ্লোরা যেমন মেয়ে তাতে ও ভালোমতই জানে মাকে নিয়ে এক সংসারে থাকতে ও রাজি হবে না।
শ্রেয়াদির জন্য
খারাপ লাগছে। ছোট থেকেই দাদাকে ভালোবাসত
শ্রেয়াদি। কিন্তু বেকার ছেলের সাথে বিয়ে দেবে না বলে শ্রেয়াদির বাবা মা জোর করে
শ্রেয়াদিকে অন্য জায়গায় বিয়ে দিয়ে দেয়।
বছর তিনেক পরেই শ্রেয়াদি আবার ফিরে আসে বিধবার বেশে।
গতকাল শ্রেয়াদি
এসেছিল সন্ধ্যাবেলা।খুব কান্নাকাটি করছিল দাদার জন্য। মাও কাঁদতে কাঁদতে
শ্রেয়াদিকে বলছিলেন--"তুই যদি আমার ঘরে আসতি তবে কি এভাবে আমার ছেলেকে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হতো।"
মায়ের কথাতে
শ্রেয়াদির কান্নার দমক যেন আরও খানিকটা বেড়ে গেল। তারপর কাঁদতে কাঁদতেই বলতে লাগল
--"তোমার ছেলে তো সেসময় আমার বাবাকে বলতেই পারল না কাকীমা। ওর সেই চাকরি হল
কিন্তু আমার বিয়ের পর। টুকুনদা যদি তখন আমায় একটুখানি ভরসা দিত তবে আমি আমার
বাবাকে কনভিন্স করার চেষ্টা করতাম। "
আসলে সে সময় কোন
ভরসাতে দাদা শ্রেয়াদিকে ভরসা দিত। বাবার পেনশনের ওই কটা টাকায় সংসার চলত। বুকুন
টিউশনি করে নিজেরটুকুই চালাতে পারত। তারপর দাদা যখন ব্যাঙ্গালোরে চাকরিটা পেল তার
আগেই শ্রেয়াদির বিয়ে হয়ে গেছিল।
আসলে শ্রেয়াদির শ্বশুরবাড়িটা তেমন ভালো ছিল না। শ্রেয়াদির হাসবেণ্ড একসিডেণ্টে মারা যাওয়াতে ওর ভাসুর সমস্ত সম্পত্তি একা আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যে শ্রেয়াদিকে এককালীন একটা মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল। শ্রেয়াদির বাবা এ নিয়ে কোর্ট কাছারি করতে পারত কিন্তু করতে চায়নি। কারণ শ্রেয়াদির বাবারও সম্পত্তি কিছু কম নেই। শ্রেয়াদি বাবা মায়ের একটাই মেয়ে।সবটাই ও পাবে। শ্রেয়াদি বিধবা হয়ে বাপের বাড়ি ফিরে আসার মাস ছয়েকের মধ্যেই ওর মা মানে কাকিমা মারা গেলেন সামান্য জ্বরে। এখন বাবা আর মেয়ের সংসারে। শ্রেয়াদির বাবা এখন মাঝে মাঝে আপসোস করেন বেকার ছেলে বলে দাদার সাথে বিয়েটা না দেওয়ার জন্য।
"এপারে থাকবো আমি তুমি রইবে ও পারে "
বেজে উঠল
মুঠোফোনটা।ফ্লোরা কল করেছে।
আসলে ফ্লোরা
জানেই না বুকুন ইণ্ডিয়ায় কেন এসেছে। ও জানে বুকুনের অফিস বুকুনকে ইণ্ডিয়ায়
পাঠিয়েছে। বুকুন যে ওর বাড়ি ওর মায়ের সাথে মন থেকে জড়িয়ে আছে সেটা ফ্লোরাকে বলতে
চায়নি। কারণ বুকুন দেখেছে ফ্লোরা ওর নিজের মম্ ড্যাডের সাথেই কোনোরকম সম্পর্ক রাখে
না। সে বুকুনের মাকে কি ভাবে মেনে নেবে? ভীষণ রকম দোটানায় পড়ে গেছে বুকুন। এখন কি বলবে
ফ্লোরাকে। রিং হয়েই যাচ্ছে ফোনে। ফোনটা ধরল বুকুন --"হ্যালো "
ওপারে ফ্লোরা
জিজ্ঞেস করল --"হ্যালো প্রটাপ,টুমি
ইণ্ডিয়ায় রিচ করার পর নো ফোন কল, নো মেসেজ, আর ইউ ওয়েল? "
বুকুন বলল
--"হ্যাঁ, আমি ভালো আছি ডার্লিং। "
ফ্লোরা বাংলাটা
ভালো বলতে না পারলেও ভালো বোঝে। বুকুন তাই ওর সাথে বাংলাতেই কথা বলে। ফ্লোরা
জিজ্ঞেস করে বুকুন কবে স্টেটসে ফিরবে। বুকুন জানায় কিছুদিন দেরি হবে। অফিসের কাজ
এখনো শেষ হয়নি।
অনেকক্ষণ হল ছাদে
এসেছে বুকুন। এবার নামতে হবে। মা একা নিচে কি করছে কে জানে। পাশের একটা ফ্ল্যাটের
দিকে দৃষ্টি গেল বুকুনের। ওখানে পারমিতাদের বাড়ি ছিল। পারমিতার দাদা টেকো হারুকে
বাড়ি দিয়ে দুটো ফ্ল্যাট পেয়েছে আর বেশ কিছু টাকা। পারমিতাকে একটুও তার ভাগ দেয়নি।
এই নিয়ে নাকি দাদার সাথে পারমিতার খুব
ঝামেলা হয়েছে। পারমিতা দাদার বক্তব্য অনেক
টাকা খরচ করে ওর বিয়ে দেওয়া হয়েছে তবে এখন আর ভাগ কিসের।পারমিতার বক্তব্য দাদাকেও
তো পড়াশুনা শেখাতে অনেক খরচ হয়েছে তবে সবটাই ও নেবে কেন। পারমিতা আজকাল এখানে আসে
না। ওর আসামে বিয়ে হয়েছে। মা বলছিল আগে আগে পারমিতা আসলেই নাকি বুকুনদের বাড়ি আসত
দেখা করতে।ও মাকে বলত --"কাকিমা তোমরা কি সুন্দর এখনো খোলামেলা বাড়িতে বাস
করছ।আর আমার দাদাকে দেখ টাকার লোভে বাড়িটা দিয়ে দিল টেকো হারুকে। "
কতদিন পারমিতাকে
দেখেনি বুকুন। এখন কেমন চেহারা হয়েছে কে জানে। চিলেকোঠার ঘরটার দিকে একবার তাকাল
বুকুন। সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাকের মত সব কিছু চোখের সামনে ভেসে উঠছে। তখন বয়স কত হবে
তেরো কি চোদ্দ। সবে বড়ো হচ্ছে ওরা। সেদিন দাদা ও পাড়ার আরও কয়েকজন মিলে লুকোচুরি
খেলার সময় এই চিলেকোঠার ঘরে প্রথম বার পারমিতাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়েছিল ও। তারপর
আরো বেশ কয়েকবার সবার অলক্ষ্যে এই চিলেকোঠার ঘরে আদর করেছিল পারমিতাকে। বুকুন
প্রথমে পড়ার আছিলায় ছাদে চলে আসত। পারমিতাও ওর বাড়ি থেকে লক্ষ্য করত বুকুনের ছাদে
আসা। তারপর একটা বই নিয়ে চলে আসত বুকুনদের
বাড়ি। মাকে বলত --"জেঠি,বুকুন কোথায়? স্কুলের কতগুলো নোটস নেবো। "
আমার সহজ সরল মা
বলত --"যা বুকুন ছাদেই আছে। পড়ছে বোধহয়। "
বুকুনও যেই ছাদের
সিঁড়িতে পায়ের শব্দ পেত অমনি চিলেকোঠার ঘরে ঢুকে যেত। পারমিতা জানত চিলেকোঠার ঘরে
বুকুন ওর জন্যই অপেক্ষা করছে। তারপর দুজনে দুজনকে আদরে আদরে ভরিয়ে দিত। দাদা একদিন
ধরে ফেলেছিল ওদের। প্রথমে দুজনকে খুব বকেছিল। তারপর বুঝিয়েছিল এমন করতে নেই। এর
পরেও যদি ওরা এমন করে তবে বাড়িতে সকলকে বলে দেবে। খুব ভয় পেয়ে গেছিল ওরা।তারপর থেকে
আর কোনোদিন গায়ে হাত দেয়নি পারমিতার।
খুব হাসি পাচ্ছে
আজ বুকুনের। দৃশ্যগুলো যেন চোখের সামনে ভাসছে। ছেলেবেলার ছেলেমানুষী।
নিচে নেমে এলো
বুকুন। মা আলমারি থেকে সমস্ত কাপড় নামিয়ে একটা ট্রলি ব্যাগে ভড়ছে আর মাঝে মাঝে
কাপড়ের আঁচল দিয়ে চোখ মুছছে।বুকুন বুঝতে পারছে
মায়ের কষ্ট হচ্ছে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে এত দিনের সংসার ফেলে চলে যেতে। কিন্তু কিছু
করারও তো নেই। কোনো বিকল্প ব্যবস্থা তো মাথায় আসছে না।
অনেক কাজ
বুকুনের।সমস্ত ফার্নিচারগুলো বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে, বাড়িটা টেকো হারুর নামে রেজিষ্ট্রেশন করতে হবে।
সর্বপরি মায়ের পাসপোর্ট করতে হবে। মায়ের পাসপোর্ট করার কথা কোনোদিন মাথাতেই আসেনি
বুকুনের। মাকে যে কোনোদিন বিদেশে নিয়ে যেতে হবে সেটা কখনো ভাবেইনি ও। একবার
ভেবেছিল মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসবে। কিন্তু মন সায় দেয়নি। ওর মনে হয়েছে ছেলে
খ্যাঁদান মায়েরাই কেবল বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে যায়। ও তো তেমন নয়। ও তো মাকে খুব
ভালোবাসে।
এদিকে সময়ও খুব
দ্রুত চলে যাচ্ছে। অফিসও বুঝি আর ছুটিটা এক্সটেনশন করবে না। চারিদিকের ঝামেলাতে
বুকুন যখন দিশেহারা ঠিক সেই সময় শ্রেয়াদি ভগবানের দূতের মত ওর কাছে হাজির হল।
--"হ্যাঁরে বুকুন, তুই নাকি বাড়ি টেকো হারুকে দিয়ে কাকিমাকে নিয়ে
চলে যাচ্ছিস? "
--"এ ছাড়া উপায় কি বল? মাকে কার কাছে
রেখে যাবো? "
---"কেন কাকিমাকে আমি দেখবো। বাড়িটা তুই আমাকে
বিক্রি কর। টেকো হারুর দামই পাবি। এই বাড়িতে টুকুনের স্মৃতি রয়েছে। টুকুনের দোকান
আছে। আমি এটা তোকে বিক্রি করতে দেবো না। আর আমার মনে হয় কাকিমা এই বাড়ি ছেড়ে
কোত্থাও গিয়ে শান্তি পাবে না। "
মা মাঝখান থেকে
বলে উঠল --"তুই দেখবি মানে? তোর সারাটা জীবন পড়ে আছে। তোর বাবা কি তোকে
আরেক বার বিয়ে দেওয়ার কথা ভাববে না? "
---"রক্ষে কর,বিয়ের সাধ আমার মিটে গেছে।টাকা পয়সা যা আছে সেই
দিয়ে বাকী জীবনটা চলে যাবে।" শ্রেয়াদি মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল।
বুকুন যেন হাতে
চাঁদ পেল।
"তুমি মাকে দেখবে শ্রেয়াদি? তবে তো খুবই ভালো হয়। আর শোনো টাকার জন্য আমি
বাড়ি বিক্রি করছিলাম না। তোমাকে বাড়ি বিক্রি করবো কেন? এমনিই তোমার নামে
লিখে দিচ্ছি। তুমি শুধু আমার মাকে একটু দেখে রেখো। "
---"তুই নিশ্চিন্তে ওদেশে যা। কাকিমার দায়িত্ব আমি নিচ্ছি।"
অনেকদিন পর
টুকুনের দোকানটা খুলল শ্রেয়া।কাকিমার কথা মতো শ্রেয়া এখন থেকে এই দোকানে বসবে।
হঠাৎ করেই হার্ট এটাকে বাবা মারা যাওয়াতে শ্রেয়াও একা হয়ে গেছে। বাবাহীন ওই বাড়িতে
শ্রেয়ার একদম থাকতে ইচ্ছে করে না। তাই ও নিজের বাড়ি তালা বন্ধ করে প্রয়োজনীয় জিনিস
পত্র নিয়ে বুকুনদের বাড়িতেই এসে উঠেছে।
বুকুনের মায়ের এতে ভালোই হয়েছে।এক ছেলে চলে গেছে না ফেরার দেশে, আরেক ছেলে থেকেও নেই। সেই কোন দূর দেশে একা একা পড়ে আছে। শ্রেয়াকে আঁকড়েই এখন দিন গুজরান বুকুনের মায়ের।
শ্রেয়াদির উপর
মায়ের সমস্ত দায়িত্ব দিয়ে বুকুন যেদিন স্টেটসএ চলে এলো ফ্লোরা সেদিন বাড়ি ছিল না।
ফ্লোরাকে ফোন করেও না পেয়ে বুকুন সোজা ফ্লোরার অফিসে চলে গেল। সেখানে গিয়ে জানতে
পারল ফ্লোরা বেশ কয়েকদিন হল অফিসে আসে নি। ওর মমের বাড়িতে যাবে না জেনেও খোঁজ করল।
না ফ্লোরা কোথাও নেই। খুব রাগ হল বুকুনের। ফ্লোরার মত মেয়েরা কাউকেই ভালো বাসতে
পারে না। বুকুনের ফিরতে কিছুদিন দেরি হয়েছে বলে ও নিশ্চয় ববের কাছে চলে গেছে। বব
বুকুনেরই বন্ধু। ফ্লোরার এডমায়ারার।খুব রাগ হল বুকুনের। মনে হচ্ছিল ববকে সামনে
পেলে গুলি করে দেবে। গাড়িটা বের করে সোজা ববের বাড়ি পৌঁছে গেল বুকুন। ডোরবেল
বাজাতেই বব বেরিয়ে এলো। বুকুন খুবই উত্তেজিত হয়ে ববকে জিজ্ঞেস করল
---"হোয়্যার ইজ ফ্লোরা? প্লিজ কল হার।
"
বব তো আকাশ থেকে
পড়ল --"ফ্লোরা??
আই ডোন্ট নো। শী হ্যাজ নট
কাম হেয়ার। "
এবার তো মহা চিন্তায় পড়ে গেল বুকুন। কোথায় গেল ফ্লোরা।
দুপুরে খাওয়ার পর
বুকুনের মা সবে একটু বিছানায় গেছে। ছোট্ট করে একটু ভাতঘুমের উদ্দেশ্যে। হঠাৎ
ডোরবেলটা বেজে উঠল।
---"শ্রেয়া দেখ তো মা কে এলো এই ভর দুপুরে। "
খাওয়ার পর
রান্নাঘরের টুকিটাকি কাজ সারছিল শ্রেয়া।
--"যাই কাকিমা। "
শ্রেয়া দরজা খুলে
দেখে এক বিদেশিনী। অবাক হয়। বিদেশিনী ভাঙা বাঙলায় প্রশ্ন করে --"এটা কি
প্রটাপের বাড়ি। আমি স্টেটস হইতে আসিয়াছি। "
শ্রেয়া বলে
--"হ্যাঁ এটা প্রতাপের বাড়ি
কিন্তু ও তো এখন এখানে নেই। "
---"উয়ার মম আছে নিশ্চয়। আমি উহার সহিত মিট করিতে
চাই। "
শ্রেয়া মহিলাকে
ঘরে ঢোকায় না। বাড়িতে কোনো পুরুষ মানুষ থাকে না। কি জানি কি উদ্দেশ্যে বিদেশিনী
এসেছে। ও বলে --"আপনি একটু দাঁড়ান আমি ডেকে দিচ্ছি।"
কাকিমা আসার পর
সেই বিদেশিনী যা বলল তার মর্মার্থ হল --ওর নাম ফ্লোরা। স্টেটসে থাকে। ওকে প্রতাপ
অর্থাৎ বুকুন বিয়ে করেছে দুবছর হল।মাস দুয়েক হল প্রতাপ ইণ্ডিয়ায় এসে আর ফিরছে না
দেখে ও নিজেই চলে এসেছে ইণ্ডিয়ায়।প্রতাপকে কিছু জানায়নি সারপ্রাইজ দেবে বলে।
প্রতাপের কাগজ পত্র ঘেঁটে এখানকার এড্রেস জোগার করেছে। কথাগুলো খুব কেটে কেটে যথাসম্ভব
বাঙলায় বলার চেষ্টা করেছে ফ্লোরা।
কাকিমা ও শ্রেয়া
ফ্লোরার কথা শুনে তো আকাশ থেকে পড়ল। বুকুন তো ফ্লোরার কথা কোনোদিন মাকে বলেনি।
কাকিমা বলল --"তোমার কথা তো বুকুন আমাকে বলেনি। তুৃমি সত্যি বলছ তো? "
ফ্লোরা এরপর যা করল তারজন্য বুকুনের মা একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। ও ঢিপ করে বুকুনের মাকে একটা প্রণাম করে বলল --"ইয়েস,আমি সট্টি বলছি। ইউ আর মাই মাদার ইন ল। আমি টোমার কাছেই থাকতে এসেছি। দ্যাট কানট্রি আমার ভালো লাগে না।
ঠিক সেই সময়
ফোনটা বেজে উঠল বুকুনের মায়ের। ওপারে বুকুন।
--"হ্যালো মা, এখানে পৌঁছে তোমায় ফোন করা হয়নি। আমি ভালোভাবে
পৌঁছে গেছি। আসলে এখানে এসে একটা কাজে ফেঁসে গেছি। "
মায়ের হাত থেকে
ফোনটা নিয়ে ফ্লোরা বলল --"হ্যালো, ফ্লোরা হেয়ার।
আমি টোমাকে সারপ্রাইজ দিতে এখানে চলে এলাম
আর টুমি আগেই স্টেটসে পৌঁছে গেছ? "
ফ্লোরার গলা শুনে
যারপরনাই অবাক বুকুন।
--"আমি আসার পর তোমাকে নিয়ে কতখানি টেনসড ছিলাম
তুমি জানো? কত জায়গায় তোমাকে খুঁজেছি।তোমার ফোনও আউট অফ
সার্ভিস বলছে। "
--"মাই সেলফোন চুরি হয়ে গেছে এয়ারপোর্টে। টুমি
টোমার মমকে বলে দাও আমি টোমার ওয়াইফ।"
--হ্যাঁরে, বুকুন এসব কি শুনছি। আমাকে বলিসনি কেন ফ্লোরার কথা?
"
ফোনে মায়ের গলা।
--"আসলে আমি ভয় পেয়েছিলাম মা। তুমি ফ্লোরাকে মেনে
নেবে কি না। "
বুকুন আমতা আমতা
করে বলল।
--"দূর পাগোল, তুই পছন্দ করেছিস যখন তখন ও ভালো না হয়ে যায়
না। আমার এক ছেলে চলে গিয়ে দুই মেয়ে পেয়েছি।আমার মতো সুখী আর কে আছে বল। তুই এবার
এখানেই চলে আয়। আমরা সকলে মিলে এই বাড়িটায় একসাথে থাকব।অনেক কাজ তোর। এখানে এসে
সামাজিক বিয়েটা সারবি তারপর একটা ভালো ছেলে দেখে আমরা শ্রেয়ারও একটা বিয়ে দেবো।
"
বুকুনের খুব আনন্দ হচ্ছে। ও বলল --"হ্যাঁ মা খুব শিগগিরই আমি এখানকার চাকরি ছেড়ে দেশে ফিরবো। তারপর আমাদের বাড়িতেই সবাই একসাথে থাকবো। "
No comments:
Post a Comment