1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, February 21, 2021

সন্ন্যাসী

ছবি  : ইন্টারনেট 

সন্ন্যাসী
পল্লব পত্রকার 

          চৈত্র মাস শেষ হতে চলল। কদিন পরেই সংক্রান্তি। ঘোষালপুরে তাই ব্যস্ততার সীমা নেই। এ গ্রামের অনেকেই সন্ন্যাসী হন। নতুন বস্ত্র, উত্তরীয় পরে স্বগোত্র ত্যাগ করে শিব গোত্র নেন। কদিন সংযমে থেকে, হবিষ্য খেয়ে তারকেশ্বরে শিবের মাথায় জল ঢালতে যান।
            ঘোষালপুর থেকে তারকেশ্বরের দূরত্ব প্রায় পঁচিশ মাইল। এতদিন সবাই জলভরা ঘট বাঁকে  নিয়ে, পায়ে হেঁটেই গেছেন। এবার অন্য ব্যবস্থা। বাস রিজার্ভ করা হচ্ছে। সে ব্যাপারে আজ দুপুরে শীতলা মন্দিরে সভা। ছেলেরা তেমন কেউ নেই। সবাই কাজে বেরিয়েছে। মেয়েরা কয়েকজন এসেছে। ঝর্না, বুল্টি, কৃষ্ণা, সবিতা, নমিতা। আর কটা নেন্ডিগেন্ডী।
          দলের মধ্যে কৃষ্ণা একটু লেখাপড়া জানে। ভালো কথাবার্তা বলতে পারে। মাস ছয়েক আগে এ গ্রামের বউ হয়ে এসেছে। তারই উদ্যোগে বাস ভাড়া করা হচ্ছে। 
         কিন্তু কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে। সভার শুরুতে সেটাই কৃষ্ণা বলে। 'লোক যদি এইভাবে কমতে থাকে আমাদের মাথাপিছু ভাড়া অনেক বেড়ে যাবে! খুব মুশকিল হবে! ড্রাইভারকে আজ সকালেই ফোন করেছিলাম। বলল, এক পয়সা কমানো যাবেনা!' 

     নমিতা সঙ্গে সঙ্গে বলে, 'আমরা কি করব! ঘন্টু যেভাবে ছিঁচকেপনা শুরু করেছে! ঘরে তালা দিয়ে লোক যাবে কি করে!'

  'ঘন্টু কে?' জানতে চায় কৃষ্ণা।

  'ঘন্টুকে চেন না!' অবাক হয় নমিতা। 'এই তো মাস তিনেক আগে সন্তোষপুরে ঘোষেদের বাড়ি চুরি করে ধরা পড়লো। জেলের ঘানি টানল কদিন। এক সপ্তা হল বেল পেয়ে বাইরে এসেছে।'

   সবিতা যোগ করে, 'এসেই চুরি-চামারি শুরু করে দিয়েছে! কাল বিকেলে বাগানে গিয়ে দেখি অত বড় কলার কাঁদিটা হাফিস! ও ছাড়া কার এমন বুকের পাটা আছে এ কাজ করবে!' 

   'মুশকিল হয়ে গেল! এতগুলো টাকা অ্যাডভান্স দেওয়া হয়ে গেছে!...' বেশ চিন্তায় পড়ে কৃষ্ণা। তার সঙ্গে অন্যরাও। সত্যিই তো! বাসের কথা কৃষ্ণার মাথায় প্রথম এসেছিল বটে, কিন্তু সিদ্ধান্তটা সবাই মিলে নেওয়া হয়েছে। অ্যাডভান্সের টাকা কৃষ্ণা দিয়েছে। পরে সবাই ভাড়ার টাকা দিলে কৃষ্ণাকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে ঠিক হয়েছে। 

   এখন এই অবস্থা!   

   একটু পরে আলোচনা বন্ধ করে সবাই মনমরা হয়ে বাড়ির পথ ধরে।

   রাস্তায় যেতে যেতে কৃষ্ণা ভাবল, তার বর গৌরাঙ্গর সঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলবে। সে যাতে ঘন্টুকে বুঝিয়ে বলে, সেই চেষ্টা করবে।

   ধর্ম-কর্মের ব্যাপারে গৌরাঙ্গ খুব একটা উৎসাহী নয়। সে নিজে তো তারকেশ্বরে যাচ্ছেই না, কৃষ্ণা যাক সেটাও প্রথমে চায়নি। শেষ পর্যন্ত বউয়ের পীড়াপিড়িতে রাজি হয়েছে। যাইহোক, কৃষ্ণার অনুরোধ নিশ্চয়ই সে ফেলতে পারবে না। টাউনের একটা হাইস্কুলের মাস্টার সে। পাড়ার সবাই তাকে মান্যিগন্যি করে। কদিন আগে নেতাজির জন্মদিনে যে সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা হল, গৌরাঙ্গ তার সভাপতি হয়েছিল। নেতাজি সম্পর্কে খানিকক্ষণ বক্তব্যও রেখেছিল। বক্তৃতা শেষ হলে সবাই যখন হাততালি দিল, গর্বে বুকটা ভরে গিয়েছিল কৃষ্ণার। 

   তো গৌরাঙ্গ যদি ঘন্টুকে  বুঝিয়ে বলে নিশ্চয়ই সে শুনবে। বাবা তারকনাথের নামে দিব্যি করিয়েও নেওয়া যেতে পারে। ঘন্টু চোর বলে কি পরকালের ভয় নেই!

    সন্ধেবেলা গৌরাঙ্গ বাড়ি ফিরলে চা জলখাবার দিতে দিতে কৃষ্ণা বলল, 'জান তো, বাস ভাড়া করে ফ্যাসাদে পড়ে গেছি!' 

   'কেন! কি হয়েছে?' নির্লিপ্ত গলায় জানতে চায় গৌরাঙ্গ।

   'এখানে ঘন্টু বলে কে আছে...!'

   'হ্যাঁ আছে তো!'

   'তুমি চেনো?'

   'না চেনার কি আছে!'

   'সে নাকি চুরি করে জেলে গিয়েছিল! কদিন আগেই ছাড়া পেয়েছে! তারপর আবার চুরি জোচ্চুরি শুরু করে দিয়েছে! কেউ আর বাড়ি ছেড়ে যেতে চাইছে না! এদিকে অতগুলো টাকা অ্যাডভান্স দেওয়া হয়ে গেছে!'

   'তাই বুঝি!' গৌরাঙ্গ আগের মতই নির্লিপ্ত।

   একটু থেমে কৃষ্ণা বলে, 'তোমাকে একটা কাজ করতে হবে!'

   'কি কাজ?' 

   'তুমি ঘন্টুকে বুঝিয়ে বলবে যাতে সে চুরি না করে। বাবা তারকেশ্বরের নামে দিব্যি করিয়েও নিতে পারো!' 

   'ওসব আমার দ্বারা হবে না!'

   'কেন হবে না কেন!' জানতে চায় কৃষ্ণা।

   গৌরাঙ্গ এবার গলা তোলে। 'আমি ওসব বিশ্বাস করিনা। ঘন্টুকেও বলতে পারব না।'  

   গুম মেরে যায় কৃষ্ণা। আচ্ছা লোক  বাবা! বউয়ের জন্য এটুকু করতে পারবে না! অন্য সময় তো 'তুমি আমার অমুক!' 'তুমি আমার তমুক!'...

   ওদিকে সবিতা, নমিতারাও বসে নেই। শুধু নিজেদের পাড়ার নয়, পাশের পাড়াতেও বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করে, 'এই তোমরা সন্ন্যাসী হবে?'

    'হ্যাঁ হব তো!' 

    'তারকেশ্বর যাবে?'

    'যাব তো!'

    'আমাদের সঙ্গে চলনা ভাই! বাসের ভাড়া না হয় কিছু কমই দিও। আমাদের লোকজন হচ্ছে না। এদিকে অ্যাডভান্স দেওয়া হয়ে গেছে।…' 

   সবাই প্রথমে একটু সহানুভুতি দেখাল। তারপর কিন্তু কিন্তু...। নিশ্চিত করে কেউ কিছু বলতে পারল না। খরচের ব্যাপারটা তো আছেই। সেইসঙ্গে ঘন্টু!

    ঝর্না বুল্টিরা একটু অন্যভাবে ব্যাপারটা সামাল দেবার চেষ্টা করল। পাড়ার ক্লাবগুলোর মধ্যে রুলিং পার্টির ক্লাবটা বেশ জোরদার। তাদের সেক্রেটারি ভবানী হালদারকে সরাসরি গিয়ে বলল, 'ভবানীদা, প্লিজ একটা কিছু ব্যবস্থা করুন!'

   'কি ব্যবস্থা?' জানতে চান ভবানী।  

   ঝর্না, বুল্টিরা বাসভাড়া এবং ঘন্টুর ব্যাপারটা খোলাখুলি বলল। 

   রাজনীতি করা ভবানী মন দিয়ে সব শুনল। তারপর মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, 'ঠিক আছে, আমি দেখছি ব্যাপারটা।'

    ঝর্না, বুল্টি মনে মনে বলল, তুমি কচু দেখবে! ইচ্ছা করলে এখনই ক্লাবের ছেলেদের দিয়ে ঝন্টুকে ডেকে আনাতে পারতে! বলতে পারতে, কারও কিছু চুরি গেলে তোকেই ধরা হবে! তারপর ভালো রকম দলাই-মলাই! না! সেসব কিছুই করলে না! করবে বলে মনেও হচ্ছে না! যা চিজ তুমি! দুমুখো সাপ! হয়তো দেখা যাবে ঘন্টুর থেকেও কমিশন খাচ্ছ!

   একরাশ হতাশা নিয়ে ঝর্না, বুল্টি বাড়ি ফিরল।

    কিন্তু পরের দিন সকালে প্রায় নাচতে নাচতে কৃষ্ণাদের বাড়ি এলো বুল্টি। মাটির দাওয়ায় বসে পড়ল ধপাস করে। 'ও কৃষ্ণা বউদি! দারুন খবর আছে! বাইরে এসো আগে!'

    'কি! কি হয়েছে রে বুল্টি! কি খবর!' হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে আসে কৃষ্ণা।

    'কি খাওয়াবে বলো আগে, তবেই বলব।'

    'আহা বল না! তারপর দেখছি কি খাওয়ানো যায়! বাগানের অনেকগুলো কাঁঠাল কেটে সিঁড়ির ঘরে রাখা আছে। কয়েকটা মনে হচ্ছে পেকে গেছে। তোকে একটা কাঁঠাল…'

   'সত্যি! তাহলে তো বলতেই হয়!' একটু থামে বুল্টি। তারপর চোখ নাচিয়ে, মাথা দুলিয়ে হাসিতে ফেটে পড়ে বলে, 'বাসের লোক যা আছে তাই থাকবে! একজনও কমবে না! বরং আর একজন বাড়বে!'

    'তার মানে!'

    'ঘন্টুদা আমাদের সঙ্গে যাচ্ছে!'

    'সে কি রে!' কৃষ্ণার চোখ কপালে ওঠে।

    'ও-ও তো সন্ন্যাসী হবে! এইমাত্র বাজারে আমার সঙ্গে দেখা। দেখলাম নতুন জামা-কাপড় কিনছে। জিজ্ঞেস করলাম, কি ব্যাপার গো ঘন্টুদা!

ঘন্টুদা বলল, আমিও তো সন্ন্যাসী হব। তোদের বাসে যাব। একটা সিট রাখিস।'

pallabkumarparui@gmail.com
কলকাতা 

No comments:

Post a Comment