1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, February 21, 2021

পুরনো বউ

 

ছবি  : ইন্টারনেট 

পুরনো বউ
বিকাশকলি পোল‍্যে

পুরনো-ও-ও  হার মোনিয়া আ- আ -আ -আ- ম।

পুরনো গেরামো -ও ফো -ও-ও-ও-ন।

আছে-এ-এ-এ।পুরনো টি-ই-ভি-ই-ই-ই।

পুরনো সি ডি -ই-ই-ই। আছে-এ-এ-এ-এ।

পুরনো ক-ম্পু-তা-আ-আ-আ।

পুরনো মনিতা-আ-আ।

ফেরিওয়ালার চিৎকারে ঘুমটা ভেঙে গেল।ঠিক ভেঙে গেল না। আধো ঘুম আধো জাগরণ।বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। রবিবার। অফিস ছুটি।দেরি করে ঘুম থেকে ওঠার অভ‍্যাস।পাশ বালিশ জড়িয়ে আবার ঘুমনোর চেষ্টা করলাম।

পুরনো মনিতা-আ-আ-আ-।ফেরিওয়ালার চিৎকার আবার ভেসে এল কানে।স্পষ্ট।

তড়াক করে লাফিয়ে উঠলাম বিছানায় ।পুরনো মনিতা ? বলে কি ফেরিওয়ালা !

ঐ আবার ।আছে-এ-এ-এ-এ।পুরনো মনিতা-আ-আ-আ।

হাঁকতে হাঁকতে চলে গেল ফেরিওয়ালা।

মনিতা! পুরনো মনিতা চাইছে ফেরিওয়ালা ! বিস্ময়ে ঘোর লাগে আমার ।

মনিতা আমার বউ।বিয়ের পরে অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। মেয়ে বড় হয়ে গেছে।জুট টেকনোলজি নিয়ে পড়াশোনা করে ব‍্যাঙ্গালোরে। পুজো বা পরীক্ষা শেষের ছুটিতে বাড়িতে আসে।ফ্ল‍্যাটে আমরা দুজনেই থাকি।মনিতা এখন আর নতুন নেই।এখন সে পুরনো হয়ে গেছে।

সত‍্যিই যদি পুরনো মনিতাকে পাল্টে নতুন মনিতা আনা যেত কি ভালোই না হত। নতুন মনিতার কথা ভাবতেই ঘর ভরে গেল রজনীগন্ধার সুগন্ধে। মনের মধ‍্যে জ্বলে উঠল হাজার বাতির রোশনাই। মনিতার খোঁজে বিছানা ছেড়ে ডাইনিং এ আসতেই বুঝতে পারলাম, সে বাথরুমে। স্নানে ঢুকেছে। খুব সকালে উঠে আগে তার স্নান করা চায় । তারপর পুজো।তারপর অন‍্যকিছু।বিয়ে হয়ে আমাদের বাড়িতে আসার পর থেকে এই একই রুটিন চলছে তার। এর রকমফের ঘটেনি কখনও । তার পুজোআচ্চা, উপোষ,বিভিন্ন বার ব্রত পালন করা নিয়ে আমার সঙ্গে কম মনোমালিন‍্য হয়নি। এই সমস্ত কিছু  আমার একদম ভালো লাগে না। কখনো নিজেকে আস্তিক বলি না আবার নিজেকে নাস্তিক বলে বড়াইও করি না। এ সব কিছু নির্ভর করে আমার প্রয়োজনের উপর। কারণ আমার কাছে জীবনটা হল প্রয়োজনের আয়োজন মাত্র। যাক্, এ সব অন‍্য কথা। তবে মনিতার এই ধর্মীয় আচরণ পালনে মা খুব খুশি ছিলেন ।

-কি হল, আজ এত তাড়াতাড়ি উঠে পড়লে যে? স্নান সেরে বেরিয়ে এল মনিতা।

তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম । না, খুব খারাপ তো লাগছে না। নতুনের মতো না হলেও পুরাতন লাগছে বলে তো মনে হচ্ছে না। শরতের রোদ্দুরের মতো লাগছে তাকে।ঝলমলে।স্নিগ্ধ।

বললাম,শুনলে ফেরিওয়ালা কি বলে গেল? 

-কই না তো ! আমি তো বাথরুমে ছিলাম। কি বলে গেল ফেরিওয়ালা ?

-পুরনো মনিতা চাইছে।

-ধ‍্যাৎ, কানটা তোমার গেছে । ও পুরনো মনিটার চাইছে। ও তো কাশেম।প্রতি রবিবার আসে আমাদের পাড়ায় । পুরনো জিনিস পত্র কিনতে।

-কিন্তু আমি যেন শুনলাম পুরনো মনিতা।

-আ হা হা,ঢং।কেন, আমাকে আর ভালো লাগছে না বুঝি?

সোফায় বসে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম।বললাম,না,তা নয়।

তা হলে কি? উঁ। পুরাতন বউয়ের চোখে চপল চাহনি।

চমকে উঠি আমি । নতুন মনিতার চাহনি ছিল লাজুক।আর এখন তার চাহনি শান দেওয়া ছুরির মতো। আলো ঠিকরে পড়ে। আগে গলার স্বর বিরাজ করত উদারায়। এখন করে তারায়।কিছু কিছু গান থাকে যা তারাতেই গায়তে হয় । পুরাতন বউ বুঝি জীবনের সেরকম কিছু গান। আগে তার হাসি ছিল মধুর।এখন হয়েছে মধুরতর। হাসতে হাসতে আমাকে বলল,'নাও ব্রাশ কর। চোখ মুখ ধুয়ে নাও। আমি পুজোয় বসছি। পুজো করে ব্রেকফাস্ট বানাব।লুচি আর আলু চচ্চড়ি।' ঠাকুর ঘরে ঢুকে গেল মনিতা।

কোন কিছু নতুন থাকেনা।একটা সময় পুরাতন হয়ে যায় সবকিছু ।মানুষের সম্পর্কগুলো দিন দিন পাল্টে যায়। বদলে যায় মন মানসিকতা। স্বামী স্ত্রীর মধুর সম্পর্কের রসায়নও বুঝি বদলে যায় । না হলে নতুন বউয়ের যে কদর,যে আদর,যে যত্ন,যে মনোযোগ তা আর থাকে না পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে। তখন শুধুই সংসার সমূদ্রে গা ভাসিয়ে দেওয়া।স্রোত যেখানে নিয়ে যাবে,যাবে।

ভাবলেই যদি এত আনন্দ।ভাবলেই যদি এত সুখ।ভাবলেই যদি রক্ত ছলাৎ ছল। তাহলে সত্যি হলে কি হত ! কিন্তু পুরনো বউ কিনবে কে? কে নিয়ে  যাবে তাকে? ফেরিওয়ালা? আহা, পুরানো বউ যদি বদলানো যেত কি ভালোই না হত। জীবনটা বুঝি আরো মধুর হয়ে উঠত। সত্যিই কি জীবন মধুর হয়ে উঠত? না কি জীবন হয়ে উঠত বিষময়? চিন্তা ভাবনাগুলো সব কি রকম এলোমেলো হয়ে যায় । সোফা ছেড়ে উঠি।বাথরুমে ঢুকি।ব্রাশ করি। চোখ মুখ ধুই। শুরু হয় আমার দিন ।

মনিতা লুচি ভাজে।কালো জিরের ফোড়ন দিয়ে আলুর সাদা চচ্চড়ি করে।যত্ন করে ব্রেকফাস্ট খাওয়ায়।খাওয়ার পরে নির্দেশ দেয়,'এখন জল খেয়ো না।একটু পরে খাবে। এখনই জল খেলে অম্বল হয়ে যাবে।তেলে ভাজা জিনিস খেয়েছ তো।'

রবিবারের দুপুর।আমার পছন্দের সব রান্না করে।তরকারিতে তেল দেয়,নুন দেয়,মিষ্টি দেয়,মশলা দেয়। হ‍্যাঁ,আরো একটা জিনিস দেয় মনিতা। বেশ ভালোই বুঝতে পারি। সেটা হল যত্ন।অন‍্যদিন সে তার মতো করে রান্না করে। আমি খেলে আমার মতো। তার কথা সে তখন ভুলে যায়।যত্ন করে দুপুরে খাওয়ায়।কাছে বসে আমার খাওয়ার তদারকি করে। আমার যেন কোন অসুবিধা না হয় । আমি তার প্রভু নই। তবুও সে ভাবে  প্রভু । সময় ধরে জল খাওয়ায়,ফল খাওয়ায়। আহা,মধুর আলস‍্যে ভরে ওঠে আমার জীবন।

আমার ছুটির দিনে মনিতার বিশ্রাম নেই এতটুকু ।

আমাকে নিয়ে ভীষণ ব‍্যস্ত হয়ে পড়ে সে। যেন আমার আনন্দই তার আনন্দ। আমার খুশিই তার খুশি।

ছুটির দিন।মেয়ে ফোন  করে বিকেলে। আমার সঙ্গে তার কথা হয় কম। যেটুকু হয় তার বেশির ভাগটাই তার প্রয়োজনের। মার সঙ্গেই কথা হয়  বেশি।তবে বুঝি, তার মার সঙ্গে যেটুকু কথা হয় তার বেশির ভাগটাই আমাকে নিয়ে ।

-'মানু,তোর বাবার প্রেশারটা বেড়ে গেছে। কোলেস্টেরলটা ছ'মাস হয়ে গেল চেক করা হল না। পিঠের ব‍্যথাটা বোধহয় একই রকম আছে। মাঝে মধ্যেই কষ্ট পায়।মুখে কিছু বলে না। তোর বাবাকে তো জানিস। দেখি এ মাসেই যাব ডাক্তারের কাছে ।' আমি চুপ করে শুনি।

না, তার শরীরের কথা কিছু বলে না সে।পাছে মেয়ে চিন্তা করে। কিংবা আমি জেনে ফেলি।

যদিও  আমি বেশ ভালো জানি। তার হাঁটুর ব‍্যাথা এখনো কমেনি। সিঁড়ি ভাঙতে হাঁফ ধরে যায় । দাঁতের ব‍্যথায় কাবু থাকে প্রায় সময়ই। আমাকে নিয়ে ব‍্যস্ত মনিতার এগুলো নাকি কিছুই নয়। তার কথায়,শরীর থাকলে ও এরকম একটু আধটু হয়ই।

মনিতার সঙ্গে এক অদৃশ‍্য সুতো বেঁধে রাখে আমাকে । সেই অদৃশ‍্য সুতোর নামই বোধ হয় মায়া।সব সম্পর্কের চারটি পিলার থাকে। চাওয়া পাওয়া দেওয়া নেওয়া। স্নেহ মায়া মমতা ভালোবাসা হল চুন সুরকির মতো। সম্পর্কের চারটি স্তম্ভকে মজবুত করে। রক্তের সম্পর্কও শিথিল হয়ে আসে এক সময় ।মনিতার সঙ্গে আমার কোন রক্তের সম্পর্ক নেই। তবুও তার সঙ্গে আমার অটুট বাঁধন।

তার প্রতি আমার অবহেলার অন্ত নেই। তবুও আমার প্রতি তার দায়বদ্ধতা আমাকে দিশেহারা করে রাখে। সে আমার কাছে যত পুরনো হয়,আমিও তত পুরনো হই তার কাছে ।আমার আপাদমস্তক সে প্রতিদিন পাঠ করে একটু একটু করে। আমাকে নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালায় তার মনের ল‍্যাবরেটরিতে। সে হয়ে ওঠে আলোকিত । সেই আলো তাকে আমার প্রতি করে তোলে কর্মচঞ্চল। আহা,মধুরতায় ভরে ওঠে আমার জীবন। কে যেন বলেছিলেন,'ওল্ড ইজ গোল্ড' ! কেমন করে বলেছিলেন ! ভাবতে থাকি।

তবুও মনে হয় মনিতা এখন আর নতুন নেই। পুরাতন হয়ে গেছে। আমার  মনে অসুখ ভিড় করতে থাকে।

bikashkalipolleya24@gmail.com
কলকাতা


No comments:

Post a Comment