1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, February 21, 2021

বিসর্জন

 

ছবি  : ইন্টারনেট 

বিসর্জন
মন্দিরা ঘোষ

          আজ মহালয়া,পিকলুর স্কুল ছুটি। চারিদিকে কাশফুল,নীল আকাশ,সাদা মেঘ পেঁজা তুলোর মতো ভেসে বেড়াচ্ছে,পূজোর মন্ডপ তৈরী হচ্ছে,ঢাক বাজছে,মা আসছেন-পিকলুর আনন্দ যেন আর ধরে না। প্রতিদিন সকালে উঠে সে দিন গোনে আর কদিন বাকী পূজো আসতে,কারণ এবার পূজোয় তার বাবা আসছে।
         পিকলুদের মধ‍্যবিত্ত পরিবার, তার বাবা প্রমথ স‍্যান‍্যাল,আর্মিতে চাকুরিরত। কাশ্মীরে থাকেন। বছরে একবারই বাড়ি আসতে পারেন।এবার পূজোতে আসবেন। বাড়িতে থাকে পিকলুর মা,ঠাম্মি,দাদু, দিদি আর পিকলু। দিদি পড়ে ক্লাস সেভেনে আর সে পড়ে টু-এ।ছুটির দিন তার দিদি আর দাদুর সঙ্গে সময় কেটে যায়।
পিকলু ও তার দিদি একই স্কুলে পড়ে,পিকলুর সকালে স্কুল। মহালয়া হয়ে গেছে,কদিন পরেই স্কুলে ছুটি পড়বে। পিকলু স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করে -তার বাবা ষষ্ঠীর দিন আসবে,তার জন‍্য একটা বিশেষ জিনিস নিয়ে আসবে। বন্ধুরা জিজ্ঞেস করে, 'কী জিনিস রে পিকলু?'সে বলে 'আমি জানিনা রে ,স্কুল খুললে একদিন নিয়ে আসবো।' নানাকিছু ভাবতে ভাবতে তার দিন কেটে যায়। যথারীতি নির্দিষ্ট দিনে স্কুলে ছুটি পড়ে।
        আজ চতুর্থী। পিকলু জানে তাব বাবা বাড়ি আসার জন‍্য আজ সকালে ট্রেনে উঠবে। মা তাকে বলেছে। সে সকালে ঘুম থেকে উঠে মা কে জিজ্ঞেস করে,'মা,বাবা ট্রেনে উঠেছে?' মা জানায়,'জানি না রে সোনা,তোর বাবার সঙ্গে ফোনে কোনোভাবেই যোগাযোগ করতে পারছি না।'  সকাল থেকে দাদুও অনেকবার চেষ্টা করেছে কিন্তু হচ্ছে না। পিকলুর মন হঠাৎ খারাপ হয়ে যায়। সে দিদির সঙ্গে খেলতে খেলতে ভুলে যায় সেকথা। এদিকে বেলা বাড়তে থাকে,তার বাবার কোনো খবর পাওয়া যায় না। সেখানে কারোর ফোন নাম্বার জানা নেই যে খোঁজ নেবে। তার দাদু টিভি দেখে যদি কোনো কারণে ট্রেন বাতিল হয় বা লেট থাকে তাহলে অনেকসময় খবরের চ‍্যানেলগুলো জানায়। কিন্তু সেরকম কিছু দেখায় না। এদিকে ঢাকের বোল যত জোরালো হতে থাকে,তাদের বাড়ির আবহাওয়ায়ও যেন তত শান্ত হয়ে আসে। সময় কেটে যায়। রাত হয়,পিকলুর মার চিন্তায় ঘুম আসে না। মনের দুশ্চিন্তার কথা জানাবে কাকে? ছেলেমেয়ে ছোটো।আর শ্বশুর-শাশুড়ি বয়স্ক। কী করবে কিছুই স্থির করতে পারে না...

          পঞ্চমীর সকাল। পিকলুর বন্ধু্রা সবাই ওকে খেলতে ডাকে।চারিদিকে পূজোর গন্ধ। কিন্তু পিকলুর মন ভালো নেই। বাড়ির সবাই চুপচাপ। বাবা কোথায় আছে কেউ জানে না। সে আর খেলতে যায় না। বাড়িতেই নিজের মতো খেলে। দুপুরবেলায় একটা অচেনা নম্বর থেকে পিকলুর দাদুর ফোনে হঠাৎ ফোন আসে। তার দাদু ফোনটা ধরে,ওপাশ থেকে একজন বলে,গতকাল ভোর ৩টেয় কাশ্মীরে একটা সেনাবোঝাই গাড়িকে জঙ্গীরা বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়েছে।সেই গাড়িতে পিকলুর বাবা ছিল। কেউ ই আর বেঁচে নেই। আরও বলা হয়,আগামীকাল দেহ বাড়িতে পৌছাঁবে। হঠাৎ এ দুসংবাদে পিকলুর দাদুর স্তব্ধ হয়ে যায়। সম্বিৎ ফেরে কিছুক্ষণ পরে। হাউহাউ কেঁদে উঠে পিকলুর ঠাম্মাকে বলে,'ওগো ,আমাদের প্রমথ যে আর নেই...' খবরটা শোনামাত্র পিকলুর মা অজ্ঞান হয়ে যায়। শাশুড়ি মা চোখে মুখে জল দেয়, বলে'নিজেকে শান্ত করো বৌমা, ছেলেমেয়ে ছোটো'। একমাত্র সন্তানের মৃত‍্যুতে তার ঠাম্মাও শোকে পাথর হয়ে যায়, কিন্তু কাঁদতে পারে না। বিষাদময় আবহাওয়ায় বাড়িটা ভরে থাকে। তার দিদি বাবার জন‍্য কাঁদতে থাকে কিন্তু সে ছোটো অতশত বুঝতে পারে না। শুধু এটুকু বোঝে কিছু একটা হয়েছে, তাই বাবা আসতে পারছে না।

         সময় বয়ে যায়। আজ ষষ্ঠী,দেবীর বোধন শুরু হয়ে গেছে। সকলে নতুন জামা পরে পূজোমন্ডপে যাচ্ছে। কিন্তু পিকলুদের বাড়িতে শোকের ছায়া। আগে সবাই অপেক্ষা করছিল কখন ঘরের ছেলে  ফিরবে। আর আজ তারা অপেক্ষা করছে কখন দেহ আসবে! পিকলু আর তার দিদি বারান্দায় বসে লোকজন দেখে। কারোর মুখে কোনো কথা নেই। তার দিদি মাঝে মাঝে বাবার জন‍্য কেঁদে উঠছে।আর পিকলু ভাবে,বাবা তো আসতে পারছে না কোনোকারণে কিন্তু তার জন‍্য যে জিনিসটা আনবে বলেছিল সেটা কি কিনেছে?ধীরে ধীরে সময় গড়িয়ে যায়। সন্ধ‍্যা হয়,আত্মীয় স্বজন,পাড়া পড়শিরা পিকলুদের বাড়িতে আসতে থাকে। একথা সেকথা বলতে থাকে ।তাদেরকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু স্বজনহারানোর শোক এ সবের ঊর্ধ্বে। চারিদিকে আলো রোশনায়ের মাঝে একটি গাড়ি এসে
       পিকলুদের বাড়ির সামনে দাঁড়ায়। উঠোনে নামানো হয় পিকলুর বাবার কফিনমোড়া দেহ। ফুল দিয়ে সাজানো। পিকলুর দাদু,ঠাম্মি আর মা কান্নায় ভেঙে পড়ে। তার বাবার দেহ নিয়ে আসে একজন অফিসার আর তার বাবার এক সহকর্মী। সেই তাদেরকে জানায়, ছুটিতে বাড়ি আসবে বলে তার বাবা প্রস্তুত ছিল। রাতে একটা ডিউটি ছিল ২ঘন্টার। ডিউটি সেরে সকালে ট্রেন ধরার কথা ছিল। সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু তারা ডিউটি করে ফেরার সময় জঙ্গীরা বোমা মেরে গাড়ি উড়িয়ে দেয়। সকলের দেহ ছিন্নভিন্ন। মোট ১০জন ভারতীয় সেনা প্রাণ হারিয়েছে।
         পিকলুর বাবার সহকর্মী যাবতীয় জিনিসপত্র পিকলুদের হাতে তুলে দেয়। আর সেইসঙ্গে দেয় কাগজে মোড়া একটি প‍্যাকেট। সবাইকে কাঁদতে দেখে আর বাবাকে ঐ অবস্থায় দেখে ছোট পিকলু কিছুটা যেন বুঝতে পারে। সে প‍্যাকেটটা খোলে। দেখে বাবা তার জন‍্য একটা খেলনা কিনেছিল, একটা কাঠের যুদ্ধগাড়ি। যে কোনো গাড়িই তার খুব প্রিয়। পিকলু এই খেলনাটা নিয়ে বাবার মৃতদেহের সামনে যায় আর 'বাবা' বলে ডুকরে কেঁদে ওঠে।।
anirbanghosh3498@gmail.com
নদীয়া

No comments:

Post a Comment