1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, February 21, 2021

ইতিহাস

 

ছবি  : ইন্টারনেট 

ইতিহাস
শুভাশিস পাল

কুয়াশার জালে জড়িয়ে দিনগুলো কেটে যাচ্ছে। হেমন্তের শেষ গোধূলি  মুছে গিয়ে অন্ধকার নামছে রাতের বাতাসে। ছড়িয়ে পড়ছে হিম। দূরে রাস্তার ধোঁয়া ধোঁয়া লাইট গুলো জীবনের সংকেত। সে দিকে চোখ রেখে অবিশ্রান্ত হেঁটে চলা দিনগুলোর কথা ভাবতে থাকে অনিমেষ। সারারাত সেভাবে ঘুম হয়নি। জানালার দিকে চেয়ে রাত গুলো কেটে গেছে। একটা যন্ত্রনা গুমড়ে গুমড়ে খাচ্ছে।

অনিমেষ কেন্দ্রীয় কৃষি প্রযুক্তির প্রধান সচিব। ভালো-মন্দ সব তার হাতে। কিন্তু নামেই। ওপর থেকে যা নির্দেশ আসে তাতেই হ্যাঁ মেলাতে হয় তাকে। তবে এ নিয়ে অনিমেষের কোন মাথাব্যাথা তেমন কিছু ছিল না । মোটা মাইনে তো পেয়ে যায়। এসব নিয়ে কখনো ভাবে নি সে। যা নির্দেশ আসবে তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে । নইলে অযথা ঝুর-ঝামেলা।কে আর হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে।

 স্ত্রী-পুত্র নিয়ে অনিমেষের সংসার। বৃদ্ধ মা ঘরে আছেন অবশ্য কিন্তু তার উপস্থিতি টের পাওয়া যায় না। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে কেমন হয়ে গেছেন। যেন প্রাণহীন এক বস্তু। নাতির সঙ্গে যখন খেলা করেন তখন যা একটু নইলে..

বাবা পরিমল দত্ত ইতিহাসের শিক্ষক ছিলেন। শিক্ষক ছিলেন বললে ঠিক বলা হয়না-- শিক্ষাব্রতী মানুষ ছিলেন। ইতিহাস নিয়ে তার ভাবনার অন্ত ছিল না। বিচিত্র রকম গবেষণা করতেন, বিচিত্র রকম ভাবতেন। মাটির নিচে চাপা পড়ে যাওয়া কাহিনির খাঁজে খাঁজে রসের উৎস খুঁজতেন। ধুলোমাখা অতীতের পাতায় ছিল তাঁর বাঁচার রসদ। বিশেষ করে বৃটিশ বিরোধী বিভিন্ন আন্দোলন তাঁর জিভ থেকে অনর্গল বিচ্ছুরিত হত। অনুশীলন সমিতির কার্যকলাপ, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, বুড়িবালামের যুদ্ধ, কৃষক বিদ্রোহের কথা বলতে বলতে তাঁর চোখ থেকে আগুন ঠিকরে বের হত। ছাত্রদের মধ্যে ইতিহাসের জাল বুনে দেওয়ার চেষ্টা করতেন। আপন পুত্রকেও চেয়েছিলেন ইতিহাসের অমৃত রসে ডুবিয়ে দিতে। ‘আমার ইচ্ছে তুমি ইতিহাস নিয়ে এগোও। বহু কাজ এখনো বাকি আছে ইতিহাসের। এই ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস নতুন করে লিখবে’। ‘ইতিহাস পড়ে কিছু হবেনা বাবা’। ‘কোনো কিছু নিয়ে পড়েই কিছু হবে না যদি না ভালোবাসা যায়। বাংলার গৌরবময় ইতিহাস, ভারতের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ইতিহাস আমাদের বেঁচে থাকার প্রধান রসদ। মানুষকে জানাতে হবে সেই প্রকৃত ইতিহাসের কথা। এই ইতিহাসই মানুষকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করবে। তাদের মেরুদন্ড কে ঋজু রাখবে'।‘ আমি ইতিহাসের মধ্যে কিছু পাই না। হারিয়ে যাওয়া জিনিসের প্রতি আমার আগ্রহ নেই। তাছাড়া আমারও তো একটা ইচ্ছা-অনিচ্ছা আছে। বর্তমান নিয়ে ভাবতে চাই। আমি সাইন্স নিয়ে পড়বো' । আর কোনো কথা বলেননি পরিমল বাবু। কারো উপর নিজের ইচ্ছে জোর করে চাপিয়ে দেবেন এতটা নির্দয় তিনি নন। তিনি ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন। তবুও মন ক্ষুণ্ণ হল। ভেবেছিলেন ছেলে হয়তো তারই মত মানুষের প্রকৃত ইতিহাস চর্চায় আগ্রহী হবে। হল না । চোখের সামনে ভেসে ওঠে বাবা সংগ্রাম বাবুর স্মৃতি।

অনিমেষ কোন দিন আবেগকে প্রশ্রয় দেয় নি। বড় একখানি চাকরি বাগিয়ে নিয়ে সংসার জীবনযাপনকেই একমাত্র পণ করেছে । বাবার ওইসব আদর্শ-টাদর্শ নিয়ে মাথা ঘামানো তার কাছে অরণ্যে রোদন ছিল। দিনরাত এক করে পড়াশোনা করেছে। একটা নেশা যেন পেয়ে পেয়ে বসেছিল তাকে । শুধু একটু আধটু ভ্রমণের ইচ্ছে প্রবৃত্তিকে তাড়না দিত। এরই মাঝে জীবনে আসে রিনিতা। আৰ্থিক মেরুদন্ড সোজা করার পর বিসমিল্লাহ খানের সুর বেজে উঠতে দেরি হয় নি।

কয়েকদিন হল  অনিমেষকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে একটা বিষয় । সেভাবে পাত্তা না দিলেও স্বেচ্ছাচারিতা, দলিতদের উপর নির্মম আক্রমণ এসব বিষয় বোঝে না এতটা আহাম্মক সে নয়। কৃষকদের বুক চেতানো আন্দোলন অনিমেষ কে নাড়া দিয়েছে। অতীত যে মানুষকে স্পর্শ করেনা বর্তমান তাকে আন্দোলিত করে। বাবার কাছে যা শুনেছে সে সবই তার কাছে ছবির মতো। এখন তার চোখের সামনে সব। সব থেকে বড় কথা এটা তারই ডিপার্টমেন্টের ব্যাপার। কোথাও যেন বড় একটা ভুল হয়ে যাচ্ছে।

 জানালার দিকে অনিঃশেষ চেয়ে থাকে অনিমেষ । জ্যোৎস্নার বাঁকা স্রোত নেমে আসছে পৃথিবীতে। ন্যাড়া শিমুল গাছটাও জ্যোৎস্নার স্রোতে শেষ গা ধুয়ে নিচ্ছে। এভাবেই কি শেষ হয়ে যাবে সব? সোনা রোদ, ক্ষেত ভরা ফসল, স্নিগ্ধ কাকলি সব!  পৃথিবী কি মানুষের বাসযোগ্য আর থাকবে না? হারিয়ে যাবে অতল গহবরে? রাজনৈতিক হিংসার আগুন কুন্ডলি পাকিয়ে পাকিয়ে উপরে উঠছে। ছেয়ে যাবে আকাশে-বাতাসে।

নূপুরের শব্দে ঘোর ভাঙে অনিমেষের।‘ কি হয়েছে বলোতো তোমার?তোমাকে এতোখানি অস্থির হতে কখনো দেখিনি তো!’ রিনিতার প্রশ্নে হা করে তাকিয়ে থাকে অনিমেষ। দূরে  পেঁচা ডেকে ওঠে। ‘কি হয়েছে জানিনা । তবে মনে হচ্ছে সারা জীবন ভুল করে এলাম'।‘কি যা তা বলছ! কি ভুল করেছ বলবে তো'। ‘কিসের ভুল তোমায় ঠিক বোঝাতে পারবো না। জানো বাবা আমাকে অনেক কথা বলতে চাইত। কখনো শুনতে চায় নি। বাবার ইতিহাস নিয়ে অদ্ভুত আলাপচারিতা বরাবর বাড়াবাড়ি বলেই মনে হয়েছে। বাবার সেই কথা গুলো ‘ বাবা শোন তোকে কতগুলো কথা বলার ছিল। বলব বলব করে বলা হয় নি।তোর ঠাকুরদার সম্পর্কে তুই তো তেমন জানিস না'। ‘ও সব পরে শুনব। আমার এখন কাজ আছে'। ‘কাজ আছে! কিন্তু তোর ঠাকুরদার বিভিন্ন লেখা চিঠিপত্র সব ঐতিহাসিক দলিল… নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে মানুষের জন্য লড়াই….’।

চারদিক নিস্তব্ধ। মলিন পরিবেশে বাইরের কালো অন্ধকার যেন আরো প্রলেপ লাগিয়ে দিচ্ছে। মাঝে মাঝে দু-একটা মোটরের আওয়াজ নিস্তব্ধতাকে খানখান করে ছুটে যাচ্ছে রাতের বুক চিরে। অনিমেষের বুকের মধ্যেও যুদ্ধের দামামা বেজে চলেছে। যে রক্ত এতদিন শীতল নিষ্ক্রিয় ছিল আজ তা টগবগ করে ফুটছে।

তুমি জানো না রিনি কতবড়ো ভুল আমি করেছি। মানুষ হয়ে মানুষের পাশে কখনও দাঁড়ায় নি। দু'দিন আগে বাবার জিনিসপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে বাবাকে লেখা ঠাকুরদার একখানা চিঠি পেয়েছি। তুমি শুনবে শুনবে সেই চিঠি’?দৌড়ে বেরিয়ে চলে যায় অনিমেষ। রিনিতা জোরে নি:শ্বাস ফেলে। তারপর আসতে আসতে চেয়ারে বসে পড়ে। যেন খুব ক্লান্ত। কি যে হয়ে গেল হঠাৎ অনিমেষের সে বুঝে উঠতে পারে না। দূর থেকে হালকা গানের সুর ভেসে আসে।

মা মা তোমার কি হয়েছে? এরকম করে বসে আছো কেন’ ? রোহনের কথায় সম্বিত ফেরে রিনিতার। ‘না কিছু হয়নি বাবা, তোমার পড়া হয়ে গেছে’? ‘হ্যাঁ আমি সব পড়ে নিয়েছি'। ‘আচ্ছা, সোনা ছেলে আমার'। কাছে টেনে গালে একটা চুমু খায়। ‘তুমিওই ঘরে গিয়ে ঠাকুমার সাথে খেলা করো একটু আমি আসছি'

রোহন চলে যায়। ঘরে আবার একরাশ নিস্তব্ধতা খেলা করে চলে। তবে বেশিক্ষণ নয়। হুড়মুড় করে হাতে একটা কাগজ নিয়ে অনিমেষ ঢোকে। চুল গুলো উস্কখুস্ক। কোন না কোন কথা না বলে চিঠি পড়তে শুরু করে—

স্নেহের

পরিমল

তোমাকে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার জন্য এই চিঠি লিখছি। কারণ আর সময় নেই। এই চিঠি যখন পাবে তখন হয়তো আমি ‘মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে জীবনের সকল দেনা শোধ করে দিতে' ইহলোকের পারে বিশ্রাম নিচ্ছি।

সংসার চালাতে গিয়ে আমাকে ব্রিটিশের পদচাটা চাকরি করতে হয়েছে। কোনো দিন মন থেকে মেনে নিতে পারিনি। তবে তাবেদারি করিনি। তবু অনেক জায়গায় আপোষ করেছি। কোন উপায় ছিল না। কিন্তু আজ সময় এসেছে। ভারতের আকাশ-বাতাস আজ রক্ত চাইছে। বলিদান চাইছে । সেই রক্তেই ভারতাত্মার বেদী ধৌত হবে। বিন্দু বিন্দু অত্যাচার পুঞ্জিভূত হয়ে আসমুদ্রহিমাচল ব্যপ্ত।

মাটির সন্তান কৃষকেরা নিপীড়িত হতে হতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে হাতে । লাঙলের ফলা আজ রক্তের তৃষ্ণায় কাতর । তোমার দাদুও ভাগচাষি ছিলেন। আজ অনেক কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে হাত ধরে মাঠে যেতাম ভোরে। সকালের সোনার আলোয় সবুজ ধানে হাত বুলিয়েছি কত! ওরাও আমাদের সন্তান। তারপর পড়াশোনা করে চাকরি পেয়েছি বটে ব্রিটিশ শাসনের শুরু থেকে ভাগচাষিদের ওপর নিপীড়ন অত্যাচারের কথা ভুলতে পারিনি। আজ বাবা নেই। কিন্তু জানি বাবা দেখছে। এই তেভাগা আন্দোলনে আমি আবার সেই ছোটোবেলাকে ফিরিয়ে নিয়েছি। হাতের লাঙল আজ সন্তানপ্রসূ নয়, জীবন সংহারক। এটাই ভবিতব্য। এটাই মানুষের ইতিহাস । আমার জন্য চোখের জল ফেল না। চোখে আগুন রেখ। বারবার এ আগুনের প্রয়োজন হবে। কালের নিয়মে আবার হয়তো মানুষকে কোনোদিন ঐক্যবদ্ধ  হতে  হবে। এরকম কোন কৃষক বিদ্রোহের প্রয়োজন হবে। এই ইতিহাসই মানুষকে জাগিয়ে তুলবে। বারবার তুলেছে।  মানুষের পাশে মানুষ হয়ে থেকো। আশীর্বাদ নিও।

আমি পারিনি মানুষের পাশে দাঁড়াতে  রিনি। এদের বংশধর হয়ে কলঙ্ক লেপন করেছি।  চিরকাল আপোষ করে এসেছি। কিন্তু আর নয়। এবার উঠে দাঁড়াতে হবে।

আবার জানালার দিকে চোখ ফেরায় অনিমেষ। রাত নামে। বাইরে কুয়াশার মধ্যেও স্ট্রিট লাইট আপন চেতনা জানান দেয়। আপন মনে বিড়বিড় করে অনিমেষ বলে চলে ‘ ইতিহাস দিয়েই তৈরি হবে ইতিহাস’।


subhasishpal56@gmail.com


No comments:

Post a Comment