1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Sunday, February 21, 2021

বিভুর অসুখ

ছবি  : ইন্টারনেট 

 বিভুর অসুখ
শুভঙ্কর দে 

          বাউলের আসর বসেছে গ্রামে। গানের সুরে ভেসে আসছে 'এমন মানব জনম আর কি হবে...'। গাঁয়ের পথ যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে মিশেছে রূপালী নদী। নদীর জল রূপোর মতো দেখতে লাগে বলে গাঁয়ের মানুষ 'রূপালী নদী' বলে ডাকে। মোহরপুর গ্রামে বেশিরভাগ ঘরের মাথায় খড়ের ছাউনি, মাটির দেয়াল। কিছু মাটির বাড়ির দেয়ালে সুন্দর সুন্দর নকশা আঁকা আছে। কিন্তু কয়েকটি দেয়ালে ঘাসফুল ও পদ্মফুলের ছবি আঁকা। এইসব বাড়ির দেয়ালগুলোয় বাড়ির লোকেরা ছবি আঁকলেও তার উপর চুনের প্রলেপ দিয়ে পার্টির কিছু ছেলে নিজ নিজ পার্টির প্রতীক এঁকে দিয়ে চলে যায়। ছবির পাশে ও নীচে লেখা থাকে 'এবারের ভোট এই চিহ্নে দিন/ এই চিহ্নে ভোট দিন/ আমরা মানুষের পাশে আছি'... 
গাঁয়ের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীতে বর্ষায় থৈ থৈ করে জল। শীতের সময় চর পড়ে। এখন শরতের সময় নদীর জল কমে এসেছে। সেই নদীর জলে প্রতিদিন চান করতে আসে সজল। আজ তার সাত বছরের ছেলেও বায়না ধরেছিল বাবার সঙ্গে নদীতে যাবে। বাড়ি থেকে একা তাকে যেতে দেওয়া হয়না বলে বাবার সঙ্গে আসে মাঝে মাঝে। পাড়ে বসে বসে অনেকক্ষণ ধরে নদীর জলে ঢিল ছুঁড়তে ছুঁড়তে আর যখন ভালো লাগছে না, এদিকে পাড়াতে খেলার সঙ্গীরা এতক্ষণে খেলা শুরু করে দিয়েছে, তখন অধৈর্য হয়ে বলে, “বাবা, এবার বাড়ি চলো। আর কত চান করবে?” তার বাবা গামছা দিয়ে ভিজে গা মুছতে মুছতে বলে, “এই তো বেটা হয়ে গেছে”। গা মুছে কোমরে গামছা পরে ছেলেকে নিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দেয় সজল।  
বাড়ির উঠোনে পা দিতেই দেখে, তার অফিসযাত্রার সঙ্গী কামাল বসে আছে একটা চেয়ারে। 
-সজল তুই প্রতিদিন নদীতে চান করতে যাস কেন বলতো? বাড়িতে বাথরুম আছে। নদীতে গিয়ে রোজ কত দেরি করছিস?
-ঠিক আছে ঠিক আছে। মেলা ফ্যাঁচফ্যাঁচ করিস না। নদীতে চান করার মজা তুই আর কি বুঝিস? বেটা ঘরকুণো। দুদণ্ড বোস, খেয়ে রেডি হয়ে নিচ্ছি। 
কামাল হল সজলের অফিসের কলিগ। এই গ্রাম থেকে তারা দুজনই শহরের পঞ্চায়েত অফিসে চাকরি করে। কিছুদিন হল কামাল একটা মোটর বাইক কিনেছে। আগে দুজনেই সাইকেল নিয়ে অফিসে যেত। গাড়ি কেনার পর সজল তার গাড়িতেই যায়। মাসে অবশ্য অর্ধেক পেট্রলের দাম দেয় সজল। এই বাজারে সবকিছুর যা দাম, মাগনায় কোথাও কিছু পাওয়া যায়না সে কথা সজলের অজানা নয়। অফিস যাবার আগে ছেলেকে বলে যায়, “মায়ের কাছে থাকবি। মা যেন কষ্ট করে তোকে ডাকতে না যায়”। 
        ছেলে সে কথা শুনলে হয়। বাবা অফিস চলে গেলেই একছুটে পাড়ার ছেলেদের দলে গিয়ে যোগ দেয়। এদিকে তার মা আট মাসের গর্ভবতী, ভারি পেট নিয়ে ঠিককরে নড়াচড়া করতে পারে না। কাজের লোক একজন আছে বটে কিন্তু সে ঐ কাকভোরে এসে ঘর দুয়ার মুছে, থালা বাসন ধুয়ে চলে যায়। তারপর বাড়ির সব কাজই ঐ পোয়াতি বউকেই করতে হয়। বিয়ের পর থেকে শ্বশুর-শাশুড়ীকে পায়নি। বরের মুখে শোনা কথা শ্বশুর-শাশুড়ীর গল্প। নিশিপুর গ্রামের গল্প। সেখান থেকে সজলের কলকাতায় পড়াশোনা, চাকরি সূত্রে এই গ্রামে আসা। তার জীবনে ঘুরে ফিরে গ্রাম ঠিক চলে আসে। নয়তো দিব্যি তো শহরে চাকরি করছিল, ঘর ভাড়া করে বৌকে নিয়ে থাকছিল, এভাবে এই মোহরপুর গ্রামে ট্র্যান্সফার করে দেবে তা কি আর ভেবেছিল। অবশ্য দুমাস হল আবার গ্রাম থেকে কাছের একটা শহরে পোস্টিং হয়েছে। কিন্তু এবারে পোয়াতি বৌকে নিয়ে আর এখানে ওখানে করবে না বলে গ্রামের বাড়িতেই রেখেছে। হাসপাতালে ভর্তির সময় এলে তখনই একেবারে নিয়ে যাবে। গ্রামের সতেজ হাওয়া, সবুজ সবজি শরীরের পক্ষে ভালো। তাই গ্রাম থেকেই প্রতিদিন সবজি কিনে আনে সজল। আজও কিনে এনেছে। কিন্তু সেই সবজি কাটবার জন্য ছেলেকে সেগুলো কাছে এনে দেবার জন্য ডাক দেয়— ‘বিভু’। ছেলের কোনো পাত্তা নেই। সে এতক্ষণে পাড়ার মোরবতলায় শিবু, ঋজু, কেষ্ট, বামা, ছোটুর সঙ্গে খেলা জুড়ে দিয়েছে। আজ তাদের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা। শিবুর আছে কাঠের তৈরি একখানা হাতে টানা গাড়ি। সেই গাড়িতে চেপে শত্রুপক্ষকে গুলি করতে যাবে বামা, শিবু ও বিভু। কিন্তু সেই গাড়িতে কে চেপে বসবে আর কে টানবে এই নিয়ে গোলযোগ বেঁধেছে। বামা সেই গাড়িতে চেপে বসবে বলে ঝোঁক ধরে থাকে। কিন্তু শিবু তার গাড়িতে নিজে চাপবে বলে বামাকে চাপতে দেয়না, বামাও নাছোড়বান্দা হয়ে গাড়িতে চেপে বসে থাকে। বিভু বরাবর শান্ত ছেলে। এই ঝামেলা দেখে বলে, “ঠিক আছে তোরা দুজনেই বোস, আমি গাড়ি টানবো”। শিবু বিভুকে থামিয়ে দিয়ে বলে, “কেন? তুই সবসময় টানবি কেন? আজ বামনাটাই টানবে গাড়ি। তুই আর আমি বসবো”। শেষমেশ বামা শিবুর সঙ্গে না পেরে গাড়ি টানতে রাজি হয়। কিন্তু সে দুজনকে টানতে পারবে না। তাই বিভু গাড়িতে চড়ে না। সে শিবুর পিঠ দিয়ে ঠেলা দেবে বলে পেছনে পেছনে দৌড়ায়। এদিকে বামা নিজে গাড়িতে চড়তে না পারায় মাথার মধ্যে দুষ্টু বুদ্ধি খাটায়। ঢালাই করা সমান রাস্তা দিয়ে টানতে টানতে হঠাৎ গায়ের জোর দিয়ে সেই রাস্তা থেমে গাড়ি নামিয়ে এবড়ো খেবড়ো মাটির রাস্তার ওপর দিয়ে দড়ি ধরে টানতে টানতে নিয়ে চলে। শিবু ভয় পেয়ে যত থামতে বলে, বামা তত জোরে টেনে দৌড়ায়। এদিকে বিভুও অনেক পেছনে পড়ে গেছে। সে যে আটকাবে তার উপায় নেই। এমন সময় গাড়ির দড়ি গেল ছিঁড়ে, আর একটা চাকা গাড়ি থেকে ছিটকে গড়াতে গড়াতে গিয়ে পড়লো পাশের ডোবায়, শিবু ছেঁচড়ে গিয়ে পড়লো একটা গাছের গোড়ায়। এমন কাণ্ড দেখে শত্রুপক্ষের ঋজু, ছোটুরাও ততক্ষণে ব্যাপারটা বোঝার জন্য খেলার জায়গা থেকে দৌড় লাগিয়ে হাজির হয়েছে। শিবুর হাঁটু থেকে তখন রক্ত ঝরছে। সেদিকে না তাকিয়েই, মাটি থেকে উঠে বামাকে এক ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে পাগলের মতো হাত-পা ছুঁড়ে মারতে শুরু করে শিবু। বাকিরা তাকে ছাড়াবার চেষ্টা করলেও জোঁকের মতো এঁটে সে মারতেই থাকে। মারামারি দেখে পাড়ার নন্দদা ছুটে এসে থামায়। সেসময় মঞ্জু দূর থেকে ‘এই বিভু। বিভুউ’ বলে ডাক দেয়। ডাক শুনে বিভু সাড়া দিলে মঞ্জু বলে, “তাতাড়ি ঘর যা। তুর মা...”। ‘মা’ শব্দ শুনেই সেখান থেকে এক দৌড়ে ঘরে গিয়ে ভয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করে, “কী হয়েছে মা?”
তার মা ধমকে বলে, “কার সঙ্গে মারপিট করছিলি? আসুক তোর বাবা আজ। সারাদিন টো টো করে খেলা করে বেড়ানো। ঘরে মন বসে না, না? কোনো কাজে তো পাবো না। পড়াশোনা ডকে তুলে গুণ্ডাদের মতো মারামারি করা শিখেছো। এখুনি কলতলায় গিয়ে চান করে ফ্রেশ হয়ে পড়তে বোস। তাপ্পর তোর বাবা আসুক আজ...”
মায়ের একনাগাড়ে বলে যাওয়া কথার মাঝে সে যে কিছু বলবে, মারামারি গুণ্ডাগিরি সে করেনি, কিন্তু সেই সাহস আর কুলালো না। তাই কলতলায় গিয়ে চান করা শুরু করলো। ফ্রেশ হয়ে বইপত্র নিয়ে বসার পর পাঁচমিনিটও হয়নি, মাথায় হাত দিয়ে মুখ কাঁচুমাচু করে মাকে বলে, “মা, মাথায় লাগছে। একটু ঘুমাবো? তুমি দেখো সন্ধ্যায় আজ সব পড়া মুখস্থ করে নেবো”। রোজ রোজ ছেলের এই এক কথা শুনতে শুনতে মায়ের কান সয়ে গেছে। পড়তে বসলে শরীরে যত অসুখ এসে জড়ো হয়। ছেলের এই কীর্তিকলাপে তাই আর কিছু বলে না। মুখ বুজে কাপড় সেলাই করে যায়। মনে মনে ঠিক করে রাখে সন্ধ্যায় বর ফিরলে আজ এর একটা হেস্তনেস্ত করে ছাড়বে। বিভু ততক্ষণে বইয়ের উপর মাথা রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছে। 
সন্ধ্যায় সজল বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে চা খাচ্ছে। ছেলে বিকেলে আরো একদান খেলে এসে হাত-মুখ ধুয়ে পড়ার ব্যাগ নিয়ে বসেছে। ব্যাগ খুলে বই বের করতে তার আলসেমি লাগছে না ভয় তা মুখ দেখে বোঝা যায় না। ছেলের এই অবস্থা দেখে তার মা চেঁচিয়ে বলে, “এখনও বই বের করিসনি?” ছেলেকে ছেড়ে এবার বরকে বলে, “আমি রোজ রোজ তোমার ছেলের এসব ন্যাকামো সয়তে পারিনাকো। এবার নিজে ওকে পড়াবে। সারাদিন রাখালের মতো টো টো করে ঘুরে বেড়াবে, জলা জঙ্গলে খেলে এসে পড়ার সময় যত রোগ। সামলাও নিজের ছেলেকে...”
সজল চা খাওয়া শেষ করে ছেলের কাছে গিয়ে বসে। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে পড়ানো শুরু করে। মাঝে মাঝে বলে, “ভালো করে না পড়লে বড়ো হবেনা বেটা। এবার শহরে গিয়ে বড়ো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করবো তোমাকে। সেখানে চান্স পেতে গেলে যে এখন থেকে অনেক পড়াশোনা করতে হবে”। বাবার এসব কথা শুনতে শুনতেই তার মাথার মধ্যে ঢিপ ঢিপ করে ব্যথা শুরু হয়। এবার আর বাবার ভয়ে সেকথা বলতে পারেনা। সারাদিন ছোটাছুটি করলে সন্ধ্যায় মাথা ব্যথা করবেই একথা মায়ের কাছে শুনতেই হয়। তাই বাবার সঙ্গে পড়তে বসলে মাথা ব্যথার কথা সে আর বলেনা। এদিকে দিন দিন যেন তার মাথা-ব্যথা বাড়তে থাকে।
সাতমাস পরের কথা। গ্রাম থেকে তল্পিতল্পা ঘুটিয়ে সজল বৌ ও দুই ছেলে মেয়েকে নিয়ে এখন শহরে ঘর ভাড়া করে থাকে। পাঁচমাস হয়ে গেল তার মেয়ে হয়েছে। সারাদিন এখন মেয়েকে নিয়েই মা ব্যস্ত থাকে। সজলেরও অফিসে কাজ বেড়েছে। রাত করে বাড়ি ফিরতে হয়। ছেলে বিভুকে নামজাদা ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তি করে দিয়েছে। বিভু সেই সকাল সাতটাই গাড়ি করে স্কুলে যায়। বিকেল পাঁচটার পরে বাড়ি ফেরে। খেলাধূলা, পড়াশোনা, খাওয়া দাওয়া সব স্কুলেই হয়। স্কুল থেকে দায়িত্ব নেওয়া হয়েছে ছেলেমেয়েদের সারাদিন ধরে এমন পড়ানো হবে যে আলাদা করে আর বাড়িতে টিউশনের দরকার পড়বে না। বাড়িতে বেশি পড়তেও হবে না। সেইমতো এখন ছেলেও সন্ধ্যায় ধুঁকতে ধুঁকতে বাড়ি ফিরে । মাথার যন্ত্রণা তার আগের থেকে যেন অনেকগুণ বেড়ে গেছে। বাড়িতে বললেও স্কুলে সারাদিন কাটানো, পড়ার চাপে হচ্ছে বলে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। একদিন স্কুলে ক্লাস চলাকালীন স্যারের চোখে পড়লো বিভু দরদর করে ঘামছে, আর মুখচোখে যন্ত্রণার ছাপ ফুটে উঠেছে। পড়া থামিয়ে বিভুকে জিজ্ঞেস করে, “কী হয়েছে? এনি প্রবলেম?” বিভু না সূচক মাথা নাড়লেও স্যার ওখান থেকে বেরিয়ে আসতে বলেন তাকে। বিভু বেরিয়ে এলে তাকে দেখে সুস্থ বলে মনে না হওয়ায় বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বাসের মধ্যে মাথার যন্ত্রণায় চিৎকার করতে থাকে। ছেলের এমন অবস্থা শুনে ও স্কুলের প্রিন্সিপালের মেইল পেয়ে দেখা করে সজল প্রিন্সিপালের সঙ্গে। প্রিন্সিপাল জানান যে, ইমিডিয়েটলি ডাক্তার দেখানো জরুরী তার ছেলেকে। এবার বাবা-মায়ের টনক নড়ে। পরেরদিনই ডাক্তার দেখায়। রিপোর্ট আসতে দুদিন দেরি হবে। এখন ছেলের উপর চাপ দেওয়া বন্ধ করেছে। আপাতত স্কুলে যাওয়াও বন্ধ। সারাদিন বাড়িতেই থাকে। খাওয়া-দাওয়া করেই না। সারাক্ষণ মাথাব্যথা করতে থাকে। 
দুদিন পর সন্ধ্যায় সজল রিপোর্ট নিয়ে বাড়ি ফেরে। তাকে দেখে মনে হয় মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। বৌ বেশ কয়েকবার জিজ্ঞাসা করার পর সজল বলে, “ডাক্তার বললেন, প্রথম দিকে যখন প্রায়ই বলতো মাথা ব্যথার কথা তখনই ডাক্তার দেখানো উচিত ছিল। সব ব্যথা পড়ার অজুহাত হয়না সেটা ছোটো ছেলেমেয়েদের মা-বাবাকে বুঝতে হবে। আজ না বুঝে এড়িয়ে গেছি বলে বিভুর মাথার টিউমারটা আজ অনেক বেড়ে গেছে...” বলতে বলতে বৌয়ের কোলে মুখ রেখে কান্নায় ভেঙে পড়ে সজল।  

subhankardey27@gmail.com
পশ্চিম বর্ধমান 



No comments:

Post a Comment