1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, March 31, 2021

প্রেত নিবাস

 

ছবি  : ইন্টারনেট 
প্রেত নিবাস
রতন চক্রবর্তী

এক

বাড়ির সদর দরজায় বড় একটা তালা। সেটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে বিমল।পাশে ভবানি প্রসাদ। বাড়ি বেচার দালাল।

বাড়িটার চার পাশে গাছপালা। তারপর বাউন্ডারি দেয়াল।

বাড়িটা অন্ধকার।কেউ থাকেনা। আশে পাশে আর কোন বাড়ি ঘর নেই। লোক বসতি অনেক দূরে দূরে।চার পাশটা কেমন যেন ছমছমে।

বোকা না হলে কেউ এই সন্ধ্যে বেলায় বাড়ি দেখতে আসে? আসলে বিমল নিজেকে বোকাই মনে করে। ব্যবসায়িক একটা কাজে এখানে এসেছিলো সে।লোকটার সাথে,অর্থাৎ ভবানি প্রসাদের সাথে ওর দেখা একটা ভাতের হোটেলে।

মাসিমার হোটেল।

লোকটা ওর সাথে একই টেবিলে বসে মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খাচ্ছিল।কিছুক্ষনের মধ্যে ভাব জমিয়ে ফেলল লোকটা বিমলের সাথে।

ভবানি প্রসাদের সাথে কথায় কথায় সে বলেছিল,এই এলাকাটা তার পছন্দ।সে এখানটায় একটা বাড়ি করতে চায়। ব্যস্,পেয়ে বসল ভবানি প্রসাদ। নিজের পরিচয় দিল, বাড়ি কেনা বেচার দালাল বলে।

বলল,তার জানা একটা বাড়ির খোঁজ আছে। তাকে এখনই নিয়ে যেতে পারে সে।ইচ্ছে করলেই এ বেলা বাড়ি ফিরতে পারবে না সে।রাত হতেও দেরি। সময়টা তো কাটতে হবে?  বিমল রাজি হয়ে গেল। দু'জর মিলে একটা অটো রিক্সা ভাড়া নিলো।

কিন্তু বিমল তখনো জানতো না,ভবানি বেটা তাকে এত দূর নিয়ে আসবে যে আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে।

দুই

অন্ধকার বাড়ির বারান্দায় বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রাগে গজগজ করতে লাগল বিমল,

এ আপনি কোথায় নিয়ে এলেন ভবানি বাবু,রাত করে কী বাড়ি দেখবো আমি এ অন্ধকারে?

ভবানি প্রসাদ লোকটা বিমলের হাতে একটা টর্চ ধরিয়ে দিলো।বলল,নিন টর্চটা ধরুন তালা বরাবর।এসেই যখন পড়েছেন দেখেই যান।

ভবানি বেটা তালা খুলে দরজায় একটা ধাক্কা দিলো। ক্যাচ কোচ শব্দে দরজাটা খোলে যেতেই ঘরের ভেতর থেকে ধেয়ে আসা একটা শীতল হাওয়া বিমলকে কাঁপিয়ে দিল।গা টা কাঁটা দিয়ে ওঠল ওর।

ভেতরে পা রাখতেই আবার ও কেঁপে ওঠল বিমল।

পেছনে ধাম করে শব্দ হতেই ভীষন ভাবে চমকে ওঠে পেছন ফিরল সে।কিন্তু কিছুই দেখতে পেলনা। শুধু অন্ধকার ছাড়া।

এটা কী হল, ভবানি বাবু? গলা চড়িয়ে জিজ্ঞেস করল সে দাদাল লোকটাকে।

কিন্তু কোন জবাব পেল না।আবার ডাকল লোকটার নাম ধরে। তারপর আবার। কোন জবাব নেই!

তিন

ভয় পেল বিমল। ভীষন ভয়। এক ছুটে বেরিয়ে যাবার জন্য দৌড় দিল সে দরজা আন্দাজ করে।

প্রচন্ড এক ধাক্কা খেল সে বন্ধ দরজার সাথে। উল্টে পড়ে গেল।মাথায় আর শরীরে জোর ব্যথা পেয়েছে। মাথাটা ঘুরছে ওর। এবার বুঝতে পারল বিমল,ওটা তাহলে দরজা বন্ধ হবার আওয়াজ ছিল!

টর্চটা ভবানি বাবুকে ফিরিয়ে দেয়া উচিৎ হয়নি ওর। লোকটা গেল কোথায়? পকেট হাতড়ে ম্যাচ লাইটারটা বের করল বিমল। জ্বেলে দিল ওটা।

ভুতুড়ে  আলোয় ঘরটা দেখল বিমল। দেয়াল গুলো মলিন।মাকড়সার ঝুল, চামচিকের বিষ্ঠায় ভরা মেঝে।

কিন্তু ঘরে দালালটা নেই।

হঠাৎ দেয়ালের দিকে আবার চোখ গেল ওর।একটা বড় পোট্রেট। অপরূপ এক নারীর ছবি।

মনে হচ্ছে জ্বল জ্বল চোখে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।

হঠাৎ করেই বিমলের মনে হল, ছবির মেয়েটা যেন ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে।

বিমূঢ় হয়ে হাতের আলোটা নিভিয়ে ধপ করে ধুলোময় মেঝেতে বসে পড়ল বিমল।

এ আমি কিসের পাল্লায় পড়লাম! ভাবছে সে।

চার

অনেক ক্ষন পর ওঠে দাঁড়িয়ে সে দরজাটা ধরে টানা টানি আর ধাক্কাধাক্কি করল। কোন লাভ হল না।

ভবানি প্রসাদ বেটাকে ডাকাডাকি করল কিছুক্ষন। কোন সাড়া পেলনা।

হঠাৎ,বিমলকে চমকে দিয়ে কোন এক নারী কন্ঠের খিলখিল হাসিতে ভরে ওঠল ঘরটা!সেই হাসিতে গমগম করছে ঘরটা।

হঠাৎ, যেমন শুরু হয়েছিল,তেমনি হঠাৎই থেমে গেল।কিন্তু সে রেশ রয়ে গেল অনেক্ষন।

তারপর, সহসা ঘরটায় ধপ্ করে আলো জ্বলে উঠল। বিশাল বিশাল চারটে মোম বাতি।ঘরের চার কোনে।ধ্বক্ ধ্বক্ করে জ্বলছে।এক নিমিষে ঘরের আঁধার দূর হয়ে গেল।

বিমল ঘরটা ভাল করে দেখার প্রয়াস পেল।এটা একটা বসার ঘর। ঘরের মাঝ খানটায় গদি আটা কতগুলো চেয়ার। চেয়ার গুলোর মাঝখানে একটা বড় টেবিল।তাতে ফল ফলাদি আর পানিয়।

বিমলের মনে হল সে যেন হঠাৎ করে কোন মধ্য যুগের জমিদারের বসার ঘরে ঢুকে পরেছে।

সহসা, তার চোখ গেল তার ডান পাশের দেয়ালটার দিকে। আরো একটা ছবি।গ্রুপ ছবি।

পাঁচ জনের ছবি।ছবিটা ভাল করে দেখার জন্য বিমল এগিয়ে গেল। সবচেয়ে বাঁ দিকের ছবিটায়

চোখ যেতেই চমকে গেল সে।

লোকটাকে সে চেনে।ভাল করে চেনে।ভবানি প্রসাদ! মধ্য যুগের একটা ছবিতে ভবানি প্রসাদ!

বুকটা কেঁপে উঠল বিমলের।বাড়ি বেচার দালাল ভবানি প্রসাদ মানুষ তো? নাকি - - -।

পাঁচ

না,ভবানি কোন বাড়ি বেচার দালাল নয়।একজন মানুষ শিকারি নয়তো!এ বাড়ি কোন প্রেত নিবাস নয়তো!

অনেক গুলো প্রশ্ন মনে ভিড় করছে বিমলের।এখান থেকে বের হতে পারবে তো সে? ভবানি লোকটা কার জন্য রেখে গেছে ওকে? সেকি কোন পিশাচের শিকার?

হঠাৎ তার মনে হল, কে যেন বারান্দায় হাঁটছে।মনে সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে গেল সামনের একটা বড় দরজা দেখে। ধাক্কা দিতেই খুলে গেল দরজাটা।

একটা টানা বারান্দা।দু পাশে দেয়াল।দেয়ালে আটকানো ছোট ছোট মশাল জ্বলছে ধ্বক ধ্বক করে।বারান্দাটাও আলোকিত।বারান্দার শেষ মাথায় আরো একটা দরজা।

মন্ত্র মুগ্ধের মত সে দিকে এগিয়ে গেল বিমল। দরজাটার সামনে দাঁড়ালো সে।

হাত দিয়ে হালকা ধাক্কা দিতেই ক্যাঁচ কোঁচ শব্দে খুলে গেল ওটা।ঘরটার ভেতর পা রাখল বিমল।

এই ঘরেও বসার ঘরের মত চার কোনে চারটে দানবিয় মোম জ্বলছে। আসবাব শুন্য ঘরটার মাঝখানে একটা দোলনা ঝুলছে ছাদ থেকে।

ছয়

মোমের লাল আলোয় দোলনাটাকে কেমন যেন রক্তাভ লাগছে।শুন্য দোলনাটা শুধু শুধুই এদিক ওদিক দোল খাচ্ছে।মনে হচ্ছে কোন অদৃশ্য কেউ ওটাকে দোলাচ্ছে।

বুকের ভেতরটা ধুপ ধাপ করছে বিমলের।হঠাৎ ঘরের মোম গুলো নিভু নিভু হয়ে গেল।একটা ভুতুড়ে আলো আধাঁরি খেলা করতে লাগল ঘরটায়।তারপর বিমলকে চমকে দিয়ে ধপ্ করে ঘরের সব ক'টা আলো নিভে গেল!

বিমূঢ় বিমল বোকার মত দাঁড়িয়ে থাকল।

তারপর আবার কথা নেই বার্তা নেই ধ্বক করে  জ্বলে উঠল মোম গুলো।

দোলনাটার দিকে চোখ যেতেই বুকের রক্ত ছলকে ঊঠল ওর।এতক্ষন যে দোলনাটা শুন্য ছিল, এখন সেটাতে কে যেন বসে আছে!

লাল শাড়ি পরা একটা মেয়ে। দু হাটুর ফাঁকে মাথা গুজে বসে আছে। হাত দুটু দিয়ে পায়ের পাতা দুটো ধরে আছে। হাতে লাল চুড়ি। নখে লাল নেইল পলিস।

আস্তে আস্তে দোলনায় দোল খাচ্ছে মেয়েটা।তারপর বিস্মিত বিমলের চোখের সামনে মেয়েটা ধীরে ধীরে দোলনা থেকে নেমে এল।মাথাটা আস্তে আস্তে তোলে তাকাল বিমলের দিকে।

সাথে সাথে বুকের ভেতরটা ধ্বক করে উঠল বিমলের। ভয়ের একটা শীতল স্রোত নেমে গেল ওর মেরুদন্ড বেয়ে। ছবির সে মেয়েটা!

ভয়ঙ্কর চোখে বিমলের দিকে তাকাল মেয়েটা।ওর চোখ দুটো আগুনের ভাটার মত জ্বলছে।

হঠাৎ মেয়েটার ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়ে গেল।সুঁচালো দুটো সাদা দাঁত দেখা যাচ্ছে সেখানে।ঠিক সে সময় বিমলের পেছনের দরজাটা ধড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল।

আর তখনই বিমলের দিকে ধির পায়ে এগিয়ে আসতে লাগল মেয়েটা।

বিমল বুঝতে পারল,ভবানি ওকে এই পিশাচির জন্যই কৌশলে ধরে এনেছে। এর হাত থেকে বাঁচার কোন উপায় দেখতে পেলনা সে।

পরিশিষ্টঃ মাসিমার ভাতের হোটেলে এসে বসল একটা লোক।ভাত আর মুরগির ঝোল অর্ডার করল সে।ঠিক তখনই তার সামনের চেয়ারে এসে বসল বাড়ি কেনা বেচার দালাল ভবানি প্রসাদ।

chakratan73@gmail.com
কলকাতা


No comments:

Post a Comment