1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Wednesday, March 31, 2021

মাতৃত্ব

 

ছবি  : ইন্টারনেট 
মাতৃত্ব
রাজশ্রী দে

শীতের সকাল , এক কাপ কফি নিয়ে  ব‍্যালকনিতে বসেছে বিপাশা। আজ রোববার , ছুটির দিন, সুন্দর সকালের আরামটুকু উপভোগ করছে বিপাশা। পাঁচতলার এই ফ্ল্যাটের ব‍্যালকনিটা বড্ডো প্রিয় বিপাশার। প্রানভরে আকাশ দেখা যায়।  আজ আকাশ ঝকঝকে নীল, নীচে চোখ গেলে দেখা যায়  সবুজ গালিচা পাতা লন, তার পাশে পাশে কতরকমের ফুলের গাছ। মনের মতো করে সাজিয়েছে এই দুকামরার ফ্ল্যাটটাকে বিপাশা।  আজকের দিনটা একটা বিশেষ দিন, বিপাশা আর অরীনের বিয়ের দিন। তাই পুরোনো কথাগুলো মোড়ক খুলে বেড়িয়ে আসছে।মুম্বাইয়ে এম.বি.এ পড়তে গিয়ে আলাপ অরীনের সঙ্গে। তারপর দুজনেই সেটেলড্ হওয়ার পর বিয়ে। মা  থাকতেন কলকাতায়,  বাবা বিপাশার ছোটবেলাতেই মারা যান।বিপাশার ছোটবেলাটা কেটেছে মা, দাদু , ঠাম্মার সঙ্গে।

অরীন দীর্ঘদিন মুম্বাইয়ে, প্রবাসী বাঙালি ওরা। বেশ ধূমধাম করে বিয়ে হয়েছিল তাদের।

মুম্বাইয়ে  ভালোই কাটছিল  বিপাশার ,  শ্বশুর, শাশুড়িকে নিয়ে তাদের চারজনের সংসার।অমায়িক শ্বশুর শাশুড়ি ।  বিয়ের ঠিক তিন বছর পর হঠাৎ করেই অরীন সেটেলড্ হতে  চাইলো দেশের বাইরে।অরীনের কথা শুনে মনে হলো ও অনেক আগে থেকেই পরিকল্পনা করে রেখেছে। তখন বিপাশা প্রেগনেন্ট। তাছাড়া বিপাশার মত নেই দেশ ছেড়ে যাওয়ার।  একটা ম‍্যাল্টিন‍্যাশনাল কোম্পানির উচ্চপদে আছে বিপাশা। কোনমতেই  সব দায়িত্ব ছেড়ে কোনদিনই বিপাশা বিদেশে সেটেলড্ করতে পারবে না, জানিয়ে দেয় অরীনকে।শ্বশুর , শাশুড়ি, মাকে ছেড়ে কেমন করে যাবে বিপাশা।

তার কিছুদিন পর  অরীন চলে যায় কানাডা। মেয়ে হিয়া হওয়ার এক বছর পর ডির্ভোস হয় তাদের।ডির্ভোস হয়ে যাওয়ার পর কলকাতায় ট্রান্সফার হয়ে যায় বিপাশার। কলকাতায় ফ্ল্যাট কিনে মেয়েকে নিয়ে চলে আসে বিপাশা। কিন্তু শ্বশুর বাড়িতে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলে । মাঝেমধ্যে মুম্বাইয়ে মেয়েকে নিয়ে  যায়  শ্বশুর বাড়িতে। বিপাশার মা আজ আর নেই। কলকাতার সেই বাড়ি ও বিক্রি করে দিয়েছে বিপাশা।

হিয়ার এখন চার বছর বয়স, সবসময় বকবক করেই চলেছে। আজ স্কুল ছুটি বলে এখনও অঘোরে ঘুমোচ্ছে। একটু পরেই শান্তি মাসী আসবে কাজ করতে, সেই সব করে।রান্না থেকে শুরু করে  হিয়ার  দেখাশোনা, রাতে বাড়ি ফিরে যায়। বিপাশা  ট্যুরে গেলে হিয়াকে  নিয়ে রাতে থেকে যায়  শান্তি মাসী।

বিপাশা এক কথায় সিঙ্গল মাদার। এখন ও পর্যন্ত  সবকিছু ঠিকঠাক সামলে চলেছে।  কিন্তু মানুষের কৌতহলের  শেষ নেই। সামনের ফ্ল্যাটের মিসেস গুরসুরকারের অসীম আগ্ৰহ হিয়ার বাবাকে নিয়ে। কোথায় থাকে , কেন আসে না মেয়ের কাছে এই সব আর কি। ছুটির দিনে কমপ্লেক্সের  মধ্যে পার্কে নিয়ে  যায় বিপাশা হিয়াকে , সেখানেও সেদিন মিসেস সেন আর মিসেস ধর গল্প করতে করতে বললেন হিয়া কি মিস্ করে  ওর বাবা কে , ডিভোর্স হয়ে গেলেও মেয়ের কাছে তো আসা উচিত। বিপাশা বুঝিয়ে পারে না যে হিয়া তার বাবাকে কোনদিন  দেখেইনি তাই বাবাকে মিস্ করার কোন প্রশ্নই আসছে  না। হিয়ার কাছে বিপাশাই সব , একসঙ্গে বাবা মায়ের দায়িত্ব পালন করে চলেছে।

 কলকাতায় এসে স্কুল লাইফের বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে, সকলে পাশে আছে বিপাশার। বন্ধুরা  আছে বলেই এই প্রতিকূলতার মধ্যে ও এগিয়ে চলেছে বিপাশা। বন্ধুর মতো আজ ও পাশে আছেন শ্বশুর শাশুড়ি দূরে থেকেও। তারা ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন না। ডিভোর্সের কয়েক মাসের মধ্যে অরীন ওর ছোটবেলার বান্ধবীকে বিয়ে করেছে শুনেছে বিপাশা। আগে কষ্ট হতো খুব এখন আর কোন প্রতিক্রিয়া হয় না। কষ্টগুলো জমাট বেঁধে মনের কোন এক জায়গায় লুকিয়ে আছে। আজকের দিনে সেগুলো ঝাঁপি খুলে বেড়িয়ে পরে। আজকে যে বিপাশার বিয়ের দিন ছিল।

 কখন গুটি গুটি পায়ে ব‍্যালকনিতে এসেছে হিয়া, মেয়ের ডাকে চমক ভাঙলো বিপাশার।পরম স্নেহে জড়িয়ে ধরলো মেয়েকে। কিছুক্ষণ আদর করার পর ব‍্যস্ত হয়ে পরল মেয়েকে নিয়ে। ইতিমধ্যে শান্তি মাসীও চলে এসেছে, ব্রেকফাস্ট রেডি করছে। ল‍্যাপটপ্ নিয়ে বসলো  বিপাশা, অফিসের কিছু কাজ করে নিয়ে মেয়েকে পড়াতে  বসতে হবে।

আজ  বিপাশা অফিস ছুটি নিয়েছে। হিয়ার স্কুলের পেরেন্টস্ টিচার মিটিং আছে।  শান্তি মাসী মেয়েকে  রেডি করে দিয়েছে। তাড়াতাড়ি মা ও মেয়ে রওনা হলো স্কুলের  উদ্দেশ্য।  হিয়ার স্কুলের বন্ধুদের মায়েদের সঙ্গে বেশী বন্ধুত্ব নেই বিপাশার। সকলের ওর পার্সোনাল লাইফ সম্বন্ধে অসীম কৌতহল। তাই হিয়ার স্কুলে আসতে ও একদম মন চায় না বিপাশার। যাইহোক টিচারের সঙ্গে কথা বলে ক্লাসরুম থেকে বেড়তেই বৃষ্টির মা বাবার সঙ্গে দেখা। বৃষ্টির মা মধুরা সকলের সামনে প্রশ্ন করে বসলো এবারও হিয়ার বাবা আসে নি।  বৃষ্টির বাবা বললেন ডির্ভোস তো অনেকেরই হয়  তবু মেয়ের কথা ভেবে একবার অন্তত ওর বাবার একবার স্কুলে আসা উচিত। কি উত্তর দেবে বিপাশা বুঝতে পারে না। মেয়েকে কোনরকমে টানতে টানতে নিয়ে এসে গাড়িতে  ওঠে। আজকে আর ড্রাইভ করতে মন চায় না। মনে হয় অনেক দূরে চলে যায় যেখানে তাকে প্রশ্ন করার কেউ থাকবে না। অরীন যেন তার জীবন থেকে চলে গিয়েও চলে যায় নি। অতিষ্ট করে তুলেছে বিপাশার জীবন। অরীন যদি মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখে সেজন্য তো বিপাশা দায়ী নয়। এত বড় অপরাধ করেও অরীন কেমন স্বাধীন ভাবে জীবন কাটাচ্ছে।

সামার ভ‍্যাকেশন্ হিয়ার, তাই বিপাশা মেয়ে আর শান্তি মাসীকে নিয়ে বেড়াতে এসেছে মন্দারমনিতে।হোটেলের সামনেই সমুদ্র।অনবরত ঢেউয়ের আনাগোনা দেখছে বিপাশা ব‍্যালকনি থেকে। ছোট্ট হিয়া সমুদ্র দেখে খুব খুশি।শান্তি মাসী এই প্রথম সমুদ্র দেখে অবাক। তারা সবসময় বীচে সময় কাটাচ্ছে।

ভোরবেলায় একা একা বেড়িয়ে পরে বিপাশা, সমুদ্র সৈকতে সূর্যোদয় দেখে।তার পর জলের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বহুদূর চলে যায়। এখন নির্জনতাকেই ভালো লাগে বিপাশার।কলকাতার ভীড় আর তাকে নিয়ে অযথা কৌতূহলে হাঁপিয়ে উঠেছিল বিপাশা। আবার নতুন করে জীবন শুরু করতে পারতো সে কিন্তু মেয়ের কথা ভেবে আর ওসব চিন্তা করেনি। তাছাড়া আর কাউকে বিশ্বাস করতে বড্ডো ভয় হয় বিপাশার। এই তো বেশ আছে মেয়ের সঙ্গে।মেয়েকে সুন্দরভাবে  মানুষ করছে বিপাশা যেন বাবা অরীনের মত না হয় হিয়া।তার পরিচয় সে সিঙ্গল মাদার। গর্বিত বিপাশা, একসঙ্গে সবকিছু সামলে চলার জন্য। তার হিয়াকে  সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতেই হবে।হিয়াকে সুন্দর মানসিকতার মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখে বিপাশা।এই সমাজ মুখে বড় বড় কথা বললেও, আধুনিক হলেও  সম্পূর্ণভাবে আজ ও এগিয়ে যেতে পারে নি।বিপাশা সমুদ্রের ঢেউয়ের আনাগোনা দেখতে দেখতে ভাবে আলো ঝলমলে ভবিষ্যতের কথা…..

rajasreedey30@gmail.com



No comments:

Post a Comment