1 / 7
2 / 7
3 / 7
4 / 7
5 / 7
6 / 7
7 / 7

Thursday, July 1, 2021

সমাপ্তি

ছবি : চিরাঞ্জিত ঘোষ

সমাপ্তি 

তরুণ চক্রবর্তী

        ঘোর বর্ষা । আকাশে কালো মেঘের চাঁদোয়া । মাঝে মাঝেই অঝোরে বৃষ্টি পড়িতেছে । রাস্তা ভীষণ রকম কর্দমাক্ত । এখন সময় বৈকাল  হইলেও  , সূর্যদেব মেঘের আড়ালে মুখ ঢাকিয়াছেন  । মনে হয় গভীর রাত্রি । মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলকানি পথ দেখাইতেছে । বড়ই দুর্যোগময় পরিবেশ । এরই  মধ্যে, অপূর্ব, সেই কর্দমাক্ত , পিচ্ছিল মাটির রাস্তায় অতি সন্তর্পণে সাইকেল চালাইতেছে । মাঝে মাঝেই সাইকেল সহ সে ভূপতিত হইতেছে । বাড়ি হইতে বাহির হইবার সময়কার নিপাট বস্ত্র এখন সম্পূর্ণ কর্দমাক্ত । মৃণ্ময়ীর  সহিত দেখা হইলে কি বলিবে কে জানে । অপূর্বর এখন অত ভাবিবার সময় নাই । ঘড়ির দিকে তাকাইয়া দেখিল , সময় পাঁচটা । তাহাকে যে করিয়াই হউক , ছয়টার মধ্যে মৃণ্ময়ীর সহিত সাক্ষাত করিতে হইবে । না হইলে কপালে প্রভূত দুঃখ আছে , অপূর্ব তাহা বিলক্ষন জানে । মৃণ্ময়ী , আমোদপুর গ্রামের গাবগাছ তলায় , নির্মীয়মান নৌকার গলুইয়ে অপেক্ষা করিতেছে । অপূর্বর বিলক্ষন জানা আছে । 

       অপূর্বর বাড়ি শিবকালি তলা।গ্রামে ঢুকিবার মুখেই শিব-কালির মন্দির আছে ,তাহার জন্যই এই নাম।অপূর্ব অবশ্য কলিকাতার কলেজে অধ্যয়ন করে,ছুটিতে বাড়ি আসিয়াছে।আসিতে না আসিতেই, মৃন্ময়ীর এই আহ্বান।যাহা অবজ্ঞা করিবার জন্য অপূর্বর স্কন্ধে  কোন অতিরিক্ত মাথা নাই ।তাই কর্দমাক্ত রাস্তায় ক্রমাগত অপদস্ত হইতে হইতে অপূর্ব, মৃন্ময়ীর সহিত সাক্ষাত করিতে চলিয়াছে।

       এই অবসরে,মৃন্ময়ীর সম্বন্ধে যৎকিন্চিত বলিয়া লওয়া যাক।আমোদপুর গ্রামের সর্বাপেক্ষা বর্ধিষ্ণু  পরিবার রায় বাড়ি।

সেই পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুত্র মহিম রায়ের একমাত্র সন্তান মৃন্ময়ী । বড়ই আদরে পালিত হওয়া কন্যা রত্নটি ভীষণই ডানপিটে । মাঝে মাঝে গ্রামবাসী এবং পরিবারের সদস্যদের সন্দেহ হয় , হয়তো পুত্র সন্তান জন্মাইতে গিয়া ভুল করিয়া  কন্যা সন্তান জন্ম গ্রহণ করিয়াছে । 

    মৃন্ময়ী যতই ডানপিটে হউক , সে পড়াশোনায় অত্যন্ত মেধাবী । অল্প পড়িয়াও কি ভাবে কে জানে , ভালভাবেই পাশ করিয়া সে বিদ্যালয়ের পাঠক্রম শেষ করিয়া আনিয়াছে । সামনের বৎসর পাশ দিয়া সে কলিকাতায় কলেজে ভর্তি হইবে এমনি স্থির আছে । মৃন্ময়ীর পিতা মহিম তার এই দুরন্ত কন্যা সন্তানটিকে অত্যন্ত স্নেহ করেন । তার একমাত্র চিন্তা কলিকাতায় মৃন্ময়ীকে কে সামলাইয়া রাখিবে । সেইজন্যই অপূর্বর সহিত মৃন্ময়ীর এই বিশেষ সম্পর্কে তাঁহার প্রছন্ন প্রশ্রয় আছে । অপূর্বর পিতা মহিমের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ । তাছাড়া পালটি ঘর । একটাই সংশয় , অপূর্বর মাতা এই ডানপিটে কন্যাটিকে একদমই পছন্দ করেননা । 

          যত সময় অগ্রসর হইতেছিল , নৌকার গলুইয়ে বসিয়া মৃন্ময়ী ক্রমাগত অস্থির হইতেছিল। চারিদিকে আলো ক্রমে কমিয়া আসিতেছে । গাবগাছের নিচে অন্ধকার আরও গাঢ়। তবে একটাই সুবিধা , গাছের ঘন পাতার আস্তরণ ছাতার মতো আচ্ছাদনের কাজ করিয়া , গাছের নিচের আশ্রিতদের বৃষ্টির জল হইতে রক্ষা করে ।

           অপূর্ব যখন অকুস্তলে পৌঁছাইল , তখন ঘন সন্ধ্যা । অপূর্বর দেরি দেখিয়া মৃন্ময়ীর ক্রোধের পারদ ক্রমাগত চরিতেছিল । কিন্তু সিক্ত , কর্দমাক্ত,কিম্ভুত অপূর্বকে দেখিয়া তাঁহার মধ্যে এক অন্য রকম স্নেহের উদ্রেক হইলো । অপূর্বকে কিছু বলিবার সুযোগ না দিয়াই সে তাঁহার শাড়ির আঁচল দিয়া তাঁহার সিক্ত কেশ মুছিতে শুরু করিল ।

---কিজন্য ডেকেছ বলবে না ? অপূর্ব জিজ্ঞাসা করিল । 

  অপূর্বর জিজ্ঞাসার উত্তরে মৃন্ময়ী গলুইয়ের মধ্য হইতে একটি বাঁশের খাঁচা বাহির করিল । অপূর্ব  দেখিল , তাহার মধ্যে একটি নধর কাঠবেড়ালি নিশ্চিন্তে  ঘুরিয়া বেড়াইতেছে । 

---এর জন্য ডেকে পাঠিয়েছ ? চমকিত বিদ্যুতের আলোয় অপূর্বর বিস্ম্যয় গোপন রহিল না । 

--- কেন ? শিবে কি হেলা ফেলার জিনিস , যে তার জন্য তোমাকে ডেকে পাঠান যাবেনা ?বলিয়া মৃন্ময়ী অপূর্বর থুতনি নাড়িয়া দেয় । অপূর্ব বুঝিল , কাঠ-বিড়ালিটির নাম শিবে । 

---না , আমি তা বলছি না । তবুও তোমার শিবের তুলনায় আমি কি এতোই মূল্যহীন , এতো কষ্ট করে তোমার কাছে আসার পরেও  আমার কিছু প্রাপ্তি ঘটবে না । 

        অপূর্বর কথার ইঙ্গিত বুঝিতে মৃন্ময়ীর বিলম্ব হইলো না । সে অপূর্বর মুখটিকে দুহাতে তুলিয়া ধরিয়া , তাহার ওষ্ঠ অপূর্বর ওষ্ঠের উপর নামাইয়া আনিল । 

        এইসময় নিকটেই কোথাও ভীষণ জোড়ে বজ্রপাত হইলো । আশেপাশের গৃহস্থ বাড়ি হইতে শাঁখ ও উলুধ্বনীর আওয়াজ শোনা গেল।  কিন্তু অপূর্ব - মৃন্ময়ীর কানে সেই আওয়াজ পৌঁছাইল  না । 

        রাত্রি গভীর হইলে , মেঘ আস্তে আস্তে কাটিয়া গেলে , বৃষ্টি ধরিয়া আসিল । সে রাত ছিল পূর্ণিমার রাত । পূর্ণশশী  তাহার নির্মল জ্যোৎস্নায় চরাচর ভাসাইয়া দিল । 

       পরদিন প্রত্যুষে আমোদপুরের গ্রামবাসী দেখিল গাবগাছের তলায় নির্মীয়মাণ নৌকার গলুইয়ে দুইজন যুবক- যুবতী আলিঙ্গনাবদ্ব অবস্থায় শুইয়া আছে । প্রাণহীন , বজ্রদদ্ধ। তাঁহাদের পাশে একটি কাঠবেড়ালি বাঁশের খাঁচায় নিশ্চিন্তে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে  । 

tchak1961@gmail.com
কলকাতা 

2 comments:

  1. বা, শেষটা তো বেশ অন্যরকম। ভালো লাগল।

    ReplyDelete